রজব ১৪৩০   ||   জুলাই ২০০৯

প্রেসিডেন্ট ওবামার কায়রো ভাষণ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

মে মাসের শেষভাগ থেকেই ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়েছিল যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা মুসলমানদের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন। তাই ৪ জুন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ওবামার ভাষণ ছিল অনেকের কাছেই বহুল প্রতিক্ষিত।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে তিনি এ ভাষণ প্রদান করেন। স্বাভাবিক কারণেই ভাষণটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং পুরো বিশ্বের কুটনৈতিক, গবেষক ও সাংবাদিকরা এর পক্ষে বিপক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন এবং এখনো লিখে যাচ্ছেন। তাদের অনেকেই ভাষণটিকে ঐতিহাসিক ও সাহসী বলে অভিহিত করেছেন। কেউ বলেছেন, এটি সাম্রাজ্যবাদের নব আগ্রাসী কৌশল, কেউ কেউ ভাষণের উদ্দেশ্য ভালো বলে মন্তব্য করলেও এতে সুনির্ধারিত কোনো কর্মপন্থা নেই বলে এর উপকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বন্ধু-বান্ধবের অনেকেই ফরমায়েশ করেছেন যেন আলকাউসারে উক্ত ভাষণের উপর একটি মূল্যায়ন পেশ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ওবামার ভাষণের উপর মন্তব্য লেখার তেমন কোনো ইচ্ছা ব্যক্তিগতভাবে আমার ছিল না। এমনকি আমেরিকার বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওবামার প্রতিদ্বন্দিতা ও তাকে ঘিরে ভবিষ্যতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের আশাবাদও আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। ওবামা মুসলিম পরিবারের ছেলে, তিনি ক্ষমতায় আসলে বিশ্বব্যাপি মুসলমানদের উপর  আমেরিকা ও তার মিত্রদের জুলুম-অত্যাচার বন্ধ হবে, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন অন্যায় সমর্থন বন্ধ হবে, ইরাক, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে, স্বাধীন ফিলিস্তীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন অনেক প্রত্যাশা ব্যাপকভাবে করা হলেও আমার কাছে তা মনে হয়নি। আমি যা মনে করেছি তা হল, বারাক হোসেন ওবামার পিতা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি তো আগাগোড়াই খৃষ্টান এবং সর্বোপরি তিনি একজন পাকাপোক্ত আমেরিকান। যুগ যুগ থেকে চলে আসা আমেরিকান নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা তার পক্ষে সহজ নয় এবং তিনি তা করতেও যাবেন না। আর ওবামা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত কয়েক মাসেও তো এমনই দেখা গেল। ইসরাইলের গণহত্যা এবং আগ্রাসী দখল ও বসতি স্থাপন হ্রাস  পায়নি এবং তাদের প্রতি আমেরিকান সমর্থনেও চিড় ধরেনি। পাকিস্তানে আমেরিকান বিমান হামলা আরো বাড়ানো হয়েছে এবং ইতিহাসের কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে কারাগারও বন্ধ হয়নি। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে এসে ওবামা যাই বলুন তিনি যে কী করতে চান এবং কতটুকু কী করতে পারবেন তা সহজেই অনুমেয়।

এবার আসা যাক আলোচিত ভাষণ প্রসঙ্গে। ৪ জুন ২০০৯ এ কায়রোতে ওবামার ভাষণ সম্পর্কে যখন আগাম প্রচারণা এবং মন্তব্য ও বিশ্লেষণ চলছিল তখন নাকি আমেরিকান গবেষক ও ভাষ্যকারদের অনেকে আশঙ্কা ও সন্দেহে পড়ে গিয়েছিলেন যে, ওবামা আবার কতটুকু কী বলে ফেলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা তাদেরকে হতাশ করেননি; তিনি বরং আগ্রাসী আমেরিকাকেই নতুন  কৌশলে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।

ওবামা তার ভাষণে ধর্মকে টেনে এনেছেন বিভিন্নভাবে। পবিত্র কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন একাধিক বার। অন্যান্য ধর্মের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। বক্তৃতার শুরুর দিকে আসসালামু আলাইকুমও বলেছেন। (অবশ্য ইসলামী নিয়মানুযায়ী একেবারে শুরুতে সালাম দেননি; বরং থ্যাঙ্ক ইউ ভ্যারি মাচ, গুড আফটারনূন বলে শুরু করার পর কায়রোর ঐতিহ্যবাহী ২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসা এবং তাদের কর্তৃক তাকে দেওয়া অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করার পর বলেছেন, আমি মুসলিম বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়ে গর্ববোধ করছি। অতঃপর বলেছেন, আসসালামু আলাইকুম।) ধর্মের কথা বারবার উচ্চারণ করে তিনি বিশ্ব মুসলিমের আনুকূল্য পাওয়ার যেমন চেষ্টা করেছেন তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম বিরোধী অবস্থানকেও ঢাকার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষা ছিল পূর্বসূরী প্রেসিডেন্টদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে মার্জিত ও নম্র। এসব কারণে ভাষণটি অনেকের কাছেই নন্দিত হয়েছে। আলোচিত বক্তৃতাটির ইতিবাচক দিকের মধ্যে আরো রয়েছে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে বারবার স্বীকার করা, মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের অধিকারকে শ্রদ্ধা জানানো এবং ইয়াহুদীগণ কর্তৃক আরব এলাকায় বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান।

কিন্তু আলোচিত ভাষণের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি ছিল এতে তিনি ইসলামকে দাড় করিয়েছেন আমেরিকার প্রতিদ্বন্দী হিসাবে। কখনো বা ইসলাম আবার কখনো মুসলিম বিশ্ব বলে এর প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও অবশিষ্ট বিশ্বকে। ঠিক যেভাবে তার পূর্বসূরী জর্জ বুশ আমরা বনাম তারা বলে পুরো বিশ্বকে ইসলামের প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করেছিলেন।

একথা সহজেই বোধগম্য যে, ইসলাম কোনো রাষ্ট্রের নাম নয়, এটা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক আয়তনেও সীমাবদ্ধ নয় তাহলে তা আমেরিকা নামক রাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ বা এলাকার প্রতিপক্ষ হয় কীভাবে? আসলে প্রেসিডেন্ট ওবামা তার পূর্বসূরীদের আগ্রাসী একপেশে নীতি থেকে একটুও বের হয়ে আসতে পারেননি। প্রশ্ন এই যে, প্রকৃতপক্ষেই কি আমেরিকার সমস্যা ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব কেন্দ্রিক? তাহলে স্নায়ুযুদ্ধকালে  তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের লড়াই হয়েছিল কেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন তো  মুসলিম রাষ্ট্র ছিল না। সোশ্যালিজম তো কোনো ইসলামী নীতি নয়। বর্তমানে কিউবা, ভ্যানিজুয়েলা এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধও কি ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের কারণে। যদি তা না হয় তাহলে শুধু ইসলাম ও মুসলিমদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে কেন? জর্জ বুশ বলেছিলেন, ইসলামো ফ্যাশিজম। সন্ত্রাস এবং ইসলামকে একাকার করে ফেলার এ ভ্রান্ত নীতি আমেরিকা আর কত কাল বয়ে বেড়াবে?

ওবামা বলেছেন, ইসরাইলের সাথে আমেরিকার শক্তিশালী বন্ধন সুবিদিত, এ সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। অচ্ছেদ্য শব্দটি ওবামার আনব্রেকবল শব্দের তরজমা। পুরো ভাষণের এই একটি বাক্যের প্রতিও যদি নজর দেওয়া হয় তবুও বুঝা যাবে যে, মুসলিম নিধন ও মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্টের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ওবামা ভাষণটি দিয়েছেন মুসলমানদের উদ্দেশে এবং তার স্থান ছিল একটি ঐতিহ্যবাহী আরব রাষ্ট্র, যাদের মতো লক্ষ লক্ষ আরব মুসলিম নর-নারী ও শিশুকে হত্যা, অমানবিক নির্যাতন, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে ইসরাইল এবং সে জুলুম-অত্যাচার এবং আগ্রাসী দখল এখনো অব্যাহত রয়েছে। সে আরবদের সামনেই ওবামা নিঃসঙ্কোচে বলে গেলেন ইসরাইলের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য! ধন্যবাদ আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে তার মনের কথা পরিষ্কারভাবে উচ্চারণের জন্য!

এ ঘোষণার দ্বারা ওবামা জানিয়ে গেলেন, ইয়াহুদীরা যত অন্যায় করুক না কেন আমেরিকার সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে না; বরং সর্বক্ষেত্রেই আমেরিকা তাদেরকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাবে যেমনটি তারা করে আসছে বিগত কয়েক দশক যাবৎ।

বারাক হোসেন ওবামা ইসরাইলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, ইয়াহুদীরা যুগ যুগ ধরে মার খেয়ে এসেছে, ইউরোপে তাদের ৬০ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছিল, যা বর্তমান ইয়াহুদী রাষ্ট্রের জনসংখ্যা থেকেও বেশি।

খুবই মর্মান্তিক এ কাহিনী! অতএব যাদের ৬০ লক্ষ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তারা যদি অন্য কয়েক লক্ষকে মেরে দেয় তাহলে এতে তেমন দোষের কী আছে! ওবামা কিন্তু একবারও উচ্চারণ করেননি যে, ইয়াহুদীদের উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তা মুসলমানদের পক্ষ থেকে হয়নি এবং ইসলামের নামেও হয়নি। ইসলাম বা মুসলিম বিশ্বের কেউ এর সাথে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, অন্যের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করানো হচ্ছে মুসলমানদেরকে হত্যা ও নির্যাতন করার মাধ্যমে!

ওবামা তার ভাষণে কয়েকবার পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতের তরজমা শুনিয়েছেন, কিন্তু তার সহকারীগণ তাকে হয়ত ঐ আয়াতটির নির্দেশনা দেননি যাতে বলা হয়েছে, এবং একের অন্যায়ের বোঝা অন্যের উপর চাপানো যাবে না।

কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সভাকক্ষে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ, যারা ওবামাকে করতালি দ্বারা অভিনন্দিত করে যাচ্ছিলেন তারা কি একবারও জিজ্ঞেস করতে পারলেন না যে, ইয়াহুদীদেরকে কারা হত্যা করেছিল, কোনো মুসলিম কি তা করেছিল? যদি তা না হবে তাহলে কেন ইয়াহুদীদের সকল অন্যায় কর্মকান্ডকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করে যাচ্ছে আমেরিকা?

ওবামা তার বক্তৃতায় ফিলিস্তীনী জনগণের দুঃখকষ্টের কথাও ভুলে যাননি। যুগ যুগ থেকে ফিলিস্তীনীদের উদ্বাস্ত্তর জীবনযাপন এবং শরণার্থী শিবিরে বসবাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আমেরিকা কখনো ফিলিস্তীনীদের রাষ্ট্রগঠনের বৈধ আকাঙ্খা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে না। তিনি বলেছেন, দুটি জাতির আকাঙ্খাই বৈধ। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ফিলিস্তীনীরা শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে একথা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, গোটা ইতিহাসজুড়ে ইসরাইল তার সীমান্তের অভ্যন্তরে ও বাইরে সার্বক্ষণিক বৈরিতা ও হামলার শিকার হচ্ছে।

কী বুঝা গেল? ওবামা রায়ও দিয়েছেন এবং এর স্বপক্ষে যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন। রায় হল, দুটি জাতির আকাঙ্খাই বৈধ অর্থাৎ ইয়াহুদী রাষ্ট্রও থাকবে এবং ফিলিস্তীনী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হবে। (প্রথমটি তো আছেই তবে দ্বিতীয়টি কবে কীভাবে হবে তা তিনি উল্লেখ করেননি)। আর রায়ের স্বপক্ষে যুক্তি হল নিম্নরূপ :

১. ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ফিলিস্তীনীরা শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ফিলিস্তীনীদের আবাসভূমি ইয়াহুদীরা দখল করেছে।

২. গোটা ইতিহাসজুড়ে ইসরাইল হামলার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ ফিলিস্তীনীদেরকে তাদের আবাসস্থল থেকে বের করে দিয়ে তাদের জায়গা দখল করায় ইসরাইল বৈরিতা ও হামলার শিকার হচ্ছে। এই কারণেই সেখানে ইয়াহুদী রাষ্ট্রটি থাকা অপরিহার্য! উপরোক্ত রায় ও যুক্তির মিল খুঁজে বের করবেন সম্মানিত পাঠক।

ওবামা বলেছেন ইসরাইলকে ধ্বংস করার হুমকি দেওয়া চরম ভুল।

আসলে ইতিহাসের বাস্তব সত্য হল, ইসরাইল নামক কোনো রাষ্ট্র কখনো জন্ম নিত না যদি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ন্যূনতম মানবাধিকার ও নৈতিকতার তোয়াক্কা করে তাদেরকে সামরিক, আর্থিক ও সর্বপ্রকার অন্যায় সমর্থন না দিত। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশভাবে পাশ হওয়া কত প্রস্তাবে যে আমেরিকা ভেটো প্রয়োগ করেছে তার হিসাব কে করবে? এখনো যদি আমেরিকা তাদের বন্ধুর সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে ছেদ সৃষ্টি করে এবং তাদের অন্যায় কার্যকলাপকে সমর্থন-সহযোগিতা না করে তবে কেউ হুমকি দেওয়ার আগেই ইসরাইল ধ্বংস হতে বাধ্য হবে। বারাক হোসেন ওবামা কুরআনুল কারীমের ঐ আয়াত পড়েছেন কি না জানি না যাতে বলা হয়েছে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও মানুষের প্রতিশ্রুতির বাইরে যেখানেই তাদেরকে পাওয়া গেছে সেখানেই তারা লাঞ্ছিত হয়েছে। তারা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হয়েছে এবং হীনতাগ্রস্ত হয়েছে।-সূরা আলইমরান : ১১২

ইসরাইল ও ফিলিস্তীন প্রসঙ্গ ছিল ওবামার ভাষণের দ্বিতীয় বিষয়। এর আগে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে। ইসলাম, মুসলিম বিশ্ব ও আমেরিকার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। সেগুলোর সারমর্ম হল :

১. ইসলাম শান্তির ধর্ম।

২. যুগ যুগ থেকে মুসলমানরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে অসামান্য অবদান রেখেছে।

৩. আমেরিকান মুসলমানরা তাদের দেশ গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সেখানে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করছে।

৪. আমেরিকা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না এবং কখনো করবে না।

৫. ইসলাম ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিযোগিতার দরকার নেই। দুটিই বিশ্বের জন্য অপরিহার্য।

৬. ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা আমেরিকান জনগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দিয়েছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে যে, ইসলাম শুধু আমেরিকার জন্য নয় পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য, এমনকি মানবাধিকারের জন্যও ক্ষতিকর।

৭. আমি এখানে (মিসর) এসেছি মুসলিমজাহান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের নয়া দিগন্ত সূচনার আশায়।

৮. ইরাক যুদ্ধ ছিল এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আমার নিজ দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) এবং বিশ্বব্যাপী প্রবল প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। তারপরও আমি বিশ্বাস করি যে, সাদ্দামের স্বৈরশাসনের চেয়ে ইরাকীরা বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে!

৯. আমি ইরাকী জনগণকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমরা তাদের দেশে কোনো ঘাঁটি স্থাপন করব না।

১০. তাদের ভূখন্ড অথবা সম্পদের উপর আমাদের কোনো দাবি নেই।

১১. ২০১২ সালের মধ্যে ইরাক থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।

১২. ৯/১১ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই, সে দিন আলকায়েদা প্রায় ৩,০০০ লোককে হত্যা করেছিল।

১৩. আমরা যদি দেখতে পেতাম যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আমেরিকানদের হত্যা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোনো চরমপন্থী গোষ্ঠী নেই তাহলে আনন্দের সাথে আমরা প্রতিটি সৈন্যকে দেশে ফিরিয়ে আনতাম, কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। এজন্য আমরা ৪০টি  দেশের সঙ্গে জোট গঠন করেছি। প্রাণহানী ঘটা সত্ত্বেও আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি পালনে দুর্বল হবে না।

মোটামুটি একথাগুলো ছিল ওবামার কায়রো ভাষণের প্রথম অংশে। একথাগুলোর সার সংক্ষেপ হচ্ছে :

ক) ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান

খ) ইরাক ইস্যু নিয়ে আলোচনা

গ) পাক-আফগান ইস্যু

ঘ) আমেরিকা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না এবং কখনো করবে না।

প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসলামের মহত্ব সম্পর্কে যে কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন এবং তিনটি মহাদেশে ও তার পরিবার থেকে তিনি ইসলাম সম্পর্কে যা কিছু অবগত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন, আমার মনে হয়, তার একথাগুলো বলা দরকার ছিল আমেরিকায় তার জনগণের উদ্দেশ্যে। আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদেরকেই বরং বুঝানো দরকার ছিল ইসলামের ব্যাপারে তার উল্লেখিত ইতিবাচক দিকগুলো। কারণ ওবামার মতেই ৯/১১ এর পর আমেরিকান জনগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মের খুঁটি-নাটি দুচারটি ভালো কথা শোনানো তো মায়ের কাছে মামার বাড়ির গল্প করার মতো। মুসলমানরা তো তার কাছে প্রশংসা শুনতে আগ্রহী নয়। তারা দেখতে চায়, আমেরিকা তার কাজ বা নীতিতে পরিবর্তন আনছে কি না। ওবামা যদি এসব কিছুই না বলতেন, যদি ভাষণের শুরুর দিকে সালামও না দিতেন, কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তীন প্রতিষ্ঠার এবং ইয়াহুদী সন্ত্রাস বন্ধের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতেন, যদি তাদের অতীত ভুলগুলো কিছু হলেও স্বীকার করতেন, যদি ইরাক ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে তাদের সৈন্যবাহিনী দ্রুত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতেন তবে বিশ্বের শান্তিকামী মুসলমানরা অনেক বেশি খুশি হত।

ওবামা তার বক্তব্যের শুরুর দিকে কুরআন মজীদের আয়াত উদ্ধৃত করে (আল্লাহকে জান এবং সব সময় সত্য বল) বলেছেন, আমরা সব সময় এটা অনুসরণ করব, যতটা পারি সত্য কথা বলব। কিন্তু তার এ প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারেননি। ইরাক প্রশ্নে তিনি   বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেননি যে, তার পূর্বসূরী বুশ ইরাকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং আলকায়েদার উপস্থিতি রয়েছে বলে যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু করে গেছেন এবং লক্ষ মুসলমান নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করেছেন সে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ও আলকায়েদার উপস্থিতি দুটিই পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

৯/১১-এ ৩,০০০ এর মতো আমেরিকানের মৃত্যু অবশ্যই দুঃখজনক এবং অসমর্থনযোগ্য, কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে একটি সমৃদ্ধ দেশ, একটি জাতিকে ধ্বংস করা এবং লক্ষ জনতাকে হত্যার জন্য সামান্য দুঃখ প্রকাশের সৌজন্যতাও দেখাতে ব্যর্থ  হলেন সাহসী কথা বলার বিষয়ে প্রসিদ্ধ বারাক হোসেন ওবামা। উল্টো তিনি খোঁড়া যুক্তি পেশ করলেন যে, ইরাকীরা এখন সাদ্দামের সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে!

ওবামা বলেছেন, আমেরিকা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না এবং কখনো করবে না। যদি তাই হয় তবে ইরাকে যে লক্ষ লোক হত্যা করা হল এরা কোন ধর্মাবলম্বী, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ৪০টি মিত্র রাষ্ট্রের সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে প্রতিদিন যে অসংখ্য লোক হত্যা করা হচ্ছে তাদের ধর্ম কী, চালকবিহীন বিমান দিয়ে আলকায়েদা মারার অজুহাতে প্রায় প্রতিদিন     পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য বেসামরিক মানুষ হত্যা করা হচ্ছে তারা কোনো ধর্মের লোক? এর কোনোটিই যদি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না হয় তাহলে আর বলার কী আছে।

ওবামা উচ্চারণ করেন, ৯/১১ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কিছুটা শব্দই প্রমাণ করে, সত্য বলার ব্যাপারে তিনি তার প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করেছেন। তিনি অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন, এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই সেদিন আলকায়েদা প্রায় ৩,০০০ লোককে হত্যা করেছিল কিন্তু তিনি বললেন না যে, ইরাক, আফগান ও পাকিস্তানে যে লক্ষ বেসামরিক লোককে হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে তারা আলকায়েদার কেউ নয়।

ওবামা বলেছেন, শুধু সামরিক শক্তি দ্বারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সমস্যা সমাধান হবে না। তাই পাকিস্তানের জন্য ১.৫ বিলিয়ন ও আফগানিস্তানের জন্য ২.৮ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘোষণা করা হয়েছে।

খুবই চমৎকার প্রতিদান। আসলে বুশ-ওবামারা জানেন যে, কারজাই, মুশাররফ ও জারদারীদেরকে এভাবে কিছু ডলার ও ক্ষমতা দিয়েই খুশি করে ফেলা যায়। তাদের জাতির বা রাষ্ট্রের যাই হোক তাতে কিছু যায় আসে না।

ইসলাম ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিযোগিতার দরকার নেই বারাক ওবামার এ উক্তি পুরোপুরিই অবান্তর। এ প্রশ্ন আসবে কেন? আমেরিকা তো একটি ভৌগোলিক এলাকার নাম, ইসলাম কী তেমন কিছু?

পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওবামা ইরানপ্রসঙ্গ টেনে এনেছেন এবং এই বিধ্বংসী অস্ত্রের বিরুদ্ধে তার দেশের অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন, কিন্তু তিনি ইতিহাসের ছাত্র হয়েও ইতিহাসের এই সত্য উচ্চারণ করেননি যে, পৃথিবীতে পারমাণবিক বোমার সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ আমেরিকাই চালিয়েছে, হিরোশিমা ও নাগানাসাকিতে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করে।

ওবামা কেন এমন ভাষণ দিলেন

বিষয়বস্ত্ত ও বাস্তবতার বিচারে যাই হোক ওবামার ভাষণ ছিল বাহ্যিক দিক থেকে খুবই আকর্ষণীয়। সালাম দিয়ে, বারবার কুরআন মজীদের উদ্ধৃতি দিয়ে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রশংসা করে তিনি মুসলিম জনগণের মন ভোলানোর কম চেষ্টা করেননি। অতীত কোনো ভুলের জন্য ক্ষমা না চাইলেও আমেরিকা যে তার কৌশল বদলাচ্ছে তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। হুমকি ধমকির পরিবর্তে মিষ্টি-মধুর কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে স্বার্থ আদায়ের পন্থাই হল ওবামা-আমলে আমেরিকার কৌশল। অভ্যন্তরীণ মন্দা এবং ইরাক-আফগানিস্তানসহ প্রতিটি যুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ার পর জর্জ বুশীয় হুমকি-ধমকির আগ্রাসী নীতির বদলে কৌশলগত আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই হয়তো আমেরিকান জনগণ আফ্রো-আমেরিকান কৌশলী সুবক্তা বারাক হোসেন ওবামাকে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন।

কিন্তু বিশ্ববাসী এবং খোদ আমেরিকা ও তার জনগণের জন্য কতই না মঙ্গল হত যদি আমেরিকা এই সত্যকে বুঝতে পারত যে, আমেরিকার আগ্রাসী নীতিই সেই দেশ ও তার জনগণের জন্য ক্ষতিকর, তা জোর প্রয়োগের মাধ্যমে হোক কি মিষ্টি কথার মাধ্যমে। যেদিন আমেরিকা তার সাম্রাজ্যবাদী-আগ্রাসী নীতি পরিহার করে বিভিন্ন দেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী দেশে ফিরিয়ে নিবে এবং আলোচনার চেষ্টা করবে সেদিনের পরের বিশ্ব হবে অনেক নিরাপদ এবং তা আমেরিকার জন্যও। অন্যথায় মিষ্টি কথার আবেদনও খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যাবে।

বারাক হোসেন ওবামা যথার্থই বলেছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দেশের জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা তার সর্বোত্তম কর্তব্য।

এখন দেখা যাক, ভবিষ্যতে সে কর্তব্য তিনি কীভাবে পালন করেন। যুক্তরাষ্ট কতটুকু বদলেছে তার প্রমাণ কাজ দ্বারাই পাওয়া যাবে। #   

 

 

advertisement