জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩০   ||   জুন ২০০৯

খাজা উসমান হারূনী রাহ.

ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সিলসিলা প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে। এসব সিলসিলার মাঝে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে চিশতিয়া সিলসিলা। এই সিলসিলার সূচনা করেছিলেন শায়খ আবু ইসহাক শামী রাহ. (মৃত্যু : ৯৪০ হিজরী)। কিন্তু সিলসিলাটিকে সুখ্যাতির চুড়ায় পৌঁছানো ও বিস্তৃতি দানের কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন হযরত খাজা মঈনুদ্দীন আজমিরী রাহ.।

এই পূত সিলসিলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কড়া হচ্ছেন হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ.। তিনি ছিলেন হযরত খাজা আজমিরী রাহ.-এর পীর ও মুর্শিদ। যদিও তিনি শুধু একবার ভারত উপমহাদেশে আগমন করে এ অঞ্চলকে ধন্য ও সম্মানিত করেছিলেন তবুও পরোক্ষভাবে তাঁর অবদান গোটা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে আছে। কেননা তাঁরই নির্দেশে খাজা আজমিরী ভারতে তাশরীফ এনেছিলেন এবং মানুষকে ইসলাহ করেছিলেন।

হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ. ছিলেন হযরত আলী রা.-এর বংশধর। এগারটি ধাপের মধ্যস্থতায় হযরত আলী রা.-এর সঙ্গে তাকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়। তার মাতৃভূমি ছিল খোরাসানের বরূন নামের একটি প্রদেশ।

প্রধম জীবন থেকেই তিনি ইবাদত-আমলের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। নয় দিনে ও এক রাতে পবিত্র কুরআন খতম করতেন। সত্তর বছর পর্যন্ত কঠিন মুজাহাদা করে জীবন কাটিয়েছেন। কখনো তৃপ্ত হয়ে খানাও খাননি, পানিও পান করেননি।

তাঁর দুআ সব সময় কবুল হয়ে যেত। মুখে তিনি যা বলতেন বাস্তবে তা-ই ঘটে যেত। তাঁর দৃষ্টির ছিল পরশ পাথরতুল্য প্রভাব। সে দৃষ্টি যার ওপর একবার পড়ত আধ্যাত্মিকতার ধাপসমূহ অতিক্রম করে উর্ধ্ব মাকামে পৌঁছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে যেত।

হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ.-এর পীর ও মুর্শিদ ছিলেন হাজী শরীফ জিন্দানী রাহ.। আধ্যাত্মিকতা ও সুলূকের ক্ষেত্রে তিনি তার যুগের শীর্ষ মাশায়েখদের মাঝে অতুলনীয় উদারহণশূন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। ওই যুগের সব আলেম-ফাযেল বিশেষত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা তাঁর দিকে ধাবিত ছিলেন। হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ. যখন তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে তার মুরীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেন তখন তিনি খাজা উসমানের প্রতি পূর্ণ অনুগ্রহের আচরণ করলেন। তাকে বাইআত করে ধন্য করলেন এবং নিজ হাতে তাঁর গায়ে খিরকা পরিয়ে দিলেন। অবশেষে তাকে নসীহত করে বললেন, হে উসমান! যেহেতু তুমি দরবেশীর খিরকা দিয়ে শরীরটাকে সজ্জিত করেছ তাই এখন থেকে চারটি বিষয়ে তোমাকে কঠোরভাবে আমল করতে হবে। এক. দুনিয়া এবং দুনিয়ার অপরিহার্য অনুষঙ্গগুলো থেকে দূরে থাকো ও সংযত থাক। দুই. লোভ-লালসা ত্যাগ কর। তিন. নফসের প্রবৃত্তিসমূহ থেকে দূরে থাক। চার. রাত জাগ এবং আল্লাহর যিকিরে নিমগ্ন হও। কেননা বুযুর্গদের ফরমান হল, দরবেশীর খিরকা ওই ব্যক্তিই তার মাথার উপর রাখতে পারে যে আল্লাহ ব্যতীত দুনিয়ার সব জিনিসকে বর্জন করেছে। আমিও এর উপরই আমল করেছি। তুমিও এই ধারারই আনুগত্য কর। দ্বিতীয়ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আল্লাহর সৃষ্টজীবের সঙ্গে দয়া ও কোমলতার সঙ্গে আচরণ কর।

খাজা উসমান হারূনী রাহ. তার পীর ও মুর্শিদের এই নসীহতগুলোকে জীবনের পণ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিজের গোটা জীবনকে আল্লাহর ইবাদত ও সৃষ্টির খেদমতে বিলিয়ে দেন। এভাবেই তিনি কৃতিত্ব ও পূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে যান।

হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ.-এর জীবনে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার নজির পাওয়া যায়। সিয়ারুল আউলিয়া গ্রন্থে লেখা আছে যে, খাজা মুঈনুদ্দীন হোসাইন সাঞ্জারী বলেন, একবার আমি খাজা উসমান হারূনী রাহ.-এর সঙ্গে সফরে ছিলাম। যখন আমরা দজলার পারে এসে পৌঁছলাম তখন সেখানে কোনো নৌকা ছিল না। খাজা উসমান হারূনী রাহ. বললেন, তুমি তোমার চোখ দুটো সামান্য সময়ের জন্য বন্ধ করে রাখ। আমি তাই করলাম। এরপর যখন চোখ খুললাম তখন আমি আমাকে এবং খাজা উসমানকে দজলার ওপারে আবিষ্কার করলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এটা কীভাবে করলেন? তিনি বললেন, পাঁচবার সূরা ফাতিহা পাঠ করেছি।

একবার এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ.-এর খেদমতে হাজির হল। ওই বৃদ্ধ লোকটির চেহারায় ছিল দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও পেরেশানীর স্পষ্ট ছাপ। খাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : কী ব্যাপার?

বৃদ্ধ লোকটি নিবেদন করল, চল্লিশ বছর ধরে আমার বড় ছেলেটি নিখোঁজ। সে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা-ও জানি না। আমি আপনার খেদমতে দুআর জন্য উপস্থিত হয়েছি। শুনেছি, আপনার দুআ সব সময় কবুল হয়। হযরত খাজা উসমান তখন ক্ষণিকের জন্য মুরাকাবা করে হাজিরীনে মজলিসকে বললেন, কয়েকবার সূরা ফাতিহা পড় যেন এই মুসাফির লোকটির ছেলে ফিরে আসে। হাজিরীন সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। এরপর খাজা ওই লোকটিকে বললেন, যাও তোমার ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়ি ফিরার আগেই পথে এক ব্যক্তি তাকে খরব দিল, তোমার ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে।

হযরত খাজা উসমান হারূনী রাহ. শেষ বয়সে মক্কা মুয়াজ্জমায় ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। সেই পবিত্র শহরেই ৬শাওয়াল ৬০৭হিজরীতে তিনি আল্লাহর সাক্ষাতে চলে যান। #

[হযরত মুফতী ওলী হাসান টোংকী রাহ.কৃত আওলিয়ায়ে পাক ও হিন্দ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত]   

 

 

advertisement