শাওয়াল ১৪৩৩   ||   সেপ্টেম্বর ২০১২

দা ঙ্গা : কাগুজে সাধুর কদাকার হৃদয়

ওয়ারিস রব্বানী

ভারতের আসাম রাজ্যে গত জুলাইয়ের শেষ দিকে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তখন রমজান মাসের শুরু। আসামের বোড়ো সম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে। মুসলিম অধ্যুষিত বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে শতাধিক লোক নিহত ও কয়েক লাখ লোক হয় ঘরহারা। এদের বেশিরভাগই মুসলিম। জীবন বাঁচাতে দাঙ্গাকবলিত এলাকার অনেকেই ত্রাণশিবিরে এসে আশ্রয় নেয়। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, আসামের চারটি জেলায় এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকদিন পর্যন্ত বোড়ো উগ্রপন্থীদের আক্রমণ চললেও রাজ্যপ্রশাসন দাঙ্গা বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর  খামখেয়ালিপনা নিয়েও গণমাধ্যমগুলো প্রশ্ন তুলেছে। এ পর্যায়ে গত ২৮ জুলাই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসামের দাঙ্গাকবলিত এলাকায় যান। সেখানে তিনি বলেন, এ দাঙ্গা ভারতের জন্য কলঙ্কজনক। দাঙ্গায় নিহত ও তিগ্রস্তদের জন্য ৩০০ কোটি রুপি অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দেন। শেষ খবর পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা। এ নীতি কতোটা কাগুজে আর কতটা বাস্তব -গত ৬৫ বছরে সেটা বিরাটভাবেই ধরা পড়েছে। সেজন্যই আসামের এ ঘটনাকে ভারতের জন্য নতুন কোনো কলঙ্কের ঘটনা বলে উল্লেখ করার প্রয়োজন আসলে পড়ে না। এ রকম কলঙ্ক ভারতের গায়ে অনেক। তারপরও ভারতীয় ধর্মনিরপেতা নিয়ে এ দেশের কিছু কূপমন্ডুক সব সময় গলা চড়িয়ে কথা বলে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের জন্য ভারতের মাহাত্ম গেয়ে যায়। অথচ এই ভারতেই বার বার গুজরাটের মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববাসী জানে, মোদীর মতো কসাইদের পিঠ চাপড়ানি পেয়েই সব সময় হিংস্র সাম্প্রদায়িক হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরাও দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের সহযোগীর ভূমিকা নিয়ে নেমে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক কালের আসাম রাজ্যের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাটিও অনেক বেশি উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। কারণ ভারতের দাঙ্গা মানেই দাঙ্গাবাজ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিলিত হিংস্রতা।

আসাম ভারতের একটি বড় প্রদেশ। বহু মুসলিম এ রাজ্যে বসবাস করেন। আসামের প্রদেশিক পরিষদে বহু মুসলিম সদস্য, এমনকি ইসলামী দলের সদস্যও রয়েছেন। সেখানে এ জাতীয় ঘটনা সাম্প্রদায়িক ভারতের নতুন কোনো উগ্রতা বা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে সংখ্যালঘুরা সেখানে বার বার আক্রান্ত হচ্ছে। বিপন্ন, বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হচ্ছে। শয়ে শয়ে, হাজার হাজারে, লাখে লাখে। দাঙ্গা লাগলে দেশি অস্ত্র-শস্ত্রের পাশাপাশি ভারতে ব্যবহার করা হয় গুলি, বোমা ও আগুনের সর্বধ্বংসী অস্ত্র। আর মেয়েদেরকে ব্যপক ও করুণ নিগ্রহের শিকার বানানো হয়। পরবর্তীতে সেসব ঘটনার কোনো বিচারও হয় না। নিকট অতীতে নববই দশকের গোড়ায় বাবরী মসজিদ শাহাদাতের ঘটনার সময় আর এর পর গুজরাটের আহমাদাবাদের দাঙ্গায় উত্তর প্রদেশসহ গোটা ভারতের মুসলমানদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলা হয়েছিল। আশির দশকের গোড়ায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর কলকাতাসহ পুরো ভারতজুড়ে শিখ হত্যার নারকীয় উৎসব চলেছে বেশ কিছু দিন। গত বিজেপির শাসনামলে বিভিন্ন রাজ্যে খ্রিস্টানদের গির্জায় হামলা চালানো হয়। হত্যা করা হয় কয়েকজন পাদ্রীকে। ভারতের প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানরা তো হরহামেশাই আক্রান্ত হচ্ছেন। অপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোও শিকার হচ্ছে নানা হামলার।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের চেহারাটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক ও হিংসাদুষ্ট চেহারা। কারণ সেদেশে হিংস্র দাঙ্গাবাজরা একটি শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ নয়, আইনশৃঙ্খলার লোক, রাজনীতির নেতা, মিডিয়ার কর্তা ও সুশীলদের বড় অংশই দাঙ্গাবাজদের সহযোগী হিসেবে সেখানে ভূমিকা রাখে অকপটে। এতে দাঙ্গার আগুন তীব্রতর হয় আর সবকিছু সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার কারণে বিচার ও প্রতিকারহীন থেকে যায়।

আসামের দাঙ্গার সময় ওই সংঘবদ্ধ সম্প্রদায়িকতার ভয়টাই বড় হয়ে ওঠেছে। আরেকটি দাঙ্গার মধ্য দিয়ে কাগুজে সাধুর কদাকার হৃদয়টা যদি আবারও প্রকাশ হয়ে যায় তাহলে না জানি কত মানুষের, কত মুসলিমের জীবন বিনাশ হয়। আল্লাহ তার বিশ্বাসী বান্দাদের হেফাযত করুন। 

 

 

advertisement