মুহাররম-১৪৩৪   ||   ডিসেম্বর-২০১২

প্রফেসর হযরতের সাথে আমেরিকা সফর-৩

মুহাম্মাদ আদম আলী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

নিউইয়র্কে এপ্রিল-মে মাসে এশার নামায হয় রাত সাড়ে টায়। দূরে কোথাও প্রোগ্রাম থাকলে খাবার খেয়ে আমাদের ফিরতে এমনিতেই রাত বারটা-একটা বেজে যেতো। প্রায় রাতেই একটা-দুটায় ঘুমুতে গেছি। কিন্তু হযরতের রুটিন ছিল দেখার মত। তিনি ঠিকই রাতের শেষ প্রহরে এমন সময় উঠে যেতেন, যখন ওঠেন আল্লাহর প্রিয় বান্দারা। একদিন আমার ভাই হযরতকে বললেন, ‘‘হযরত, ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে দেই - টায় উঠবেন?’’ হযরত বললেন, ‘‘তার তো দরকার নেই। আমার আলীই তো আমাকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেয়। সে হচ্ছে লাইভ এলার্ম।’’ কথায় আমি খুশি হলাম ঠিকই। কিন্তু হযরতের জন্য লাইভ এলার্ম জরুরি কিছু না। সারা বছর হযরতের একই রুটিন। সে রুটিনে কয়েকদিনের বিচ্ছিন্ন খেদমতের ভুমিকা খুবই নগন্য। তবে এই সফরে ভোর রাতে আমার জেগে উঠা স্পষ্টতই হযরতের কারামত। রাত দুটায় শুয়ে দেড় ঘন্টা পরে ঘুম থেকে উঠে এত ফ্রেশ কখনো বোধ করিনি। পুরো সফরে আমি দুরাত হযরতকে সময়মত ডাকতে পারিনি। সেই রাত দুটোর একটা মিশিগানে, অন্যটা অস্টিনে। সে গল্প একটু পরেই বলছি।

দারুল উলুম নিউইয়র্ক

মে ২০১২। অনেকগুলো প্রোগ্রাম আজ। হযরতের ভাই কর্ণেল সাহেব চলে যাবেন। তিনি নিউইয়র্কের লাগোয়ার্দা এয়ারপোর্ট (LaGuardia airport) থেকে ফ্লাইট ধরবেন। আমরা সকাল এগারটার দিকে তাকে নিয়ে সেখানে গেলাম।

এয়ারপোর্ট থেকে আমরা আব্দুল ওহাব সাহেবের বাসায় গেলাম। তার বাসা কুইনস শহরে। সেখানে নাস্তার দাওয়াত ছিল। আমরা পৌঁছলাম পৌনে বারটায়। তিনিও সুযোগ বুঝে নাস্তা-লাঞ্চের ব্যবস্থা করলেন। আব্দুল ওহাব সাহেব হযরতের সাথে পরিচিত হয়েছেন বেশি দিন হয়নি। সুন্নাত তরীকায় বিবাহ সমিতির মাধ্যমে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিছু দিন আগে। এই সমিতিটা হযরত প্রায় বিশ বছর যাবত পরিচালনা করছেন। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজে সুন্নাত তরীকায় বিবাহের ব্যাপক প্রচার-প্রসার করা। মুসলমানরা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আমলে খুব অবহেলা করে। বর্তমানে সুন্নাত তরীকায় বিবাহ হয় না বললেই চলে। ছবি তোলা নেই। ভিডিও নেই। গানবাদ্য নেই। মসজিদে বিয়ে। আজকাল কেউ আর এটা এভাবে করতে চায় না। যারা চায়, তারাও সামাজিকতার জন্য করতে পারে না। বিভিন্ন হিন্দুয়ানী কালচারে মুসলমানরা ইতিমধ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, হযরতের প্রচেষ্টায় অনেক পরিবারে সুন্নাত তরিকায় বিবাহ হচ্ছে। মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

শুরুর দিকে সমিতির কার্যক্রম এত ব্যাপক ছিল না। ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে আমি দেখছি। হযরত প্রতি সপ্তাহে একটা মিটিং করতেন। নিমতলীতে। সেখানে হযরতের একটা মাদরাসা আছে। মাদরাসার একটা রুমে এই মিটিং হত। বায়োডাটার কয়েকটা ফাইল ছিল। তাতে বায়োডাটা বেশি ছিল না। ব্যক্তিগত পরিচয়ে অনেকে আসতেন। কিছু কথা-বার্তা বলতেন। অনেক সময় কোন এজেন্ডাও থাকতো না। হযরত কাউকে দিয়ে একটু কুরআন তিলাওয়াত করে দু করে দিতেন। বিবাহ সমিতির একটা রেজিস্টার আছে। সেখানে সবাই   দস্তখত করে মজলিস শেষ করতেন। কাজ কতটুকু হল কিছু বোঝা যেত না। এখন বোঝা যাচ্ছে। কাজ খুব বেড়ে যাওয়ায় একটা অফিস খোলা হয়েছে। একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি সপ্তাহে তিন দিন সেখানে নিয়মিত বসেন। বায়োডাটার ফাইলের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এটা সম্পূর্ণভাবে  নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন। কত মানুষ যে এর উসিলায় দ্বীনের পথে আসছে! আল্লাহ তাআলা হযরতের কাজকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত বহাল রাখেন। আমরা খাওয়া শেষ করে নিউইয়র্কের একটা মাদরাসার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।

নিউইয়র্কে দেওবন্দের কারিকুলামে সম্ভবত একটাই কওমী মাদরাসা আছে। মাদরাসার নাম দারুল উলুম নিউইয়র্ক। এটি জ্যামাইকাতে অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পর্যন্ত পঞ্চাশ জন ছাত্র হাফেজ হয়েছে। এখানে মেশকাত এবং দাওরা হাদীসের দরস এখনো চালু হয়নি।

সিনিয়র ছাত্ররা পরিপূর্ণ আলেম হওয়ার জন্য কেউ কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমায় অথবা এশিয়ার কোন দেশে আসে। এভাবে মাদরাসার সাত জন ছাত্র ইতিমধ্যে পরিপূর্ণ আলেম হয়েছে। বর্তমানে তারা আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত আছে। এখন প্রায় দেড় শত ছাত্র হিফ্জ কিতাব বিভাগে পড়ালেখা করছে। হযরত এসব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আসরের নামাযের পরে বয়ান করেন ইংরেজীতে। মাদরাসায় অনেক বাঙ্গালী ছাত্র আছে। তবে তারা সবাই আমেরিকান বাঙ্গালী। পরিবেশে তারা যে আল্লাহর কালাম শিখছে, এটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। এখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম মাওলানা তোফাজ্জল হক সাহেবের সাথে দেখা হল। তিনি আমেরিকায় হযরতের মতই দ্বীনি প্রোগ্রাম করতে এসেছিলেন। কিন্তু গাড়িতে উঠার সময় পায়ে ব্যথা পেয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। হযরত তার সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময় কাটান।

লং বিচ (Long Beach)

ইল্যান্ড শহর থেকে খুব কাছেই সী বিচ। আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে এই বিচের নাম লং বিচ। বিশ মিনিটের ড্রাইভ। এখন অফ সিজন। আমাদের মত লোকদের জন্য এখনই সবচেয়ে ভাল সময়। লোকসমাগম কম। আমাদেরকে সেই বিচ ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলেন মাওলানা আহমাদুল্লাহ ভাই।  আমি তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে আমার কখনো খারাপ লাগে না।

হযরত যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরী হয়েছেন। বাইরে অনেক শীত। এজন্য হাত-পায়ে মোজা পরেছেন। . মুজিব স্যারের হাদিয়া হিসেবে দেয়া ওভার কোট গায়ে দিয়েছেন। আমেরিকার বিখ্যাত লন্ডন ফগ (London Fog) কোম্পানির ওভার কোট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে একজন দেখা করতে আসবেন বলে তিনি আর যেতে পারেননি। সমুদ্রের কাছাকাছি সবকিছু এমনিতেই সুন্দর। সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে আমেরিকানরা সব ধরনের আয়োজন করে রেখেছে। রাস্তার পাশে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সেখানে হরিণের দেখা পেলাম। নির্ভয়ে ঘাস খাচ্ছে। শিকার করা নিষেধ। আইনের প্রয়োগ এত বেশি যে, জরিমানার ভয়ে এখানে কেউ শিকারের কথা চিন্তাও করে না।

আটলান্টিক মহাসাগর। বিস্তীর্ণ সৈকত খালি পড়ে আছে। মানুষজন একদম নেই। সাগর পাড়ে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। বাইরে বেশি হাঁটা যাচ্ছিল না। আমরা কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। কয়েকজন বুড়ো মানুষ একটা টেবিল দখল করে আছে। প্রায় সবারই শরীরের চামড়ায় ভাঁজ। একজনের মাথায় একটা হ্যাট কাত হয়ে ঝুলছে। টেবিলে ড্রিংকস আর চিপ্স পড়ে আছে। খাওয়ার চেয়ে গল্প হচ্ছে বেশি। একটু পর পর অট্টহাসির শব্দ। এখানকার বুড়োদের দেখলে মায়া হয়। বয়সে ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে কোনো সেবা পাওয়ার কল্পনাও তারা করে না। যাদের পায়ে হাঁটতে কষ্ট, তাদের হুইল চেয়ারেই বাইরে বেরুতে হয়। বুড়ি বেঁচে থাকলে হয়তো সে- বুড়োর হুইল চেয়ার টানবে। আর না হলে একা একাই চলতে হবে। ইলেকট্রিক হুইল চেয়ার। একা চলতে অসুবিধে নেই। নিউইয়র্কের রাস্তায় কত বুড়োকে যে কষ্ট করে কুঁজো হয়ে হাঁটতে দেখেছি! সঙ্গে কেউ নেই। বয়স এমনই। সব বোধকে ছাপিয়ে আপনাকে আবার নির্বোধ-অকেজো করে ছাড়বে। আল্লাহর বিধান সত্য। আমরা সেটা বুঝেও বুঝি না।

বাইতুল হাম্দ মাদরাসা

মুফতী জামাল উদ্দিন। বাংলাদেশের হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ফারেগ। প্রায় সতেরো বছর শিক্ষকতা করেছেন ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদরাসায়। আমেরিকায় এসেছেন অনেকদিন। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে একটা মহিলা মাদরাসা গড়ে তুলেছেন। বাইতুল হাম্দ মাদরাসা। মুফতী সাহেব হযরতের পরিচিত। হযরত এদেশে আসার পরেই দেখা করেছেন। প্রায় সব মাহফিলে গিয়েছেন। তার মাদরাসায় প্রোগ্রাম আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

মে ২০১২।  আমরা তার মাদরাসায় যোহর পড়েছি। নামাযের পর সেখানে ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে হযরত বয়ান করেছেন। মাওলানা আব্দুল্লাহ কামাল সাহেব নিউইয়র্কের পরিচিত সব উলামাদের সেদিন মাদরাসায়ই একসঙ্গে করেছিলেন। হযরত তাদের উদ্দেশ্যেও বয়ান করেছেন। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। এক পর্যায় হযরত বলেন যে, মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব (দামাত বারাকাতুহুম) বসুন্ধরায় ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক। মাওলানা আবরারুল হক সাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর খলীফা। তিনি ২০০৪ সালে হরদুই সফর করেন। তার কিছুদিন পরেই মাওলানা আবরারুল হক সাহেব ইন্তেকাল করেন। সে সফরে মাওলানা আবরারুল হক সাহেব তাকে বলেছেন, ‘‘আলেমদের এসলাহী সম্পর্কের ব্যাপারে জোর দাও।’’ আর মাদরাসায় মুদাররিস রাখার ব্যাপারে পরিস্কার বলেছেন যে, ‘‘যার এসলাহী সম্পর্ক নেই, তাকে মুদাররিস হিসেবে নিও না।’’ এটা খুব শক্ত কথা। বর্তমানে আলেমরা নিজেকে এসলাহের জন্য মুখাপেক্ষি মনে করে না। এখন ‘‘কুনু মাআসসাদিকিন’’ কি শুধু সাধারণ লোকের জন্য, নাকি আলেমদের জন্যও প্রযোজ্য? ব্যাপারে খুব তাগিদ দেয়া দরকার।

হযরত বুয়েটে মক্তব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর ভূমিকার কথা বলেন। তারপর বলেন যে, সমাজে সহীহ তালিমের ব্যবস্থা করা আলেমদের দায়িত্ব।

আপনাদেরকে নসিহত করার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। বয়সে আমি আপনাদের চেয়ে বড়। আপনারা এলেমে বড়। আমি আপনাদের পূর্বপুরুষদের কয়েকজনকে দেখেছি। তাদের কিছু কথা আপনাদের সামনে কেবল নকল করছি। এখানে একটা দশ বছরের ছেলেকে যদি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়, আর যদি সে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) অথবা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর কথা পড়ে শুনায়, তার দ্বারা কি অনেক সংশোধনী হতে পারে না? পারে। সে বয়সে কমজোর বাচ্চা। আর আমার বেলায় হল, এলেমে কমজোর মানুষ। আমি কেবল মনে করিয়ে দেয়ার জন্য কয়েকটা কথা বললাম।

বয়ানের শেষ দিকে বলেন যে, আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে কবুল করেন। আপনারা এদেশে ইসলামের ঝান্ডাকে বহন করছেন। আমার তো দেখে খুব খুশি লাগছে। এরকম পরিবেশ পাব, আমি ভাবিনি। আমি আবার বলি, আমি তো আপনাদের গোলাম। আনপাদের গোলাম হওয়াকে আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি। আমার কথায় কষ্ট নিবেন না। আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে রাসূলের খাঁটি নায়েব হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য দেন। আমীন।

মাহফিলে অনেক আলেম বাংলাদেশে থাকতে দাওয়াতুল হকের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা আমেরিকায় দাওয়াতুল হকের কাজ চালু করার জন্য হযরতের সাথে আলোচনা করেন। সাংগঠনিক প্রচেষ্টার কথা অনেকেই বললেন। সেটা হয়ে ওঠেনি এখনো। মুফতী জামাল উদ্দিন সাহেবের আগ্রহ অনেক। হযরত সবাইকে নিজ নিজ এলাকায় একাই কাজ শুরু করার পরামর্শ দিলেন।

ম্যানহ্যাটন সিটি

নিউইয়র্কে শেষ দিন। আসরের নামাযের আগেই বাইতুল হাম্দ মাদরাসায় প্রোগ্রাম শেষ হল। ম্যানহ্যাটন সিটি এখনো দেখা হয়নি। আজ দেখা হতে পারে। একটা সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টার, ব্রুকলিন- বাদ মাগরিব প্রোগ্রাম। সেখান থেকে ফেরার পথে ম্যানহ্যাটন সিটি হয়ে আসা যায়। হযরত অনুমতি দিলে সেটা সম্ভব। মঈন ভাইকে বলা আছে। আমি আশায় থাকলাম।

আমরা নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টারে পৌঁছলাম। এখানকার মসজিদের ইমাম বিখ্যাত ক্বারী রুহুল্লাহ সাহেব। চট্টগ্রামের মানুষ। অনেকদিন হল নিউইয়র্কে আছেন। হযরতের বয়ানের পর এশার নামাযে তার ক্বিরাত শুনলাম। কি অদ্ভূত আওয়ায আর মিষ্টি পড়া! এমন ক্বারীর পেছনে কেবল নামায পড়ার জন্য নিউইয়র্কে থেকে যাওয়া যায়। বাংলাদেশে আমাদের ইমাম সাহেবদের পড়াও সুন্দর। তবে অনেক সময় নিজ এলাকায় ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। ব্রুকলিন এলাকার মুসলমানদের অনেক ভাগ্যবান মনে হল।

আমরা ফিরতি পথে রওনা হলাম। মঈন ভাই আমার কথা মনে রাখলেন। তিনি হযরতকে বললেন যে, আমরা চাইলে এখন ফেরার পথে শহরটা দেখে যেতে পারি। হযরত বললেন, ‘‘আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি তোমাদের সাথে থাকব।’’ হাডসন নদীর উপর ব্রিজ পার হয়ে আমরা ম্যানহ্যাটন সিটিতে ঢুকলাম।

টাইম স্কোয়ার। এটা দেখতেই সবার আগ্রহ বেশি। আমরা সেখানে গেলাম। বিশেষ দিনগুলোতে এখানে জায়গা পাওয়া যায় না। ইংরেজী নববর্ষের রাতে মানুষের ঢল নামে। আজ তেমন মানুষজন নেই। রাতের লাইটগুলো রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। কিছু বিলবোর্ডে নিয়ন বাতি জ্বলছে। পুরো শহরে আভিজাত্য আর অহংকারের একটা ঝলমলানি ভাব। উঁচু উঁচু ভবন আর বিভিন্ন রং-এর ফ্লাসিং লাইট চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। হযরতের চোখই বন্ধ। তিনি কিছুই দেখছেন না। আমরাও তাকে ডাকিনি। টাইম স্কোয়ার থেকে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জায়গাটা দেখতে গেলাম। সেখানে এখন পুরোদমে নির্মাণ কাজ চলছে। রাস্তায় পুলিশের ব্যারিক্যাড। খুব কাছাকাছি যেতে পারিনি। একটু দূর থেকেই জায়গাটা দেখতে হল।

বাফেলো নায়াগ্রা

বাফেলো নিউইয়র্ক স্টেটের একটি শহর। ১৮২৫ সালের দিকে ইরি ক্যানেল (Erie Canal) নামে একটি নদীপথ চালু হওয়ার পর থেকেই শহরে জনবসতি বাড়তে থাকে। ১৯০০ সালের মধ্যে বাফেলো আমেরিকার অষ্টম বৃহৎ শহরে পরিণত হয়। সে সময় এটা আমেরকিার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন হিসেবে ব্যবহৃত হত। তাছাড়া বাফেলো সর্ববৃহৎ শষ্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র ছিল। কিন্তু গ্রেট লেক থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে যাওয়ার নতুন একটি সমুদ্র পথ (St. Lawrence Seaway)  চালু হওয়ার পর থেকে জাহাজ চলাচলের রুটে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। কারণে বাফেলো বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তখন এখানে ব্যবসায় ধস নামে। স্টিলমিলসহ অন্যান্য হেভী ইন্ডাস্ট্রিগুলো সব বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের দিকে এসে এখানে বসতি অনেক কমে যায়। কাজকর্মের অভাবে মানুষ পরিবারসহ অন্য শহরে জীবিকার সন্ধানে চলে যেতে থাকে। এখন বিরান হতে হতে পুরো শহর বিক্রি করে দেয়ার মত অবস্থা হয়েছে। আমরা যে শহরে গিয়ে পৌঁছলাম, সেখানেও একই অবস্থা। উল্য এভিনিউ (Woltz Avenue)-এর আবাসিক এলাকাটা পুরোপুরি নীরব-নিস্তব্ধ। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। বাংলাদেশে থাকতে পত্রিকায় এধরনের একটা খবর পড়েছিলাম যে, আমেরিকায় একটা শহর কিনে ফেলেছে এক বাঙ্গালী। অবিশ্বাস্য খবরটি বাফেলোর শহরকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। বাড়ি কিনতে পারে, শহর কিনে ফেলে কিভাবে! এখানে প্রায় বাড়িই শূন্য পড়ে আছে। দেয়ালের আস্তর খসে পড়ছে। কোথাও কোথাও ভাঙ্গা দরজা দিয়ে ভেতরের অন্ধকার চোখে পড়ে। সিটি কর্পোরেশন অথবা ব্যাংকের লোকেরা এসে বাড়ি সীল করে গেছে। মানুষ নেই। এই সুযোগে মুসলমানরা কম দামে অনেক বাড়ি কিনে ফেলছে। কিছু মেক্সিকান এখনো রয়ে গেছে। তাদের ভয়ে রাতে হাঁটা মুস্কিল। তবে দিনের বেলায় শহর পুরোপুরি মুসলমানদের দখলে। মহিলারা চেহারা ঢেকে বোরকা পরে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য আমেরকিায় কমই দেখা যায়।

মে ২০১২। আমরা নিউইয়র্ক থেকে রওনা হয়েছিলাম ফজরের পরেই। মঈন ভাইয়ের গাড়ি। তিনি আমাদেরকে নিয়ে বাফেলো পর্যন্ত যাবেন। পথে মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব উঠলেন। তিনিও হযরতের সাথে যাবেন। তারা পালা করে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমরা প্রায় চারশ মাইল ড্রাইভ করে বাফেলোর সদরুজ জামান সাহেবের বাসায় যখন পৌঁছলাম, তখন দুপুর। তার বাসাটা উল্য এভিনিউর বাফেলো মারকায মসজিদের খুব কাছেই। যোহরের নামায সে মসজিদেই পড়লাম। সদরুজ জামান সাহেব তার বাসায় আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। খুব আন্তরিকতা ছিল তার মেহমানদারিতে। আল্লাহ তাআলা তার মেহমানদারীকে কবুল করুন। 

হযরতের কাছে বাইআত

বিকেলে আমাদের কোন প্রোগ্রাম ছিল না। বাফেলোর মারকায মসজিদে আসরের নামায পড়বো। মঈন ভাই হযরতের সোহবতে মাত্র সাত দিন ছিলেন। দিন-রাত হযরতের খেদমত করেছেন। আজ শেষ দিন। একটু পরেই তিনি নিউইয়র্ক ফিরে যাবেন। যাওয়ার আগে হযরতের কাছে বাইআত হবেন। এটা আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা পথ দেখান। খাঁটি আল্লাহওয়ালা মিলিয়ে দেন।

এক কঠিন সময় পার করছি আমরা। ভন্ড পীর আর ফকিরেরা সমাজে দাপটের সাথে টিকে আছে। সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষ এখন সঠিক দ্বীন থেকে দূরে। তাদের মধ্যে আখিরাতের চিন্তা কম। তারা কেবলই ধনী হতে চায়। আর প্রতারকরা তাদের সে স্বপ্নকে বাড়িয়ে দেয়। মাটির নিচের গুপ্ত ধনের খবর দেয়। এদের উপর নাকি নামাযই ফরয হয় না। নাউযুবিল্লাহ। এই ভন্ডদের খবর পড়তে পড়তে মানুষ বিভ্রান্ত। সত্যিকার আল্লাহওয়ালাদের কাছেও যায় না। ভেজাল বলে আসলকেও ছেড়ে দেয়। আসল আল্লাহওয়ালা খোঁজার চেষ্টা নেই। আরেক দল পরহেযগার। নামাযী। তারা নিজেরা নিজেদের বুঝমতো দ্বীনের উপর চলেন। অন্য কারো সাথে আত্মশুদ্ধির জন্য সম্পর্ক করতে চান না। এটার কোন দরকার আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন না। অথচ কুরআনে আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণের হুকুম রয়েছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

advertisement