যিলহজ্ব ১৪৩৪   ||   অক্টোবর ২০১৩

বড়দের মজলিসে তালিবুল ইলমের সতর্কতা : দুটি আদব

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিয়েছেন তাই দুয়েকটি আদবের মুযাকারা করার নিয়তে বসেছি।

(আলোচনার শুরুতে কেউ কেউ মুসাজজিলা সামনে রাখছিল। হুজুর চেয়ারে বসে আলোচনা করছিলেন। আর তারা মুসাজজিলা রাখছিল নিচে। যমীনে। সেজন্যে প্রথমেই হুজুর এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বললেন।)

মুসাজজিলা এখন আলায়ে ইলম

তোমাদের মুসাজজিলা যেহেতু ইলমের কথা, দ্বীনের কথা ধারণ করছে সেহেতু এটাও এখন অন্তত তোমাদের জন্য একটা আলায়ে ইলম বা ইলম গ্রহণের মাধ্যম। অতএব এটাকে আলায়ে ইলমের মর্যাদা দিতে হবে। কখনো দেখি মুসাজজিলাকে তোমরা যমীনে রাখ, কখনো রাখ একেবারে পায়ের কাছে। এটা ঠিক নয়।

কিতাবের ব্যাপারেও তাসাহুল

এমনিভাবে কিতাব। কখনো দেখা যায় চেয়ার খাট বা বিছানায়, যেখানে বসা হয়, শোয়া হয়। কেউ কেউ সেখানেই কিতাব রেখে দেয়। অথবা সেখানে কিতাব রেখে মুতালাআ করে। এটাও কিন্তু আদবের খেলাফ।

যদিও এগুলো এমন আদব যার খেলাফ করাটা ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন গুরুতর নয়। বরং উত্তম-অনুত্তম বা খুব বেশি হলে মাকরূহে তানযীহী পর্যায়ের। তবুও তো আদব।

তাছাড়া সবকিছুর বিচার তো কেবল ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে হয় না। কারণ ফিকহী বিধানের স্তর বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হেকমতের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। সেজন্য আমি কী করব, কী করব না সেটা শুধু ফিকহী বিধানের

স্তরের উপরই নির্ভর করে না। আমি কেমন হব, আমার আদব-আখলাক কেমন হবে, সেটা নির্ভর করে আমার সালাফ কেমন ছিলেন এবং কোন তরীকা অবলম্বন করলে আমার যিন্দেগী কোনদিকে মোড় নেবে, কোন তরীকা অবলম্বন করলে আমার যিন্দেগীর উপর কী ধরনের প্রভাব দেখা দেবে এ জাতীয় আরো অনেক বিষয়ের উপর।

ফরয-ওয়াজিব আদায় করতে হবে। সুন্নতে মুআক্কাদাহ আদায় করতে হবে। হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এগুলো তো জানা কথা। সকল তালিবুল ইলমই এগুলো মেনে চলবে। তাই বলে পুরো যিন্দেগী তো আর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার বাইরেও রয়েছে যিন্দেগীর বিশাল এক ময়দান। সেই ময়দানে তুমি যদি শুধুই ফিকহী বিধানের স্তর অর্থাৎ এটা মুস্তাহাব, না করলে সমস্যা নেই। এটা মাকরূহ তানযীহী, করলে সমস্যা নেই। এটা অনুত্তম, করলে সমস্যা নেই, শুধুই এই দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে বিচার কর তাহলে তো চলবে না। যারা নিজেদেরকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে তাদের যিন্দেগী কখনো সুন্দর হয় না।

যারা আদর্শ, অথবা যারা কোনো পয়গাম নিয়ে চলতে চায় তাদের থেকে এই মানসিকতা কখনো কাম্য নয়।

আদব চিনব কীভাবে

আদবের ক্ষেত্রে খুব বেশি যত্নবান হতে হবে। খেয়াল করতে হবে যে, এটা আদব কি না। কোনো না কোনো পর্যায়ে এটা সৌন্দর্য, শোভা, মর্যাদা, ওয়াকার (গাম্ভীর্য) বা ওজন পয়দা করে কি না। এমন বিষয় আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি অবলম্বন করব। করণীয়-বর্জনীয় উভয়ক্ষেত্রেই।

এর বিপরীতে এমনভাবে বিচার করা উচিত নয় যে, এটা তো একটা আদবমাত্র। এবং এমন আদব যা সরাসরি কুরআনের আয়াত বা হাদীসের বাক্য দিয়েও প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এটা ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নতও নয়। এমনকি মুস্তাহাব বলতে হলেও ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। অতএব এর প্রতি অত গুরুত্ব দেয়ার কী আছে?!

দুইটি আদব

যাইহোক, আমি মূলত দুইটি আদবের কথা বলতে চাচ্ছি।

এক. বড়দের সামনে কথা বলার ক্ষেত্রে হাত না নাড়ানো।

দুই. বড়দের পারস্পরিক আলোচনার মজলিসে আমাদের মতামত প্রকাশের চেষ্টা না করা।

বড়দের মজলিসে হাত নাড়ানো

বড়দের সামনে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের হাত হয়তো নিজের অজান্তেই নড়াচড়া শুরু করে। কারো বেশি, কারো কম। কথা বলতে গিয়ে একেবারে স্বাভাবিক হাতনাড়া যেটা-সেটাও কিন্তু আমার বড়র উপস্থিতিতে কিংবা তার সাথে কথা বলার সময় অনুচিত। কথা বলার সময় একটু আধটু হাত নাড়া, অনেকেরই এটা অভ্যাস। ঠিক আছে। কিন্তু আমার মুরববীর সাথে কথা বলার সময় কিংবা তার মজলিসে, তার উপস্থিতিতে কথা বলার সময় যেন আমার হাত না নড়ে। কমও না, বেশিও না। কারণ এটা ছূয়ে আদব বা আদব পরিপন্থী কাজ। তবে কোনো মাহফিলে, মজলিসে কিংবা কোনো জরুরি বিষয়ে তুমি আলোচনা করছ। সেখানে বয়ানের তাকাযায় স্বাভাবিকভাবে তোমার হাত নড়ছে। এরপর ঘটনাক্রমে সেই মজলিসে তোমার কোনো উস্তায উপস্থিত। এ জাতীয় ক্ষেত্র হলে ভিন্ন কথা। যেহেতু সেখানে তোমার আসল শ্রোতা অন্যরা। এরপরও যারা একটু বেশি সতর্ক তারা এমন ক্ষেত্রেও সংযম অবলম্বন করার চেষ্টা করে।

হাত নাড়াটা সাধারণত হয় কোনো কথার গুরুত্ব বুঝানোর জন্যে কিংবা কথাটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার উদ্দেশ্যে। তো উস্তায বা তোমার মুরববীকে তোমার কথার গুরুত্ব আর তুমি কী বুঝাবে?! এরপর তাকে খুব ভালোভাবে কথাটা বুঝানোর এই প্রক্রিয়াও তোমাকে মানায় না।

এছাড়া কখনো হাত নাড়াটা হয় এমনিতেই। অনর্থক। সেটা তো এমনিই পরিহার করা উচিত।

বড়দের মজলিসে কথা বলা

আমি যখন বড়দের মজলিসে শরিক হব তখন কেবল তাদের কথা শোনার জন্যে শরিক হব। নিজে কথা বলা কিংবা হাসা অথবা নিজের রায় প্রকাশ করার মাধ্যমে শরিক হব না। মুরববীদের মজলিস। সেখানে আমি আছি খাদেম হিসেবে। তাই বলে সেই মজলিসের সদস্য আমি নই। অতএব তারা যখন কোন বিষয়ে কথা বলবেন, মত বিনিময় করবেন তখন আমি নীরব হয়ে কেবল তাদের কথা শোনব। মতবিনিময় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব। নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বা মত প্রকাশ করতে আমি যাব না। এমনকি হাসির কোন বিষয় আসলে যখন তারা হাসবেন তখন তাদের সাথে আমি হাসবো না। যদিও এটা একটু কঠিন তবু এটাই আদব। তবে হ্যাঁ, যদি শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে সেখানে তুমি কোন কথা বলা জরুরি মনে কর তাহলে ইজাযত চেয়ে নাও। অথবা একটা চিরকুট লিখে দাও। এক্ষেত্রে তুমি যার খাদেম, বা যার সাথে এসেছ তার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে কথাটা তাকেও বলতে পার। কিংবা তাকেই চিরকুট লিখে জানাতে পার বা ইজাযত নিতে পার।

আর যদি ওরকম জরুরি কিছু মনে না কর তাহলে পরেই তাকে বল। মোটকথা বড়দের মজলিসে কথা বলা বা হাসা-এটা অনুচিত। কেবল তাদের কথা শোনা-এটাই আদব।

এরপর তাদের আলোচ্য বিষয় যদি তোমার হাইছিয়াত বা অবস্থানের উর্ধ্বে হয় তাহলে তো তোমার কথা বলা সেখানে আরো বেশি ছূয়ে আদব।

এই আদবটার কথা সর্বপ্রথম শুনেছি মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব হুজুর দামাত বারাকাতুহুমের কাছে। একবার তাঁর মজলিসে আমার সাথে দুইজন তালিবুল ইলম ছিল। যারা তারও ছাত্র। তো ওরা মজলিসে হাসছিল। তখন তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে এই আদবটার কথা বললেন। তার আগে হয়তো আমি নিজে এমনটা করতাম না। তবে এটা যে একটা ভিন্ন আদব সেটা আমার ইলমে এসেছে হুজুরের মাধ্যমেই।

তো আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আদাবে যিন্দেগী জানার শেখার বুঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। ষ

 

 

advertisement