জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩০   ||   জুন ২০০৯

অতুলনীয় জীবন অনন্য আদর্শ প্রসঙ্গ : প্রামাণিকতা

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৪. সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. (মৃ. ৯০ হিজরীর পর) বলেন, ওমর রা. মনে করতেন যে, নিহত ব্যক্তির দিয়তের অধিকারী হবে আকিলা। নিহতের স্ত্রীর এতে কোনো অংশ নেই। পরে যাহহাক ইবনে সুফিয়ান কিলাবী রা. জানালেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লিখিত ফরমান পাঠিয়েছিলেন যে, আশইয়াম দিবাবীর দিয়ত থেকে তার বিধবাকে যেন অংশ দেওয়া হয়। তখন ওমর রা. তাঁর মত পরিবর্তন করেন। -সুনানে তিরমিযী হাদীস : ১৪১৫; সুনানে আবু দাউদ, ফারায়েয, হাদীস : ২৯২৫; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ২৬৪২; মুয়াত্তা ইমাম মালিক পৃ. ৩৩৯

৫. ইবনে আববাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুরাশবাসীকে খেজুর ও কিশমিশের তৈরি পানীয় সম্পর্কে নিষেধ লিখে পাঠিয়েছিলেন।-সহীহ মুসলিম  হা : ১৯৯০

৬. সুয়াইদ ইবনে গাফালা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে সদকা (যাকাত) উসূলকারী আমাদের নিকট এলেন। আমি তাঁর পত্রে এই বিধানটি পাঠ করলাম- সদকার আশংকায় একত্রকে পৃথক করা যাবে না এবং পৃথককে একত্র করা যাবে না।

এক ব্যক্তি একটি উত্তম উটনী নিয়ে এলেন, কিন্তু দূত তা নিতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আমি নবীজীকে কী জওয়াব দিব যদি মুসলমানের সম্পদ থেকে এটা (এত উত্তম বস্ত্ত) গ্রহণ করি।-সুনানে নাসাঈ হাদীস : ২৪৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস ১৮০১; সুনানে দারাকুতনী ২/১০৪

৭. যিমাম ইবনে ছালাবা রা.-এর একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে। তিনি ছিলেন কবীলায়ে বনু সাদ ইবনে বিক্র-এর সদস্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত ও আহকাম দিয়ে ওই কবীলায় দূত  প্রেরণ করেছিলেন। যিমাম ইবনে ছালাবা রা. কবীলার প্রতিনিধি হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এলেন। তাঁদের কথোপকথনের বিবরণ হাদীসের কিতাবে রয়েছে। তাতে একদিকে যেমন প্রশ্নকারীর স্পষ্টভাষিতা ও সত্যগ্রহণে দ্বিধাহীনতার পরিচয় পাওয়া যায় অন্য দিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহনশীলতা ও অতুলনীয় আখলাকের  দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

সুনানে দারেমী (১/১৩০-১৩১), মুজামে কাবীর, তবারানী (৮/৩০৬ হাদীস : ৮১৫০, ৮১৫১); মুজামে আওসাত ,তবারানী (৩/৩৪১ হাদীস ২৭২৮)-এর  বর্ণনায় এসেছে যে, কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘‘আমরা আপনার পত্রে দেখেছি এবং আপনার দূতগণ আমাদের আদেশ দিয়েছেন, আমরা যেন দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি। আমি আপনাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তিনিই (আল্লাহ) কি আপনাকে এই আদেশ করেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ

যিমাম আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আমরা আপনার পত্রে পেয়েছি এবং আপনার দূতগণ আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকে আমাদের দরিদ্র লোকদের দান করি? আমি আপনাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তিনিই (আল্লাহ) কি আপনাকে এই আদেশ করেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। ...’’

এই বর্ণনাতেও দেখা যাচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দূতকে একটি লিখিত দলীল দিয়েছিলেন, যাতে শরীয়তের হুকুম-আহকাম ছিল।

 ৮. আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে যা কিছু শুনতাম তা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে লিপিবদ্ধ করতাম। কুরাইশের কিছু ব্যক্তি আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে যা কিছু শোনো তা সবই লিপিবদ্ধ কর! অথচ তিনিও একজন মানুষ! অন্যদের মতো তিনিও কখনো কখনো রাগান্বিত হন! হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. তা নবীজীকে জানালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি লিখবে। কেননা এই দুই ঠোঁটের মধ্য দিয়ে হক ও সত্য ছাড়া অন্য কিছুই বের হয় না। -মুসনাদে আহমদ ২/১৬২ হাদীস ৬৪৭৪; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ৩৬৪১; মুসতাদরাকে হাকেম ১/১০৪ হাদীস ৩৬৩

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. এই সংকলনের নাম রেখেছিলেন আসসহীফাতুস সাদিকা। পরবর্তীতে এটি তাঁর পৌত্র বিশিষ্ট তাবেয়ী শুআইব ইবনে মুহাম্মাদ রাহ.-এর নিকটে সংরক্ষিত ছিল। তাঁর পিতা যৌবনেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ফলে তিনি দাদার নিকট প্রতিপালিত হয়েছেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছেন।

এই দলীলটি সম্পর্কে হাদীসশাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন রাহ. বলেছেন, শুআইবের কাছে আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর গ্রন্থসমূহ বিদ্যমান ছিল। তিনি তা থেকে দাদার উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করতেন। এগুলো আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণিত। তবে শুআইব দাদার নিকট থেকে এর পাঠ শ্রবণ করেননি। (তাহযীবুত তাহযীব ৮/৫৪)

পরে তাঁর পুত্র আমর রাহ. (মৃত্যু : ১১৭হি.) এই আমানত গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পিতার উদ্ধৃতিতে হাদীস বর্ণনা করতেন। মুহাদ্দিসীনে কেরামের সিদ্ধান্ত এই যে, পিতার গ্রন্থসমূহই তাঁর হাদীস বর্ণনার মূল সূত্র ।

ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (মৃত্যু : ২৩৪হি.) বলেন, আমাদের মতে আমর ইবনে শুআইব নির্ভরযোগ্য এবং তাঁর গ্রন্থ বিশুদ্ধ। (তাহযীবুত তাহযীব ৮/৫৫)

উল্লেখ্য, আমর ইবনে শুআইব আন আবীহী আন জাদ্দিহী একটি প্রসিদ্ধ সনদ। এই সনদে বর্ণিত হাদীসগুলো প্রকৃতপক্ষে সহীফায়ে সাদিকার-ই বর্ণিত রূপ। গ্রন্থরূপ থেকে বর্ণনারূপে রূপান্তরিত হয়ে সহীফায়ে সাদিকা হাদীসের কিতাবসমূহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে।

৯. হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘‘ফাতহে মক্কার বছর খুযাআ গোত্র জাহেলী যুগের এক হত্যাকান্ডের প্রতিশোধে বনু লাইসের এক ব্যক্তিকে হত্যা করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হল। তিনি তখন বাহনে সওয়ার হলেন এবং খুতবা দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা মক্কা থেকে হস্তীকে হটিয়ে দিয়েছেন এবং তাতে আল্লাহর রাসূল ও মুমিনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জেনে রেখো, এই নগরী আমার পূর্বে কারো জন্য হালাল ছিল না এবং আমার পরেও কারো জন্য হালাল নয়। শুধু দিবসের কিছু সময় তা আমার জন্য হালাল করা হয়েছিল। জেনে রেখো, এই মুহূর্ত থেকে তা পুনরায় হারাম হয়ে গেল। এ নগরীর কাঁটা উপড়ানো যাবে না, বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না এবং এতে পড়ে থাকা কোনো কিছু তুলে নেওয়া যাবে না, তবে যে তা মালিককে পৌঁছে দিতে চায়।

যার কোনো স্বজনকে হত্যা করা হয় সে দুই বিষয়ের কোনো একটির অধিকার লাভ করে : দিয়ত অথবা কিসাস। তখন ইয়ামানের অধিবাসী এক ব্যক্তি (আবু শাহ) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কথাগুলো আমাকে লিখে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখে দেওয়ার আদেশ করলেন।’’ (সহীহ বুখারী হাদীস ১১২, ২৪৩৪, ৬৮৮০) #

  (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement