সুন্নাহসম্মত নামায : কিছু মৌলিক কথা-৫
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমরা সবাই জানি যে, সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন ইসলামী শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। যে শহরে যে সাহাবী অবস্থান করছিলেন তার নিকট থেকেই ওই শহরের অধিবাসীরা দ্বীন ও ঈমান, কিতাব ও সুন্নাহর ইলম অর্জন করেছেন। ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি ও জীবনযাপনের আহকাম ও বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছেন। যেসব অঞ্চলে ইসলাম সাহাবায়ে কেরামের পরে প্রবেশ করেছে কিংবা ইসলামের ব্যাপক প্রচার সাহাবায়ে কেরামের পরে হয়েছে সেখানকার লোকেরা তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনের কাছ থেকে এই বিষয়গুলো শিখেছেন। কিংবা ওই সব দায়ী ইলাল্লাহ, মুজাহিদীন ও মুয়াল্লিমীনের কাছ থেকে, যাদের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে ইসলামের প্রচার প্রসার হয়েছে।
শরীয়তের অনেক বিধিবিধানের মধ্যে যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের যুগেই মতভেদ হয়েছে, যা ধারাপরম্পরায় পরবর্তীতেও বিদ্যমান ছিল তাই এটাই স্বাভাবিক যে, প্রত্যেক ইসলামী শহরে নামায ইত্যাদির পদ্ধতি সম্পূর্ণ অভিন্ন হবে না। ওই বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে পূর্বের ভিন্নতা বিদ্যমান থাকবে।
এই উপমহাদেশে যেই দায়ী ইলাল্লাহ, মুজাহিদীন, মুয়াল্লিমীন ও আওলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপক প্রচার হয়েছে তারা ফিকহে হানাফী অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করতেন, ফিকহে হানাফীর সহযোগিতায় কুরআন ও সুন্নাহর বিধিবিধান পালন করতেন। এজন্য এই অঞ্চলে নামাযের ওই পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে যা ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর ফকীহ ও মুহাদ্দিস শাগরিদগণ ফিকহের গ্রন্থাদিতে সংকলন করেছেন, যার ভিত্তি হল কুরআন ও সুন্নাহ, এপর হাদীস ও আছার এবং যার ভিত্তি হল ওই ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ ব্যাপক কর্মধারা, যা ইরাকে অবস্থানকারী হাজারেরও অধিক সাহাবায়ে কেরামের সূত্রে তাঁদের কাছে পৌঁছেছিল।
যেহেতু সালাফের নীতি এই ছিল যে, যেসব মাসআলায় একাধিক পন্থা দলীল দ্বারা প্রমাণিত তাতে যে এলাকায় যে পন্থা প্রচলিত, সে এলাকার জনগণকে ওই পন্থা অনুযায়ীই আমল করতে দেওয়া উচিত, এজন্য উলামায়ে কেরাম এসব অঞ্চলে অন্য কোনো পন্থা প্রচার করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ, দ্বীনের সাধারণ রুচি ও মেযাজের সঙ্গে যাদের পরিচয় ছিল না, রেওয়ায়েতের ইলম ছিল কিন্তু তাফককুহ ফিদ্দীন পর্যাপ্ত ছিল না, তারা এই সূক্ষ্ম বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেননি। তাই তারা এক মাসনূন তরীকাকে অন্য মাসনূন তরীকার দ্বারা, এক মুবাহ তরীকাকে অন্য মুবাহ তরীকার দ্বারা এবং এক মুজতাহাদ ফীহ মতকে অন্য মুজতাহাদ ফীহ মতের দ্বারা খন্ডন করার মধ্যে ছওয়াব অন্বেষণ করেছেন। তদ্রূপ অন্য মতটিকে (যার ভিত্তিও দলীলের উপর) বাতিল বলে দেওয়াকে ছওয়াবের কাজ বলে মনে করেছেন। ফলে বিবাদ-বিসংবাদের সূত্রপাত হয়েছে যা নিশ্চিতভাবে হারাম। আর ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে, যার বিষফল আজও মুসলমানদেরকে ভুগতে হচ্ছে। অথচ আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। আমরা এই বিভিন্নতার বিষয়গুলোতে ‘ই’ এর পরিবর্তে ‘ও’ কে অবলম্বন করতে পারিনি!
যেখানে রাস্তা শুধু একটি সেখানে তো আমরা ‘ই’ বলব যেমন ‘ইসলামই আমার দ্বীন। ইসলামই হক্ক ও আল্লাহর কাছে মকবুল দ্বীন।’ ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’ অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ-এর পথই সঠিক। কিন্তু যেখানে সুন্নাহর বিভিন্নতা, মুবাহের বিভিন্নতা এবং একাধিক সম্ভাবনার অবকাশযুক্ত মুজতাহাদ ফীহ বিষয়ের প্রশ্ন সেখানে ‘ই’ অবলম্বনের কী অর্থ? এখানে তো বলতে হবে-‘ও’। অর্থাৎ এটাও সঠিক ওটাও সঠিক। কোনোটাই খেলাফে সুন্নত নয়।
আজকাল বেমক্কা ‘ই’ ব্যবহারের ব্যধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। দ্বীনের প্রচার ও সংরক্ষণের জন্য নানা অঙ্গনে খিদমতের প্রয়োজন রয়েছে। আর একথা বলাই বাহুল্য যে, কারো একার পক্ষে সব খিদমত আঞ্জাম দেওয়া কখনও সম্ভব নয়। এজন্য কর্মবন্টনের বিকল্প নেই। এতদসত্ত্বেও দেখা যায় যে, খাদিমে দ্বীনের বিভিন্ন শ্রেণী, যারা পরস্পর একে অন্যের সতীর্থ, এদেরই কমসমঝ লোকেরা নিজেদেরকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ মনে করে থাকে। আমাদের আকাবির বলতেন, ‘সতীর্থ হও, প্রতিপক্ষ হয়ো না।’ যেখানে সতীর্থতা কাম্য সেখানে যদি প্রতিপক্ষতার নীতি গ্রহণ করা হয় তবে তো বিবাদ ও বিসংবাদের সূত্রপাত ঘটবেই।
তেরো
এখান থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, হাদীস অনুযায়ী আমল করারও নির্ধারিত পন্থা রয়েছে। এই পন্থার বাইরে গেলে সেটা আর হাদীস অনুসরণ থাকে না, যা শরীয়তে কাম্য। ইত্তেবায়ে সুন্নতেরও মাসনূন পদ্ধতি রয়েছে। ওই পদ্ধতি পরিহার করে সুন্নতের অনুসরণ করতে গেলে তা একটা অসম্পূর্ণ ও সংশোধনযোগ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়।
কেউ যদি রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নত অনুযায়ী আমল করে তবে এতে অসুবিধার কী আছে? শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের লোকেরাও তো এই সুন্নত মোতাবেক আমল করে থাকেন। হারামাইনের অধিকাংশ ইমাম হাম্বলী মাযহাবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তারাও এই সুন্নতের উপর আমল করে থাকেন। কিন্তু তারা তো রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার সুন্নতকে প্রত্যাখ্যান করেন না। যারা এই সুন্নত অনুযায়ী আমল করেন তাদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হন না, তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জবাজি, লিফলেটবাজি করেন না। তারা অন্যের নামাযকে বাতিল বলা তো দূরের কথা খেলাফে সুন্নতও বলেন না। তারা হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধির উপর নির্ভর না করে ‘আহলুয যিকর’ আইম্মায়ে ফিকহের উপর নির্ভর করে থাকেন।
এখানে ওই ঘটনাটা উল্লেখ করা যায়, যা হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর মালফূযাতে রয়েছে। ঘটনার সারসংক্ষেপ এই যে, এক জায়গায় আমীন জোরে বলা নিয়ে হাঙ্গামা হয়ে গেল এবং বিষয়টা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াল। ঘটনার তদন্তের জন্য যাকে দায়িত্ব দেওয়া হল তিনি তদন্ত শেষে রিপোর্টে লিখলেন যে, ‘আমীন বিলজাহর’ অর্থাৎ আমীন জোরে বলা হাদীস শরীফে আছে এবং মুসলমানদের এক মাযহাবে তা অনুসরণ করা হয়। তদ্রূপ ‘আমীন বিছছির’ অর্থাৎ আস্তে আমীন বলাও হাদীস শরীফে এসেছে আর মুসলমানদের এক মাযহাবে তা অনুসৃত। আরেকটি হল ‘আমীন বিশশার’ অর্থাৎ হাঙ্গামা সৃষ্টির জন্য উচ্চ আওয়াজে আমীন পাঠ। এটা উপরোক্ত দুই বিষয় থেকে ভিন্ন। প্রথম দুই প্রকার অনুমোদিত হওয়া চাই আর তৃতীয়টা নিষিদ্ধ। (মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত খন্ড ১, কিসত ২, পৃষ্ঠা ২৪০-২৪১; খন্ড ২, কিসত ৫, পৃষ্ঠা ৫০৬ প্রকাশনা দেওবন্দ)
অনেকেই এই বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেন না। তারা ‘আমীন বিশশার’ ও ‘আমীন বিলজাহর’ অর্থাৎ মাসনূন তরীকার জোরে আমীন আর হাঙ্গামার জোরে আমীনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বলাবাহুল্য যে, আস্তে আমীন বলাকে ভুল বা হাদীস পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে একমাত্র নিজেদেরকে সুন্নতের অনুসারী দাবি করে উচ্চ স্বরে আমীন পাঠ করা বস্ত্তত তা ঐ আমীন বিলজাহর নয়, যা হাদীস শরীফে এসেছে এবং সালাফ যার অনুসরণ করতেন।
চৌদ্দ
ব্যক্তি ও সমাজের সংস্কার-সংশোধনের জন্য করণীয় বিষয় ছিল বেনামাযীদেরকে উৎসাহ দিয়ে নামাযী বানানো এবং অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যারা এমন সব ভুল করেন যার কারণে নামায মাকরূহ বা খেলাফে সুন্নত হয়ে যায় বরং কখনও কখনও ওয়াজিব পর্যন্ত ছুটে যায় এমন লোকদের সংশোধনের চেষ্টা করা। আমাদের পূর্বসূরীরা এদিকেই মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ওই বন্ধুদের চিন্তা ও মনোযোগের সিংহভাগ ব্যয় হয় নামাযীদেরকে বিরক্ত করার কাজে। তাদের সকল কর্মকান্ড শুধু এমন কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে যে সব বিষয়ে এ অঞ্চলের লোকেরাও সুন্নাহরই অনুসারী। যে পন্থায় তারা নামায আদায় করেন তাও শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত এবং নবীযুগ ও সাহাবা-যুগ থেকে অনুসৃত। তারা এক সুন্নাহকে ভুল সাব্যস্ত করে লোকদেরকে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন আর একে এত বড় ছওয়াবের কাজ মনে করলেন যে, এর স্বার্থে সব ধরনের বিবাদ-বিসংবাদ এবং ফিতনা-ফাসাদকে খুশির সঙ্গে মঞ্জুর করে নিলেন!
এদের ডাকে আমাদের যে সব ভাই সাড়া দিয়ে থাকেন তাদের কর্তব্য ছিল আলিমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যে, আপনাদের অনুসরণে আমরা যে নামায পড়ছি, কিছু লোক বলে, এটা হাদীস পরিপন্থী, সুন্নাহ পরিপন্থী। তাদের এইসব কথা কি ঠিক? কিন্তু অনেক সরলমনা বা অতিউৎসাহী মানুষ কোনোরূপ অনুসন্ধান না করেই তাদের দাওয়াত গ্রহণ করে নেন। তারা নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করতে আরম্ভ করেন, আস্তে আমীন বলা ছেড়ে জোরে আমীন বলতে থাকেন। বিষয়টা শুধু এই পর্যন্ত সীমিত থাকলে বলার কিছু ছিল না। কেননা এগুলোও মাসনূন বা মোবাহ তরীকা। কিন্তু তারা আমল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু অদ্ভুত ধ্যান-ধারণা ও কাজ কর্মও আরম্ভ করেন।
তারা রফয়ে ইয়াদাইন এজন্য আরম্ভ করেননি যে, এটাও মাসনূন বা মোবাহ; বরং তারা মনে করেন যে, এটাই সুন্নাহ এবং রফয়ে ইয়াদাইন না করা সুন্নাহর পরিপন্থী। এতদিন তারা সুন্নাহ বিরোধী কাজ করে এসেছেন এবং এখন যারা রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়া নামায পড়ছে তারা সুন্নাহবিরোধী কাজই করে চলেছেন। অতএব তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া এবং প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে ‘জিহাদ’ করা জরুরি! এমনকি তারা এই ধারণাও পোষণ করেন যে, নাউযুবিল্লাহ, এ অঞ্চলের আলিমরা হয়তো কুরআন-হাদীসের কোনো জ্ঞান রাখে না কিংবা মাযহাবকে হাদীসের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে!
বলাবাহুল্য, এই কুধারণা তাদের দ্বারা নিন্দা-সমালোচনা, কটুবাক্য ব্যবহার এমনকি গালিগালাজ পর্যন্ত করিয়ে ছাড়ে। ফিকহ-ফুকাহা ও আইম্মায়ে দ্বীনের অনুসারীদের সম্পর্কে কটুবাক্য, গালিগালাজ এবং তাদেরকে গোমরাহ-ফাসিক এমনকি কাফের পর্যন্ত আখ্যা দেওয়াও গোপন কোনো বিষয় নয়।
দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত বন্ধুরাই এই সব ভ্রান্ত ধারণা গ্রহণ এবং এই ভুল পথ অবলম্বনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী। হাদীসের দু’চারটি কিতাবের অনুবাদ পড়ে তারা ভাবতে থাকেন যে, তারা হাদীস ও সুন্নাহর সুপন্ডিত হয়ে গেছেন। অতএব গবেষণার যোগ্যতাও তাদের অর্জিত হয়েছে এবং অন্যদেরকে অজ্ঞ ও জাহিল আখ্যা দেওয়ারও অধিকার তারা অর্জন করেছেন। তারা যদি শুধু এটুকুও চিন্তা করতেন যে, আমি সম্পূর্ণরূপে অনুবাদের উপর নির্ভর করছি। আমার তো এটুকুও বোঝার যোগ্যতা নেই যে, এই অনুবাদটা যিনি করেছেন তিনি কি সঠিক করেছেন না ভুল করেছেন। আর যেসব কিতাবের অনুবাদ হয়নি সেসব কিতাবের হাদীস সম্পর্কে আমার কীইবা জানা আছে। অনুদিত গ্রন্থগুলোও কি আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেছি? এক বিষয়ের সকল তথ্য কি সংগ্রহ করেছি? সংগ্রহ করলেও শুধু সেগুলোর তরজমা জানাই কি সঠিক বিষয় অনুধাবন ও আমলের জন্য যথেষ্ট?
যেখানে বিভিন্ন ধরনের দলীল রয়েছে সেখানে আমলের আগে কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করে আসতে হয়, যা শুধু ইজতিহাদ ও তাফাক্কুহ-র মাধ্যমেই অতিক্রম করা সম্ভব। ওই সব ক্ষেত্রে ফকীহ ও মুজতাহিদের সহযোগিতা গ্রহণ না করার অর্থই হল, বিষয়গুলো যাচ্ছেতাইভাবে ও নীতিহীনভাবে অতিক্রম করতেই তিনি আগ্রহী কিংবা নিজের পছন্দের কোনো মৌলবীর তাকলীদ করে ফিকহের ইমাম ও খাইরুল কুরূনের ইমামদের যারা অনুসারী তাদের উপর আপত্তি করতে আগ্রহী।
এই ব্যক্তিদের প্রতি আমার অভিযোগ এই যে, এই অসম্পূর্ণ জানার উপর ভিত্তি করে আপনারা ‘সিদ্ধান্ত’ দেন কীভাবে? তদ্রূপ ‘তাকলীদী ইলম’ অর্থাৎ যে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আপনি সম্পূর্ণরূপে অন্যের উপর নির্ভরশীল তার ভিত্তিতে গবেষণাসুলভ বা মুজতাহিদসুলভ সিদ্ধান্ত দেন কীভাবে? আপনি এত অসংখ্য উলামা-মাশায়েখের বিপরীতে এক নতুন দাওয়াতে এত সহজে সাড়া দিয়ে দিলেন, তাদের প্রতি আপনার এত আস্থা তাহলে আজ পর্যন্ত যাদের কাছ থেকে আপনি দ্বীন শিখেছেন, কিংবা যাদেরকে দেখে আপনি নামায শিখেছেন তাদের প্রতিই বা এত মন্দ ধারণা কেন?
তাদের মধ্যে কি এটুকু ঈমানী জযবাও নেই যতটুকু আপনার মধ্যে আছে? এতটুকুও নবীপ্রেম নেই যতটুকু আপনার মনে আছে?!
আপনি কি কখনও তাদের কাছে নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের দলীল জানার চেষ্টা করেছেন, যাকে আপনি ভুল ঘোষণা দিচ্ছেন?
একবার আমার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ফোন করলেন। তিনি মূলত জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ কিন্তু একই সঙ্গে উলামা-মাশায়েখের সোহবত-সাহচর্যও লাভ করেছেন। তিনি বললেন, অমুক (একজন জেনারেল শিক্ষিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) আসতে চান, কিছু বিষয়ের দলীল দেখার জন্য। এরপর বললেন, তিনি যদি দলীল শোনার জন্য বা দলীল জানার জন্য বলতেন তাহলেও একটা কথা ছিল কিন্তু তিনি বলেছেন, দলীল দেখতে চান!
দেখুন, তিনি তো এই দুই বাক্যের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন কিন্তু ওইসব লোকদের তো এ সম্পর্কে কোনো খবরই নেই। এরপরও সৌভাগ্য যে, দলীল দেখতে চেয়েছেন, এর আগেই যদি কোনো ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়ে দিতেন তাহলেই বা কী করার ছিল?
এই ভাইদের কাছে আমার শেষ কথা এই যে, আপনি যে প্রথম পদ্ধতিটা পরিত্যাগ করেছেন কেন পরিত্যাগ করেছেন? সেটা কি ভুল ছিল? ভুল হওয়ার দলীল কী? কিংবা উভয়টাই সঠিক? তাহলে একটা ছেড়ে অন্যটা ধরার কী অর্থ? কিংবা একটির তুলনায় অন্যটি কি অগ্রগণ্য?
প্রশ্ন হল, কীসের ভিত্তিতে আপনি এটা চিহ্নিত করলেন?
পনেরো
যদি সাধারণ মানুষের কাছে উলামা-মাশায়েখের আমলের বিপরীত কোনো দাওয়াত পৌঁছে তাহলে তাদের জন্য যা করণীয় তা এই যে, তারা পরিষ্কার বলে দিবেন যে, ভাই, আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের নিজেদের পক্ষে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়, তোমাদের কথা যদি মানতে হয় তাহলে তোমাদের উপরই নির্ভর করে মানতে হবে, সেক্ষেত্রে ওলামা-মাশায়েখের কথার উপর নির্ভর করতে অসুবিধা কী?
আর যদি এ বিষয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতেই হয় তাহলে তার পদ্ধতি এই :
১. কেউ যদি আপনাকে বলে, (উদাহরণস্বরূপ) ভাই, তুমি যে রাফয়ে ইয়াদাইন করছ না-এটা তো হাদীস বিরোধী! আপনি আদবের সঙ্গে বলুন, সব হাদীসের বিরোধী না রফয়ে ইয়াদাইন না-করারও কোনো হাদীস আছে? তারা বলবে, হ্যাঁ, হাদীস তো কিছু আছে, কিন্তু সব জয়ীফ বা ভিত্তিহীন। আপনি প্রশ্ন করুন, এটা কি আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, না হাদীস বিশারদদের ফয়সালা? এরপর সব হাদীস-বিশারদের ফয়সালা না তাদের কারো কারো? একজন ইমামও কি রফয়ে ইয়াদাইন না-করার হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেননি? যদি তার মধ্যে সততা থাকে তাহলে সে বলতে বাধ্য হবে যে, জ্বী, একাধিক ইমাম ওই হাদীসকেও সহীহ বলেছেন।
আপনি বলুন, আমার জন্য এই যথেষ্ট। যখন সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের একটি বিশিষ্ট জামাত রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার হাদীস মোতাবেক আমল করেছেন তো আপনি তার বিশেষ কোনো সনদকে জয়ীফ বললে কী আসে যায়? সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসা এবং উম্মাহর উলামা-মাশায়েখের মাঝে স্বীকৃত বিষয়কে শুধু সংশ্লিষ্ট একটি হাদীসের সনদের দুর্বলতা দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ করা কত বড় ভুল!
আর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, আপনি তাকে হিকমতের সঙ্গে কোনো বিশেষজ্ঞ আলিমের কাছে নিয়ে যাবেন, যার হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহের উপর এবং ফিকহে মুদাল্লাল ও ফিকহে মুকারানের কিতাবসমূহের উপর দৃষ্টি রয়েছে। ইনশাআল্লাহ সকল ভুল ধারণার অবসান ঘটবে এবং কটুকথা, নিন্দা-সমালোচনার ধারাও বন্ধ হয়ে যাবে। সমস্যা এই যে, আমাদের এই বন্ধুরা শুধু সাধারণ মানুষকেই ‘হেদায়েত’ করে থাকেন, আলিমদের কাছে যান না। এটা তো ঠিক না। আলিমদের কাছেই তো আগে যাওয়া উচিত। কেননা, তাদেরকেই তো ‘হেদায়েত’ করার প্রয়োজন বেশি। তারা হেদায়েত পেলে গোটা জাতির হেদায়েতের সম্ভাবনা!
ষোলো
যারা খতীব বা মুদাররিস-এর দায়িত্বে রয়েছেন কিংবা দ্বীনী বিষয়ে সাধারণ মানুষ যাদের শরণাপন্ন হয় তাদের খিদমতে আবেদন এই যে, যদিও আম মানুষ ও জেনারেল শিক্ষিত মানুষের পক্ষে দলীল ও দলীল দ্বারা দাবী প্রমাণের পদ্ধতি বোঝা কঠিন তবুও তাদেরকে এই প্রশ্ন না করাই ভালো যে, দলীল জানতে চাওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না? বরং রাহমাতান বিইবাদিল্লাহ তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করুন এবং অনুগ্রহপূর্বক তাদের কথাবার্তা-যদিও তা উল্টাসিধা হোক না কেন-শুনুন। তারা যদি দলীল জানতে চায় তাহলে অন্তত দু’একটি স্পষ্ট দলীল তাদেরকে জানিয়ে দিন। তবে এর জন্য প্রস্ত্ততির প্রয়োজন আছে। আপনাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করতে হবে এবং সকল বিষয়ের সর্বাধিক সহজ ও সবচেয়ে বিশুদ্ধ দলীল সহজভাবে উপস্থাপন করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। #