মুহাররম-১৪৩৪   ||   ডিসেম্বর-২০১২

বিজয়ের ৪১ বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বছর শেষে আবার ফিরে এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে আমরা পার করে ফেলেছি চার দশকেরও বেশি সময়। একটি দেশের জন্য ৪১ বছর কম সময় নয়। আমাদের পরে বা আমাদের কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশ আমাদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। উন্নতি করেছে কাঙ্খিত মাত্রায়। তাই এ পর্যায়ে এসে পাওয়া-নাপাওয়ার হিসাব কষা খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়।

স্বাধীনতার পর কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা একটি সংবিধান পেয়েছি। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক সরকার। এরপর ক্রমান্বয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও যোগাযোগ আবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। আগের তুলনায় মানুষের কর্মসংস্থানও বেড়েছে। এসব কিছুই সফলতার প্রাথমিক খতিয়ান।

কিন্তু চিন্তাশক্তিকে কিছুটা প্রশস্ত করে খোলা চোখে তাকালেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের ব্যর্থতার বোঝা কত ভারী। গুরুত্বপূর্ণ এমন অনেক কিছু করার সুবর্ণ সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি যা আমরা সহজেই করতে পারতাম।

শুরুতেই নজর দেওয়া যাক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন প্রসঙ্গে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ব্যাপক গণজাগরণের মাধ্যমে অর্জিত দেশটির সংবিধান হতে পারত আরো অনেক উন্নত ও গণমুখি। রাষ্ট্রের মৌলিক বিভাগগুলোর (নির্বাহী, আইন, বিচার) দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ব্যালেন্স সৃষ্টি করা যেত তখনি, একই সঙ্গে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনভিত্তিক স্বাধীন ক্ষমতা, নিজস্ব নিয়োগ পদ্ধতি ও অর্থ পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান তখনি করে নিলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন, পিএসসি এবং অবশেষে দুদক-এর উপর জনগণের এত অনাস্থা সৃষ্টি হত না। যুগে যুগে ক্ষমতাবানরা এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের মর্জি-মতলবে ব্যবহার করতে পারতেন না। বিভিন্নভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতা আকড়ে রাখা, বারবার বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস হওয়া এবং দলীয় লোকদের রাষ্ট্রের কর্মকর্তা বানিয়ে প্রশাসনে দলবাজি সৃষ্টি করার তেমন সুযোগ হত না। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি নীতি অথবা একপেশে তদন্তের অভিযোগ, এক কথায় দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা এবং মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে না পারার পেছনেও দুর্বল আইন কাঠামোই দায়ী। অথচ সংবিধান প্রণয়নের সময় এ প্রতিষ্ঠানের চিন্তাই করা হয়নি। পরে যখন এটি সৃষ্টি করা হয় তখন থেকেই তা ব্যবহার হয়ে আসছে সকল যুগের ক্ষমতাসীনদের মর্জি-খুশি মোতাবেক।

আমাদের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ এবং নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ধারাগুলো কত দুর্বল থেকেছে তা কিছু দিনের মধ্যেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, অর্থায়ন, নিম্ন আদালতে নিয়োগ-বদলি বিষয়ক আইনগুলোর দুর্বলতা যুগ যুগ ধরে কীভাবে বিচারকসমাজ ও জনগণকে ভুগিয়েছে সচেতন মহলের তা অজানা নয়। উচ্চ আদালতে নিয়োগের আজব আইনটির (কোনো ব্যক্তি হাইকোর্টে ১০ বছর ওকালতি করলেই তিনি এ বিভাগের বিচারক হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন) সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন আমলে দলীয় সরকারগুলো তাদের অনুগত এমনকি উচ্চপদস্থ দলীয় সদস্যদেরও বিচারক নিয়োগের সুযোগ পেয়েছে। হাইকোর্টের ওকালতিতে তালিকাভুক্ত হয়ে তিনি কয়টি মামলা পরিচালনা করেছেন, সেগুলোর ধরন কেমন, মামলা পরিচালনায় তার দক্ষতা ও সততা কেমন ছিল, এসব কোনো কিছুরই বিবেচনার প্রয়োজন নেই। এমনকি কারো বিরুদ্ধে বড় ধরনের ফৌজদারী অভিযোগ থাকলেও তাকে বিচারক নিয়োগে আইন কোনো বাধা হয়নি। তাইতো কোনো এক প্রধান বিচারপতি বিবেকের তাড়নায় এধরনের কোনো কোনো ব্যক্তিকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করলেও পরবর্তী প্রধান বিচারপতি আইনের চাপে (!) তাদেরকে শপথ পড়াতে বাধ্য হয়েছেন। আর দুর্বল আইন কাঠামোর সুযোগে উচ্চ আদালতে দলেদলে বিচারক নিয়োগের যে হিড়িক দু আমলের দু’সরকার দেখাল সেটা যে ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে অভিজ্ঞ মহল তা নিয়ে বাস্তাবিক কারণেই শংকিত। অথচ বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি আরও সুনির্দিষ্ট করা যেত মূল সংবিধানেই। সার্চ কমিটি গঠন বা অন্য কোনোভাবে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার বিধানও সেখানে থাকতে পারত। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আইনটি আরো সুস্পষ্ট ও সুন্দর হলে বার বার এ পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের তাঁদের কাজ শুরুর পূর্বেই সরকার বিরোধী উকিলরা বিব্রত করার সুযোগ পেতেন না এবং রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভের প্রধান পদটি বার বার বিতর্কিত হত না।  মাননীয় বিচারপতিগণের জবাবদিহিতা এবং আচরণবিধিও আরো সুস্পষ্ট এবং সুনির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।

স্বাধীনতার পর মোটামুটি অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান তৈরি করে ফেলায় এর প্রণয়নের সাথে জড়িত বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সাধুবাদও পেয়েছেন। কিন্তু সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন যে অনেক ক্ষেত্রেই তাতে ঘটেনি, তা শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে মৌলিক চারটি নীতির কথা বলা হয়েছে সেগুলো এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বলা হয়েছে যে, এ সকল আদর্শ ও নীতি বাস্তবায়নের জন্যই বাংলার বীর জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর সে চারটি নীতির দু’টি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। অথচ সে সময়ে তো দূরের কথা, ৪১ বছর পরে এসে এখনো এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মর্মে বিশ্বাস করেন-এমন দাবি কোনো সত্যবাদী মহল করবেন বলে মনে হয় না। মুক্তিযোদ্ধাগণ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন এটি নিতান্তই সত্যের অপলাপ। আমরা আগেও চ্যালেঞ্জ দিয়েছি যে, এখনো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যারা হায়াতে আছেন তাদের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ জরিপ চালালেই ওই দাবির অসারতা প্রমাণিত হবে। মূলত এ বাক্যটি সংবিধানে লিখে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। বললে ভুল হবে না যে, এ

অবাস্তব কথা লিখে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ও জীবনদানকারীদের আত্মাকে কষ্টই দেওয়া হয়েছে। একথা সকলেই জানেন যে, পাকিস্তানী শাসকদের অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবাদে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবং মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কর্তৃক যতগুলো আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে এর কোনোটিতেই ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি ওঠেনি। ঐতিহাসিক ৬ দফাতেও এমন কোনো বাক্য ছিল না। অর্থাৎ অতর্কিতভাবেই এটি জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সরকার এর বাস্তবতা উপলব্ধি করে এটি সংবিধান থেকে সরালেও সর্বশেষ সংশোধনীতে আবার তার পুণর্বহাল হয়েছে। অথচ এ সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে কখনো বলেনি যে তারা আবার ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ফিরিয়ে আনবেন। আর ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি আমাদের সংবিধানে কেন এসেছিল এবং কেন পুণর্বহাল হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা এ যাবৎ কারো থেকে পাওয়া যায়নি। যে দেশের বাজার, অর্থনীতি ও রাজনীতির পুরোটাই বুর্জোয়া পুঁজিবাদীদের (সমাজতন্ত্রীদের ভাষায়) দখলে সে দেশের সংবিধানে এ শব্দটি কী উদ্দেশ্যে শোভা পাচ্ছে সে কথার জবাব কি কখনো পাওয়া যাবে?

একজন নাগরিক হিসেবে সংবিধান ও এর সংশোধনীগুলো নিয়ে বলার মত আরো অনেক কথাই রয়ে গেছে। লেখাটি সংক্ষিপ্ত করার স্বার্থে আজ এখানেই ক্ষান্ত করছি।

রাজনীতি

বিগত চার দশকে আমাদের রাজনীতির তেমন কোনো গুণগত উন্নতি ঘটেনি। পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ি, নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো, বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা,  সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবাজদের লালন, ক্ষমতায় বসলেই দেশকে নিজের তালুক ভাবার মানসিকতা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা-এসব নেতিবাচক বিষয়গুলোই মূলত আমাদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল। মাঝে কিছু কিছু সময়ের সামরিক শাসন বাদ দিয়ে বাকি সময় কাগজে-কলমে গণতন্ত্র থাকলেও মূলত আমাদের দেশে এখনো গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড়ায়নি। আসলে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছিল বিজয় পরবর্তী সরকার থেকেই। রাষ্ট্রক্ষমতাকে একটি দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর বদলে সবকিছুকে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেলা হয়েছিল, যার ষোলকলা পূর্ণ করা হয়েছিল ৪র্থ সংশোধনীতে সংবিধানের মূল কাঠামো পাল্টে দিয়ে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল) কায়েমের মাধ্যমে। এভাবেই বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতাকে করে ফেলা হয়েছিল চরম বিতর্কিত।

নববইয়ের গণআন্দোলনের পর থেকে গণতন্ত্রে ধারাবাহিকতা এলেও (মাঝের ২ বছর বাদ দিয়ে) ক্ষমতা থেকে গেছে বরাবরই এই ব্যক্তি বা ওই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সংসদ, মন্ত্রীসভাসহ সবকিছুই মূলত পরিচালিত হয়ে আসছে দলীয় প্রধানের ইচ্ছাতেই। বড় বড় দলগুলো রাষ্ট্রতো দূরে থাক দলীয় ফোরামেও গণতন্ত্রের চর্চা করে না। এ যেন গণতন্ত্রের নামে রাজতন্ত্র বা জমিদারী প্রথারই ভিন্ন রূপ।

শিক্ষা

স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান যতটুকুই বাড়ুক সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারী এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা। শিক্ষা ও স্বাক্ষরতার হার অনেক বেড়েছে। তবে পুঁজিবাদের কুপ্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও আগ্রাসন চালিয়েছে। শিক্ষায় রমরমা বাণিজ্যের বিষয়টি এখন খোলামেলা ব্যাপার। বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স কোর্সের জন্য লাখ লাখ টাকা মূল্য র্নিধারণ করে প্রচার মাধ্যমে অসংখ্য বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে থাকে। আর কোর্স ফি বেশি হলেও এমবিএ, বিবিএ, সিএস ইত্যাদি বিষয়গুলোতেই শিক্ষার্থীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে অধিক। এসব বিষয় পড়লে বেশি বেতনে চাকরি পাওয়ার আশা থেকেই এমনটি করছে তারা। অর্থাৎ বাজারমুখি অর্থনীতির হাওয়া শিক্ষাক্ষেত্রকেও গ্রাস করেছে। ফলে শিক্ষকতা ও অন্যান্য মহৎ পেশার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থী কমই থাকছে। অপরদিকে শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীর বিভিন্ন দলের লেজুড়বৃত্তি করা, পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোর ভিসি নিয়োগে বিভিন্ন সরকারের তামাশা, বার বার ধর্মঘট, আন্দোলন ও বন্ধঘোষণার মত বিষয়গুলো জাতিকে হতাশ করে চলেছে চরমভাবে। যেমনিভাবে অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বিক্রি ও শিক্ষার নামে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে জোরে শোরে।

মাদরাসা শিক্ষার মধ্যে আলিয়া মাদরাসাগুলো ইতিমধ্যে ফাযিল ও কামিলের মান আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জেনারেল বিষয়গুলোতে অধিক ঝুঁকে পড়ায় এশ্রেণীর মাদরাসাগুলো থেকে কুরআন-সুন্নাহ ও ধর্মীয় বিষয়ে দক্ষ আলেম বের হচ্ছেন খুবই কম। আর এ ধারার মেধাবীদের সিংহভাগই শেষপর্যন্ত জেনারেল লাইনে চলে যাচ্ছেন, ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পর্যায়ের দক্ষ শিক্ষকের অভাব হওয়াই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে কওমী মাদরাসাগুলো তাদের দ্বীনী খেদমতের পরিধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে ব্যাপকভাবে। যদিও মাদরাসা সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষার গুণগতমান এক্ষেত্রেও আশানুরূপ বাড়েনি। তবে কওমী আলেমগণের অধিকাংশ এখনো জাতির দ্বীনী বিষয়াদির সমাধানে যথাসাধ্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন এবং দেরিতে হলেও মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জনের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন তারা। ধর্মীয় শিক্ষার বিভিন্ন অনুষদে উচ্চতর গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানো, বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চস্তরের কিতাবাদি আমদানি এবং অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে কওমী-ছাত্রদের মধ্যে গবেষণাধর্মী ও আরবী ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলো পড়ার ঝোঁক ইতিবাচক অগ্রগতির প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এ সেক্টরের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোর একটি হল পুরো দেশের কওমী মাদরাসাগুলোর এখন পর্যন্ত একটি প্লাটফর্ম বা একটি বোর্ডে একত্র হতে না পারা। এছাড়া একই ধরনের শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ করা, তারবিয়াতুল মুদাররেসীনের ব্যবস্থা করা এবং ছাত্র শিক্ষকদের মাঝে তাদের পূর্বসূরীদের তাকওয়া ও আত্মত্যাগের বিষয়গুলো জাগ্রত করা গেলে কওমী মাদরাসাগুলো আরো সফলকাম হতে পারবে বলে মনে হয়।

স্বাস্থ্য

দেশে এখন অনেকগুলো বড় বড় বেসরকারী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হলেও সাধারণ আয়ের লোকদের জন্য সেগুলোর সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই নিম্ন আয়ের লোকদের ভরসা এখনো সরকারি হাসপাতালগুলো। আর এগুলোর বেহাল দশার যত কথা প্রচারিত রয়েছে সে সব উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

অর্থ-বাণিজ্য

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার কিছু ব্যাংক, বীমা ও কিছুসংখ্যক বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করেছিল । যেগুলো পরবর্তিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ওই ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি চলেছে পুঁজিবাদী ধারায়। ফলে এক দিকে যেমন শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, অন্যদিকে একই তালে বেশিরভাগ সম্পদের মালিকানা চলে গেছে অল্প কিছু পুঁজিপতির হাতে। পাশাপাশি এক শ্রেণীর অসাধু লোক ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, কেউবা শেয়ার বাজার, এমএলএম কোম্পানী, এনজিও সোসাইটি, মাইক্রো ক্রেডিট বাণিজ্য-ইত্যাদির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে চলেছে। রাষ্ট্রের দুর্বল আইনী কাঠামো, কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা ও সততার অভাব এক্ষেত্রে বড় দায়ী।

বিভিন্ন সরকারের অর্থমন্ত্রীগণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যতই হিসাব-নিকাশের যাদুকরী দেখান বাস্তবে দেশের অর্ধেকের বেশি বনী আদম এখনো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। আকাশচুম্বি বাজারমূল্যের সাথে তাদের সীমিত আয় কোনোভাবেই তাল মেলাতে পারছে না। আর একই দেশের একই নগরীর বা গ্রামের নাগরিকদের জীবন যাত্রার মানে পাহাড় সমান বৈষম্যের কথা হয়ত বলাই বাহুল্য।

মিডিয়া

অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও বহু নতুন পত্রিকা, রেডিও ও টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এসবের মালিকানা পেয়েছে ঘুরে ফিরে সেই পুঁজিপতিরাই। যার দরুন এ সেক্টরে যেমন দলাদলি রয়েছে তেমনি মালিক পক্ষের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাংবাদিক সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সততা ও পেশাদারিত্ব বহাল রাখতে পারছেন না। অন্যদিকে একশ্রেণীর মিডিয়া এদেশের জনগণের হাজার বছরের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার ছুঁড়ে ফেলে বিদেশী বস্তাপচা, অশ্লীল সংস্কৃতি বিকাশে আদা-জল খেয়ে লেগেছে। যার ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই হচ্ছে বিপথগামী। অবার কোনো কোনো মিডিয়া যখন রমযান, ঈদ ইত্যাদির চেয়ে পূজা ও ক্রিসমাস ইত্যাদির প্রচারে বেশি মনোযোগী হয় তখন সহজেই বোঝা যায় তারা কাদের হয়ে কাজ করছে।

ধর্ম ও নৈতিকতা

যে সব ক্ষেত্রে আমাদের জনগণ রাষ্ট্র কর্তৃক চরম অবহেলার স্বীকার হয়েছে সে সবের অন্যতম হচ্ছে ধর্ম ও নৈতিকতা। মানুষের ধর্মীয় জীবনের উন্নতি এবং নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনে কোনো সরকারই সেভাবে এগিয়ে আসেনি। উল্টো বিদেশীদের অন্ধ অনুকরণ করে শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সব কিছুকে সেক্যুলার করার হিড়িক চলছে। অথচ মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও আল্লাহভীতি জাগ্রত করা ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মুনাফাখোরি ও চাঁদাবাজি ইত্যাদির মতো বড় বড় ব্যাধি যে দূর করা সম্ভব নয়-তা তো এখন আর যুক্তি দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখন জাতির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

উপসংহার

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। মহান আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে এ দেশটি আমাদেরকে দিয়েছেন। এটি একটি নিয়ামত, যার মূল্যায়ন করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। এর আগে ১৯৪৭ সালে আরেকটি নিয়ামত আমরা পেয়েছিলাম পাকিস্তান নামে। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারের বিকাশ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি হিসেবে সেটি আমরা পেয়েছিলাম। তখনকার সময়ের উলামা, মুসলিম পন্ডিতগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দীর্ঘ সংগ্রাম ও বহু মানুষের আত্মত্যাগের পর পাওয়া গিয়েছিল পাকিস্তান। এ দেশের অনেক নেতৃবৃন্দ (শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ) পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সকলের আশা ছিল, ইসলামের সাম্য ও ন্যায়ের শিক্ষার আলোকে একটি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে কারো উপর জুলুম-অত্যাচার হবে না, সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহর আইন

বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনকারীগণ হতাশ হয়েছেন। কারণ পাকিস্তানী শাসকরা তাদের কথা রাখেননি। ইসলামী আইন, সমাজ ব্যবস্থা বা ইসলামের সুষম অর্থ ব্যবস্থার কোনোটিই তারা বাস্তবায়ন করেননি। পূর্ব পাকিস্তান (এখনকার বাংলাদেশ) সবচেয়ে বড় প্রদেশ হয়েও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। এর পরবর্তী ইতিহাস কম- বেশি সকলেরই জানা।

মোটকথা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দ্বি-খন্ডিত হয়েছে। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরেকটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ব্যাপক গণজাগরণের মধ্য দিয়ে এ দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমাদের অনেক সম্ভাবনা ছিল। সুযোগ ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার, যা বহু ভাষা ও বিবিধ সংস্কৃতির ফলে পাকিস্তানের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু বিজয়ের ৪২তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে এসেও এ দেশের মানুষ সুখে নেই। এখনো একই দিনে শিল্পকারখানায় আগুন লেগে ও নির্মাণাধীন উড়াল সেতু ভেঙ্গে প্রাণ হারায় অসংখ্য নিরাপরাধ বনী আদম। সঠিক নিরাপত্তা ও ইনসাফ এখনও সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে। এ বেহাল দশা থেকে যদি আমরা নিজেদেরকে মুক্তি না দিতে পারি তবে আমাদের বিজয় সার্থক হবে কীভাবে। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকরা নিজেদের মর্জি-খুশি মোতাবেক রাষ্ট্র চালিয়েছে, বিদেশীদের উপর নির্ভর করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। ফলাফল স্বরূপ রাষ্ট্রের অর্ধেক তারা হাতছাড়া করেছে।  তাই আমাদের এখন অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, আমরা কোন পথে হাঁটছি এবং সেটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব ও জনগণের অনুকূলে কি না? গণপ্রত্যাশা, ইতিবাচকতা ও নানামুখি উৎপীড়ণমুক্তির ন্যায়ানুগ পথে হাঁটা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।

আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করুন, এদেশের শাসকদের সুমতি দান করুন, ইসলামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জনগণের কল্যাণে ইতিবাচক কাজ করার তাওফীক দিন। শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়পরায়ণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বিজয়ের মাসে গণমানুষের এটিই প্রত্যাশা। ষ

 

 

advertisement