শাওয়াল ১৪৩৪   ||   আগস্ট ২০১৩

আমাদের রাজ্যশাসন-৯

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

ইসলামের প্রভাব

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের আগে আরব তথা গোটা বিশ্বের অবস্থা কী ছিল। ২৩ বছর আর কতটুকুইবা সময়। অথচ এই সামান্য কয়েক বছরেই সমগ্র আরবের চিত্র পাল্টে গেছে। এখন সেখানে কোনো চোর নেই, নেই কোনো ছিনতাইকারী, কোথাও ঘটে না কোনো ডাকাতির ঘটনা। কোনো কাফেলাও আর হয় না লুটতরাজের শিকার।

 সবখানেই এখন বিরাজ করছেন শুধু আল্লাহ তাআলার পবিত্র ও মুখলিস বান্দাগণ। নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজ করছে পূর্ণ নিরাপত্তা। যে কোনো অসহায় বৃদ্ধা নারী প্রকাশ্যে স্বর্ণালংকারে সজ্জিত হয়ে ইয়ামানের সানআ নগরী থেকে হাজার হাজার মাইল সফর করে মক্কায় চলে এলেও তার গতিরোধ করার কেউ ছিল না। গনীমতের সম্পদ চৌকিদারের কোনো পাহারা ছাড়াই দিনের পর দিন মসজিদে পড়ে থাকলেও কেউ তা নেওয়ার ছিল না। এমনকি তা স্বর্ণালংকার  না মাটির স্ত্তপ- তা দেখার জন্য কেউ চোখ তুলেও তাকাতো না।

 

যেখানে প্রতিহিংসা ও শত্রুতা এমন ছিল যে, ভাই ভাইকে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না সেখানে হঠাৎ অবস্থার এমন পরিবর্তন হয়ে গেল যে, অপ্রিয়রা হল প্রিয়তর আর পর হল অতি আপন। ঘৃণার পরিবর্তে সর্বত্র শুধু প্রীতি ও সৌহার্দের চর্চা। যে পাত্রে মদ ছিল মুহূর্তেই তা ভেঙ্গে ফেলা হল। তাদের দিনরাতের খেলা-জুয়াও নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। মন্দ ও খারাপের আড্ডা বন্ধ হয়ে গেল। মেলা-প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেল। মূর্তি ধ্বংস হল। এখন কোথাও আর বৃক্ষের পূজা হয় না। হয় না পাথরের অর্চনা। এখন কবরের উপর আর সিজদা হয় না, রাজা-বাদশাহদের সামনে হয় না কোনো কুর্নিশ। সর্বত্রই শুধু এক ইলাহর যিকির আর তাঁরই নামের বন্দনা।

ঈমানের শক্তি হিম্মত বুলন্দ করে দিয়েছে। সেই হতদরিদ্র, অসহায় ও নিঃস্ব আরব যাদের গোটা জীবন কেটেছে ছাগলের রাখালি আর উটের দেখাশুনা করে তারাই আজ রাজত্ব ও সাম্রাজ্যের আশা করতে পারছে। যে কায়সার ও কিসরার (রোম ও ইরানের বাদশা) নামে তারা ছিল প্রকম্পিত, গাসসানীদের ভয়ে ছিল নিদহারা আজ তারাই অধিষ্ঠিত হতে চায় তাদের সিংহাসনে।

অসহায়ত্ব আর দারিদ্র্যই ছিল যেখানে সদা বিরাজমান, উটের দুধ আর খেজুর খেয়ে যারা দিন নির্বাহ করত, চার-পাঁচদিন পার হলেও যারা শস্যদানার দেখা পেত না অল্প দিনের ব্যাবধানে তারা সম্পদের এমন প্রাচুর্য লাভ করল যে, দানের জন্য হাজার হাজার মুদ্রা বয়ে নিয়ে বেড়ালেও তা গ্রহণের যোগ্য কাউকে পাওয়া যেত না।

চিন্তার বিষয় এই যে, শেষ কয়েক বছরে অবস্থার এই আমূল পরিবর্তন কীভাবে হল? আসলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন সেই মহান ব্যক্তি, যিনি সারা দুনিয়াকে বদলে দিলেন!

 

খেলাফতে রাশেদা

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম ঐকমত্যের ভিত্তিতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.কে খলীফা নির্বাচন করেন। তখন রাষ্ট্রের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। একদিকে আরবের বিভিন্ন গোত্র ইসলাম থেকে ফিরে গিয়েছে। মুসায়লামা-আসওয়াদ আনাসীরা হয়ে উঠেছে নবুওয়তের দাবিদার। আর যারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদেরও অনেকে যাকাত দিতে অস্বীকার করে বসেছে। অন্যদিকে ছিল বহিঃরাষ্ট্রের আক্রমণের ভয় ও শংকা।

আবু বকর রা. সার্বিক অবস্থা ভালোভাবে দেখলেন এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সকল সাহাবীর কঠোর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি প্রথমে হযরত উসামা রা.কে শামে অভিযানের আদেশ করলেন। অবস্থার নাজুকতা অনুভব করে বহিঃরাষ্ট্রে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করাকে কেউ মুনাসিব মনে করেননি। কিন্তু আবু বকর রা. নিজ দূরদর্শিতার কারণে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকায় এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং হযরত উসামা রা.কে শামে প্রেরণ করে দেন। অল্প কদিনেই তারা শত্রুদের পরাজিত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন।

হযরত খালিদ রা.কে তিনি প্রেরণ করলেন মিথ্যুক মুসায়লামাদেরকে প্রতিহত করার জন্য। তাকে আদেশ দিলেন যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধেও লড়াই করার। এবারও সাহাবায়ে কেরাম বাধা দিলেন। কিন্তু আবু বকর রা. হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বলতে লাগলেন, আল্লাহর শপথ! যদি এসব লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে একটি রশিও দিত কিন্তু এখন তা আদায় করতে অস্বীকার করে তাহলেও আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তাঁর এই কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। এরপর কাফেলা রওয়ানা করল।

 

নিঃসন্দেহে আবু বকর রা. সার্বিক অবস্থা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তার এই কৌশলের ফলে সকল রাষ্ট্র ভয়ে কেঁপে ওঠল এবং সবার মনে এই কথা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, মুসলমানরা খুবই শক্তিশালী ও সুদৃঢ়। যদি তাদের শক্তি না থাকত তবে এভাবে চারদিকে সৈন্য প্রেরণ করতে পারত না। এর ফল এই দাঁড়াল যে, দুশমনদের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে গেল, কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের অনুগত হয়ে গেল। আর যারা মোকাবেলার জন্য ময়দানে এসেছিল তারাও ভয়ে কম্পিত হয়ে নিজেদের অস্ত্র গুটিয়ে নিল। মুসায়লামা ও তার অনুসারীরা নিহত হল। এভাবে আবার চারদিকে ইসলামের বিজয়ধ্বনি বাজতে লাগল। ষ

 

       (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement