জুমাদাল উলা ১৪৩৪   ||   মার্চ ২০১৩

মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্তসারশূন্যতা : বর্তমানে বিশ্বে একশ্রেণীর মানুষ

মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। তারা মনে করে যে, মানুষ যেমন স্বাধীন তেমনি তার চিন্তা ও বুদ্ধিচর্চাও স্বাধীন, মুক্ত ও বাধনহীন। যে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে পারবে ও তার বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারবে। কথাগুলো এভাবে বললেও মূলত তারা কেবল ধর্মীয় দিকনির্দেশনাবিরোধী চিন্তা ও বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটাতে চায়। অন্য বহু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে মুক্তবুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন। কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও সেদিকে যেতে চায় না। এভাবে তারা ধর্মীয় বিষয়ে ধ্বংসাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী চিন্তা ও কর্মের পথে ধাবিত হয়। আর এ জাতীয় ধ্বংসাত্মক কোনো বিষয়ে চিন্তা ও বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটানো, নিজের স্বার্থ ও সিদ্ধান্তের ক্ষতি হয় এমন কোনো বিষয়ে বুদ্ধি ও চিন্তার প্রয়োগ ঘটানোকে কেউই ভালো মনে করে না। এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।

আল্লাহ তাআলা মানুষের কল্যাণের জন্য ধর্ম দিয়েছেন। সবশেষে ইসলাম ধর্মকে মানুষের জন্য চূড়ান্ত করে দিয়েছেন। কেয়ামত অবধি আর কোনো ধর্ম সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারবে না। আর তা আল্লাহর কাছে গৃহীতও হবে না। আল্লাহ বলেন, আর যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা

হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।-আলকুরআন, ৩ : ৮৫

অন্যত্র বলা হয়েছে : নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্ম (ইসলাম)কে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।-আলকুরআন, ২ : ১৩২

এজন্য ইসলাম ধর্ম নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা এবং এর শিক্ষা ও নির্দেশনাকে ব্যাপকভাবে কার্যকর করার উন্নতির জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বুদ্ধি ও বিবেকের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে ঈমানের দাবি এবং আপরিহার্যও বটে। অথচ এদিকটাই আজ উপেক্ষিত। যেখানেই আজ মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কথা বলা হয় সেখানেই মূলত ইসলামী চিন্তা-চেতনা বিসর্জন দিয়ে বিভ্রান্ত চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর মানসিকতার প্রকাশ ঘটানো হয়। এটি কোন যুক্তিতে কাম্য হতে পারে? এ ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আয়াতটি হলো : হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও, আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না।-আলকুরআন, ২ : ২০৮

আয়াতের প্রেক্ষাপট হলো-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা. প্রমুখ প্রথমে ইহুদী আলেম ছিলেন। সে ধর্মমত অনুযায়ী শনিবার ছিল সপ্তাহের পবিত্র দিন আর উটের গোস্ত ছিল হারাম। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর ধারণা হয় যে, হযরত মূসা আ.-এর ধর্মে শনিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে সম্মান করা ওয়াজিব। কিন্তু ইসলাম ধর্মে শনিবারকে অসম্মান করা তো ওয়াজিব নয়। তেমনিভাবে মূসা আ.-এর শরীয়তে উটের গোস্ত খাওয়া হারাম কিন্তু ইসলাম ধর্মে তা খাওয়া ফরজ নয়। কাজেই যদি যথারীতি শনিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় আর উটের গোস্ত হালাল জেনেও তা বর্জন করা হয় তাহলে তো দু’কুলই রক্ষা হয়।

হযরত মূসা আ.-এর শরীয়তের প্রতিও আস্থা থাকে আবার ইসলামের বিরোধিতাও হয় না। আল্লাহ তায়ালা আলোচ্য আয়াতে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে এ ধারণার সংশোধনী উচ্চারণ করেছেন, যার সারমর্ম হলো, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। চিন্তা-চেতনা ও বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে ইসলামের চূড়ান্ত আনুগত্য করতে হবে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত মনে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে হবে। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনা প্রাণপণ দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে দ্বিমুখী চিন্তা-ভাবনার কোনো অবকাশ নেই। বরং একনিষ্ঠ হয়ে ইসলামকে নিয়ে ভাবতে হবে অথবা ইসলামের গন্ডিতে থেকে ইসলামের আলোকে আলোকিত হতে হবে।

আবার এমন বিষয় নিয়েও ভাবা যাবে না যাতে খোদ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে মনের মধ্যে সংশয়ের জন্ম হয়। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণার মাত্রা এভাবে নির্ণয় করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। এমনকি বলা হয়, এসবকে তো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন? যার এমন প্রশ্ন জাগবে, তার বলা উচিত যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি।-বুখারী ও মুসলিম

কাজেই বুঝা গেল যে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ বা চিন্তা-ভাবনার অবকাশ নেই। এটি শয়তানী প্ররোচনা এবং ঈমান বিধ্বংসী অপপ্রয়াস। এমন ধারণা হলেই ঈমানের দিকে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টি ও সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। তাহলে আল্লাহর অপার মহিমা উন্মুক্ত হবে। আল্লাহর প্রতি ঈমানের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। এতে ঈমান আরো মজবুত ও সুদৃঢ় হবে। এমন চিন্তা-গবেষণা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগানো নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক ও কাম্য বিষয়। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এরশাদ করেন : (তরজমা) নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহে। আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি অবতীর্ণ করেছেন, যা দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং  আসমান ও যমীনের মাঝে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য।- সূরা বাকারা (২) : ১৬৪

পক্ষান্তরে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার নামে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়া অথবা ইসলামের নির্দেশনা বহির্ভূত মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রচলন ঘটানো কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। এসবের কোনো অবকাশই ইসলামে নেই।

ড. আবু সালেহ মোহাম্মাদ তোয়াহা

প্রভাষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

advertisement