শাবান-রমযান-১৪৩৩   ||   জুলাই-আগস্ট-২০১২

যে সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে সেগুলোই আসল সময়

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

এক এক মুহূর্তের সমষ্টিই তো জীবন। প্রতিটি মুহূর্ত সময়ের একটি অংশ। সময়ের আলাদা কোনো অস্তিত্ব যেহেতু মানুষ অনুভব করে না। তাই সময়ের বয়ে চলাও অনুভূত হয় না।

وإنا لفي الدنيا كركب سفينة  

نظن وقوفا، والزمان بنا يجري

আমরা দুনিয়ার বুকে যেন নৌকার যাত্রী। মনে হয়, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। অথচ সময় আমাদের নিয়ে বয়ে চলেছে।

নৌকা কিংবা গাড়ির আরোহী কোথাও যাওয়ার সময় মনে করে সে বসে আছে। অথচ সে চলছে। ঠিক তেমনি সময়ও তার কাজ করে চলেছে। সময় শেষ হয়েই যায়। বয়স বাড়ার অর্থ জীবন কমে যাওয়া। অথচ আমরা একটুও ভাবি না। আমাদের অবস্থা হল, কবির ভাষায়-

الوقت أنفس ما عُنِيت بحفظه

وأراك أسهل ما عليك يضيع

 

সংরক্ষণ করা যায় এমন বস্ত্তর মধ্যে সময় সবচেয়ে মূল্যবান/অথচ তোমাকে দেখছি, এটিই সবচেয়ে সহজে তোমার কাছে নষ্ট হচ্ছে।

আমার শ্রদ্ধেয় আম্মাজান-হাফিযাহাল্লাহু ওয়া রাআহা-কে সব সময় দেখেছি, যোহরের পর থেকেই তিনি বলতে থাকেন, নামাযের সময় চলে যাচ্ছে! প্রথমদিকে আরয করতাম, এইমাত্র আপনি নামায পড়লেন!? তিনি বলতেন, আসরের নামাযের সময় চলে যাচ্ছে! ঘড়ির কাটা পাঁচের কোঠা পার হলেই বলতেন, ছটা বেজে গেছে। অথচ ডিজিটাল ঘড়িতে ৬টা ৫৯ মিনিট হলেও তা ৬ টাই থাকে। আর এমনটিই হল সাধারণ ধারণা!!

রমযানুল মুবারক শুরু হয়। বুদ্ধিমানেরা আগে থেকেই মানসিক প্রস্ত্ততি নেয়, কর্মের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে, আলাদা নিযামুল আওকাত তৈরি করে। এরপর রমযানের শুরু থেকেই প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগায়। আর কিছু মানুষ প্রথম দশক পর্যন্ত মনে করে, কেবল তো রমযান শুরু হল। আর অধিকাংশ মানুষ তো প্রথম দুই-চার দিনেই তাদের সব আগ্রহ-উৎসাহ শেষ করে ফেলে। আর সকলের কাছেই শেষ দশক যেন রমযানের পরিশিষ্ট, মূল রমযান তো আগেই শেষ হয়ে যায়! এ কারণে শেষ দশক কাটিয়ে দেওয়া হয় ঈদের প্রস্ত্ততিতে। এ সময়ের প্রধান ব্যস্ততা থাকে কেনাকাটা, ঘুরে বেড়ানো ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা। এ তো আমাদের অবস্থা!!

কিন্তু আমাদের আকাবির কী করতেন? তাঁদের রমযান কেমন ছিল? শেষ দশক তারা কীভাবে কাটাতেন-এসব তাদের জীবনী-গ্রন্থ থেকে পাঠ করা উচিত। শায়খুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ.-এর পুস্তিকা ‘‘আকাবির কা রমযান’’ও অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

শেষ দশকের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, এটিই হচ্ছে সুন্নত ইতিকাফের সময়। আর লায়লাতুল কদরেরও প্রবল সম্ভাবনা শেষ দশকেই হওয়ার। হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি লায়লাতুল কদরের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সে তো সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৪৪

সুতরাং শেষ দশককে যে নষ্ট করে সে প্রকৃতপক্ষে নিজের সব কল্যাণ বিসর্জন দেয়।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা করেন-

 كان رسول الله صلى الله عيله وسلم يجتهد في العشر الأواخر ما لا يجتهد في غيره

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে সবচেয়ে বেশি মেহনত করতেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৭৫

তিনি আরো বলেন,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيا الليلَ، وأيقظ أهلَه، وجّدَّ وَشَدَّ المِئْزَرَ.

শেষ দশক শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত জাগতেন। পরিবারের লোকদেরকেও জাগাতেন। অনেক মেহনত করতেন। এমনকি কোমর বেঁধে নিতেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০২৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৭৪

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه، ومن قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه.

যে সওয়াবের আশায় রমযানের সওম আদায় করে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে সওয়াবের আশায় লায়লাতুল কদরে জাগরণ করে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০১৪

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন-

قال رسول الله صلى الله عيله وسلم : التمسوها في العشر الأواخر، يعني ليلة القدر، فإن ضعف أحدكم أو عجز

 

فلا يُغْلَبَنَّ على السبع البواقي.

তোমরা শেষ দশকে লায়লাতুল কদর অন্বেষণ কর। তোমাদের কেউ দুর্বল কিংবা অক্ষম হলে সে যেন অবশিষ্ট সাত রাতের বিষয়ে পরাজিত না হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬৫ (২৭৪১)

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন-

تّحَيَّنوا ليلة القدر في العشر الأواخر، أو قال : في التسع الأواخر.

তোমরা শেষ দশ রাতে লায়লাতুল কদর তালাশ  কর। অথবা বলেছেন, শেষ নয় দিনে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬৫ (২৭৪৩)

এই হাদীসের মতো অন্য অনেক হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, লায়লাতুল কদর নির্দিষ্ট কোনো রাতের নাম নয়, যে রাতে সবাই মসজিদে সমবেত হবে, কিছু কথা শুনবে, এরপর সম্মিলিতভাবে উচ্চস্বরে দুআ করে চলে আসবে!!

লায়লাতুল কদর লাভের জন্য গোটা রমযান বিশেষ করে শেষ দশকে পূর্ণ প্রস্ত্তত থাকা উচিত এবং এর খোঁজে নিজেকে পূর্ণ মনোযোগী রাখা উচিত। নফল নামায, দুআ-যিকির, ইস্তিগফার, কুরআন তিলাওয়াত ও দরূদ শরীফ ইত্যাদি আমলে সময় কাটানো উচিত। যেন শবে কদরের বরকত হাসিল হয় এবং মাগফিরাতের নেয়ামত লাভ করা যায়।

এজন্য প্রথম চেষ্টা হওয়া উচিত, শেষ দশকের ইতিকাফ। কমপক্ষে অধিকাংশ সময় মসজিদে ও ইবাদতে কাটানো। আর গুনাহ থেকে বিরত থাকা এবং অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বেঁচে থাকা তো মুমিনের সবসময়ের কর্তব্য। রমযান মাসে বিশেষ করে শেষ দশকে তা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে অনর্থক ও অযথা যে কাজে এই মুবারক সময়টুকু নষ্ট করা হয় তা হল কেনাকাটা, ঘুরে বেড়ানো ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা।

আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন এবং রমযান থেকে তাকওয়ার নেয়ামত লাভ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

 

advertisement