যিলহজ্ব ১৪৩৪   ||   অক্টোবর ২০১৩

স্ব দে শ : মারাত্মক উন্নতি

ওয়ারিস রব্বানী

কোনো দেশের যে মারাত্মক উন্নতি হতে পারে-এটা তিনিই প্রথম বললেন। তার সে কথায় চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। বিদেশ থেকে আসা দেশী নেতা তিনি। বড় নেতার বড় নাতি। মায়ের ক্ষমতাও একচ্ছত্র। বক্তৃতার সময় তার মুখ ও শরীরের ভাষাই থাকে অন্য রকম! সব কথার মধ্যেই একটা উত্তেজনা। সব দিনের মধ্যেই চমক। আর সব কাজের মধ্যেই কম্পিউটার। যেন ডিজিটাল নেতৃত্বের এক বরপুত্র। আঙ্গুল নাচানো বক্তব্যে সেটাই ইদানীং তিনি জানান দিচ্ছেন।

গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এক সমাবেশে তিনি বললেন, তিন দিনের মধ্যেই তিনি চমক দেখাবেন। তিনি তো আর যদু-মধু নন, তার কথার মূল্য আছে। সবাই চমক দেখতে নড়ে চড়ে বসলেন। কিন্তু তিন দিন পর দেখা গেল, মারাত্মক উন্নতির গল্প বলে তিনি সবাইকে ভড়কে দিলেন। তিনি জানালেন, পঁচাত্তরের পর দেশে স্কুল তৈরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে প্রতি তিনজন স্কুলছাত্রের বিপরীতে একজন মাদরাসার ছাত্র তৈরি হয়েছে। মাদরাসা ছাত্রের এই হার কমিয়ে দিতে তিনি ইতোমধ্যেই কর্ম-তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, দেশের মসজিদগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। তাই প্রতি শুক্রবারে দলের কর্মীরা যেন মসজিদে মসজিদে গিয়ে ইমাম-খতিবদের বক্তব্যে বাধা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে।

তার বক্তৃতা শুনে মাইন্ড করা একদম নিষেধ। দামী মুখের দামী কথা হজম করেই নিতে হয়। এটাই নিয়ম। এ জন্যই তার এ বক্তব্যে দেশের কোথাও কেউ মাইন্ড করেছেন বলে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। উল্টো অনেকেই মনে করার চেষ্টা করেছেন যে, মারাত্মক উন্নতির কথা না বললেও এ রকম ভিড়মি খাওয়া বক্তব্য তো এবারই তিনি প্রথম দেননি। এর আগে দেশে বোরকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তার উদ্বেগের কথা তিনি অকপটে বলে দিয়েছেন। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে এক তৃতীয়াংশ মাদরাসা-ছাত্র অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় (!) দেশে জঙ্গিবাদের আশংকা বেড়ে যাওয়ার একটি পান্ডিত্যপূর্ণ গবেষণাও তিনি করেছিলেন। বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত সে গবেষণায় তার সহকর্মী ছিলেন এক ইহুদী। তার ওইসব বক্তব্যেও কেউ মুখ খোলার ঝামেলায় যেতে চায়নি। অবশ্য মাস দেড়েক আগে আগামী নির্বাচনে তার দল জিতে আসার গোপন তথ্য তার কাছে থাকার কথা বলে দেশেজুড়ে তিনি প্রচুর হাস্যরসের উৎপাদন করেছিলেন।

তিনি গোপন করলেও গত ঈদের আগে ঢাকাজুড়ে সরকারের উন্নতির ফিরিস্তি দেওয়া বিতর্কিত ডিজিটাল বিলবোর্ড-এর কারিশমার সঙ্গে তার নামটা চাউড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি দেশ ছেড়ে তখন চলে গিয়েছিলেন। তড়িঘড়ি করে সেইসব রহস্যজনক বিলবোর্ড নামিয়ে নেওয়ার পর আবার দেশে ফিরে এসেছেন। কিছুদিন যাবত হঠাৎ করেই তিনি একটা চমক দেন, আর এর তিন-চার দিনের মধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে যান। কদিন পর উড়ে আসেন, কিছু বলেন আবার চলে যান। এই ঘন ঘন আসা-যাওয়ার মধ্যেই তাকে নিয়ে দুষ্ট লোকেরা অন্য রকম মন্দ কথার ফানুস উড়ায়। কেউ কেউ বলেন, ভিওআইপির বাতাসী ব্যবসার গুড়-মিষ্টিটা বেশির ভাগ সময় তার কাছেই জমা দিতে হয়। আর কেউ কেউ আবার দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র (কুইক রেন্টাল)-এর ঠিকাদারি ব্যবসার প্রধান শরিকদার হিসেবেও তার নাম উল্লেখ করেন। হাতবদল হওয়া মোবাইল অপারেটর কোম্পানির পেছনেও তার বড়সড় হাত রয়েছে বলে কারো কারো মুখে গল্প শোনা যায়। কী আর করা। এমন তার বড় মানুষদের তো কিছু ছোট-বড় গল্প থাকতেই পারে। সে সব গল্পে আমরা একদমই কান দিই না।

আমরা জানি, দুষ্ট লোকের মন্দকথায় কান দেওয়া ভালো কাজ নয়। সেজন্যই অন্যের মুখে তার আয়-উপার্জনের গল্প বাদ দিয়ে তার মুখেই দেশের গল্প শুনি। দেশে-বিদেশে তার আসা-যাওয়ার দৃশ্য দেখি। দেশে তিনি বেশি একটা না থাকলেও তাকে নিয়ে আমরা খুব তৃপ্তি বোধ করি। অনেকে বুঝতে চান না যে,  দেশী মানুষের পরিবর্তে তার আবার আহলে কিতাবদের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতা ঘরে-বাইরে সব জায়গায়।

এজন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সব সময় দেশী মানুষদের সঙ্গে তিনি থাকতে পারেন না। বিদেশী আহলে কিতাবদের তো সময় দিতে হয়। একবার নিজ উদ্যোগে তার জননীই জানিয়েছেন, আহলে কিতাব মতে তার এসব ঘনিষ্ঠতায় কোনো রকম অবৈধতা নেই। বিরাট এক সমাধান!

বড় পরিবারের বড় প্রতিনিধি। কোনো ফেলনা বিষয় নয়। তাই এই রাজপুত্রের সব কথাই আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যত মারাত্মক চমকই দেন আমরা সেটা গ্রহণ করতে বাধ্য। বদহজম ঘটানোর মতো

সাধ্য বা সাহস কোনোটাই আমাদের নেই। আমরা কেবল আশংকা ব্যক্ত করতে পারি, তার এসব উন্নত বাণী-বক্তব্য দেশের নির্বোধ মানুষের অন্তরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে তো কিছুটা মুশকিল হয়েই যেতে পারে। তখন তো কোনো ডিজিটাল জয় দিয়ে এনালগ পরাজয় ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। 

 

 

advertisement