যিলক্বদ ১৪৩৪   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৩

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

আল্লাহ তাআলা এ উম্মতকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ

এভাবেই আমি তোমাদেরকে বানিয়েছি মধ্যপন্থী উম্মত, যাতে তোমরা (কিয়ামতের দিন) মানুষ সম্পর্কে সাক্ষী হতে পার (বাকারা : ১৪৩)।

সাক্ষীর জন্য মধ্যপন্থী ও পরিমিতিবোধসম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য। কেননা তার সাক্ষ্য অনুযায়ী বিচারক রায় দিয়ে থাকে। সে যদি তার দেখা ঘটনার যথাযথ বিবরণ না দেয়, উভয়পক্ষের মাঝখানে না থেকে কোনও একদিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সে অনুযায়ী বর্ণনায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায় বা দোষ-গুণ বাড়িয়ে-কমিয়ে বলে, তবে ন্যায়বিচার সম্ভব হয় না; বরং নির্দোষ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয় ও দোষী ব্যক্তি খালাস পেয়ে যায় কিংবা লঘু-দোষে গুরুদন্ড বা গুরুদোষে লঘুদন্ড হয়ে যায়। পরিণামে সমাজে জোর-জুলুম ও অন্যায়-অনাচারের পথ খুলে যায়। সুতরাং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়-বিচারের স্বার্থে সাক্ষীর নিরপেক্ষ হওয়া ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া অপরিহার্য।

এই যে নিরপেক্ষতা, সবকিছুর ঠিক মাঝখানে অবস্থান করা ও বিশেষ কোন দিকে ঝুঁকে না পড়া-একে আয়াতে এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ উম্মত তার সবকিছুতে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেবে। কোনও ক্ষেত্রে প্রান্তিকতার পরিচয় দেবে না। বাড়াবাড়ি করবে না ও শৈথিল্যের পরিচয় দেবে না। তা করলে সে নিজ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে। অন্যদের মত প্রান্তিক ও একরোখা সম্প্রদায়ে পরিণত হবে, যেমন ইহুদী, খৃষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়। উম্মত যাতে তার এ বৈশিষ্ট্য না হারায় তাই সকল কাজে তাকে এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

سددوا وقاربوا واغدوا وروحوا وشيء من الدلجة والقصد، القصد تبلغوا

তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, বাড়াবাড়ি করো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড় এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৬৩)

মানুষের পরম গন্তব্যে পৌঁছার মহাসড়ক হল দীনে ইসলাম। এ দীন আদ্যোপান্ত দুই প্রান্তিকতার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। কোনও জায়গাতেই তা দিকবিশেষে সরে যায়নি। এ ছাড়া যত পথ আছে সবই প্রান্তিকতা দোষে দুষ্ট। তার অনুসরণ মানুষকে একরোখা করে তোলে ও পাপের পথে ধাবিত করে। পরিণামে মানুষ তার পরম গন্তব্য থেকে দূরে সরে যায়। এভাবে জীবন হয়ে যায় ব্যর্থ। সে ব্যর্থতা থেকে বাঁচতে হলে তথা জীবনকে স্বার্থক ও পুণ্যময় করে তুলতে হলে তার একমাত্র উপায় মধ্যপন্থার ধর্ম ইসলামের অনুসরণ।

বিখ্যাত তাবেঈ মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পুত্রকে লক্ষ করে বলেছিলেন, বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্যাবস্থাই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে (উয়ূনুল আখবার, খ. ১,

পৃ. ৩৭৬)।

বর্ণিত আছে,

خير الأمور أوسطها

সকল বিষয়ে মধ্যবর্তীটাই সেরা।

ইসলামের যথাযথ অনুসরণ সকল ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করে। কেননা ইসলাম তার শিক্ষার প্রত্যেকটি ধারায় মধ্যাবস্থার প্রতি লক্ষ রেখেছে। আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, আয়-ব্যয়, লেনদেন সবকিছুতেই তার এ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সুতরাং ইসলামের প্রকৃত অনুসারী তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে হবে মধ্যপন্থারই প্রতিকৃতি। সেজন্য প্রথমেই তাকে ইসলামের প্রতিটি বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং কোন বিষয়ে ঠিক কী নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে সে দিকে লক্ষ রেখে পথ চলতে হবে। যাতে কোন ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি বা শিথিলতাজনিত প্রান্তিকতা ইসলামী জীবনের এ অনন্য বৈশিষ্ট্যকে নস্যাৎ করতে না পারে।

আকীদা-বিশ্বাস : ইসলামে তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি আকীদা-বিশ্বাসের যতগুলো ধারা আছে তার প্রত্যেকটিতেই মধ্যপন্থার বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট। সর্বপ্রধান আকীদা আল্লাহ তাআলার যাত ও সত্তা সম্পর্কে মানুষের ভেতর নানারকম প্রান্তিকতা বিদ্যমান। কারও বিশ্বাস তিনি এমনভাবেই মানুষের ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-কল্পনা ও বোধ-ভাবনার অতীত যে, সরাসরি তাঁর পর্যন্ত পৌঁছা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য কোনও না কোনও মধ্যস্থের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। সেই মধ্যস্থের মাধ্যমেই তাঁর নৈকট্য পাওয়া ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব। এর বিপরীতে কারও বিশ্বাস, তিনি এমনই অধিগম্য যাকে বোঝার জন্য এমনকি নবী-রাসূলের শিক্ষারও কোন প্রয়োজন নেই। কেউ তাঁকে সম্পূর্ণ নির্গুণ এক নামসর্বস্ব সত্তা মনে করে, আবার কারও ধারণা তিনি মানুষেরই মত অংগ-প্রত্যংগধারী। এসবই প্রান্তিক ধারণা। প্রকৃত বিষয় এর মাঝামাঝি। সুতরাং কুরআন মাজীদ  যেমন তাঁকে

الكبير المتعال

 

মহান, সমুচ্চ বলেছে, তেমনি তিনি বলেন,

فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعاني

 

আমি তো কাছেই, যখন কেউ আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া দেই। অর্থাৎ তিনি মহান ও সমুচ্চ হয়েও বান্দার কাছাকাছি। ফলে তাঁকে ডাকা ও পাওয়ার জন্য কোন মধ্যস্থের দরকার নেই। এমনিভাবে তিনি আদৌ নির্গুণ নন; বরং সমস্ত ভালো গুণের অন্তহীন আধার তিনি। সারা কুরআন জুড়েই রয়েছে তাঁর সে গুণাবলীর বিবরণ। কিন্তু তাই বলে তাঁর সে গুণ মানুষের মত নয় এবং তাঁকে তাঁর কোন সৃষ্টির সাথে তুলনা করা যাবে না। তাঁর সত্তা ও গুণাবলী একান্তভাবে তাঁরই শান মোতাবেক-

ليس كمثله شيء

তাঁর মত নয় কোন কিছু। অর্থাৎ তিনি যেমন কারও সাথে তুলনীয় নন, তেমনি এমনও নন যে, তাঁর সম্পর্কে কোনরূপ ধারণা লাভ সম্ভব নয়। তাঁর ইবাদত-আনুগত্যের জন্য যতটুকু জানা দরকার নবী-রাসূলের শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে ততটুকু জানা সম্ভব। এই হচ্ছে আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ইসলামী আকীদার সার-নির্যাস, যা সব রকম প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ।

নবী-রাসূল সম্পর্কে ইসলামী আকীদা হল- তাঁরা আল্লাহ বা আল্লাহর অবতার নন, নন ফিরিশতাও। তাঁদের কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে না। আল্লাহর গুণে তাঁদের কোন অংশীদারিত্ব নেই। বরং তাঁরা রক্ত মাংসেরই মানুষ। অন্যসব মানুষের মত প্রাকৃতিক সব বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বিদ্যমান তাই বলে তাঁরা সাধারণ মানুষের মত দুর্বলচিত্ত, ইন্দ্রিয়পরবশ ও পাপপ্রবণও নন। তাঁদের প্রতি যেহেতু ওহী নাযিল হয়। তাই তাঁরা ওহী ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকেন এবং ওহীলব্ধ জ্ঞানের শিক্ষাদাতা হিসেবে এক অপাপবিদ্ধ সত্তা ও সর্বোচ্চ স্তরের আদর্শিক গুণাবলী তাঁরা ধারণ করেন।

সংক্ষেপে এটাই নবী-রাসূল সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাস। নিঃসন্দেহে এটা

প্রান্তিকতামুক্ত এক ভারসাম্যমান বিশ্বাস। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ বিশ্বাসেরই শিক্ষাদান করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) বল, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ (কাহফ : ১১০)। অর্থাৎ আমি ঈশ্বর নই, ঐশ্বরিক কোন ক্ষমতা আমার নেই। আমি একজন মানুষ, তবে তোমাদের উপর ওহী নাযিল হয় না, আমার প্রতি হয় এবং ওহী সংশ্লিষ্ট বিশেষত্ব আমার আছে বিধায় এক স্বতন্ত্র মর্যাদারও আমি ধারক। এভাবে অতি সংক্ষেপে এ আয়াত নবী সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ধারণা আমাদের সরবরাহ করেছে।

 

এর বিপরীতে নবীগণকে ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন সত্তা মনে করা যেমন চরম বাড়াবাড়ি, তেমনি তাঁদেরকে সাধারণ মানুষের মত দোষগুণসম্পন্ন বলে ধারণা করাটাও তাদের প্রকৃত মর্যাদার পরিপন্থী। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে আজ তাঁর উম্মতের মধ্যেই এ উভয়বিধ প্রান্তিকতা লক্ষ করা যায়। এক শ্রেণীর লোক তাঁর নবুওয়াতী এবং তাঁর কথা ও কর্মের প্রামাণিক মর্যাদা স্বীকার করে না। তাদের দৃষ্টিতে তাঁর মর্যাদা একজন বার্তাবাহকের বেশি নয়।

অপর এক দলের বিশ্বাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। তারা তাঁর মর্যাদাদানে চরম বাড়াবাড়ির শিকার। তাদের মতে মাটির মানুষ বলাটা তাঁর পক্ষে অমর্যাদাকর। তাদের মতে তিনি নূরের সৃষ্টি। অনেকে এতটুকু বলেই ক্ষান্ত নয়; বরং তাদের বিশ্বাস তিনি সর্বজ্ঞানের অধিকারী একজন ঐশ্বরিক এখতিয়ারসম্পন্ন সত্তা। প্রকৃত সত্য এ উভয় ধারণার মাঝখানে। উপরে বর্ণিত আয়াতটি এ উভয় ধারণাই খন্ডন করছে এবং জানাচ্ছে, তাঁকে তাঁর প্রকৃত মর্যাদার উপরে তুলে খোদা বানিয়ে দিও না এবং নিচে নামিয়ে অমর্যাদাও করো না। নবুওয়াতের যে প্রকৃত অবস্থান সেখানেই তাঁকে থাকতে দাও। তাতেই তাঁর সম্মান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপুল সংখ্যক হাদীস দ্বারা যেমন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে নিজ মর্যাদা তুলে ধরেছেন, তেমনি সাবধানও করেছেন যাতে মর্যাদাদানের ক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করা না হয়। তিনি বলেন,

لا تطروني كما اطرت النصارى ابن مريم، فإنما أنا عبده فقولوا عبد الله ورسوله

খৃষ্টান সম্পদ্রায় যেমন মারয়াম-পুত্র (ঈসা আলাইহিস সালাম)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে (এমনকি তারা তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে), তেমনি আমাকে নিয়ে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো তাঁর বান্দা মাত্র। সুতরাং বলো আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৪৪৫)।

আখিরাত সম্পর্কিত আকীদায়ও গুরুত্বের সাথে এ মাত্রাজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আখিরাতের সফলতাই মানব জীবনের পরম লক্ষ এবং সেই লক্ষেই মানুষের যাবতীয় কাজ অনুষ্ঠিত, এতো ঠিক, কিন্তু তার মানে এ নয় যে, সে ইহজগতিকতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করবে এবং আখিরাতের সফলতার জন্য দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা জরুরি মনে করবে। এটা বৈরাগ্যবাদ, ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান নেই। বরং আখিরাত-বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে মানুষ পার্থিব জীবনের মোহে বুঁদ হবে না, সে পার্থিব জীবনে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে আর তা করবে আখিরাতকে মাথায় রেখে। এভাবে পার্থিব জীবনের স্বচ্ছ-সুষ্ঠু নির্বাহ দ্বারা আখিরাতকে নির্মাণ করবে। আখিরাত যেহেতু অবিনশ্বর আর দুনিয়া নশ্বর, তাই মাত্রাজ্ঞানের দাবি এটাই যে, প্রত্যেকটিকে তার আপন পর্যায়ে রেখে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কর্মপন্থা অবলম্বন করবে। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি তার দুনিয়াকে ভালোবাসে সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আর যে তার আখিরাতকে ভালোবাসে সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে (অর্থাৎ উভয়দিক সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করা সম্ভব নয়) সুতরাং তোমরা স্থায়ীকে অস্থায়ীর উপর প্রাধান্য দাও (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯৬৯৭ মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৮৫৩। অর্থাৎ ভালো আখিরাতকেই বাসবে আর ইহজীবনের প্রাসঙ্গিকতা ও আখিরাতের সঞ্চয় হিসেবে দুনিয়ার যা কিছু প্রয়োজন মোহমুক্ত হয়ে তাও আনজাম দিয়ে যাবে। এই মাত্রাজ্ঞানের অনুসরণেই উভয় জাহানের কল্যাণ। সে কল্যাণ অর্জনের জন্যই দুআ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে,

ربنا آتنا في  الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنة وقنا عذاب النار

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দাও দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণ আর আমাদেরকে রক্ষা কর জাহান্নামের আযাব থেকে (বাকারা : ২০১)।

যেকোন আকীদায় মধ্যপন্থা ত্যাগ করলে পথভ্রষ্টতা হয় তার অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসে এ পর্যন্ত বহুলোক এভাবেই পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি এ কারণে বহু দল-উপদলও সৃষ্টি হয়েছে। বরং সত্যকথা হচ্ছে মুসলিম জাতিসত্তার ভাঙন সৃষ্টি ও ইসলামের ভেতর নানা-ফির্কার উৎপত্তি প্রধানত আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা পরিত্যাগেরই কুফল। মুতাযিলা, মুরজিয়া, জাহমিয়া, কাদরিয়া, খারিজী, রাফিজী, বাতেনী, কারামাতী প্রভৃতি সম্প্রদায়সমূহ এভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। কোন সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে বিশেষ কোন আকীদায় শিথিলতাকে কেন্দ্র করে এবং কোনওটির মূলে রয়েছে সেই আকীদা বা অন্য কোনও বিষয়ে বাড়াবাড়িজনিত প্রান্তিকতা।

উল্লেখ্য, কোন বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির শিথিলতাহেতু যারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয় অন্যের প্রতি আচরণে তারাও কিন্তু বাড়াবাড়ির পরিচয় দেয় ও চরমপন্থা অবলম্বন করে। তাছাড়া এমনিতেও সেই শিথিল দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরই একরকম বাড়াবাড়ি ও হঠকারিতা নিহিত থাকে এবং থাকে নিজ মত ও চিন্তাভাবনার উপর সীমাতিরিক্ত আস্থা ও অহমবোধ। তাই দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তারা ভিন্নমতকে মেনে নিতে পারে না। সুতরাং এ হিসেবে শিথিলতা ও বাড়াবাড়ি মূলত একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। কিংবা বলা যায় সীমালঙ্ঘন ও অহমবোধই আসল রোগ। সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে বাড়াবাড়ির প্রতি অংগুলিনির্দেশ করে তার অনিষ্টতা সম্পর্কে উম্মতকে সাবধান করেছেন ও তা পরিহার করে মধ্যপন্থা আকড়ে ধরার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, (অর্থ) কথা ও কাজে সীমালঙ্ঘনকারীগণ ধ্বংস হোক (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬৭০)। আরও ইরশাদ করেন, (অর্থ) সাবধান তোমরা দীনের ভেতর বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা দীনের ভেতর বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩০৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩০২৯; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৮৭১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৮৬৭)

ইবাদত-বন্দেগী : মানব জীবনে ইবাদত-বন্দেগী সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরই জন্য মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, (তরজমা) আমি জিন্ন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে (যারিয়াত : ৫৬)। নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ এ চারটিই প্রধান ইবাদত। এগুলো ইসলামের রুক্ন বা স্তম্ভ। এছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ গুরুত্বের কারণেই কুরআন-হাদীসে এসব বিষয়ে বিস্তারিত শিক্ষাদান করা হয়েছে এবং এর গুরুত্ব ও মর্যাদার প্রতি সুস্পষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও কুরআন-হাদীসে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাবধান করা হয়েছে যাতে কেউ এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা- এ দুই প্রান্তিকতার কোনওটারই শিকার না হয়। যেমন ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) তুমি নিজের নামায বেশি উঁচু স্বরে পড়বে না এবং অতি নিচু স্বরেও না। বরং উভয়ের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করবে (বনী ইসরাঈল : ১১০)।

ইবাদতের জন্যই যেহেতু মানুষের সৃষ্টি তাই এ ব্যাপারে শিথিলতার অবকাশ না থাকাটা তো স্পষ্ট, যা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। তা সত্ত্বেও কুরআন-হাদীসে বারবার সাবধান করা হয়েছে, যাতে চিন্তা-চেতনা ও ব্যবহারিকভাবে এ ব্যাপারে কেউ শিথিলতা প্রদর্শন না করে। বিশ্বাস ও চিন্তাগত শিথিলতা মানুষকে গোমরাহ বানিয়ে দেয়, এমনকি ইসলাম থেকে খারিজও করে দেয়। কেউ যদি এ চার মৌলিক ইবাদতের গুরুত্বকে খাটো করে দেখে এবং এর ফরযিয়াতকে অস্বীকার করে, তবে সে ঈমানহারা হয়ে যায়। আর তা স্বীকার করা সত্ত্বেও বাস্তবে পালন না করলে ফাসেক ও পাপিষ্ঠ বলে গণ্য হয়। উভয়ের জন্যই রয়েছে জাহান্নামের কঠোর শাস্তি। অস্বীকারকারীর জন্য স্থায়ী শাস্তি, আর আমলে অবহেলাকারীর জন্য অস্থায়ী শাস্তি। সে শাস্তি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে ইবাদতে শিথিলতা অবশ্য পরিত্যাজ্য। মানুষ যাতে সর্ববিধ শিথিলতা ত্যাগ করে ইবাদতকে তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় ও নিষ্ঠার সাথে তা পালনে রত হয়, সে জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও উৎসাহদান উভয় পন্থাই অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) যারা অহংকারে আমার ইবাদত থেকে বিমুখ হয়, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে, লাঞ্ছিত হয়ে (মুমিন : ৬০)। এবং ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ কর, সিজদা কর এবং তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর, যাতে সফলকাম হতে পার (হজ্জ : ৭৭)। তাছাড়া আলাদাভাবে প্রত্যেকটি ইবাদত সম্পর্কেও বহু আয়াত ও হাদীস আছে, যা সবরকম শিথিলতা ত্যাগ করে আমলে যত্নবান হওয়ার তাগিদ ও উৎসাহ যোগায়।

ইবাদত-বন্দেগীতে শৈথিল্যেরর মত বাড়াবাড়িও নিন্দনীয়। এটাও বহুবিধ অনর্থের কারণ। বিশ্বাস ও চিন্তাগত বাড়াবাড়ি তো গোমরাহীর কারণ হয়ে যায় এবং অনেক সময় তা মানুষকে ইবাদতের প্রতি নিরুৎসাহীও করে তোলে। আর কর্মগত বাড়াবাড়ির সর্বাপেক্ষা বড় ক্ষতি হল ইবাদতের স্থায়িত্ব ও নিরবচ্ছিন্নতা নষ্ট হওয়া। কেননা ইবাদতে মাত্রাজ্ঞান হারালে ক্লান্তি ও অবসাদ অনিবার্য হয়ে পড়ে, যার পরিণাম ইবাদতকে বিদায় জানানো। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) যে কেউ (সাধ্যাতীত আমলে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে) দীনকে কঠিন করে তোলে, দীন তাকে কাবূ করে ফেলে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৯

পক্ষান্তরে পরিমিতি রক্ষা করলে অবসাদ দেখা দেয় না, স্ফূর্তি বজায় থাকে। ফলে ইবাদত স্থায়ী হয়। সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা আমলের এ পরিমাণই বহন কর যার ক্ষমতা তোমাদের আছে। (সহীহ বুখারী, হাদীস :  ৬৪৬৫)। অর্থাৎ যা করতে সক্ষম তাই কর। সাধ্যের অতীতে লিপ্ত হতে যেও না। কেননা তা ধরে রাখতে পারবে না। পরিমিত পরিমাণ করলে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যেতে পারবে। আর আল্লাহ তাআলার কাছে সেই আমলই বেশি প্রিয় যা অল্প হলেও স্থায়ীভাবে করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস :  ৬৪৬৫)।

একবার তিনজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের কাছে এসে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তাদেরকে যখন তা জানানো হল তারা অবাক হলেন। কারণ তার পরিমাণ তাদের ধারণা অপেক্ষা ঢের কম ছিল। তাদের ধারণা ছিল তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে দিবারাত্র নামায-রোযাতেই কাটান। কখনও রাতে ঘুমান না এবং কোনও দিন বিনা রোযায় কাটান না। পরক্ষণে তারা ভাবলেন, তাঁর তো এত বেশি ইবাদতের দরকার নেই। আল্লাহ তাআলা তাকে নিষ্পাপ রেখেছেন-তাঁর কোনো গুনাহ নেই। তাই খুব বেশি ইবাদত করার তাঁর দরকার নেই। অন্যরা তো তাঁর মত নয়। তাদের অনেক গুনাহ হয়ে যায়। তাই তাদেরই বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে। সেমতে একজন বললেন, আমি রাতভর নামায পড়ব। কখনও ঘুমাব না। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি জীবনভর প্রত্যেকদিন রোযা রাখব। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারীসংগ পরিহার করে চলব। কখনো বিবাহ করব না। তাদের একথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে গেল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা এই-এই কথা বলেছ? শোন, আমি কিন্তু আল্লাহকে তোমাদের অপেক্ষা বেশি জানি। তাই তোমাদের অপেক্ষা তাকে ভয়ও বেশি করি, অথচ আমি কোন দিন রোযা রাখি এবং কোনও দিন রাখি না। আমি নামাযও পড়ি এবং ঘুমাইও আর আমি বিবাহও করেছি। (এটাই আমার সুন্নত ও নিয়ম)। যে ব্যক্তি আমার সুন্নত উপেক্ষা করে সে আমার দলের নয় (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫০৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪০১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩২১৯)। মধ্যপন্থা ও পরিমিতি রক্ষা সম্পর্কে এ হাদীস এক সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সীমালংঘন সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী। ইবাদতে পরিমিতি সম্পর্কে এরকম আরও বহু হাদীস আছে। সবগুলোর একত্রীকরণ উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য কেবল ইবাদত-বন্দেগীতে শরীয়তের বিশেষ মেযাজ। তথা মধ্যপন্থা অবলম্বনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা। সে জন্য দু একটি হাদীসের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।

প্রকাশ থাকে যে, এই পরিমিতি রক্ষার জন্য কোন্ ইবাদত কোন্ পর্যায়ের সে সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। যাতে অজ্ঞতাজনিত কারণে কোন ইবাদতকে তার আপন অবস্থান থেকে উপরে উঠানো বা নিচে নামানোর প্রান্তিকতা দেখা না দেয়।

ফরয-ওয়াজিব, সুন্নত ও

মুস্তাহাব-সাধারণভাবে ইবাদত এই চার স্তরের। এর প্রত্যেকটিকে আপন আপন স্থানে রাখাই পরিমিতিবোধের দাবি এবং সেটাই শরীয়তের যথার্থ অনুসরণ। ফরয-ওয়াজিবকে যেমন সুন্নত-মুস্তাহাবের স্তরে নামানো ঠিক নয়, তেমনি সুন্নত-মুস্তাহাবকেও ফরয-ওয়াজিবের মর্যাদা দেওয়া সংগত নয়। এতে দীনের প্রকৃত কাঠামো যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি উম্মতের সম্প্রীতি নষ্টেরও পথ তৈরি হয়। যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ফরযিয়াতকে অস্বীকার করা হয়, রমযানের রোযা, মালের যাকাত  ও বায়তুল্লাহর হজ্জকে ঐচ্ছিক সাব্যস্ত করা হয় তবে তাতে দীনে ইসলামের অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। কেউ তা করলে তার নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ থাকে না। বেশ আগে থেকেই এক শ্রেণীর লোক এজাতীয় চিন্তা পোষণের মাধ্যমে দীনের অবকাঠামোয় ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাতে শাশ্বত ও সুরক্ষিত দীন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তাদের নিজেদের ধামির্কতা যে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই সংগে বৃহত্তর মুসলিম জাতিসত্তার এই ক্ষতি হয়েছে যে, এর ফলে বিভক্তিতে মাত্রাযোগ হয়েছে, নতুন ফেরকার গোড়াপত্তন হয়েছে।

একই রকমের কুফল রয়েছে এর বিপরীত প্রান্তিকতার ভেতর। অর্থাৎ সুন্নত-মুস্তাহাবকে ফরযের মর্যাদা দিলে তাতেও দীনের অবকাঠামো বদলে যায়। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. দীনের ভেতর রদবদল ঘটার বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখেন, আরেকটি কারণ হচ্ছে বাড়াবাড়ি। অর্থাৎ এমন কঠিন কঠিন ইবাদত অবলম্বন করা, শরীয়ত যার আদেশ করেনি, যেমন সারা বছর রোযা রাখা, রাতভর ইবাদত করা, সংসার জীবন পরিহার করা, বিবাহ না করা এবং সুন্নত-মুস্তাহাবকে ওয়াজিবের মত গুরুত্ব দেওয়া। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/১২০)

এ জাতীয় বাড়াবাড়ির ফলে বিভক্তিপ্রবণতাও উসকানি পায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে যেসব আত্মকলহের ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে এরকম বাড়াবাড়ির ভূমিকা নেহাত কম নয়। সন্দেহ নেই সুন্নত-মুস্তাহাবও দীনের একটা অংশ এবং ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকবে তখনই যখন তাকে তার আপন অবস্থানে থাকতে দেওয়া হবে। বাইরের আলো বাতাস দ্বারা গৃহাভ্যন্তরকে স্বচ্ছন্দ ও স্নিগ্ধময় করে রাখার পক্ষে জানালা ও গবাক্ষের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে ভূমিকার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে জানালা ও গবাক্ষকে যথাস্থানে যথারূপে রাখাই বাঞ্ছনীয়। নচেৎ তাকে যদি গৃহস্থদের চলাচল পথ তথা দরজার আকার-প্রকারে নিয়ে আসা হয়, তাতে দুয়েরই মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়। উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়। আলোচ্য ক্ষেত্রেও বিষয়টা

সে রকমই। সুন্নত-মুস্তাহাবকে ফরয-ওয়াজিবের মর্যাদা দিলে এভাবেই উভয়ের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয় এবং কার্যত উভয়টাই অস্তিত্ব-সংকটের শিকার হয়।

সুন্নত-মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য আরও একটা বিষয় জানা দরকার। তা হচ্ছে এর পদ্ধতিগত বৈচিত্র্য। শরীয়াতে এমন বহু কাজ আছে যা করার সুন্নতসম্মত পন্থা একাধিক-প্রতিটি পন্থা হাদীস দ্বারা প্রমানিত। তবে হাদীসের শাস্ত্রীয় নীতিমালার আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে কোন্ পন্থা অপেক্ষা কোন্ পন্থা প্রাধান্য পায় তা নিয়ে মুজতাহিদগণের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, এক মুজতাহিদের কাছে এক পন্থা অগ্রগণ্য মনে হয়েছে তো অন্য মুজতাহিদের কাছে অন্য পন্থা। এ হিসেবে একজনের কাছে এক পন্থা আফযল (উত্তম), তো অন্যজনের কাছে অন্য পন্থা। পন্থা যে উভয়টিই জায়েয ও অনুসরণযোগ্য তা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। বিরোধ কেবল অগ্রগণ্যতা নিয়ে। রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ থেকে মাথা তুলে হাত তোলা হবে কি হবে না, দোয়া কুনূত রুকূর আগে পড়া হবে, না পরে, আমীন উচ্চস্বরে বলা হবে, না নিচুস্বরে, ঈদের নামাযে ছয় তাকবীর বলা হবে, না বার তাকবীর ইত্যাদি বিষয়গুলো এ রকমই। সুতরাং এজাতীয় মাসাইলে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া খুবই জরুরি। অর্থাৎ আমি যে পন্থাই অনুসরণ করি না কেন, তাকে আফযলের বেশি কিছু ভাবব না এবং বিপরীত পন্থাকে অবৈধ ঠাওরাব না। আমার কাছে আমার অনুসৃত পন্থা যেমন উত্তম অন্যের কাছে দ্বিতীয় পন্থাও তেমনি উত্তম। কার্যত আমরা উভয়ই উত্তম পন্থার অনুসারী। সুতরাং কারও বিরুদ্ধে কারও আপত্তি তোলার সুযোগ নেই; বরং উভয়েই সুন্নত ও উত্তম পন্থার অনুসারী হিসেবে মহববত ও সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থান করব। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এসব মাসাইলে পরিমিতিবোধের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মহল বিশেষকে দেখা যাচ্ছে একটি পন্থাকে সুন্নত ও দ্বিতীয় পন্থাকে সুন্নতবিরোধী সাব্যস্ত করত জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। যেখানে উচিত ছিল এজাতীয় দ্বান্দ্বিক ও উসকানিমূলক তৎপরতা পরিহার করে উম্মতের মধ্যে তাওহীদী চেতনার বিস্তার, শিরকের মূলোৎপাটন, কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা প্রচার, ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী প্রচারণার উপযুক্ত জবাবদান, নাস্তিক্যবাদের মুকাবিলা ও ইহুদী-খৃষ্টান চক্রের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। সেখানে তারা বিভক্তি-বিভাজনের ইস্যু তৈরির তৎপরতায় নিজেদের মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট করছে।

আজ উম্মত কি কেবল ভূমি আগ্রাসনেরই শিকার? তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি শত্রুকবলিত, শিক্ষাব্যবস্থা আদর্শচ্যূত, চিন্তা-চেতনা কুফরাচ্ছন্ন, অর্থ-সম্পদ শত্রুনিয়ন্ত্রিত, সমরশক্তি রুগ্ন ও ন্যুব্জ, আখলাক-চরিত্র বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত, তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পরনির্ভর, তাদের শিল্প-সাহিত্য অপসংস্কৃতি-জর্জর, রাজনীতি লক্ষভ্রষ্ট, রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা শক্তি মদমত্তদের ভূ-রাজনৈতিক চালিয়াতির শিকার, বহুজাতিক কর্পোরেট বাণিজ্যের শোষণে নির্জীব নিরক্ত, নানামুখী অপপ্রচার ও তথ্যসন্ত্রাসে দিশেহারা, স্যাটেলাইট সংস্কৃতির থাবায় বিসস্ত্র, তারা বহিঃশত্রুর অবিরাম হামলা ও গৃহশত্রুর নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, বহুজাতিক আত্মকলহ ও বিরোধ-বিসংবাদে নাকাল-নাজেহাল। এহেন পরিস্থিতিতে উসকানিমূলক তৎপরতার মাধ্যমে শত্রুর এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা না রেখে দরকার উম্মতের অস্তিত্ব রক্ষা ও নবচেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে

সুচিন্তিত পরিকল্পনার আওতায় গঠনমূলক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কীভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ মুকাবিলা করা যায়, কীভাবে বিক্ষিপ্ত-বিভক্ত উম্মতকে একাট্টা করা যায়। কোন্ পন্থায় তাদের বহুরৈখিক পশ্চাদপদতা কাটিয়ে হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব এবং তাদের সকল শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিনাশক ভূমিকা থেকে উদ্ধার করে নির্মাণমুখী করার উপায় কী এসবই এখন মুখ্য ভাবনার বিষয়। এ ভাবনার জন্য মানসিক ইতিবাচকতা ও দৃষ্টির প্রসারতা দরকার। দরকার একদেশোদর্শী মনোভাব পরিবর্তন করে উদার ও ভারসাম্যবান দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করা। ষ    

      (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

advertisement