সফর ১৪৩৪   ||   জানুয়ারি ২০১৩

প্র তি বে শী : কসাই এখন খোশহালে

আবু তাশরীফ

আবারও তিনি খবরে। এবার বেশ জাঁকালোভাবে। তৃতীয়বারের মতো জয় পাওয়ায় তাকে নিয়ে মিডিয়ার আলোচনা তুঙ্গে। ২০ ডিসেম্বর গুজরাট বিধানসভায় তার ও তার দলের বিজয় ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তৃতীয়বারের মতো ভারতের ওই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটি তার জন্য বরাদ্দ হলো। হ্যাট্রিক জয়! বিরাট ব্যাপার।

কে এই ভাগ্যবান নেতা? আর কেউ নন, তিনি গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি। ১৭ ডিসেম্বর বিবিসির বয়ান ছিল এরকম -‘শুভ্র কেশের মুখাবয়ব, জাফরান রঙের জামা আর সোনালি ফ্রেমের চশমা পরে আহমেদাবাদের নিশান স্কুলের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।’ আহা! নিপাট ভদ্রলোক। যেন এর চেয়ে কোমল আর নিরীহ কোনো মানুষই হয় না দুনিয়ায়। শুভ্রতা, জাফরান রঙ আর সোনালি  ফ্রেম। কী কেতাদুরস্ত। আর কী তার জেল্লা। অথচ এই ভদ্রলোকটি সম্পর্কে জানে না ভূ-ভারতে এমন কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ থাকার কথা নয়। সরকারি হিসাবে প্রায় তিন হাজার মুসলিম হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এই একুশ শতকে এবং ওই গুজরাটে। দলের পান্ডা লাগিয়ে মুসলমানদের সেখানে পুড়িয়ে মেরেছেন। মুসলিম নারীদের তখন ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়েছে। অসহায় কান্নারত শিশুদের আগুনের লেলিহান শিখায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মোদির নির্দেশে পুলিশের বন্দুক দাঙ্গাবাজ হিন্দু পান্ডাদের পরিবর্তে তাক করা ছিল পালায়নরত মুসলিম নারী-পুরুষদের দিকে। তার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত মামলার ফাইলও গায়েব করা হয়েছে। হ্যাঁ, তিনিই গুজরাটের কসাই। নরেন্দ্র মোদি বললে আধুনিক যুগের নর হত্যাকারী এক সফল কসাইয়ের চেহারা ফুটে ওঠে। মিডিয়ার বর্ণনায় মোদির পরিচিতি এভাবেই উঠে এসেছে। এই কসাইগিরির কারণেই একবার তার ব্রিটেনে যাওয়ার ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার খবরও মিডিয়ায় এসেছে। সেই মোদিরই এখন প্রচন্ড খোশহাল।

না, ভারতে তার কোনো বিচার হয়নি। এমনকি ভারতের ভোটাররাও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়েই তিনি আরও দু’বার নির্বাচিত। তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। এখন তার সামনে প্রধানমন্ত্রিত্বের হাতছানি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল বিজেপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে লড়বার যোগ্যতা এখন তার করতলে। মহাত্মা গান্ধীর ভারতবর্ষের প্রধান কান্ডারি হতে যাচ্ছেন এক মানব হত্যাকারী কসাই। এক নরখাদক মোদি। তা-ও জনতার ভোটে! হায়রে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত! হায়রে ভারতীয় গণতন্ত্র!

 

বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। মোদির ভোট দেওয়ার খবর ঢাকার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন ঢাকায় একটি হরতাল চলছিল। সরকারি আয়োজন ও মেহমানদারির এক বিচিত্র হরতাল। এর প্রধান দাবি ছিল, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। সাম্প্রদায়িক মোদিরা ভারতে মুসলমানদের পুড়িয়ে মারবেন। আর বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক (নিয়মতান্ত্রিক) রাজনীতিও নিষিদ্ধ করতে হবে। এই হরতালের মেযবান ও মেহমানরা সবাই একযোগে  ভারতীয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রতি খুব শদ্ধা প্রকাশ করেন। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে গলা উঁচু করে কথা বলেন। ভারতের নিগৃহীত মুসলিমদের ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘জঙ্গিবাদী’ বলে গাল দিতে পছন্দ করেন। নাক সিঁটকানো ভঙ্গি নিয়ে এ দেশের ইসলামী দলগুলোকেও যখন-তখন উপদেশ খয়রাত করেন। এরা সোজা চোখে কসাইদের দেখেন না। বাঁকা চোখে দেখেন কসাইয়ের হাতে বধ হওয়া প্রাণীদের (?)। মোদির অনুচরেরা এখানে ঢোল-তবলা বাজান প্রগতির, সুর তোলেন আদর্শ ও সমাজবাদের। আর পুলক বোধ করেন মুসলিম বধে, ইসলাম বিরোধিতায়।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র অনেক দাপুটে দুটি শব্দ। শুনলে মনে হয়-না জানি কী আছে এর ভেতরে! কিন্তু পাশের দেশের দিকে চোখ পড়লে এর ভেতরের মাকাল ফলটাই বড় হয়ে ওঠে। না চাইলেও এখন আমাদের মানতে হয়, ভারতের গণতন্ত্র মানে বার বার কসাইদের নির্বাচিত করা। ভোটে ভোটে খুনীদের খুনীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে টেনে আনা। না চাইলেও এখন আমাদের বুঝতে হয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হাজার হাজার মুসলিম সংখ্যালঘুকে পুড়িয়ে মারা। সারা পৃথিবী তোলপাড় করা বীভৎসতার হিন্দুত্ববাদী নায়কের কোনো বিচার না করা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে আসে উদারতার প্রসঙ্গ। সে উদারতার জমাখরচ ভারতীয় মুসলমানদের জন্য কেবল মৌখিক। এর কোনোই সারবত্তা নেই। কালো হরফের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তো আছে। কিন্তু  ভোটারদের বুকের সংবিধান ভরে আছে সাম্প্রদায়িকতার থিকথিকে বিষে। ভারতের ক্ষেত্রে এটাই সত্য। সেখানে কসাইরা খোশহালেই থাকবে। মোদিরা সেখানে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফুলের মালা গলায় দেবে। হয়তো এতে অস্বাভাবিকতার কিছুই নেই। গত ৬৫ বছর ধরে তো-কিছু কম আর কিছু বেশি-এমনটাই দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি এর কিছু রদবদল ঘটে তবে আমাদের চেয়ে কেউ বেশি খুশি হবে না। 

 

 

advertisement