রজব ১৪৩৪   ||   মে ২০১৩

একটি সমাবেশ, কিছু শিক্ষা

হেফাযতে ইসলামের ডাকা ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশ প্রমাণ করল, এদেশের সর্বস্তরের মুসলিম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ। শত দৈন্য-দুর্বলতার মাঝেও হৃদয়ের পবিত্রতম স্থানে তারা লালন করেন রাসূল-প্রেমের মহাসম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় তারা আপোষহীন। শক্তি-ক্ষমতা ও প্রচার মাধ্যমের সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাতিলের সর্বপ্রকার আগ্রাসন যে এই একটি জায়গায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশে তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল। এ সত্য-সম্পদ আমাদের আজীবন রক্ষা করতে হবে, এবং এর শক্তি সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। ৬ এপ্রিলের সমাবেশ শুধু একটি সমাবেশ ছিল না, অনেক স্বাতন্ত্র ও বিশিষ্টতায় ভাস্বর ছিল। এর সঠিক মূল্যায়ন এবং এ থেকে সঠিক শিক্ষা নেয়ার জন্য যা মনে রাখা জরুরি। এক. এই মহাসমাবেশ প্রতিরোধ করার জন্য সক্রিয় ছিল গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র। ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তৎপরতায় ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হল সারা দেশ থেকে। নৌপথ, সড়কপথ এমনকি রেলপথেও যান চলাচল বন্ধ করা হল যাতে লংমার্চের কাফেলা ঢাকা পৌঁছুতে না পারে। দুই. শাহবাগের মঞ্চসহ সরকারী দল ও জোটের মদদপুষ্ট অপর দুটি সংগঠনের পক্ষ হতে ৫ এপ্রিল (শুক্রবার) সন্ধ্যা থেকে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নজিরবিহীন হরতাল আহবান করা হল। হরতাল সাধারণত ডাকা হয় ছুটির দিন বাদ দিয়ে। এই প্রথম ছুটির দিনে হরতাল ডাকতে দেখা গেল। সচেতন জনগণ একে অভিহিত করলেন ‘সরকারী হরতাল’ বলে। তিন. পথে পথে, বিশেষত ঢাকার প্রবেশ দ্বারগুলোতে নিয়োজিত করা হল কড়া পাহাড়া, যাতে সকল বাধা ডিঙ্গিয়েও যারা ঢাকার উপকণ্ঠে উপস্থিত হবেন তাদের প্রতিরোধ করা যায়। চার. এই ব্যাপক প্রতিরোধ-চেষ্টার পরও যা ঘটল তা এদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। ক. ঢাকাস্থ মতিঝিলই শুধু নয়, প্রতিরোধের কারণে গোটা দেশের প্রধান প্রধান নগরী হয়ে উঠল সমাবেশ-নগরী। খ. মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাগম ঘটল লক্ষ লক্ষ মানুষের। প্রতিরোধ করা না হলে যার সংখ্যা অর্ধ কোটিতে পৌঁছুত বলে অনেকের বিশ্বাস। গ. টঙ্গী, গাজীপুর এমনকি কুমিল্লা থেকে লক্ষাধিক মানুষ সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছুলেন পায়ে হেঁটে। পাঁচ. সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, লংমার্চের কাফেলার প্রতি গণমানুষের হৃদয় উপচানো ভালোবাসা। অসংখ্য মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে পানি ও শরবত দ্বারা আপ্যায়িত করলেন ঢাকা-অভিমুখী কাফেলাকে। নিরাপত্তার অজুহাতে মতিঝিলে হোটেল- রেস্টুরেন্টগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নবী-প্রেমিক কাফেলার জন্য তো দস্তরখান বিছানো ছিল ঘরে ঘরে। ঢাকাবাসী যেন সাধ্যের সবটুকু দিয়ে মেহমানদারি করার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। ছয়. ঘরে ঘরে মা- বোনেরা রোযা রাখলেন, আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলেন। তাদের হৃদয়ের উত্তাপ ও চোখের অশ্রুর পরিমাপ তো শুধু আল্লাহ রাববুল আলামীনই করতে পারেন। সাত. আরো অভাবিত বিষয় এই যে, চরম রাসূল-অবমাননার প্রতিবাদে যে কাফেলার যাত্রা সেই কাফেলার সদস্যদের হাতে ছিল না লগি-বৈঠা কিংবা চাপাতি, রামদা, তাদের হাতে ছিল তসবীহ-জায়নামায, মুখে ছিল আল্লাহর যিকির। আর হৃদয়ে ছিল অদম্য আবেগ আর নিরন্তর দহন। এই দহনই কাফেলাকে দান করল ঐ অপ্রতিরোধ্য গতি, যার মোকাবেলায় সকল প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। আট. এই প্রতিবাদী কাফেলার দ্বারা কোথাও কোনো ভাংচুর হল না, প্রাণহানির ঘটনা ঘটল না; অথচ পথে পথে এই কাফেলার আক্রান্ত হওয়ার খবর সমাবেশ-স্থলে আসছিল। যথাসময়ে শুরু হয়ে যথাসময়ে সমাবেশ শেষ হল। মিডিয়ায় ও ক্ষমতাসীনদের মুখে যারা ‘জঙ্গি’ হিসেবে ব্যাপক প্রচারিত, যে দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীনরাই ‘জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ বলে প্রচার করেছিল বাস্তবে তাদের কাফেলা ও সমাবেশ এতই সুসংহত ও শান্তিপূর্ণ হল যে, বর্তমান সময়ের আলোচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত তাদের ‘ধন্যবাদ’ দিতে বাধ্য হলেন। নয়. পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলয়ে অবস্থানকারী গণবিচ্ছিন্ন কয়েকশ’ শাহবাগী সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হল-‘শাহবাগ শান্ত হবে হেফাযতে ইসলামের রক্ত দ্বারা।’ দশ. সবশেষে মিডিয়ার অবস্থানটাও মনে রাখা দরকার। অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, যারা দিনের পর দিন ‘শাহবাগ চত্বরকে প্রচার করেছে কল্পনা মিশিয়ে তারা শাপলা চত্বরের বাস্তব দৃশ্যটুকু যথাযথভাবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকল। দু’একটি পত্রিকা ছাড়া অন্য দৈনিকগুলোতেও বিভিন্ন কৌশলে কাফেলা-সমাবেশের বিশালতা এবং এর শান্তিপূর্ণ গণজাগরণ-চরিত্র গোপন করার, বরং বিভিন্নভাবে নেতিবাচক ধারণা দেওয়ার প্রচেষ্টা উৎকটভাবেই দেখা গেল। এ কারণে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে এ সকল মিডিয়ার বিবরণ ও উপস্থাপন যে বাস্তব অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না তা-ও আরেকবার প্রমাণিত হল। দু একটি সৎসাহসী পত্রিকা না হলে যে এদেশের আগামী প্রজন্মের জন্য এ গণজাগরণের বাস্তব চরিত্রটি সংরক্ষিতই থাকত না তা যে কোনো সচেতন মানুষই বুঝবেন। বস্ত্তত এই কাফেলা-সমাবেশ ছিল এদেশের গণমানুষের চেতনা-বিশ্বাস এবং আবেগ-অনুভূতির এক সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এই দিক থেকে এই সমাবেশের সাফল্য অনস্বীকার্য। যদিও সমাবেশ পরবর্তী হরতাল সম্পর্কে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কারণ এ ধরনের একটি সফল সমাবেশ অনেক হরতালের চেয়ে বেশি কার্যকর। আর এ মুহূর্তে দাবির সংখ্যার বিষয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দাবিগুলো সম্পূর্ণ শরীয়তসম্মত এবং সংবিধানের সাথেও এর কোনো সংঘর্ষ নেই। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ এক বাস্তবতা যে, গায়ের কাঁচা পথে যখন কোনো গাড়ি দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে তখন পথের কিছু ধুলাবালিও তাকে ধাওয়া করতে চায়। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে পথের ধুলা পথেই পড়ে থাকে, গাড়ি এগিয়ে চলে মনজিল পানে আপন গতিতে। ষ

 

advertisement