মুহাররম-১৪৩৪   ||   ডিসেম্বর-২০১২

মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার কিছু খন্ডচিত্র

[প্রখ্যাত সহিত্যিক, কবি, সমালোচক ও বাগ্মী জাতীয় অধ্যাপক মরহুম সৈয়দ আলী আহসান ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় ছিলেন কলকাতায়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার সে সময়ের পর্যবেক্ষণ, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন-‘যখন সময় এল’ নামের বই। বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকাল, যুদ্ধের চেতনা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরতে বইটি থেকে কিছু খন্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। ৫,বাংলাবাজার-এর নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ওই সংস্করণ থেকেই এই চয়ন।]

তিনি এক জায়গায় লিখেছেন-‘ভারতের নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা এবং বিশ্বাস থেকে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। আমি পূর্বেই বলেছি যে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধ পক্ষ রূপে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য কখনও মহৎ ছিল না। ধরণা করা হয়েছিলো যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যেহেতু সেনাবাহিনীর লোক সুতরাং দেশ স্বাধীন হলে সৈনিকরাই ক্ষমতা দখল করবে। এভাবে একটি কাল্পনিক সম্ভাবনা নির্মাণ করে মুক্তিবাহিনীর বিপরীত শক্তি হিসেবে একটি বিরুদ্ধ দল গঠন করা হল। তখন যা কল্পনায় ছিল না, বিবেচনায় ছিল না, মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ফলে পরবর্তীতে তাই সত্য হল। মেজর জলিল এ অবস্থাটা মানতে পারেননি।

 মেজর জলিল সব সময় ভারত সরকারকে সংশয়ের চোখে দেখতেন এবং বাংলাদেশের আন্দোলনের পিছনে ভারতের সমর্থন স্বার্থলেশহীন নয় মনে করতেন। কিন্তু একজন সৈনিক হিসেবে এই বিরুদ্ধতাকে নিজের আচার-আচরণ এবং উচ্চারণে প্রকাশ করা নিয়মতান্ত্রিকতার বিরোধী ছিল। তাই তাঁকে অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আচরণের দ্বারা একটি সত্য প্রমাণিত করেছিলেন যে, তিনি যথার্থ দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এবং ক্ষমতা তাঁর ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তাঁর অব্যবহিত পরে তিনি সামাজতান্ত্রিক চৈতন্যে বিশ্বাসী ছিলেন। এ বিশ্বাসটি ছিল তাঁর পূর্ণাঙ্গীন। অর্থাৎ এই বিশ্বাসের সহগামী শক্তি হিসেবে তিনি নাস্তিকতাকেও মান্য করেছিলেন। কিন্তু ক্রমশ নাস্তিকতাকে তিনি অস্বীকার করতে থাকেন এবং ইসলামের বিনয় এবং বিশ্বাসের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করতে থাকেন। তাঁর সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, এখনও বলছেন। এসব কথায় সত্য-অসত্যের মিশ্রণ ঘটেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অসত্যকে সচল করবার চেষ্টা দেখা দিয়েছে। আমি এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমি শুধু জানি তাঁর ইসলামে প্রত্যাবর্তনটি আন্তরিক ছিল।’ (পৃষ্ঠা-১২৬)

তিনি আরেক জায়গায় লিখেছেন- ‘কলকাতায় বহুল পঠিত যে সমস্ত পত্রিকা আছে যেমন, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং বসুমতী পত্রিকা এরা পুরোপুরিভাবে সাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ। এ সমস্ত পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বক্তব্য থাকতো ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করতো এমন বিবরণও থাকতো। এক কথায় এ সমস্ত পত্রিকার বিবরণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ থাকতোই। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ যাঁরা সে সময় কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এ সমস্ত পত্রিকায় লিখতেন এবং এমন সব উদ্ভট কথা লিখতে থাকেন, যা  ইসলামবিরোধী চিন্তায় আকীর্ণ ছিল। তাঁরা হিন্দুদের প্রীতি এবং শুভেচ্ছার কামনায়  ইসলামবিরোধী মন্তব্য করতেন। এদের মধ্যে একজনের কথা আমি আগেই বলেছি। তিনি হাসান মোরশেদ ছদ্মনামে লিখতেন। এঁরা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজের কাছে এটা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন যে বাংলাদেশের মানুষ ইসলামকে তেমন পছন্দ করে না। মূলত হিন্দুদের ধারণা-বাসনার সঙ্গে মুসলমানদের ধারণা-বাসনার বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এ ভাবে আমাদের পরিচয়লিপি সে সময় এঁদের দ্বারা খুবই বিপর্যস্ত হয়।’ (পৃষ্ঠা-১৩৯)

তিনি আরো লিখেছেন-

‘কলকাতায় অস্থায়ী যে বাংলাদেশ সরকার গড়ে উঠেছিল, তারা সবাই যে একটি স্বাধীন দেশের যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এমন কথা বলা যায় না। এদের অভিজ্ঞতা ছিল কম, সংগ্রামের ইতিহাসও ছিল নগণ্য। সুতরাং এমন কথা বলা ঠিক হবে না যে এঁরা সবাই পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে আকস্মিকভাবে কারও উপর দায়িত্বভার অর্পিত হলে সে ক্রমশ দায়িত্বের উপযোগী হয়ে ওঠে, এমন কথা বলা যে যায় না তা নয়। এঁদের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিগত চরিত্রও ছিল অত্যন্ত জঘন্য। সারাক্ষণ মদ্য পান করতেন এবং নারীঘটিত দুর্বলতাও ছিল। একবার রাত্রিবেলা কোনো এক অশুভ স্থান থেকে বেরুচ্ছেন যখন তখন পুলিশ তাঁকে তাড়া করে। তিনি তাঁর জীপ নিয়ে দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগের চেষ্টা করেন। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে জীপ থেকে নেমে অন্ধকার আবাসস্থল ঠাহর করতে না পেরে ডানদিকে মহিষের বাথানের মধ্যে ঢুকে একটি মহিষের গায়ের উপর হোচট খেয়ে পড়েন। সে অবস্থায় তার শরীর গোবরে মাখামাখি হয়ে যায়। ভারতীয় পুলিশ তখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অস্থায়ী আবাস থেকে কয়েকজনকে ডেকে তোলে এবং মহিষের বাথানে গোবর মাখা মহাপুরুষকে দেখিয়ে দেয়। পুলিশ অবশ্য আর কিছু করেনি। কিন্তু তাদের খাতাপত্রে আমাদের মানুষদের কীর্তিকাহিনী নিশ্চয়ই লিখে রেখেছে। এরকম ঘটনা দুর্ঘটনা আরও ঘটে ছিল কিন্তু সেগুলো লিপিবদ্ধ করার মত নয়। আমি আমাদের গ্লানির দিকটা তুলে ধরতে চাচ্ছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি যে স্বাধীনতার সৌজন্য বৃদ্ধি, এবং কর্তব্য নিষ্ঠা সম্পর্কে আমরা সবাই সমানভাবে অবহিত ছিলাম না। মধ্যবিত্ত  বাঙালী মানুষ আমরা, বিপুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কখনও অগ্রসর হইনি। তাই সংকটের আবর্তে যখন চলেছিলাম তখন সবাই যে সংকটের মুখোমুখি হওয়ার দক্ষতা প্রমাণ করতে পেরেছিলাম তা নয়।’ (পৃষ্ঠা-১০৫)

তিনি অন্য জায়গায় লিখেছেন-

‘পৃথিবীর মানুষ সর্বদাই পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে এবং ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক এ সব সম্পর্ককে সে এড়াতে পারে না। মানুষ পরিবারের মধ্যে বাস করে এবং বাস করে বলেই  পারিবারিক সম্পর্কে তার পরিচয় নির্ণীত হয়।            (বাকি অংশ ৪৩ পৃষ্ঠায়)

 

জীবনের প্রতিদিনের কর্মকান্ডে আমরা সমাজের মধ্যে বাস করি এবং সমাজকে গ্রহণ করে আমাদের কর্মপদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ইতিহাসকে অস্বীকার করলে আমাদের চৈতন্যের কোনো মূল্য থাকে না। আমাদের জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মের ব্যাপকতা এবং গভীরতা মানব-জীবনে এত প্রচন্ড যে ধর্মকে অস্বীকার করলেও ধর্মের শাসন থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারে না। ধর্ম আমাদের ইতিহাসকে শাসন করে, সামাজিক জীবনকে লালন করে এবং পারিবারিক জীবনের নীতিবোধ নির্মাণ করে। যুগ যুগ ধরে মানুষ ধর্মের এই প্রতাপ থেকে মুক্ত হতে পারে নি। যারা নাস্তিক তাদের জন্য নাস্তিকতাই একটি ধর্ম এবং নাস্তিকতার নির্দেশেই তাদের জীবনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এসব কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ আমি খুঁজে পাই না।’ (পৃষ্ঠা-১৩৭)

তিনি লিখেছেন-কলকাতা শহরে বাংলাদেশের দু’জন বুদ্ধিজীবীকে ধূতি-চাদর পরিহিত অবস্থায় পথে-ঘাটে এবং সভা-সমিতিতে ঘোরেফেরা করতে দেখেছি। আমি যখন পার্ক এভিনিউতে ব্যারিস্টার সালামের গৃহে অবস্থান করছিলাম সেসময় ধূতি-চাদর পরিহিত অবস্থায় বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর অপরূপ বেশ ধারণ করার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘দেশে তো তোমাকে কখনও ধূতি-চাদর পরতে দেখিনি, তুমি কলকাতায় এসে এ বেশ ধারণ করলে কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন যে তিনি যে হিন্দু ভদ্রলোকের বাসায় থাকেন তিনিই তাঁকে এ পোশাকটি উপহার দিয়েছিলেন, আর তাছাড়া কলকাতায় হিন্দুদের মধ্যে চলাফেরা করতে হলে হিন্দু পোশাকে চলাফেরা করাই তো ভাল। আর একজন বুদ্ধিজীবী যিনি একজন খ্যাতিমান লেখক, তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে ধূতি-চাদর পরে এসেছিলেন। তাঁকেও আমি এ পোশাকটি পরার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘‘ইচ্ছে হয়েছে তাই পরলাম।’’ তখন সেখানকার এক হিন্দু ভদ্রলোক বললেন, ‘‘কলকাতার হিন্দুরা এখন ধূতি-চাদর বড় একটা পরে না। পায়াজামা-পাঞ্জাবীই পরে। এটি দামেও সস্তা, চলাফেরা করতেও সুবিধা।’’...

আমাদের নিজেদের লোকদের হীনম্মন্যতার ফলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাহিত্যিকরা এসে আমাদের উপদেশ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের আচরনে বিরক্ত হয়ে কবি জসীমউদ্দীন একটি সভায় একদিন বলেছিলেন, ‘‘আপনারা আমাদের দেশে যখন আসবেন তখন ‘দাদা’ হিসেবে আসবেন না, বন্ধু হিসেবে আসবেন। আমাদেরকে ছোট ভাববেন না, বরঞ্চ সমান ভাববেন।’’ উক্ত সভায় মনোজ বসু, প্রবোধ সান্যাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনের এই কথায় পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই কিন্তু তা তাঁরা প্রকাশ করেননি। তবে জসীমউদ্দীন যে তাঁদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন তা অনুমান করা যায় সহজেই।

মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে আমরা অন্য একটি স্বাধীন দেশের মানুষের সঙ্গে সম পর্যায়ে এবং বিশ্বস্ততায় মিলিত হতে চাই। ক্ষুদ্রভাবে তাদের আশ্রিত হতে চাই না। এ বলিষ্ঠতা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের বৈশিষ্ট্যে আমরা উজ্জ্বল থাকব এবং সেভাবেই তো আমাদের সার্থকতা।’ (পৃষ্ঠা- ১৪৪/১৪৫)

তাঁর লেখার আরেকটি অংশ-‘আমি চিরকাল বিশ্বাস করি যে ইসলামের অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন একটি নীতিবোধ আছে যা পৃথিবীর সকল ধর্মাবলম্বীই গ্রহণ করতে পারে। ভারতে অবস্থানকালে আমি আমার বিশ্বাস এবং প্রত্যয়ের কথা সকলের কাছেই বলেছি। কখনও কোনো মুহূর্তে ভারতীয়দের কারও সন্তুষ্টির জন্য আমার মতের পরিবর্তন ঘটাইনি। সেজন্য পরবর্তীতে আমি অনেকের কাছে মৌলবাদী হিসেবে বিবেচিত হয়েছি। সে সময় কলকাতাতে আমি লক্ষ্য করেছি যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ভারতীয়দের সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে কথা  বলেন এবং নিজস্ব বক্তব্যে ভারতীয়দের সমর্থন যাচ্ঞা করেন। বাংলাদেশ অঞ্চলের মুসলমানদের নিজস্ব একটা সত্তা আছে এবং সেই সত্তার বিশিষ্টতা নিয়েই আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এ কথা বলতে তাদের দ্বিধা হত। ভারতীয়দের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের লোকদের সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের মধ্যকার কেউ কেউ নিজেদের বিরুদ্ধেই কথা বলতেন।’ (পৃষ্ঠা-১৩৫-১৩৬) 

 

 

advertisement