ফযীলতপূর্ণ দিবস-রজনী : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
একটি মসজিদে ‘ইসলামী পবিত্র দিনসমূহ’ শিরোনামে একটি তালিকা নজরে পড়ল। তাতে কিছু আছে ইসলামে স্বীকৃত মহিমান্বিত দিবস-রজনী, আবার কিছু আছে আবিষ্কৃত রসম-রেওয়াজ এবং ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে না জানার ভুল। সমাজের বিভিন্ন মহলে এসব দিবস-রজনী বিশেষভাবে পালিত হতেও দেখা যায়। কোনো কোনো দিবস এমন আছে, যেগুলোতে সরকারী ছুটি থাকে অথচ ইসলামে সে সকল দিবস স্বীকৃত নয়। আর এসব দিবস-রজনী বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকায়ও দেখা যায়। তাই তালিকাটির উপর একটি পর্যালোচনা সংগত মনে হল। এ পর্যালোচনায় তালিকার ভুলগুলোও যেমন উল্লেখ করা হয়েছে তেমনি ইসলামে স্বীকৃত দিবস-রজনী বিষয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কথাও আলোচনা করা হয়েছে। যাতে স্বীকৃত বিষয়েও কেউ ভুলের শিকার না হন। প্রথমে তালিকাটি উল্লেখ করছি।
ইসলামী পবিত্র দিনসমূহ
(যেমনটা ঐ তালিকায় দেওয়া হয়েছে)
১. ১ লা মুহাররম : হিজরী নববর্ষ
২. ৯ ই মুহাররম : আশুরার রোযা
৩. ১০ ই মুহাররম : আশুরা
৪. সফরের শেষ বুধবার : আখেরী চাহার শোম্বাহ
৫. ১২ই রবিউল আউয়াল : নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম ও ওফাত দিবস
৬. রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার : লায়লাতুর রাগায়েব
৭. ১৫ই রজব : শবে এস্তেফতাহ
৮. ২৭ শে রজব : লাইলাতুল মিরাজ
৯. ১৫ই শাবান : লাইলাতুল বরাত
১০. ২১, ২৩, ২৫,২৭ ও ২৯ শে রমযান : লাইলাতুল কদর
১১. ১লা শাওয়াল : ঈদ-উল-ফিত্র
১২. ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্ব : আইয়ামে তাশরীক
১৩. ৯ই যিলহজ্ব : ইয়াওমুল আরাফা হজ্ব দিবস
১৪. ১০ই যিলহজ্ব : ঈদ-উল-আযহা
১৫. প্রতি মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখ : আইয়ামে বীজ (রোযা রাখা সুন্নত)
এই তালিকার শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘ইসলামী ফযীলতপূর্ণ দিবস-রজনী’। কারণ প্রতিটি দিনই পবিত্র, কোনো দিনই অপবিত্র বা অশুভ নয়। হাঁ, দিনসমূহের মধ্যে ঐ দিনগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ, কুরআন হাদীসে যেগুলোর বিশেষ ফযীলত উল্লেখিত হয়েছে। সুতরাং পবিত্র না বলে ফযীলতপূর্ণ বলা উচিত। নিচে এই তালিকার উপর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পেশ করা হল ।
১. ১ লা মুহাররম : হিজরী নববর্ষ
প্রথম কথা হল, ১লা মুহাররম হিজরী বর্ষের প্রথম দিন। কিন্তু এটা ‘ইসলামী পবিত্র দিনসমূহ’ বা ‘ইসলামী ফযীলতপূর্ণ দিবস-রজনী’ শিরোনামে আসবে কিনা সেটা ভাববার বিষয়। ইসলামী ফযীলতপূর্ণ দিবস হতে হলে কুরআন-সুন্নাহয় তার আলাদা ফযীলত উল্লেখ থাকতে হবে। এছাড়া এখানে হিজরী নববর্ষ শব্দ থেকে কেউ বুঝতে পারে যে, অন্যান্য জাতি যেমন নববর্ষ উদযাপন করে, হিজরী নববর্ষও মুসলমানদের জন্য সে রকম উদযাপনের দিবস। অথচ ইসলামে নববর্ষ, বর্ষপূর্তি কিংবা জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার কোনো বিধান নেই। তবে চান্দ্রমাস ও বছরের সাথে যেহেতু রোযা, হজ্ব, ঈদুল ফিত্র, ঈদুল আযহা ও যাকাতসহ বহু ইবাদাত ও শরয়ী বিধিবিধান সম্পৃক্ত এ জন্য এর হেফাযত ও চর্চা রাখা ফরযে কেফায়া। এবং এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ হ্রাস বা বিলুপ্তিরই নামান্তর।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দাদা তাঁর পিতাকে পারস্যের নওরোযের দিন (নববর্ষের দিন) আলী রা.-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন। (হাদিয়াটি ছিল নওরোয উপলক্ষে ফলে) আলী রা. বললেন, ‘‘নওরোযুনা কুল্লা ইয়াওম’’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। (আখবারু আবি হানিফা,সয়মারী) অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নব উদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে।
২-৩. ৯ ই মুহাররম : আশুরার রোযা, ১০ ই মুহাররম : আশুরা
এই উপস্থাপন থেকে মনে হয় যে, ৯ই মুহাররম আশুরার রোজা আর ১০ই
মুহাররম শুধুই আশুরা;এই দিনে রোজার কোনো বিষয় নেই। আসলে আশুরার রোযা তো মূলত ১০ই মুহাররমের রোযা। কারণ সেদিনই হল আশুরা। তবে ইহুদীদের সাদৃশ্য থেকে বাঁচার জন্য হাদীসে আশুরার দিনসহ তার আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে দুইটি রোজা রাখার কথা এসেছে। (দ্র. সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯; মুসনাদে আহমাদ ১/২৪১)
উল্লেখ্য, ১০ ই মুহাররমের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথা বলে থাকেন। যেমন, এ দিনে হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। অনেকে বলে, এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। -আল আসারুল মারফুআ, আবদুল হাই লখনবী ৬৪-১০০; মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭
এ দিনের একটি সহীহ ঘটনা হল, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতে বনী ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১
আর এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রা.। বলাবাহুল্য, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয় । কিন্তু একে কেন্দ্র করে তাজিয়া, শোকর্যালি, শোকগাঁথা পাঠ, বুক চাপড়ানো, হায় হোসেন হায় হোসেন করা -এগুলো সবই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত হোসাইন রা. ও আহলে বাইতের আদর্শের পরিপন্থী।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩; সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হা.৪৩৬১
৪. সফরের শেষ বুধবার : আখেরী চাহার শোম্বাহ
বহু মানুষ সফর মাসের শেষ
বুধবারকে একটি বিশেষ দিবস গণ্য করে এবং এতে বিশেষ আমল আছে বলে মনে করে। ‘মকসুদুল মোমিনীন’ ও ‘বার চান্দের ফযীলত’ এবং এ জাতীয় যেসব অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তাতে এই বিষয়টি রয়েছে।
(মকছুদুল মুমিনীন, বার চান্দের ফযীলত জাতীয় অনির্ভরযোগ্য বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী) সফর মাসের শেষ
বুধবারকে আখেরী চাহার শোম্বাহ বলে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ দিকে একবার এক ইহুদীর যাদুর কারণে ভীষণ অসুস্থ হন এবং এই দিনে একটু সুস্থতা বোধ করেন এবং গোসল করেন ও মসজিদে জামাতে শরিক হন। খুশি হয়ে হযরত ওসমান রা. তাঁর নিজ খামারের ৭০টি উট জবাই করে গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। খুশিতে আত্মহারা সাহাবীগণ আনন্দ প্রকাশ ও শুকরিয়া আদায় করেছিলেন রোযা রেখে, নফল নামায পড়ে এবং হামদ-নাত গেয়ে। সুতরাং এটা মুসলমানদের খুশির দিন এবং তা উদযাপনের একটি দিবস।
এ ছাড়াও এ জাতীয় বইগুলোতে এ দিনের বিভিন্ন করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন যেমনটি ভিত্তিহীন উপরোক্ত বিবরণ। কারণ-
১. হাদীস বিশারদ ও ইতিহাসবিদ কারো মতেই সুস্থতার তারিখ সফরের আখেরী চাহার শোম্বা ছিল না। (দ্র. ফাতহুল বারী ১০/২৩৭ : আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ২/১৫৪; শরহুয যুরকানী ৯/৪৪৬-৪৪৭)
২. জাদুর ঘটনা হাদীস ও সীরাত-গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু কোথাও জামাতে শরীক হতে না পারা ও জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর গোসলের কথা নেই।
৩. রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়েছে সোমবারে। এর চার-পাঁচদিন পূর্বে তাঁর সুস্থতার জন্য যে সাত কুঁয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তার দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাছীর একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (দ্র. ফাতহুল বারী ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী ৪৪৪২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪/১৯৩; সীরাতুন নবী, শিবলী নুমানী ২/১১৩)
৪. যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কীভাবে হচ্ছে? রসমের পৃষ্ঠপোষকতাকারীগণ সকলে ইন্তেকালের তারিখ বারো রবিউল আওয়াল বলে থাকেন। সোমবার যদি বারো রবিউল আওয়াল হয়ে থাকে তাহলে এর পূর্বের বুধবার তো সফর নয়, রবিউল আওয়ালেই হচ্ছে।
৫. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অনেক মুসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও অহুদে আহত হয়েছেন, আল্লাহ তাকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এই সব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে কি দিবস উদ্যাপনের কোনো নিয়ম আছে? তাহলে আখেরী চাহার শোম্বাহ, যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?
আলকাউসার মার্চ ২০০৮ সংখ্যায় ‘প্রচলিত ভুল’ পাতায় ‘আখেরী চাহার শোম্বাহ কি উদযাপনের দিবস’ শিরোনামে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
৫. ১২ই রবিউল আউয়াল : নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম ও ওফাত দিবস
ইতিহাস ও সিরাতের কিতাবের উপর যাদের নযর আছে তারা জানেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ওফাতের তারিখ কোনোটিই নিশ্চিতভাবে ১২ রবিউল আওয়াল বলা ঠিক নয়। অনেক গবেষকই জন্মতারিখ ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার ও ওফাতের তারিখ ২ রবিউল আউয়াল সোমবার-কে তারজীহ দিয়েছেন (সবচেয়ে সহীহ বলেছেন)। (দ্র. ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার আসকালানী খ. ৮ পৃ.৭৬৩ কিতাবুল মাগাযী,বাব ৮৩; রাহমাতাল লিল আলামীন, কাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান সালমান মানসুরপুরী খ.১ পৃ.৩৫; আসাহহুস সিয়ার পৃ.৫৫০-৫৫২; মাকালাতুল কাউছারী পৃ. ৩৬২-৩৭০;আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খ. ৪ পৃ. ২২৭-২৩০
সে যাই হোক ইসলামে জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করার কোনো অনুমতি নেই। কোনো সাহাবী, তাবেয়ী, ইমাম, উলামায়ে উম্মাহ কেউ এমনটি করেন নি; বরং করাকে বিদআত বলেছেন। সুতরাং তা পরিত্যাজ্য। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার রসম-রেওয়াজ ও বিদআত থেকে হেফাজত করুন। এগুলোর পিছনে না পড়ে পুরোপুরি সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন।
৬. রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার : লায়লাতুর রাগায়েব
এটা একটা আবিস্কৃত রজনী। শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে প্রথম কথা হল, এখানে বৃহস্পতিবারকে লাইলাতুর রাগায়েব বলা হয়েছে। অথচ ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত। ফলে একটি ভুল বিষয় বলতে গিয়ে আরেকটি ভুল করেছেন। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত-এর স্থলে সরাসরি বৃহস্পতিবার বলে দিয়েছেন। আর যে ভিত্তিহীন বর্ণনার আলোকে তা আবিষ্কার করা হয়েছে তা এই-
১. যারা রজব মাসে রোযা রাখে তাদের গুনামাফীর জন্য ফেরেশতাকুল রজবের প্রথম জুমআর রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুআয় মগ্ন থাকেন।
২. যে ব্যক্তি রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার রোযা রাখে অতপর মাগরিব ও ইশার মাঝখানে দু’ রাকাত করে (বিশেষ পদ্ধতিতে) বার রাকাত নামায আদায় করে তার সকল প্রয়োজন পূরণ করা হয় এবং তার সকল গোনাহ মাফ করা হয়, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা, বালুকণা, পাহাড়ের ওজন এবং বৃক্ষের পাতার সমপরিমাণ হয়। আর কিয়ামতের দিন সে তার পরিবারের সাতশ গোনাহগার জাহান্নামের উপযোগী মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।
এ দুই বানোয়াট রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে প্রয়োজন পূরণের কথিত এ রাতের নাম রাখা হয়েছে ‘লাইলাতুর রাগায়েব’ আর বিশেষ পদ্ধতির নামাযের নাম রাখা হয়েছে ‘সালাতুর রাগায়েব’।
ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেছেন, সালাতুর রাগায়েব ও এর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীস বানোয়াট ও মিথ্যা। আবু ইসমাইল আনসারী, আবু বকর সামআনী, আবুল ফযল ইবনে নাসির, ইবনুল জাওযী সকলেই এ সংক্রান্ত রেওয়ায়াতকে ভিত্তিহীন বলেছেন।-লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃ. ১৭১; মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ,পৃ. ১৮০
৭. ১৫ই রজব : শবে এস্তেফতাহ
‘শবে এস্তেফতাহ’ অর্থ নতুন করে শুরু করার রজনী। ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘এস্তেফতাহ’ অর্থ নতুন করে শুরু করা।
এখানেও ১৫ রজব বলতে ১৫ এর দিবস উদ্দেশ্য নয়; বরং রাত। অর্থাৎ ১৪ই রজব দিবাগত রাত।
একটি জাল বর্ণনার উপর ভিত্তি করে এ রাতের আবিষ্কার। বর্ণনাটি হল, ‘এ রাতে চার রাকাত নামায বিশেষ নিয়মে আদায় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ দুরূদ, তাসবীহ-তাহমীদ ও তাহলীল আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ হতে তার নিকট এক হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়। যারা ঐ ব্যক্তির জন্য নেকী লিখতে থাকেন এবং ঐ রাত পর্যন্ত যত গুনাহ সে করেছে সব মাফ করে দেন। অবশেষে তার কাঁধে হাত রেখে একজন ফেরেশতা বলেন, তুমি নতুন করে আমল শুরু কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ...।’
গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নতুন করে আমল শুরু করার এই বানোয়াট বর্ণনার কারণেই সম্ভবত এই রাতের নাম রাখা হয়েছে ‘শবে ইস্তেফতাহ’।
উল্লেখিত বর্ণনা ছাড়াও এ রাত সম্পর্কে এ ধরনের আরো ভিত্তিহীন বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু আসল কথা হল, শরীয়তে ‘শবে ইস্তেফতাহ’ নামে বিশেষ কোনো রাতের অস্তিত্বই নেই। ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন, রজব মাসের বিশেষ পদ্ধতির নামাযের কোনো বর্ণনাই প্রমাণিত নয়।-লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃ. ১৭১
৮. ২৭ শে রজব : লাইলাতুল মিরাজ
এ রাতকে লাইলাতুল মিরাজ বা শবে মিরাজ বলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো পুস্তক-পুস্তিকায় স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে এবং সাধারণ জনগণের মাঝে তা প্রসিদ্ধ যে, মিরাজের ঘটনা রজব মাসের ২৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। এ কথাটি শুধু ইতিহাসের একটি বর্ণনার ভিত্তিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যার সনদ সহীহ নয়। অন্যথায় এটি কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দ্বারাও প্রমাণিত নয়, হাদীস শরীফ কিংবা কোনো সাহাবীর উক্তি দ্বারা তো নয়ই। নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুধু এটুকুই পাওয়া যায় যে, মিরাজের ঘটনা হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মাস, দিন, তারিখের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই।
অনেক আলেম বলেছেন, মিরাজের রাত নিঃসন্দেহে একটি বরকতময় রাত ছিল কিন্তু এই রাতে যেহেতু বিশেষ কোনো আমল বা ইবাদত উম্মতের জন্য বিধিবদ্ধ হয়নি তাই এর দিন-তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত থাকেনি। -আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ও শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ ৮/১৮-১৯; আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, ইমাম ইবনে কাছীর ২/৪৭১; লাতাইফুল মাআরিফ, ইমাম ইবনে রজব ১৩৪; ইসলাহি খুতুবাত, আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী ১/৪৬-৪৮
রজব মাস যেহেতু কুরআনে বর্ণিত চার সম্মানিত মাসের একটি সুতরাং এর পুরোটাই বরকতময়। তাই এ মাসের সবকটি দিন ও সবকটি রাতেই ইবাদাত বন্দেগীর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিৎ। কিন্তু এর ২৭ তারিখ যেহেতু শবে মিরাজ হিসেবে প্রমাণিত নয় তাই এ রাতকে বিশেষ ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট না করা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট রসম রেওয়াজও ত্যাগ করা উচিত।
৯. ১৫ই শাবান : লাইলাতুল বরাত
১৫ই শাবান অর্থাৎ ১৪ই শাবান দিবাগত রাত। হাদীস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এর ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মত মনে করা এবং এ রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলোকে ‘মওযূ’ বা ‘যয়ীফ’ মনে করা যেমন ভুল তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা। বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি কোনটিই উচিত নয়। যতটুকু ফযীলত প্রমাণিত এ রাতকে ততটুকুই গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং এ কেন্দ্রিক সকল রসম-রেওয়াজ পরিহার করা উচিত।
এ রাত ও তার আমল সম্পর্কে হাদীসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নিম্নরূপ :
১.
عن مالك بن يخامر عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن، رواه ابن حبان وغيره ورجاله ثقات وإسناده متصل على مذهب مسلم الذي هو مذهب الجمهور في المعنعن ولم يجزم الذهبي بأن مكحولا لم يلق مالك بن يخامر كما زعم وإنما قاله على سبيل الحسبان، راجع : سير أعلام البلاء.
মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে মাফ করে দেন।’’- সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৬৬৫
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকী কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে।
হাদীসটির সনদ সহীহ। এজন্যই ইমাম ইবনে হিববান একে ‘কিতাবুস সহীহ’এ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হাসান’ বলেছেন; কিন্তু হাসান হাদীস সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার।
ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাসতাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন, আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১১৮, ৩/৪৫৯; লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৬৫; শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১
বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা’’ ৩/১৩৫-১৩৯-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন-
وجملة القول أن الحديث يمجموع هذه الطريق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث.
‘‘এ সব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।’’ এরপর শায়খ আলবানী রাহ. ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই।
২. ‘‘হযরত আলা ইবনুল হারিস রাহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-
هذه ليلة النصف من شعبان إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.
‘‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’’-শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৮৩
ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-
هذا مرسل جيد
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওযীফার বই-পুস্তকে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকাআত হতে হবে, প্রতি রাকাআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে-এগুলো ঠিক নয়, হাদীস শরীফে এসব নেই; এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাআত করে যত রাকাআত সম্ভব হয় এবং যে সূরা দিয়ে সম্ভব হয় পড়তে থাকা। কুরআন কারীম তেলওয়াত করা। দরূদ শরীফ পড়া। ইসতেগফার করা। দুআ করা এবং কিছুটা ঘুমানোর প্রয়োজন হলে ঘুমানো। এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।
১০. ২১, ২৩, ২৫,২৭ ও ২৯ শে রমজান : লাইলাতুল কদর
এখানে বলা উচিত, ২১ থেকে ৩০ এর রাত পর্যন্ত শবে কদর অন্বেষণ ও ইতিকাফ।
অনেকের মনে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, সাতাশের রাতই হচ্ছে শবে কদর। এই ধারণা ঠিক নয়। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাইলাতুল কদর কোন রাত তা জানানো হয়েছিল। তিনি তা সাহাবীদেরকে জানানোর জন্য আসছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে সেখানে দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। তাদের ওই ঝগড়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে সে রাতের ইলম উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ কথাগুলো সাহাবীদেরকে জানানোর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- হতে পারে, এতেই তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। এখন তোমরা এ রাত (অর্থাৎ তার বরকত ও ফযীলত) রমযানের শেষ দশকে অন্বেষণ কর। সহীহ বুখারী হাদীস নং ২০২০, সহীহ মুসলিম ১১৬৫/২০৯
অন্য হাদীসে বিশেষভাবে বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৫
তাই সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।
রমাযানের শেষ দশকের ফযীলতই সবচেয়ে বেশি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭১
১১. ১লা শাওয়াল : ঈদ-উল-ফিত্র
১২. ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্ব : আইয়ামে তাশরীক
এটি ঠিক যে, ৯ই যিলহজ্ব ফজর থেকে ১৩ই যিলহজ্ব আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পর প্রত্যেক বালেগ নর নারীর উপর একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক হল,
الله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد
তবে এই সবগুলো দিনকে পরিভাষায় ‘আইয়ামুত তাশরীক’ বলে না। পরিভাষায় নয় যিলহজ্বকে ইয়াওমু আরাফা-১০ যিলহজ্বকে ইয়াওমুন নাহর এবং ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্বকে আইয়ামুত তাশরীক বলে। (দ্র. উমদাতুল কারী শরহু সহীহিল বুখারী খ. ৬ পৃ. ২৮৯; রদ্দুল মুহতার, খ. ৬ পৃ. ৩১৬; আলমিসবাহুল মনীর, পৃ. ১৬২; আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ, কুয়েত, খ. ৭ পৃ. ৩২০)
১৩. ৯ই যিলহজ্ব : ইয়াওমুল আরাফা হজ্ব দিবস
আরবী ব্যাকরণের হিসেবে ‘ইয়াওমুল আরাফা’ বলা ঠিক নয়। বলতে হবে, ইয়াওমু আরাফা। আর এর সাথে ইয়াওমু আরাফা (৯ই যিলহজ্বের) রোযার কথা বলে দিলে ভালো। হাদীস শরীফে এসেছে, আরাফার দিনের (৯ই যিলহজ্ব) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন। -সহীহ মুসলিম হাদীস ১১৬২
১৪. ১০ই যিলহজ্ব : ঈদ-উল-আযহা
১৫. প্রতি মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখ : আইয়ামে বীজ (রোযা রাখা সুন্নত) অর্থাৎ প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ।
উপরোক্ত তালিকায় সমাজে প্রসিদ্ধ সহীহ বা ভুল দিবস-রজনীর অধিকাংশ এসে গেছে। এর বাইরেও কিছু আছে যা এই তালিকায় আসেনি। যেমন-
* আশারায়ে যিলহজ্ব (যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশদিন)।
আল কুরআনুল কারীমে সূরা ফাজর-এর শুরুতে আল্লাহ তায়ালা এই দশ রাতের শপথ করেছেন (তাফসীরে ইবনে কাছির ৪/৫৩৫) হাদীস শরীফে এসেছে- আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোন দিনের আমল নেই...। - সহীহ বুখারী, হাদীস: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ২৪৩৮
* ইয়াওমুল জুমুআ (প্রতি সপ্তাহের জুমার দিন)
আল কুরআনুল কারীমে জুমার দিনের আলোচনা এসেছে এবং ‘সূরা জুমুআ’ নামে একটি আলদা সূরাও রয়েছে। জুমআর দিনের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমুআর দিন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। -সহীহ মুসলিম ১/২৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৪
*এ ছাড়াও সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ফযীলত ও রোযার কথা হাদীস শরীফে এসেছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমি চাই যে, আমার আমল পেশ করার মুহূর্তে যেন আমি রোযা অবস্থায় থাকি। -জামে তিরমিযী, হাদীস.৭৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস.৭৬৩৯
আরেক হাদীসে আয়েশা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। - জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৩৮
আর এ তালিকার বাইরে কিছু ভুল দিবস-রজনী বিভিন্ন পুস্তিকায় পাওয়া যায়। যেমন-
* ফাতিহায়ে ইয়াযদহম (রবিউস সানীর ১১ তারিখ)
‘ইয়াযদাহম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘একাদশ’। আর ফাতিহায়ে ইয়াযদাহম অর্থ রবীউস সানীর এগারো তারিখে কৃত ফাতেহা বা ইসালে ছওয়াব মাহফিল। বলা হয়ে থাকে, এ তারিখে শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রহ.-এর ইন্তেকাল হয়েছিল। এজন্য তাঁর ওফাতদিবস পালন করার উদ্দেশ্যে এই রসমের সূচনা করা হয়। ওই আল্লাহর বান্দারা চিন্তা করেনি যে, ইসলামে না জন্মদিবস পালন করা হয়, না মৃত্যুদিবস। না শায়খ জীলানী রহ. তাঁর কোনো শায়খের জন্মদিবস বা মৃত্যুদিবস পালন করেছেন, না তার কোনো খলীফা বা শাগরিদ তা পালন করেছেন।
এদিকে মজার বিষয় এই যে, গিয়ারভীর এই রসম এ তারিখে এ জন্যই পালন করা হয় যে, এটা শায়খ জীলানীর ওফাতদিবস। আল্লাহর কী শান, এই ভিত্তিহীন রেওয়াজের উদযাপন দিবসের জন্যও একটি ভিত্তিহীন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে।
আমরা তারীখ ও রিজালের অনেক গ্রন্থে শায়খ জীলানীর জীবনালোচনা পড়েছি। কোথাও এগারো রবীউস সানীর কথা নেই। আট, নয় বা দশ রবীউস সানী ৫৬১ হিজরীর কথা উল্লেখিত হয়েছে।
-(দেখুন : সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ১৫/১৮৯; আলমুনতাযাম, ইবনুল জাওযী : ১৮/১৭৩; যায়লু তবাকাতিল হানাবিলা, ইবনে রজব ১/২৫১; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/৩৯৫; শাযারাতুয যাহাব, ইবনুল ইমাদ ৪/২০২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৩৯/৬০)
মোটকথা, এ তারিখ যদি সহীহও হতো তবুও তো জন্মদিবস-মৃত্যুদিবস পালন করার কোনো অনুমতি ইসলামে নেই।
* ফাতিহায়ে দোয়াযদহম (রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ)
দোয়াযদহম অর্থ দ্বাদশ। ফাতিহায়ে দোয়াদহম অর্থ রবীউল আউয়ালের ১২ তারিখে কৃত ফাতেহা বা ইসালে ছওয়াব মাহফিল। এটা আরো গর্হিত বেদআত।
উপরের আলোচনায় দুই ধরনের দিবস-রজনীর কথা এসেছে : এক. শরীয়তের দলীল দ্বারা যেগুলোর আলাদা ফযীলত ও বিশেষত্ব প্রমাণিত। দুই. যেগুলোর আলাদা বিশেষত্বের ধারণা ভুল ও নবউদ্ভাবিত। নীচে দুইটি আলাদা তালিকায় তা উপস্থাপিত হল :
সঠিক দিবস-রজনী
১. ইয়াওমু আরাফা (৯ই যিলহজ্ব,রোযা রাখা সুন্নত)
২. ঈদুল-আযহা (১০ই যিলহজ্ব)
৩. আইয়ামে বীজ (প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখ,রোযা রাখা সুন্নত)
৪. লাইলাতুল বারাআত বা লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান (১৫ই শাবান)
৫. লাইলাতুল কদর অন্বেষণ ও ইতিকাফ (রমযানের শেষ দশক)
৬. ঈদুল-ফিত্র (১লা শাওয়াল)
৭. আইয়ামে তাশরীক (১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ্ব)
৮. আশুরা (১০ ই মুহাররম; ৯-১০/১০-১১) তারিখে রোযা রাখা সুন্নত)
৯. আশারায়ে যিলহজ্ব (যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশদিন)
১০. ইয়াওমুল জুমুআ (প্রতি সপ্তাহের জুমার দিন)
১১. সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার (রোযা রাখা সুন্নত)
ভুল দিবস-রজনী
১. আখেরী চাহার শোম্বাহ (সফরের শেষ বুধবার)
২. লায়লাতুর রাগায়েব (রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার)
৩. শবে এস্তেফতাহ (১৫ই রজব)
৪. লাইলাতুল মিরাজ (২৭ শে রজব)
৫. ফাতিহায়ে ইয়াযদহম (রবিউস সানীর ১১ তারিখ)
৬. ফাতিহায়ে দোয়াযদহম (রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ)
৭. ১২ই রবিউল আউয়াল।