যিলহজ্ব ১৪৩৪   ||   অক্টোবর ২০১৩

আমাদের রাজ্যশাসন-১১

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

হযরত আবু বকর রা.-এর ওফাত

ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলছিল। হঠাৎ করেই হযরত আবু বকর রা.-এর ইন্তিকাল হয়ে গেল। ১৩ হিজরীর জুমাদাল উখরায় তিনি ইন্তিকাল করলেন। যুদ্ধের ময়দানে মদীনার দূত এসে ইন্তিকালের সংবাদ জানালেন।

আবু বকর রা. মাত্র ২ বছর ৩ মাস ১০ দিন খেলাফত পরিচালনা করেছেন। এত অল্প সময়ে তিনি যে বিশাল বিশাল কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন কারো পক্ষে তা বছর বছর ধরেও করা সম্ভব নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পরই মিথ্যা নবুওতের দাবিদার ও মুরতাদরা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু আবু বকর রা. অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে সেসব ফিতনার মূলোৎপাটন করেন।

স্বভাবগতভাবে তিনি যথেষ্ট নম্র-কোমল হলেও সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল-অবিচল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর যে গোত্রগুলো যাকাত প্রদানে অস্বীকার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সাহাবায়ে কেরাম সে যুদ্ধের বিরোধিতা করে পরামর্শ দিলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, এটা হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে কেউ বকরির একটা বাচ্চা দিয়ে থাকলেও আমি তলোয়ারের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তা উসূল করে ছাড়ব।

আল্লাহ ও রাসূলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল অতি গভীর ও নিবিড়। সবসময় জান-মাল নিয়ে উপস্থিত থাকতেন। কঠিন থেকে কঠিন মুহূর্তেও তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে দূরে থাকেননি।

খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার আগে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। খলীফা হওয়ার পর ব্যস্ততা এতই বেড়ে গেল যে, ব্যবসার জন্য সময় বের করতে পারছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে সকলের অনুরোধে নিজের সময়টুকুর বিনিময়ে বাইতুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) থেকে সামান্য ভাতা গ্রহণ করেন। এরপরও মৃত্যুর সময় তাঁর সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে সরকারী কোষাগারের সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার অসিয়ত করে গেছেন।

নিজ শাসন আমলে যে বিষয়টিতে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে যে সকল কাজকর্ম ছিল না তা হতে না দেওয়া। ফলে তাঁর খেলাফত আমলে কোনো নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল না। তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো ভবন নির্মাণ করেননি। এমনকি সামরিক বাহিনীর জন্য কোনো দাপ্তরিক বিভাগ স্থাপন করেননি। যেসব অর্থ আসত তা মুসলমানদের মাঝে বিলি-বণ্টন করে দিতেন। বাইতুল মালে কিছুই সংরক্ষণ করতেন না। জিহাদের জন্য কোনো বাহিনী প্রস্ত্তত করার প্রয়োজন হলে সকল মুসলমানকে জড়ো করে নিতেন। মোটকথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে যে পদ্ধতি ছিল হুবহু তা-ই তিনি বহাল রেখেছিলেন। এমনকি সে সময়ের

বিভিন্ন পদ-প্রাপ্তদের মধ্যেও কেনো রদবদল করেননি।

আবু বকর রা.-এর সবচেয়ে বড় কীর্তি কুরআন মজীদ সংকলন। কেননা সে সময়  কুরআন মজীদ ছিল চামড়ার টুকরা, উটের হাড্ডি, খেজুর পাতা ইত্যাদির মধ্যে লিখিত আকারে। তাছাড়া কারো নিকট পূর্ণ কুরআন মজীদ একসঙ্গে বিদ্যমান ছিল না। একজনের কাছে একটি সূরা, কারো নিকট একটি আয়াত, আবার কারো কাছে অংশবিশেষ সংরক্ষিত ছিল। আবু বকর রা. পূর্ণ কুরআন মজীদ একত্রিত করার পরামর্শ দিলেন। যেন ভবিষ্যতের জন্য তা সংরক্ষিত হয় এবং নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে যেহেতু কুরআন মজীদ একত্রিত ছিল না তাই প্রথম দিকে তাঁর মাঝে কিছুটা দ্বিধা হল। পরে ওমর রা.-এর পীড়াপিড়িতে এক সময় সংকলনের মাসলাহাত তিনি বুঝতে পারেন।

তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে যে সকল সাহাবী কুরআন লিখতেন এবং কুরআন মজীদ যাদের অধিক ইয়াদ ছিল তাদেরকে নিয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পূর্ণ কুরআন মজীদ একত্রিত করেন। সেই কুরআন মজীদই আজ আমরা তিলাওয়াত করি।

হযরত ওমর রা.-এর শাসনকাল

ইরান

হযরত আবু বকর রা. ইন্তিকালের সময় হযরত ওমর রা.কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। তাই আবু বকর রা.-এর ইন্তিকালের পর পরই তিনি বাইআত নেন এবং দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

আবু বকর রা.-এর সময়েই আরবের অবস্থা শৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে গেলেও ইরান ও শামের অবস্থা ছিল আগের মতোই। আগেই বলা হয়েছে, হযরত আবু বকর রা.-এর নির্দেশে হযরত খালিদ রা. শাম দেশে অবস্থানরত মুসলিম বাহিনীর সাথে গিয়ে যোগদান করেছিলেন। আর তাঁর পরিবর্তে হযরত মুসান্না রা.কে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয়। এদিকে ইরানীরা নিজেদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত করে এবং হুরমুজ-এর নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে। মুসান্না রা.ও নিজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। বাবেল নামক স্থানে উভয় পক্ষের  সংঘর্ষ হয়। ইরানীরা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়।

এই পরাজয়ের কারণে ইরানীরা ছিল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তাই তখন থেকেই তারা নিজেদের আরো শক্তি বৃদ্ধি এবং জোরালো আক্রমণের জন্য প্রস্ত্ততি শুরু করল।

হযরত মুসান্না রা. এ অবস্থা জানতে পেরে মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ইরানীদের অবস্থা তুলে ধরলেন। তখন ছিল আবু বকর রা.-এর অন্তিম মুহূর্ত। অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে তিনি উমর রা.কে অসিয়ত করলেন যেন এদিকে পূর্ণ মনোযোগ দেন।

হযরত উমর রা. খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পরপরই হযরত আবু উবাইদা ছাকাফী রা.কে বিশাল এক বাহিনী দিয়ে প্রেরণ করলেন।

ইরানীদের সাথে কয়েকবার সংঘর্ষ হল। প্রতিবারই যুদ্ধের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল মুসলমানদের হাতে। ইরানীদের সিপাহসালার এ সংবাদ শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং তৎক্ষণাৎ বাহমান জাযুবিয়াকে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে প্রেরণ করে।

এরপর ফুরাতের তীরে লড়াই হল। মুসলিম সৈন্যগণ অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। কিন্তু আরবের ঘোড়া ইতিপূর্বে হাতির মুখোমুখি হয়নি। অথচ ইরানীদের বাহিনীতে হাতির ছিল একটি পৃথক সারি। হাতি দেখে এসব ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি করতে লাগল। আরোহীগণ বাধ্য হয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন এবং তলোয়ার নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আবু উবাইদা রা. নিজে অগ্রসর হয়ে সাদা রঙের/নিশানের একটি হাতির উপর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন। আঘাত পেয়ে হাতিটি লাফিয়ে উঠল এবং ক্ষুব্ধ হয়ে সোজা গিয়ে তার বুকে পা রেখে দিল। এতে পিষ্ট হয়ে আবু উবাদা রা. শাহাদাত বরণ করেন।

তখনও তুমুল লড়াই চলছে। ইরানীরা পূর্ণ উদ্যম ও শক্তি নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে চলেছে। আর মুসলমানরা ধীরে ধীরে পিছু হটছে। এ অবস্থা দেখে কেউ গিয়ে নদী পার হওয়ার একমাত্র সেতুটি ভেঙ্গে দিল। যেন মুসলমানগণ পলায়নের চিন্তা বাদ দিয়ে পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে লড়াই চালিয়ে যান। কিন্তু ময়দানের অবস্থা এতই নাজুক ছিল যে, তাতে ঘুরে দাঁড়ানোই কষ্টকর। ফলে বাধ্য হয়েই মুসলমানগণ পিছু হটতে লাগলেন। সেতু আগেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। এখন ভয়ে ছুটাছুটি করে ৪ হাজার লোক নদীতে ডুবে মারা যান। হযরত মুসান্না রা. এই অবস্থা দেখে আরো দৃঢ়তার সাথে লড়াইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। আর পিছনের লোকদেরকে অভয় দিতে লাগলেন এবং বললেন তোমরা নিরাপদে সেতু নির্মাণ কর। সেতুর কাজ সমাপ্ত হলে তিনি অবশিষ্ট লোকদেরকে নিয়ে নিরাপদে নদী পার হয়ে গেলেন। ৯ হাজার সৈন্যের মধ্যে তখন মাত্র ৩ হাজার অবশিষ্ট ছিলেন।

হযরত উমর রা. এ সংবাদ শুনে হযরত মুসান্না রা.-এর সহযোগিতার জন্য লাগাতার কয়েক দফা সৈন্য প্রেরণ করলেন। অন্যদিকে হযরত মুসান্না রা.ও বাহিনী প্রস্ত্তত করতে লাগলেন। সকলে গিয়ে বুয়াইব নামক স্থানে একত্রিত হলেন।

ইরানীরাও মেহরানের নেতৃত্বে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। এবার উভয় দলের মাঝে তুমুল সংঘর্ষ হল। ইরানীরা বীরদর্পে লড়াই করেছে। কিন্তু এবার মুসলমানদের কোনো বেগ পেতে হল না। ইরানীরা সহজেই পরাজিহ হল। তাদের হাজার হাজার সৈন্য মারা গেল। এমনকি এ যুদ্ধে তাদের সর্দার মেহরানও নিহত হল।

 

 

advertisement