যিলহজ্ব ১৪৩৪   ||   অক্টোবর ২০১৩

ন মু না : সেকুলার উদারতা!

খসরূ খান

ঘটনার প্রথম পর্বটি নতুন ছিল না। ক্ষমতাসীন দলের প্রায় পুরো মেয়াদজুড়েই এ জাতীয় ঘটনা খুব বীরত্বের সাথেই ঘটানো হয়েছে। কিন্তু ঘটনার দ্বিতীয় পর্বটি ছিল একদম নতুন এবং চমক সৃষ্টির মতো। অন্তত গত পৌনে পাঁচ বছরে এ রকম ঘটনার নজির পাওয়া যায়নি। দুঃখপ্রকাশ, অনুতাপ আর উদারতার এক অভাবনীয় পর্বই ছিল সেটি। কিন্তু সেটিও যে পুরোপুরি তাৎপর্যবিহীন ছিল-এমন নয়। ঘটনার পর্ব দুটি আর তার ভেতরের চেহারাটা একটু উল্টে-পাল্টে দেখতে পারি।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর রোববার বিকেলে ঘটনাটির সূচনা। সিলেট শহরে সিপিবি ও বাসদের বিভাগীয় সমাবেশে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা ও ভাংচুর চালায়। সিপিবির মানে হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। আর বাসদের মানে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। চিন্তা-চেতনা, শত্রু-মিত্রজ্ঞান ও আদর্শের এক রৈখিক বিবেচনায় শাসকদলের সঙ্গে দল দুটির দূরত্ব বিশেষ নেই। কিন্তু তাতে কী যায় আসে! যেহেতু ওই সমাবেশে শাসকদের কিছু সমালোচনা করা হয়েছে তাই তাতে বীরদর্পে হামলা চালানো হয়েছে। সিপিবির ডাকসাইটে নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে মঞ্চ থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিলঘুষি ও এলোপাথারি লাঠির আঘাতে আহত করা হয়েছে অন্তত আরও ১৫ জনকে। সমচিন্তার সহযাত্রীদের প্রতি শাসকদলীয় ছাত্রদের অভিমান-আপ্যায়ণের এ যেন ছিল এক অন্যরকম অনুশীলন পর্ব।

এরপরই এক রকম হৈচৈ লেগে যায় এবং একের পর এক সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। শাসকদলের অহং এবং শাসকদলের প্রতি গণমাধ্যমের অন্ধ সমর্থনের প্রেক্ষাপটে ঘটনাগুলোকে অদ্ভুত বলাই সঙ্গত। বিকেলের ঘটনায় ওই দিন রাতের মধ্যেই সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সরকার দলীয় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সিপিবির সাবেক সভাপতির কাছে ফোন করে দুঃখপ্রকাশের কথা সংবাদপত্রে প্রচার হয়। শাসকদলের হর্তকর্তারা ঘটা করে বিব্রত হতে শুরু করেন। ভাবগতিক দেখে হামলাকারী এক ছাত্রনেতার দুদিনের মাথায় লন্ডন পাড়ি দেওয়ার খবরও প্রচার হয়। অপরদিকে প্রভাবশালী সংবাদপত্র ও বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোতে সরকারদলীয় ওই হামলার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ ও শোক-মাতম শুরু হয়। প্রায় তিন দিন বামপন্থী সম্পাদক, পরিচালক ও সাংবাদিক প্রভাবিত গণমাধ্যমে সিপিবি-বাসদের সমাবেশে শাসকদলীয় ছাত্র সংগঠনের হামলার সমালোচনা ও ফলোআপ প্রচার করা হয়।

হামলা এবং হামলা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার এই এক সপ্তাহ সবার নজর কেড়েছে। অনেক পাঠক-দর্শক মনে করেছেন, ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে সরকার পক্ষ যথেষ্ট অনুতাপ ও উদারতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে এ রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। নিজদলের ছেলেরা অন্য দলের সমাবেশে হামলা করায় তাদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ঘটনায় কেউ কেউ এদেশের গণ্যমাধ্যমকেও যথেষ্ট সাহসী ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। অথচ পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ হল, বাস্তবতা এ রকম ছিল না। এ ঘটনায় শাসকদলের উদারতা কিংবা গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতার কোনো নমুনাই প্রকাশ হয়নি। বরং ঘটনার দুটি পর্বেই বিপরীত একটি বাস্তবতার চেহারা ফুটে উঠেছে। সেটি আরও মারাত্মক! সেটি আরও ভয়ঙ্কর!

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সিপিবি-বাসদের মতো বামপন্থী ও সেকুলার রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা হওয়ায় সরকার ও গণমাধ্যম যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা কোনো অবস্থাতেই বিরোধীপক্ষের ব্যাপারে সরকার ও মিডিয়ার সামগ্রিক মূল্যায়নের নমুনা নয়। ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী কিংবা সেকুলারিজমমুক্ত ও ভারতবিরোধী কোনো দল ও মহলের ক্ষেত্রে সরকার ও মিডিয়ার আচরণ এ রকম হয়নি এবং এ রকম হতোও না। এ ঘটনা বরং প্রমাণ করল, এদেশে সরকার কিংবা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সৌজন্য-সহানুভূতি পেতে চাইলে কোনো দল বা গোষ্ঠীকে হতে হবে সেকুলার, বামপন্থী কিংবা তথাকথিত প্রগতিশীল। সেকুলার না হয়ে ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম হলে তার জন্য কোনো সৌজন্য-সহানুভূতি কিংবা ন্যায্যতা থাকবে না। সরকারের পক্ষ থেকেও নয়, গণমাধ্যমের পক্ষ থেকেও নয়। বর্তমান প্রশাসন ও প্রভাবশালী গণমাধ্যমের মূল্যায়নে সেকুলার ও ধর্মবিরোধী শ্রেণীই হচ্ছে এদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। আর ধর্মপ্রাণেরা অষ্ছুত ও অস্পৃশ্য; তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ। সিপিবি-বাসদ শাসকদলের কিলঘুষি লাথি খেলে প্রধানমন্ত্রী সরি বলেন। গণমাধ্যম কান্না করে। আর ধর্মপ্রাণ

হেফাজতের মুসলমান ভাইয়েরা নিহত হয়ে রক্তে ভাসলেও তারা নাকি লালরঙ মেখে রাস্তায় পড়ে থাকেন। গণমাধ্যম তাদের তান্ডবে গাছের লাশ নিয়ে চোখের পানি ফেলে। দৃশ্যত সিলেট-ঘটনার দ্বিতীয় পর্বে অভিনবত্বের যে আভাস দেখা যাচ্ছিল, সে রকম অভিনত্ব তার

ভেতরে নেই।

দুঃখ প্রকাশ ও নিরপেক্ষতার এই মহড়া কেবল সমগোত্রীয়দের জন্যই বরাদ্দ। সেকুলার, বামপন্থী, উপজাতি, সংখ্যালঘু আর ইসলামবিদ্বেষীর বাইরে অন্য কেউ এ গোত্রে পড়েন না। সরকার আর গণমাধ্যম যাদের আপন গোত্রের মনে করেছে তাদের প্রতিই সৌজন্য দেখিয়েছে। অন্যরা তাদের কাছে মানুষ হিসেবে গণ্যই হতে পারে না। সৌজন্য-সদাচার তো অনেক দূরের ব্যাপার। 

 

 

advertisement