শাওয়াল ১৪৩০   ||   অক্টোবর ২০০৯

মতলবী বুদ্ধিজীবীরা সরব: পাকিস্তান পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কী মিল?

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

একসময় দু’টি দেশ এক সঙ্গে থাকলেও আজ দেশ দু’টি স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আটত্রিশ বছর আগেই স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতার এই ফয়সালা সম্পন্ন হয়ে গেছে। তারপরও দেশ দু’টি মুসলিম প্রধান হওয়ার কারণে এবং গণকালচার ও ধর্মানুভূতিগত সাজুয্য থাকার কারণে অনেকেই দু’ দেশের মাঝে যেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্যগত মিল পেতেন তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভ্রাতৃত্বের একটি সম্পর্কের আবহও অনুভব করে আসতেন। সে দেশ দু’টির একটি হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং অপরটি হচ্ছে পাকিস-ান। কিন' এদেশের একটি বুদ্ধিজীবী মহল এ ধরনের মিল ও সামঞ্জস্যকে বরাবর সাংঘাতিক বিতৃষ্ণা ও বিরক্তির চোখে দেখে আসছেন। এ দু’টি মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে কোনো পর্যায়েই কোনো সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্য থাকা উচিত নয় বলে উঁচু গলায় সরব রয়েছেন। কিন' সেই মহলটিই অতি সমপ্রতি এ দেশ দু’টির মাঝে আবার একটি সাজুয্য খুঁজে বের করার প্রাণান-কর চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। সাজুয্যের সে ক্ষেত্রটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ, মাদরাসা শিক্ষা এবং রাষ্ট্রের অকার্যকর হয়ে যাওয়া। পাকিস-ানের বিরাজমান ঝঞ্জা ও দ্বন্দ্বমুখর পরিসি'তির সঙ্গে তারা নানা কল্পিত ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশকেও একই পর্যায়ের ও শ্রেণীভুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। নেতিবাচক সূত্রের গন্ধ পাওয়ায় তারাই এখন দেশ দু’টির মাঝে মিল ও সর্বনাশের সমমাত্রা হাতরে বেড়াচ্ছেন। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টক শো এবং বিভিন্ন এলিটমঞ্চে তারা এই যোগসূত্রের সন্ধান দিতে চেষ্টা করছেন। বদ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এসব তত্ত্ব পরিবেশন ও প্রচারণার পেছনে আসলে বাস-বতা কতটুকু তা খুঁজে দেখার ফুরসতও তারা পাচ্ছেন না। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে যে, দু’টি দেশের মাঝে অন-ত এই ক্ষেত্রটিতে মিল বিশেষ নেই। রাশিয়া বিরোধী দীর্ঘ আফগানিস-ান যুদ্ধের পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস-ান। আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলা আফগানিস-ানে যুগব্যাপি সশস্ত্র সংগ্রামের একটি পটভূমি রচিত হয়েছে। প্রতিরোধ যুদ্ধের সঙ্গে একপর্যায়ে জড়িত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও। এর আঁচ পাকিস-ানেও পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সাহায্যকারীর ভূমিকায় পাকিস-ান ও আফগানিস-ান উভয় দেশেই ভূমিকা রেখেছে। মিডিয়াগুলোতে তা যথারীতি প্রচারিত হয়েছে। কিন' নতুন শতাব্দীতে যখন আমেরিকা স্বার্থ ও হিসাবের দ্বন্দ্বে আফগানিস-ানের ওপর আঘাত শুরু করল তখন সব কিছুই উল্টে গেল। আফগানিস-ানের সে যুগের প্রতিরোধ যুদ্ধের সমর্থকরা সবাই ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা পেতে লাগল। এরও জের পড়ল পাকিস-ানে। আফগান নিকটবর্তী ও সীমান-বর্তী অঞ্চলগুলোতে এটি বেশি পরিমাণে ঘটল। গত বছর থেকে শুরু হল চালকবিহীন বিমান হামলা ওয়াজিরিস-ান, সোয়াতসহ বিভিন্ন সীমান-বর্তী অঞ্চলে। মার্কিনীদের ভাষায় সন্ত্রাসীদের ‘নিধন’ করতেই তারা এ ব্যবস'া নিয়েছে। পাকিস-ানের নতুন সরকার এসে এ লড়াইয়ে পুরোদস'র পাক আর্মিকেও নামিয়ে দিল। এখন মূলত পাকিস-ানের কয়েকটি সীমান-বর্তী অঞ্চলে যুদ্ধই চলছে। একদিকে চালকবিহীন মার্কিন বিমান আর সশস্ত্র পাক আর্মি, অপরদিকে আফগানিস-ানে মার্কিন আগ্রাসন বিরোধী বিপ্লবের সমর্থক গোষ্ঠী। আনর্-জাতিক মিডিয়ার ভাষায় ‘সন্ত্রাসী’। আফগানিস-ানের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে, এখন তা চলছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। পাকিস-ানের ভেতর থেকে সহযোগিতা গিয়েছিল রাশিয়া বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামে, এখন তা যাচ্ছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। আগে তারা ‘মুজাহেদীন’ ছিলেন বিশ্বমিডিয়ায়, এখন তারা ‘সন্ত্রাসী’। এর পেছনের কার্যকারণ, সূত্র ও ব্যাখ্যা খুঁজলে অনেক রকম তামাশার সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন' সেদিকে না গিয়েও যে কথাটি অকপটে বলা যায়, সেটি হল, এটি হচ্ছে আফগানিস-ান আর পাকিস-ান নামক দু’টি দেশের বিষয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী? মতলবী বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াবিদরা এর যে সম্পর্ক এখন বের করছেন, তা হল পাকিস-ান থেকে যারা আফগান বিপ্লবকে সমর্থন করেছেন তারা বেশির ভাগ গিয়েছেন মাদরাসা কিংবা মাদরাসা ঘরানা থেকে। ওই দেশে আলিয়া মাদরাসা নেই, সবই কওমী মাদরাসা। যেহেতু বাংলাদেশে কওমী মাদরাসা বিদ্যমান, তাই এখানেও সশস্ত্র সংগ্রাম ও ‘সন্ত্রাসী’ সৃষ্টি হওয়ার মতো ‘উর্বর’ পরিবেশ বিদ্যমান। সুতরাং পাকিস-ান পরিসি'তির সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ‘অপূর্ব মিল’ রয়েছে এবং এজন্য এখন থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস'া নেওয়া উচিত। এজন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও গ্রনে'রও উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে। কওমী মাদরাসা নিয়ে বিষোদগারের বন্যা ছুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই গত কিছুদিন আগে এক সাবেক রাষ্ট্রদূতের মুখে বাংলাদেশ আর্মিতে কওমী মাদরাসা ছাত্রতত্ত্ব, এক মন্ত্রীর মুখে কওমী মাদরাসাকে জঙ্গি প্রজণনকেন্দ্র আখ্যা দান এবং বহুজাতিক কোম্পানির পয়সায় চলা মিডিয়াগুলোতে কওমী মাদরাসাগুলোকে ‘জঙ্গিকেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নায়নের মহড়া চলেছে। অথচ তাদের এটা ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, গত দু-চার বছর ধরে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার নামে দেশের কোনো কোনো স'ানে বোমাবাজির যে ক’টি ঘটনা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে কওমী মাদরাসা ঘরানার লোকেরাই সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছেন। বিভ্রান- ও ভুল ব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে যারা মানুষ হত্যা করে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার পথে নেমেছে তাদের সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির কাজটিও এদেশের মাদরাসাগুলো এবং এর কর্ণধাররা করেছেন। এখানে আফগানিস-ানের তাপ বা জের লাগার মতো কোনো ব্যাপার ঘটেনি। এরপরও যারা পাকিস-ানের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল খুঁজে গলদঘর্ম হচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে? সাদা চিন-া নিয়ে এর উত্তর খুঁজলে দেখা যায়-তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, মাদরাসাগুলো বন্ধের ব্যবস'া করা, ইসলামী শিক্ষা থেকে এদেশের এ প্রজন্মের তরুণদের বঞ্চিত করা এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণকে সন্দেহভাজন নাগরিক শ্রেণীতে পরিণত করা। আগ্রাসী বিদেশী সৈন্যশক্তিকে দেশের ভেতর আহ্বান করা আর চালকবিহীন বিমান দিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় স'াপত্য ও ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াও তাদের লক্ষ্য হতে পারে। সর্বোপরি তারা যেটা চাইতে পারেন সেটি হচ্ছে এদেশের আর্মিকে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া। যেটা এখন পাকিস-ানে হচ্ছে। এদেশের মাদরাসাগুলো ও আলেমসমাজকে ‘সন্ত্রাসের’ পক্ষ শক্তি সাব্যস- করে প্রচারণা চালাতে থাকলে এছাড়া অন্য কিছু ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী নকশা অনুযায়ী-অনেকে যেমন মনে করেন-অচিরেই বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও আধা উন্নত মুসলিম দেশগুলোতে আর্মি এবং ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র রক্ষাকামী মূল ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মাঝে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দেওয়া হতে পারে। পাকিস-ানে এটা সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে কি এসব বুদ্ধিজীবীরা সেদিকেই নিতে চাচ্ছেন? তারা কি মনে করেন তাহলেই তারা নিরাপদ হয়ে যাবেন? সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা যদি কোনো জনপদে নেমে আসে সেখানে সবাই কিন' আজকের ‘বাগদাদ কিংবা ওয়াজিরিস-ানের বাসিন্দাদের’ মতো অনিরাপদই হয়ে যাবেন এই তেতো সত্যটা তাদের বুঝা উচিত। ্তাদের এসব প্রচারণার পেছনে যদি সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধন থেকে থাকে তাহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। সেটি হচ্ছে, যারা পেছন থেকে আপনাদের দিয়ে মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষা বিরোধী আতংক ছড়ানোর কাজ করছে তারাই যে, বেশধারী ‘সন্ত্রাসীদের’ দিয়ে আপনাদের মতো প্রগতিশীলদের মাথায় বাড়ি দিয়ে ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করবে না-তার কিন' কোনো গ্যারান্টি নেই। একটি স্বাধীন দেশকে অসি'তিশীল করার জন্য, সে দেশে ঢুকে লুটপাট করার জন্য তাদের দরকার ‘ছুতা’। সে ‘ছুতা’ তৈরির একটি পর্ব তারা আপনাদের হাত দিয়ে করালেও আরেকটি পর্বের দায়িত্ব তাদের দিতে হবে ‘মেইড’ সন্ত্রাসীদের, যারা ঘটনা ঘটালে মিডিয়া সক্রিয় হবে, ইস্যু তৈরি হবে এবং মতলব হাসিল হবে। সুতরাং দেশটাকে বিপদজনক অবস'ায় নেওয়ার খেলায় নেমে আজকে হঠাৎ করে পাকিস-ানের সঙ্গে বাংলাদেশকে মিলিয়ে দেখতে আগ্রহী না হওয়া সমীচীন। এ পর্যায়ে গত দু’বছরের পাকিস-ানের অভ্যন-র পরিসি'তি বিশ্লেষণে একটু মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো যেতে পারে। অনেক দূরদর্শী পাকিস-ানী সাংবাদিক গত দু’বছরে লিখেছেন, পাকিস-ানের সীমান-বর্তী অঞ্চলগুলাতে ‘সন্ত্রাসীদের’ ধরার জন্যই যে কেবল মার্কিনী সমরশক্তি ব্যয় হয়েছে এমন নয়, সন্ত্রাস সৃষ্টি, বোমাবাজি ও ধ্বংসাত্মক ঘটনার পেছনেও সিআইএ, মোসাদ ও র-এর হস-ক্ষেপের আলামত পাওয়া গেছে। ভয়ংকর সব ঘটনা তারা ঘটিয়েছে পেছন থেকে। আবেগপ্রবণ সরল লোকদের অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে, ইস্যু তৈরি করেছে এবং এরপরেই বিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এখন তো পাক আর্মির সঙ্গেই যুদ্ধ চলছে স'ানে স'ানে। ইস্যুর জন্য এমন ঘটনা ‘বড়’ দেশগুলোর গোয়েন্দারা এদেশেও ঘটাতে পারে। তখন আপনি, আমি, দেশ ও জাতি কেউ আর নিরাপদ থাকবে না। সন্দেহ, আতংক আর ঝুঁকির মাঝেই সবার বসবাস লিপিবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে সবশেষে যে কথাটি বলা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে মতলবী বুদ্ধির ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বুঝে শুনেই দেশের বারোটা বাজানোর জন্য অনেক কথা ও কাজ পেশ করতে পারে। কিন' এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে এ দেশের সব পর্যায়ের প্রতিনিধিত্বশীল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের এবং সব মাদরাসা কর্তৃপক্ষের। কোনো উষ্কানি, কোনো ইস্যুতে কোথাও কেউ যেন কোনো হঠকারী পদক্ষেপ কিংবা চরম উগ্র কোনো বক্তব্যের দিকে না যান- সেদিকে সবারই লক্ষ রাখতে হবে। ষড়যন্ত্রের জাল ও ফাঁদ পাতা আছে ধরে নিয়েই সবাইকে মেপে মেপে কদম ফেলতে হবে। নিষ্ফল ও অকার্যকর কোনো উত্তেজনার কারণে কেউ যেন ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে বিজয়ের উপলক্ষ্য তুলে না দেন এ বিষয়ে ইসলামপ্রেমী মানুষের পরিপূর্ণ সতর্কতার আসলে কোনো বিকল্প নেই। ষড়যন্ত্র ও চক্রানে-র ধরনের তো অভাব থাকবে না, কিন' সতর্কতা বজায় রাখলে ইনশাআল্লাহ দৃশ্যমান মতলবী এবং পর্দার আড়ালের নাটের গুরুরা হতাশ হতে বাধ্য হবে। আল্লাহ চাহে তো পাকিস-ান পরিসি'তির সঙ্গে বাংলাদেশকে মিলিয়ে দেখার স্বপ্ন সাধ পুরো হবে না। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করি, আমাদের জন্মভূমি এই মুসলিম রাষ্ট্রটির হেফাযত ও উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান যুদ্ধমান অবস'া থেকে অপর মুসলিম দেশ পাকিস-ানেরও উত্তরণ ঘটুক। আল্লাহ তাআলা পাকিস-ানসহ শত্রুশক্তির ষড়যন্ত্র ও হামলার শিকার প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রকে হেফাযত করুন এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক ও নেতৃত্বের মাঝে ইসলামী আত্মমর্যাদা ও চেতনা এবং ঈমানী প্রেরণা ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধ দান করুন।

 

advertisement