রজব-১৪৩৩   ||   জুন-২০১২

মুসলমান যেভাবে জীবনযাপন করবে

হযরত মাওলানা আশেক এলাহী বুলন্দশহরী

 

দ্বীন ইসলাম হচ্ছে আকীদা-আমল, ইবাদত-ইতাআত এবং আদব-আখলাকের সমষ্টির নাম। কেউ যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয় তখন তার কর্তব্য ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামের গন্ডির মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।-সূরা বাকারা (২) : ২০৮

নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু ইসলামের মৌলিক হুকুম-আহকাম আমল-আখলাক থেকে বিমুখ থাকে। মুখে ইসলামের দাবি কিন্তু কর্ম তার বিপরীত। এ তো মুমিনের শান নয়। মুসলমান হওয়ার পর ইসলামের হুকুম-আহকাম পুরোপুরি মানতে হবে।

তো সাধারণ মুসলিম ভাইবোনকে প্রয়োজনীয় কিছু কথা জানানোর জন্য এই প্রবন্ধটি লিখছি। একে অপরকে তা পাঠ করে শোনাই এবং আমলের জন্য উৎসাহিত করি।

১. ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি। আহলুস সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকীদাকে নিজের আকীদা বানাই। সকল প্রকার গোমরাহ ফের্কা থেকে দূরে থাকি। যেমন-শিয়া, কাদিয়ানী, আগাখানী ইত্যাদি। এমনিভাবে সব রকমের বিদআত থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকি।

২. প্রত্যেক সুস্থমস্তিস্ক বালেগ মুসলমানের উপর, সে পুরুষ হোক বা নারী; পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরয। মুকীম হই বা মুসাফির, সুস্থ হই বা অসুস্থ, ঘরে থাকি বা কর্মস্থলে সর্বাবস্থায় তা আদায় করি।

ইশার ফরয নামাযের পর বিতরের নামায ওয়াজিব। কোনো অবস্থাতেই তা কাযা হতে না দেই। নারীরা ঘরে আর পুরুষরা মসজিদে জামাতের সাথে নামায আদায় করি। জামাতের সাথে আদায় করলে নামাযের সওয়াব সাতইশগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।-মিশকাত, পৃ : ৯৫; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৪৯

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি পাবন্দির সাথে নামায আদায় করবে কিয়ামতের দিন তার নামায তার জন্য নূর হবে, এবং তার ঈমানের দলিল হবে ও তার নাজাতের কারণ হবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের পাবন্দি করবে না তার জন্য না আলো হবে, না তার ঈমানের দলিল হবে আর না নাজাতের কারণ হবে। কিয়ামতের দিন সে থাকবে কারুন, হামান, ফেরাউন এবং প্রসিদ্ধ উবাই ইবনে খলফের সাথে।-মিশকাত, পৃ : ৫৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৫৭৬

বিতর সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বিতর পড়া জরুরি। যে ব্যক্তি বিতর পড়ে না সে আমার দলভুক্ত নয়।-মিশকাত, পৃ : ১১৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৪১৯

সুন্নতে মুআক্কাদা সম্পর্কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাত-দিনে বারো রাকাত (সুন্নাতে মুআক্কাদা) পড়বে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানানো হবে। যোহরের আগে চার রাকাত, যোহরের পর দুই রাকাত, মাগরিবের পর দুই রাকাত, ইশার পর দুই রাকাত এবং ফজরের আগে দুই রাকাত।-মিশকাত, পৃ : ১০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০৩; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৪১৪

আসরের আগের চার রাকাতেরও (সুন্নতে মুআক্কাদা নয়) অনেক ফযীলত আছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ ঐ বান্দার উপর রহম করুন যে আসরের আগে চার রাকাত (নফল নামায) পড়ে।-মিশকাত, পৃ : ১০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১২৭১

নফল নামাযেরও অনেক গুরুত্ব আছে। তাহিয়্যাতুল ওযু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, ইশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ এবং মাগরিবের পরের নফল নামায়ের কথাও এখানে বলা যায়। দুনিয়া থেকে যাওয়ার সময় আমাদের সাথে নফল নামাযের সঞ্চয়ও থাকা চাই।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন সবার আগে নামাযের হিসাব নেওয়া হবে। এতে যে উত্তীর্ণ হবে সে কামিয়াব হবে আর এখানে যে অকৃতকার্য হবে সে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলবেন, দেখ, আমার বান্দার কিছু নফল নামাযও কি আছে? এরপর নফলের মাধ্যমে ফরযের ত্রুটি পূরণ করা হবে। এরপর এভাবেই যাকাতের হিসাব নেওয়া হবে।-মিশকাত, পৃ. : ১১৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৮৬৪

৩. সহীহ তরীকায় নামায পড়া শিখি। বাচ্চাদেরকেও সঠিক পদ্ধতিতে শেখাই।  ==== প্রভৃতি হরফের উচ্চারণ অনেকেরই ভুল হয় এগুলো সঠিকভাবে শেখা জরুরি। অনেক মানুষের তো জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণে কালিমাও পড়তে পারে না। নামাযেও অনেক রকম ভুল করে। এতে তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

৪. বাচ্চাদের নামায শেখানোর বিষয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তাকে নামায পড়তে বল। যখন দশ বছর হয় তখন নামায না পড়লে তাদেরকে প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।-মিশকাত ৫৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৯৫

৫. জুমআর নামাযের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) হে মুমিনগণ! জুমআর দিন যখন (জুমআর) নামাযের জন্য ডাকা (আযান দেওয়া) হয় তখন নামাযের জন্য রওনা হয়ে যাও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও (বন্ধ রাখ)। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা উপলব্ধি করতে।-সূরা জুমআ, আয়াত : ৯

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি বিনা ওজরে জুমআর নামায ত্যাগ করে তাকে ঐ গ্রন্থে মুনাফিক বলে লিখে দেওয়া হবে, যে গ্রন্থের লিখন কখনো মুছবে না এবং পরিবর্তনও হবে না।-মিশকাত পৃ. ১২১

যদি কখনো সফরের কারণে বা অসুস্থতার কারণে জুমআর নামায ছুটে যায় তাহলে যোহর পড়ে নিবে। বিনা ওজরে কাযা করলেও তার পরিবর্তে যোহর পড়ে নিবে।

৬. বালেগ (প্রাপ্ত বয়ষ্ক) হওয়ার পর থেকে যত ওয়াক্ত ফরয ও ওয়াজিব (বিতর) নামায ছুটে গেছে তা হিসাব করে আদায় করি। সর্বোচ্চ কত ওয়াক্তের নামায কাযা হয়ে থাকতে পারে তা অনুমান করে দ্রুত আদায় করতে থাকি। একদিনে ২০ রাকাত হয়। যোহরের চার রাকাত, আসরের চার রাকাত, মাগরিবের তিন রাকাত ও ইশার চার রাকাত, বিতরের তিন রাকাত ও ফজরের দুই রাকাত। বিশ রাকাত বিশ মিনিটে পড়া যায়। ছুটে যাওয়া নামায পাঁচ ওয়াক্তের চেয়ে বেশি হলে তরতীব বা ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা জরুরি নয়।

কাযা নামায পড়ার জন্য বিশেষ কোনো সময় নির্ধারিত নেই। সূর্যোদয়ের সময়, দ্বিপ্রহরের সময় এবং সূর্যাস্তের সময় ছাড়া অন্য যে কোন সময় কাযা নামায পড়া যায়। সূর্যোদয়ের ১৫-২০ মিনিট পর, যখন সূর্য বর্ষার ফলা পরিমাণ উপরে উঠে যায় তখন নামায পড়ার নিষিদ্ধতা থাকে না।  তবে সূর্য হলুদ হওয়ার আগ পর্যন্ত কাযা নামায পড়া যায়। আসরের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত নফল নামায পড়া যায় না। সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর কাযা নামাযও পড়া যায় না।

মাসআলা : মুকীম অবস্থায় যোহর, আসর, ইশার নামায কাযা হলে সেগুলো চার রাকাত করেই আদায় করতে হবে যদিও তা অদায় করা হয় মুসাফির অবস্থায়। আর মুসাফির অবস্থায় উক্ত নামাযগুলো কাযা হলে দু রাকাত করে আদায় করতে হবে যদিও তা আদায় করা হয় মুকীম অবস্থায়।

অতীতের কাযা নামাযগুলো দ্রুত আদায় করা চাই। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাযের সাথে একটি করে কাযা নামায আদায় করা অথবা দৈনিক বিশ মিনিট নির্ধারণ করে বিশরাকাত নামায আদায় করা কঠিন নয়। সবার ধারাবাহিকভাবে সব নামায কাযা হবে তা অপরিহার্য নয়।  কারো হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকার কারণে আসরের নামায কাযা হয়েছে, কারো ঘুমের কারণে ইশা বা ফজর কাযা হয়েছে, তো যার যে নামায কাযা হয়েছে তা আদায় করি।

৭. বিত্তশালীরা পাবন্দির সাথে যাকাত আদায় করি। যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র বর্ষের হিসাব হবে। সৌর বর্ষের নয়। যাকাত ফরয হওয়ার জন্য বড় সম্পদশালী হওয়া জরুরি নয়। (প্রয়োজনের অতিরিক্ত) ৫৯৫ গ্রাম (সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা) বা তার মূল্য অথবা এ পরিমাণ ব্যবসার পণ্যের মালিক হলে যাকাত ফরয হয়। চন্দ্র মাসের হিসাবে বারো মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যাকাতযোগ্য সম্পদের চল্লিশ ভাগের একভাগ দেওয়া ফরয। যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা দিতে হবে। যকাত গ্রহণের উপযুক্ত কারা তা আলিমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিই। যাদের কাছে ৫৯৫ গ্রাম রূপা বা তার মূল্য কিংবা এ পরিমাণ ব্যবসার পণ্য বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র আছে তাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না। অনেক লোক এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েও মানুষের কাছে হাত পাতে। এদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না। যাকাত ছাড়াও আরো কিছু আর্থিক ওয়াজিব আছে। যেমন- সাদকায়ে ফিতর আদায় করা, কুরবানী করা, স্ত্রী-সন্তান ও পিতা-মাতার জন্য শরীয়তের নিয়মানুযায়ী খরচ করা, কসম ভঙ্গ করলে কাফফারা দেওয়া ইত্যাদি।

ফরয যাকাত এবং সম্পদের অন্যান্য ওয়াজিব হুকুম আদায় করার সাথে সাথে নফল সদকাও করতে থাকি। ভালো কাজে ব্যয় করতে থাকি। কিয়ামতের দিন ফরয, ওয়াজিব, নফল সবই নাজাতের অসীলা এবং মর্যাদা বৃদ্ধির উপায় হবে। যাকাতের বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে তার সম্পদের যাকাত দিবে না কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার সম্পদকে বিষাক্ত সাপ বানিয়ে তার গলায় ঝুলিয়ে দিবেন। ঐ সাপ তাকে দংশন করতে থাকবে এবং তাকে বলতে থাকবে, আমি তোমার মাল, তোমার সঞ্চিত সম্পদ।-মিশকাত, পৃ : ১৫৫-১৫৭; সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪০৩

নফল সদকার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর, অর্ধেকটি খেজুর দ্বারা হলেও। যদি তা না পাও তাহলে একটি ভাল কথা দ্বারা হলেও।-মিশকাত ৫২৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৫৯৫

আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে কোনো নেক আমল করা হবে কিয়ামতের দিন তা কাজে আসবে। ঐ দিন ছোট থেকে ছোট নেক আমলেরও প্রয়োজন হবে।

৮. রমযান মাসের রোযাগুলো গুরুত্ব সহকারে রাখবেন। যে সকল (নাবলেগ) বাচ্চা রোযা রাখতে সক্ষম হয় তাদেরকেও রোযা রাখতে বলবেন।

নফল রোযারও অনেক ফযীলত রয়েছে। চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোযা, বুধ ও বৃহস্পতিবারের রোযা, শাওয়াল মাসের ছয় রোযা, যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের রোযা এবং মহররম মাসের ১০ তারিখের রোযার অনেক ফযীলত রয়েছে।

৯. যাদের উপর হজ্ব ফরয হয়েছে তাদের জন্য বিলম্ব না করে দ্রুত হজ্ব করা জরুরি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির হজ্ব করার সামর্থ রয়েছে এবং হজ্বে যেতে তার কোন প্রতিবন্ধকতাও নেই এরপরও সে হজ্ব করল না সে চাই ইয়াহুদী হয়ে মারা যাক বা নাসারা (খ্রিস্টান) হয়ে মারা যাক।-মিশকাত ২২২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৮১২

অনেক লোকের উপর হজ্ব ফরয হয়ে যায় কিন্তু তারা দুনিয়ার ব্যস্ততার মধ্যে লিপ্ত থাকে, অবশেষে হজ্ব না করে দুনিয়া থেকে চলেও যায়। এটা অত্যন্ত আফসোসের বিষয়।

১০. কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করি। প্রতিদিন এক পারা বা দুই পারা তেলাওয়াত করি। কুরআন মাজীদের প্রতিটি হরফ পড়ার দ্বারা একটি করে নেকি হয় যা দশটি নেকীর সমপরিমাণ। সন্তানাদিদেরকেও কুরআন মাজীদ পড়াই। সকালে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করি। সূরা ইয়াসিন একবার তেলাওয়াত করলে দশবার কুরআন মাজীদ খতম করার সওয়াব পাওয়া যায়। কুরআন মাজীদ সহীহ-শুদ্ধ করে পড়তে শিখি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন

 

 

 

 

advertisement