যিলহজ্ব ১৪৩৩   ||   নভেম্বর ২০১২

মওত ও জানাযা : বাণী ও বার্তা

মাওলানা ইমদাদুল হক

মৃত্যু মানে ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী জগৎ থেকে বৃহৎ চিরস্থায়ী জগতে পাড়ি জমানো, যেখান থেকে  কেউ কখনো ফিরে আসে না। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ তার প্রকৃত গন্তব্যের দিকে যাত্রা করে। তার এই যাত্রা গন্তব্য যেন সুখময় হয় তার কিছুক্ষণের পৃথিবীর সঙ্গী স্বজনদের এই প্রার্থনা খুবই স্বাভাবিক। ফিতরাত স্বাভাবিকতার ধর্ম ইসলাম এই প্রেরণাকে উৎসাহিত করেছে এবং প্রিয়জনের জন্য কল্যাণ-প্রার্থনার সঠিক উপায় শিক্ষা দিয়েছে। এটি ইসলামের বিশিষ্টতা।

একজন মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের যে কয়টি হক রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে, মৃত্যুর পর জানাযায় শরীক হওয়া এবং সম্ভব হলে দাফনকার্যেও অংশগ্রহণ করা।

হক আদায়ের দ্বারা যেমন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিচয় দেওয়া হয় তেমনি অনেক সওয়াবও পাওয়া যায়। তো আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, তিনিই বান্দাকে তার কর্তব্য সমাধার উপায় শিখিয়েছেন আবার এর কারণে অশেষ সওয়াবও ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সকল দয়া মেহেরবানীর মর্যাদা রক্ষার তাওফীক দান করুন। আমীন।

স্বজনের মৃত্যুতে মানুষের চোখে অশ্রু ঝরে, প্রিয়জন আপনজনের বিয়োগব্যথা মানুষ সইতে পারে না। যে ভাইটি-বোনটি এত প্রিয় ছিল, উচ্ছ্বাস-উচ্ছলতায় সকল শূন্যতা পূর্ণ করে রাখত, যে আববা-আম্মা এত আপন ছিলেন, মমতার শীতল ছায়ায় বেষ্টন করে রেখেছিলেন; যে পুত্র-কন্যা কলিজার টুকরা ছিল, যাদের দেখলে, যাদের কথা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যেত; যে জীবনসঙ্গী ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয়জন, যাঁর সঙ্গ পৃথিবীর সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলার শক্তি যোগাত, হঠাৎ তার সকল বন্ধন ছিন্ন করা চিরবিদায়ের শোক কীভাবে মানুষ সইতে পারে; তাই মানুষের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে, তার হৃদয় বিদীর্ণ হতে চায়। এই সংকটের মুহূর্তেও ইসলাম থাকে মানুষের পাশে। ইসলামের নির্দেশনা মানুষকে শক্তি যোগায় সংযত থাকার।

এখানে আরেকটি দিকও আছে যে দিক নিয়ে চিন্তা করা দরকার। মৃত্যু মানে তো শুধু পরপারে পাড়ি জমানো নয়, মৃত্যু মানে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আজ যার মৃত্যু হল, এতদিন সে পৃথিবীতে স্বাধীন ছিল। যখন যা ইচ্ছা করার শক্তি ছিল, ন্যায়-অন্যায়, ফরমাবরদারী-নাফরমানী সবকিছুর সমান ক্ষমতা ছিল। সে কি আল্লাহর পূর্ণ ফরমাবরদার ছিল, না অনেক নাফরমানীও তার দ্বারা হয়েছে? প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে গুনাহর কাজ হয়েছে? আজ আল্লাহ তাকে ডাক দিয়েছেন হিসাবের জন্য। ডাকে সাড়া না দেওয়ার উপায় নেই। স্বজন-প্রিয়জনদের সাধ্য নেই, তাকে কোথাও লুকিয়ে রাখে।

আজ তাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এখন তাকে কবরে নামানো হবে, ফেরেশতারা আসবে, তাকে প্রশ্ন করা হবে- তোমার রব কে, তোমার দ্বীন কী এবং যিনি তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? তার গোটা জীবনের কর্মই হবে এইসব প্রশ্নের জবাব। সে কি সারা জীবন ঈমানের উপর ছিল? সুন্নতের উপর ছিল? ইসলামের ফরয বিধান নামায, রোযা, হজ্জ-যাকাত, পর্দা-পুশিদা, লেনদেন, সততা, অন্যের হক আদায় ইত্যাদি কি তার দ্বারা পালিত হয়েছে?

এখন আল্লাহ যদি নিজ ক্ষমা করুণার ছায়ায় তাকে আবৃত করেন তবেই সে রক্ষা পাবে, অন্যথায় কী হবে তার অবস্থা? আল্লাহর ফয়সালা থেকে তো পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই, মুক্তি পাওয়ারও উপায় নেই, যতদিন না মালিক নিজ দয়ায় মুক্তি দান করেন। পৃথিবীতে মা-বাবার জন্য, ছেলে-মেয়ের জন্য, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য আমাদের কতই না মায়া-মমতা, প্রীতি-ভালবাসা, তাদের কষ্ট আমাদের কষ্ট, তাদের আনন্দ আমাদেরই আনন্দ। আজ সেই প্রিয়জনকেই দাঁড় করানো হচ্ছে বিচারের কাঠগড়ায়। কী হবে রায়? মুক্তির না শাস্তির? তার কবর কি হবে বেহেশতের বিছানা, না আগুনের গহবর? স্বজন-হারানোর বেদনার চেয়েও এই প্রশ্নগুলোই তো আমাদের কাছে বড় হওয়া উচিৎ। তাহলে আমরা শোকে আত্মহারা হওয়ার পরিবর্তে স্বজনের কিছু উপকার-চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে পারব।

সাহাবা-তাবেয়ীন, সালাফে সালেহীন এবং সবযুগের খোদাভীরু ব্যক্তিরা যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যুসংবাদ শুনতেন, কারো জানাযায় শরীক হতেন তখন তাদের সামনে এই দিকটিই বড় হত। সাথে সাথে তারা নিজেদের জন্যও শিক্ষা নিতেন। কারণ সকলেই তো পথের পথিক, সবাইকে একদিন কর্মের জীবন শেষে প্রতিদানের জীবনে প্রবেশ করতে হবে। সবাইকে দাঁড়াতে হবে বিচারের কাঠগড়ায়। ব্যবধান শুধু এই যে, কারো ডাক আগে আসে, কারো ডাক পরে।

আমাকেও তো একদিন গোসল দেওয়া হবে, কাফন পরানো হবে। আমারও তো জানাযা হবে, দাফন হবে। অন্ধকার কবরে আমাকেও তো ঈমানের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আমারও কবরে ফেরেশতা আসবে, জান্নাত-জাহান্নাম আমারও সামনে তুলে ধরা হবে। হায়! সেদিন আমার কী অবস্থা হবে?

তাই তো দয়ার নবী পূর্ব থেকে সতর্ক করে  বলেছেন-

عودوا المرضى وأتبعوا الجنائز يذكركم الآخرة

তোমরা রোগীদের দেখতে যাও এবং জানাযার পিছনে পিছনে গমন কর। এটা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।-মুসনাদে আহমদ /২৩, হাদীস : ১১১৮০

সাহাবা-তাবেয়ীন কোনো মৃতকে দেখলে, কারো জানাযায় শরীক হলে মৃত্যু মৃতের চিন্তা তাদের উপর এমনই প্রভাব ফেলত যে, অনেকদিন পর্যন্ত তাদের চেহারায় তা দৃশ্যমান থাকত।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বর্ণনা করেন

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا شهد جنازة رؤيت كآبة وأكثر حديث النفس.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কেনো জানাযায় হাজির হতেন তখন পেরেশানী বিষণ্ণতা তাঁকে আচ্ছন্ন করত এবং তিনি খুব বেশি চিন্তামগ্ন হয়ে যেতেন।-আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ১১১

হযরত আব্দুল আযীয ইবনে আবি রাওয়াদ বর্ণনা করেন :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো জানাযায় শরীক হতেন তখন খুব নিশ্চুপ থাকতেন এবং চিন্তায় ডুবে যেতেন।

বর্ণনাকারী বলেন : সাহাবায়ে কেরাম মনে করতেন, তিনি এসময় মৃতকে নিয়ে ভাবতেন-সে এখন কী-পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে এবং কী তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।-কিতাবুয যুহদ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক পৃ. ১০৭

একবার হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. হযরত আলী রা. কে জানাযা সংক্রান্ত বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত আলী রা. বললেন, আবু সায়ীদ, যখন আপনি আপনার মুসিলম ভাইয়ের জানাযার সাথে চলবেন তখন নিশ্চুপ থাকুন, এবং মনে মনে ভাবুন আপনার অবস্থাও তার মতো হয়েছে। সে ছিল আপনারই ভাই, যে আপনার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। আজ সে  নিঃস্ব-বিপর্যস্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে, নেক আমল ছাড়া আজ তার কোনো পুঁজি নেই।-মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ৮৩৯

হযরত অয়েশা রা. বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উসাইদ ইবনে হুযায়র রা. এর একটি বাণী বর্ণনা করেন : উসাইদ ইবনে হুযায়র ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন। তিনি বলেন : তিনটি সময়ে আমার যে অবস্থা হয় যদি সর্বদা অবস্থায় থাকতে পারতাম তাহলে নিশ্চিত হতাম যে, আমি একজন জান্নাতী মানুষ। যখন আমি কুরআন তেলাওয়াত করি বা কারো তেলাওয়াত শুনি; যখন আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়ান শুনি আর যখন কারো জানাযার নামাযে উপস্থিত হই। যখনই আমি কারো জানাযার নামাযে উপস্থিত হয়েছি তখন ভাবনাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, এখন এই মৃতের পরিণাম কী হবে এবং তার সাথে কী আচরণ করা হবে।-কিতাবুয যুহদ পৃ. ১০৭

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত মুতাররিফ ইবনে শিখখীর সম্পর্কে হযরত বুদাইল রাহ. বলেন, হযরত মুতাররিফ রাহ. জানাযায় গেলে এতই চিন্তামগ্ন থাকতেন যে, সেখানে ঘনিষ্ঠ কারো সাথে সাক্ষাৎ হলেও শুধু সালাম দিতেন এবং নিজের চিন্তায় ডুবে যেতেন।-কিতাবুয যুহদ পৃ. ১০৮

বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, তারা অর্থাৎ সাহাবা কেরাম এবং প্রবীণ তায়েবীগণ জানাযায় শরীক হলে কয়েকদিন পর্যন্ত  চিন্তাগ্রস্ত থাকতেন যা তাদের মাঝে দৃশ্যমান থাকত।

ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর কিতাবুয যুহদ- একটি অধ্যায় আছে, যার শিরোনাম

باب التفكر في اتباع الجنائز

 (জানাযার অনুসরণের সময় চিন্তা করা) তাঁর এক ছাত্র নুআইম   রাহ বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক যখন অধ্যায়টি পড়াতেন তখন তার এমন অবস্থা হত যে, আমরা কেউ তার কাছে যেতে পারতাম না, তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসাও করা যেত না, তিনি এমন ছটফট করতেন যেমন সদ্য জবাইকৃত গরু ছটফট করে।-কিতাবুয যুহদ (টিকা) পৃ. ১০৭

আপাতত কয়েকটি হাদীস-আসার উল্লেখ করেই বিষয়টির ইতি টানছি। এগুলো থেকেই সালাফের অবস্থা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে উঠে।

কিন্তু আমাদের অবস্থা এর বিপরীত। মৃতকে সামনে নিয়ে হৈচৈ, তর্ক-বিতর্ক, গীবত-শেকায়েতেও লিপ্ত হয়ে পড়ি।

অথচ আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য মৃত্যুর চেয়ে অধিক কার্যকরী আর কোনো বিষয় নেই। আল্লাহ আমাদের হৃদয় মস্তিষ্ককে জীবন্ত করে দিন এবং তাঁর খাঁটি বান্দাদের অনুসরণের তাওফীক আমাদেরকে দান করুন। আমীন। ইয়া রাববুল আলামীন।

 

 

advertisement