সফর ১৪৩৪   ||   জানুয়ারি ২০১৩

মি স র : ইসলামী অনুশাসনের প্রতি আস্থা

ওয়ারিস রব্বানী

মিসরের রাজনৈতিক চেহারা ঘন ঘন বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি একের পর এক তাৎক্ষণিক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতির উত্তাপকে শীতল করার কাজটি করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তার সুপারিশে প্রস্ত্তত খসড়া সংবিধান পাশের জন্য গণভোটও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। শেষ ফল পাওয়া পর্যন্ত দু’দফায় অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে খসড়া সংবিধানের পক্ষে। খসড়া সংবিধানটি পশ্চিমা মিডিয়ার দৃষ্টি কেড়েছে এর ভেতরের ইসলামী বিধান ও শরীয়া নীতির কারণে। পশ্চিমা মিডিয়া বার বার বিতর্ক ও বিরুদ্ধতা উস্কে দিলেও খসড়া সংবিধানটি পাস হওয়ায় মিসরে একটি পর্যায় পর্যন্ত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

হোসনি মোবারক ছিলেন সৈরাচারী সামরিক শাসক। দীর্ঘ কয়েক দশক তিনি মিসর শাসন করেছেন। ইসরাঈলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, রাষ্ট্রীয় আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ইসলামী অনুশাসনের বিরুদ্ধতার নীতি তিনি কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন। ইখওয়ানুল মুসলেমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুডসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন-প্রত্যাশী সব দল ও মহলের ওপর ধারাবাহিক দমন-পীড়ন ছিল তার শাসনামলের বড় বৈশিষ্ট্য। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইসরাঈলী নীতির কট্টর সমর্থক হওয়ায় মোবারক একজন সামরিক একনায়ক হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল শক্তিধর পশ্চিমা দেশগুলোর পিঠ চাপড়ানি পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের তীব্র-তপ্ত গণ আন্দোলনে সেই একনায়কের তখতে তাউস বালির বাধের মতো উড়ে যায়। এখন তিনি বন্দী। তার বিচার চলছে মিসরেই।

মোবারক বিদায়ের পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসে ইখওয়ানুল মুসলেমুন। ওই দলের হয়ে ড. মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একনায়ক মোবারকের বিদায়পূর্বে জারি করা নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগের হাতে সংসদ-সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার মতো আস্বাভাবিক কিছু ক্ষমতা চলে আসে। এতে শুরুতে বার বার টানাপড়েন ও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় প্রেসিডেন্ট মুরসির সরকার। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রাম ও গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা মুহাম্মদ মুরসি একের পর এক কৌশলী ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে সেসব চাপ ও ঝুঁকির খুটি উপড়ে ফেলেন।

বিভিন্ন বিভাগ থেকে মোবারক আমলের দাপুটে কর্মকর্তাদের ঘণ্টার হিসাব ধরে একযোগে তিনি বরখাস্ত করেন। নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় অনুকূল একটি ডিক্রিও জারি করেন। তখন তার বিরুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ধর্মনিরেপেক্ষতাবাদী বিরোধী দল ও মোবারক অনুসারী গোষ্ঠীর লোকেরা বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর তিনি স্থিতিশীল সরকার ও ইসলামী অনুশাসন সংবিলত খসড়া সংবিধানের জন্য গণভোট ঘোষণা করেন। খসড়া সংবিধানটি যেন গণভোটে পাস না হতে পারে- সেজন্য মিসরের কপ্টিক খ্রিস্টানদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গঠিত বিরোধীদলের সঙ্গে পশ্চিমা মিডিয়াও জোরালো ভূমিকা রাখে। এক পর্যায়ে ওই বিরুদ্ধতায় যোগ দেয় মিসরের সালাফীপন্থী ইসলামী দলটিও। তাদের বক্তব্য, খসড়া সংবিধানে ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নে মাযহাবের স্বীকৃতি দিয়ে মুরসি অসমর্থনযোগ্য কাজ করেছেন। তাই তারা কপ্টিক খ্রিস্টান, সেক্যুলার গোষ্ঠী ও ইসরাঈলের সঙ্গে মিত্রতাপন্থী বিরোধী দলের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে ইসলামী অনুশাসনের বিধি সংবলিত খসড়া সংবিধানের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচারণায় নামেন। অদ্ভূৎ জেদের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় এক উদ্ভট ঐক্য। কিন্তু উদ্ভট এই ঐক্য গড়েও গণভোটে মুরসিকে ঠেকানো যায়নি। ঠেকানো যায়নি ইসলামী অনুশাসন সংবলিত সংবিধানের খসড়ার অনুমোদন।

কিন্তু মিসরের আকাশে এখনও পশ্চিমের শকুনরা উড়ছে। ইসলাম বিরোধী শক্তি বার বার মুরসির সামনে সংকটের ব্যরিকেড তৈরি করছে। গণভোটের পরও তারা বলছে, এতে মিসরের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না-ও হতে পারে’। পশ্চিমাদের উস্কানি পেয়ে এসব নানা কথা তারা বলতেই পারেন। তবে গণভোট চলাকালে বিবিসি ও রয়টার্স পরিবেশিত একটি পর্যবেক্ষণ এ পর্যায়ে উল্লেখ করা যায়। তারা জানিয়েছে- ‘বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই গণভোট শুধু একটি খসড়া সংবিধান প্রশ্নে গণভোট নয়। এর মাধ্যমে মিসর ইসলামপন্থী, নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে, তার রায় পাওয়া যাবে।

আমরা এবার দেখলাম, গণভোটে ইসলামপন্থী মিসরের পক্ষে গণরায় পাওয়া গেছে। আমরা সামনে দেখতে চাই, এ মিসরের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে বিশ্বব্যাপি গণতন্ত্রের ইজারাদাররা কোনো কসরত ব্যয় করছে না। 

 

 

advertisement