জুমাদাল উলা-১৪৩৩   ||   এপ্রিল-২০১২

নবী-আদর্শের অনুসরণে মর্মান্তিক অবহেলা বড় বড় সুন্নত পরিত্যক্ত, বহু সুন্নত নিষ্প্রাণ এরপরও ঈমান ও মুহববতের দাবি!

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কমপক্ষে বড় বড় সুন্নতের প্রতি মনোযোগী হোন

আমি আরজ করছিলাম যে, আজ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়কে উসওয়ায়ে হাসানার আলোকে বিচার করা। আসুন, আমরা নিজ নিজ অবস্থা যাচাই করি এবং নবী-আদর্শের ছাঁচে জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করি।

কমপক্ষে উসওয়ায়ে নববিয়্যাহর বড় বড় দিক এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বড় বড় সুন্নতগুলোর জন্য তো এখন  থেকেই মেহনত শুরু করা চাই।

ইচ্ছে হচ্ছে, আমার নিজেকে এবং  ভাইদেরকে স্মরণ করানোর জন্য এ রকম কিছু সুন্নতের কথা আলোচনা করি। 

সুন্নতে নববিয়্যাহ এবং উসওয়ায়ে হাসানাহ তথা নবী-জীবন ও নবী-আদর্শে অনেক বিষয় আছে, যেগুলো করণীয়। এগুলো পালন করা এ আদর্শের বিধান। তবে কোনোটি ফরয, কোনোটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা আবার কোনোটি নফল বা মুস্তাহাব। তদ্রূপ অনেক বিষয়কে বর্জন করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এগুলো থেকে বিরত থাকা এই আদর্শের বিধান। এগুলোর মধ্যে কোনোটি হারাম। কোনোটি মাকরূহে তাহরীমী অর্থাৎ এতে লিপ্ত হওয়াও গুনাহ এবং তা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। আবার কোনোটি মাকরূহে তানযিহী। অর্থাৎ তা থেকেও বেঁচে থাকা উচিত।

এই সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত থেকে আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে, ফরয বা ওয়াজিব ত্যাগকারী কিংবা হারাম ও মাকরূহে তাহরীমীতে লিপ্ত ব্যক্তি কখনো সুন্নতের অনুসারী হতে পারে না। তার জন্য এই উপাধি প্রয়োগ করা যাবে না। যদিও সে অনেক সুন্নতে মুয়াক্কাদা, সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা বা নফল-মুস্তাহাব যত্নের সাথে পালন করুক না কেন। যেমন  দাড়ি মুন্ডনকারী কিংবা যে এক মুষ্ঠির কম রাখে তাকে সুন্নতে ওয়াজিবা ত্যাগ করার কারণে সুন্নতের অনুসারী বলা যাবে না, তেমনি সুদখোর, ঘুষখোর, ধোঁকা ও প্রতারণাকারী, দায়িত্বে অবহেলাকারী এবং হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকেও সুন্নতের অনুসারী বলা যাবে না যদিও তার মুখে দাড়ি থাকে এবং দাড়ির সাথে পাগড়িও থাকে। প্রকৃতপক্ষে সে উল্লেখিত ব্যক্তির চেয়ে সুন্নত থেকে অনেক অনেক দূরে।

নিম্নে দশটি করণীয় বিষয় ও দশটি বর্জনীয় বিষয় উল্লেখ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাকে, আমার সন্তানদেরকে, আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও তাদের সন্তানাদি এবং সকল মুসলিম নর-নারীকে আমলের তাওফীক দান করুন। আমীন।

করণীয় বিষয়

১. ঈমান-আকিদায় দৃঢ়তা এবং আদর্শের উপর অবিচলতা

ঈমান-আকিদায় দৃঢ়তা এবং আদর্শের উপর অবিচলতাই হল উসওয়ায়ে হাসানার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ আমাদের মাঝে আকিদার বিষয়ে অনেক দুর্বলতা চোখে পড়ে; কখনো অজ্ঞতার কারণে, কখনো শৈথিল্যের কারণে, যাকে আমরা নাম দিয়েছি উদারতা, আবার কখনো সাহস ও হিম্মত কম হওয়ার কারণে। এটা নবী-আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এ সম্পর্কে চিন্তাশীলদের জন্য পবিত্র সীরাতের একটি ঘটনা স্মরণ রাখাই যথেষ্ট, যা ইসলামের একেবারে প্রথম যুগে ঘটেছিল।

যখন কুরাইশ আবু তালেবকে বাধ্য করতে চাচ্ছিল তিনি যেন আপন ভাতিজার সাহায্য ত্যাগ করেন, আর শেষে আবু তালিবও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে নিজের অপারগতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ঐতিহাসিক বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, যা সবারই জানা আছে।

তিনি বলেছিলেন-

يا عم! والله، لو وضعوا الشمس في يميني والقمر في يساري على أن أترك هذا الأمر حتى يظهره الله أو أهلك دونه ما تركته.

 চাচা! এরা যদি তাওহীদের দাওয়াত ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্রও এনে দেয় তবুও আমি তা ছাড়ব না। এরপর হয় আল্লাহ এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন অথবা আমি শহীদ হব।

মক্কার মুশরিকদেরকে তিনি এই কথাও বলেছিলেন যে-

أترون هذه الشمس؟ قالوا : نعم، قال : فما أنا بأقدر على أن أدع ذلك منكم على أن تستشعلوا منها شعلة.

অর্থাৎ এই যে সূর্য তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তা থেকে এক খন্ড অগ্নি নিয়ে আসা যেমন তোমাদের পক্ষে অসম্ভব তেমনি আমার পক্ষে এই দাওয়াত ত্যাগ করাও অসম্ভব।-সীরাতে ইবনে ইসহাক, যিয়াদাতু ইউনুস ইবনে বুকায়র পৃ. ১৫৫; আলমুসতাদরাক আলাস সহীহাইন ৩/৫৭৭; আসসীরাতুন নববিয়্যাহ আস-সহীহা, আকরাম জিয়াউল ওমারী ১/১৬০

সহীহ আকিদার উপর অবিচলতা এবং মানুষকে এর দাওয়াত দেওয়াই হল আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পূর্বের সকল নবী ও রাসূলের আগমনের প্রথম উদ্দেশ্য। এজন্য আকিদাসমূহ না জানা কিংবা এ বিষয়ে সামান্য অবহেলা করা সীরাত ও সুন্নাহর নাম উচ্চারণকারী বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহববত পোষণকারী কারো থেকে হতে পারে না।

২. ইসলামের রোকনসমূহ যথাযথভাবে পালন করা

নবী-আদর্শে আকাইদের সাথেই আরকানে আরবাআর স্থান। বিশেষত নামায ও যাকাতের বিষয়ে আমাদের সমাজে যে উদাসীনতা ও অবহেলা লক্ষ্য করা যায় তার সংশোধন ছাড়া কীভাবে আমরা নিজেদেরকে সেই নবীর উম্মত বলতে পারি, যিনি তাঁর মুয়াযযিন বিলাল ইবনে রাবাহ রা.কে বলেছিলেন-

أرحني بها يا بلال!

হে বেলাল! আযান দাও। এবং নামাযের ব্যবস্থা করে আমাকে শান্তি দাও।

তিনি আরো ইরশাদ করেছেন-

جعلت قرة عيني في الصلاة.

আমার চোখের শীতলতা নামাযে।

আর মৃত্যুর সময় তো তাঁর মোবারক যবানে এই কথাই ছিল-

الصلاة وما ملكت أيمانكم

স্মরণ রেখো নামাযের কথা এবং তোমাদের দাস-দাসীদের অধিকারের কথা।

যে নবী আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য এত খরচ করতেন, গরীব-মিসকীনদেরকে এত দান করতেন, এবং প্রয়োজনগ্রস্তকে এত দিতেন যে, তাঁর উপর কখনো যাকাত ফরয হয়নি, এমনকি সামান্যতম সঞ্চয়ের রীতিও যাঁর মাঝে ছিল না, যাঁর সম্পর্কে নবুওয়তের প্রথম দিনই এই স্বাক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল যে-

إنك تحمل الكل وتكسب المعدوم وتقري الضيف، وتصدق الحديث، وتؤدي الأمانة وتعين على نوائب الحق.

অর্থাৎ আপনি অসহায়ের ভার বহন করেন, নিঃস্বকে উপার্জনের ব্যবস্থা করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন, সত্য কথা বলেন, আমানত যথাযথভাবে আদায় করেন এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকে (মানুষের) সহযোগিতা করেন। এমন নবীর উম্মত কি যাকাত আদায় না করে পারে?

৩. কুরআন ও ইসলামের বিধান ও শিষ্টাচার শিক্ষা

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোটা জীবনজুড়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হল কুরআন; এর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনানো, তা শিক্ষা দেওয়া, এর নির্দেশ ও নির্দেশনা শিক্ষা দেওয়া, এর প্রতি মানুষকে আহবান করা, এর নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের সংশোধন করা, তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং নামাযে, তাহাজ্জুদে ও অন্যান্য সময় তা তিলাওয়াত করা। কুরআন থেকে সামান্য বিমুখতাও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তার রবের নিকট অভিযোগ করেছেন-

يرب إن قومي اتخذوا هذا القرآن مهجورا

হে আমার প্রতিপালক! আমার কওম তো এই কুরআনকে পরিত্যাক্ত করে রেখেছে।-সূরা ফুরকান (২৫) : ৩০

কুরআন হল নূর (আলো), ফুরকান (ভালো-মন্দ এবং সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মাপকাঠি) ও মীযান (ইনসাফের মানদন্ড)। যে ব্যক্তি কুরআনকে হারাল সে নবীর প্রতিপক্ষ হয়ে গেল। গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। আল্লাহ তাআলা উম্মতের প্রত্যেককে এই মাহরূমী থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

৪. সত্যবাদিতা ও আমানতদারি

নবুওয়তের আগেও খোদ মুশরিকদের নিকট রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপাধি ছিল আসসাদিকুল আমীন অর্থাৎ সত্যবাদী ও আমানতদার। নবুওয়তের প্রথম দিন খাদীজা রা. তাঁর সম্পর্কে যে স্বাক্ষ্য দিয়েছিলেন তাতেও তাঁর সত্যবাদিতা ও আমানতদারির ঘোষণা ছিল। তিনি বলেছিলেন-

تصدق الحديث، وتؤدي الأمانة

আপনি সত্য কথা বলেন এবং আমানত রক্ষা করেন।

তাঁর আনীত শরীয়তের মূল ভিত্তিই হল সত্যবাদিতা ও আমানতদারির উপর। এর মূল সৌন্দর্য এই যে, তার অনুসারীরা হবে (যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই তাঁর অনুসারী) সত্যবাদী ও আমানতদার।

নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সত্যবাদিতা ও আমানতদারির গুরুত্ব কেমন ছিল তা নিচের দুটি হাদীস থেকেই অনুধাবন করা যায়।

لا إيمان لمن لا أمانة له، ولا دين لمن لا عهد له

যে আমানত রক্ষা করে না, আমানত আদায় করে না তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গিকার পূর্ণ করে না তার দ্বীন নেই।

يطبع المؤمن على كل شيء إلا الخيانة والكذب

মুমিনের মধ্যে আর যা-ই থাকুক খেয়ানত ও মিথ্যা থাকতে পারে না।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২১৭০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৬১২১; আসসুন্নাহ, ইবনে আবী আসিম, হাদীস : ১১৮

সিদক ও সত্যবাদিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই যে, ব্যক্তির মুখ ও মন এক হওয়া, কথা ও কাজ এক হওয়া, বিশ্বাস ও কর্ম এক হওয়া। কথা ও কাজে অমিল হলে তার সিদক অসম্পূর্ণ। কথা ও কাজে এক হওয়াই ছিল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোটা জীবনের অপর নাম। এজন্য সে ব্যক্তিই তাঁর উম্মত উপাধিতে ভূষিত হওয়ার যোগ্য, যার জীবন সকল মিথ্যা থেকে পবিত্র সত্যবাদিতা ও আমানতদারি যার প্রতীক।

৫. ওয়াদা পূরণ ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা

ওয়াদা পূরণ করা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ছিল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কুরআন মজীদে ওয়াদা পূরণের তাকিদ সম্বলিত আয়াতের সংখ্যা অনেক। কারো সাথে কোনো ওয়াদা করা হলে আল্লাহ তাআলা তাকে তাঁর সাথে কৃত ওয়াদা হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তা ভঙ্গ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وبعهد الله اوفوا ذلكم وصكم به لعلكم تذكرون

 (তরজমা) এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।-সূরা আনআম (৬) : ১৫২

واوفوا بعهد الله اذا عهدتم ولا تنقضوا الايمان بعد توكيدها وقد جعلتم الله عليكم كفيلا.

 (তরজমা) তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর। এবং তোমরা আল্লাহকে তোমাদের জামিন করে শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না।-সূরা নাহল (১৬) : ৯১

واوفوا بالعهد ان العهد كان مسؤلا

 (তরজমা) এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।-সূরা ইসরা (১৭) : ৩৪

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

أربع من كن فيه كان منافقا خالصا، ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها : إذا ائتمن خان، وإذا حَدَّث كذب، وإذا عاهد غَدَر، وإذا خاصم فجر

অর্থাৎ চারটি (দোষ) যার মধ্যে আছে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। আর যার মধ্যে কোনো একটি আছে সে মুনাফেকির একটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে যে পর্যন্ত না তা ত্যাগ করে। তাকে বিশ্বাস করা হলে খেয়ানত করে, কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গিকার করলে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করে।-সহীহ বুখারী ৩৪৫৮

তিনি আরো ইরশাদ করেছেন-

لكل غادر لواء يوم القيامة، يرفع له بقدر غدره، ألا ولا غادر أعظم غدرا من أمير عامة

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের সাথে পতাকা থাকবে। তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী তা উঁচু করা হবে। সাবধান! সাধারণ মানুষের নেতার চেয়ে (যদি সে বিশ্বাসঘাতকতা করে) বড় বিশ্বাসঘাতক আর কেউ নেই।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৭৩৮

বদরের ঘটনা তো সকলেরই জানা আছে। সে সময় লোকবল ও উপকরণ সকল দিক থেকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সে সময়েরই ঘটনা। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা. বলেন, আমি ও আমার পিতা বদরের যুদ্ধে এজন্য অংশগ্রহণ করতে পারিনি যে, আমরা মদীনার উদ্দেশে রওনা হলে কুরাইশের কাফেররা আমাদেরকে গ্রেফতার করে এবং এই ওয়াদা নেয় যে, আমরা মদীনায় যেতে পারি, তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না।

আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌঁছে ঘটনা শোনালে তিনি ইরশাদ করলেন-

انصرفا، نفي لهم بعهدهم، ونستعين الله عليهم،

তোমরা ফিরে যাও, আমরা তাদের সাথে কৃত অঙ্গিকার পূরণ করব আর তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করব।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৭৮৭

হুদাইবিয়া সন্ধির সময় মুশরিকদের সাথে এই চুক্তি হয়েছিল যে, কুরাইশের কোনো ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চলে এলে তাকে কুরাইশের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। হুদাইবিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পরপরই আবু বাসীর উতবা ইবনে আসীদ মক্কার কারাগার থেকে পলায়ন করে মদীনায় চলে এলেন। মুশরিকরা দুই ব্যক্তিকে মদীনায় পাঠাল তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাসীরকে বললেন-

يا أبا بصير! إنا قد أعطينا هؤلاء القوم ما قد علمت، ولا يصلح لنا في ديننا الغدر، وإن الله جاعل لك ولمن معك من المستضعفين فرجا ومخرجا، فانطلق إلى قومك.

আবু বাসীর! আমরা এই গোত্রের সাথে যেসব অঙ্গিকার করেছি তা তুমি জান। আর আমাদের ধর্মে অঙ্গিকার ভঙ্গের অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা তোমার ও তোমার মতো দুর্বলদের জন্য কোনো উপায় অবশ্যই বের করে দিবেন। তুমি তোমাদের গোত্রের নিকট ফিরে যাও।

আবু বাসীর আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আমাকে মুশরিকদের হাতে সোপর্দ করছেন? তারা তো আমাকে বিপদের সম্মুখীন করবে? আল্লাহর রাসূল বললেন, না, তুমি যাও। আল্লাহ তোমাদের জন্য কোনো উপায় বের করে দিবেন।

মোটকথা, আবু বাসীরকে কুরাইশের লোকদের হাতে সোপর্দ করে দিলেন।-সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩২৩; সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৭৩১, ২৭৩২

এজাতীয় ঘটনা নবী-জীবনে ও সাহাবা-জীবনে অগণিত। কিন্তু আজ আমাদের সমাজে চুক্তিভঙ্গ করা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ না করাকেই কৃতিত্ব মনে করা হয়।

৬. রহমত ও মমতা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। শুধু মানুষের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وما ارسلنك الا رحمة للعالمين.

তাঁর শিক্ষা ছিল-

الراحمون يرحمهم الرحمن تبارك وتعالى، ارحموا من في الأرض يرحمكم من في السماء.

দয়াকারীদের প্রতি আল্লাহ তাআলা দয়া করেন। জমিনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর তাহলে আকাশে আসমান ওয়ালা তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।

আজ আমরা একে অন্যের অধিকার হরণ করছি, একে অন্যের প্রতি জুলুম করছি, গীবত-শেকায়েত করছি। অন্যের দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণকামিতা আজ আমাদের মাঝে নেই, অহংকার ও বড়ত্বের শিকার হয়ে অন্যের মন্দ বলছি, অন্যের হেদায়েতের কথা চিন্তাও করি না কিংবা হেদায়েতের নামে গালিগালাজ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছি। এসব কিছুর মূলে রয়েছে আমাদের সহৃদয়তার অভাব কিংবা নির্দয়তা। অথচ আমরা যার উম্মত তাঁকে আল্লাহ তাআলা প্রেরণ করেছেন রহমত হিসেবে। তিনি ছিলেন রহমতের মূর্ত প্রতীক। আল্লাহ তাআলা তাঁকে রউফ ও রাহীম নামেও অভিহিত করেছেন।

৭. জীবিকা হালাল হওয়া

আল্লাহ তাআলা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেসব দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে হালাল-হারামের বিষয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

يحل لهم الطيبت ويحرم عليهم الخبئث

যে তাদের জন্য পবিত্র বস্ত্ত হালাল করে এবং অপবিত্র বস্ত্ত হারাম করে।-সূরা আরাফ (৭) : ১৫৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হালাল ও হারামের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং জীবনভর নিজেও সে বিধান মেনে চলেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

يايها الرسل كلوا من الطيبت واعملوا صلحا انى بما تعملون عليم.

 (তরজমা) হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত থেকে আহার কর এবং সৎ কর্ম কর। তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবহিত।-সূরা মুমিনুন (২৩) : ৫১

নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে উম্মতকে কুরআনের এই বিধান মোতাবেক চলার তাকিদ করে গেছেন-

يايها الذين آمنوا كلوا من طيبت ما رزقنكم واشكروا الله ان كنتم اياه تعبدون

হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমি যেসব পবিত্র বস্ত্ত দিয়েছি তা হতে আহার কর এবং আল্লাহর শোকরগোযারী কর যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত কর।-সূরা বাকারা (২) : ১৭২

উম্মতের উদ্দেশে ইরশাদ করেছেন-

ايها الناس! إن الله طيب، لا يقبل إلا طيبا، وإن الله أمر المؤمنين بما أمر به المرسلين.

লোকসকল! আললাহ তাআলা পবিত্র, তিনি কেবল পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ঐ আদেশ দিয়েছেন, যা তিনি রাসূলদেরকে দিয়েছেন (অর্থাৎ হালাল ও পবিত্র জীবিকা গ্রহণ কর এবং নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা করতে থাক)। এরপর তিনি উপরোক্ত আয়াত দুটি তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং বললেন, এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন সফরে রয়েছে, ধুলিমলিনবেশে আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে আল্লাহকে ডাকছে-ইয়া রব, ইয়া রব! (সফরের হালতে, বিশেষত এ ধরনের অসহায় অবস্থায় দুআ কবুল হয়ে থাকে।) কিন্তু এই ব্যক্তির তো পানাহার হারাম, জীবিকা হারাম। তো কীভাবে তার দুআ কবুল হতে পারে!-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৯৮৯

অন্তত এটুকু করি যে, সুদ, ঘুষ, জুয়া, চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা প্রভৃতি উপায়ে অর্জিত সম্পদ থেকে নিজেকে এবং নিজের জীবিকাকে পবিত্র রাখুন। মনে রাখবেন, হকদারকে হক থেকে বঞ্চিত রাখা, ভাইবোনকে মীরাছ থেকে বঞ্চিত রাখা এবং অন্যান্য হকদারের হক আদায় না করা, এতীমের হক আত্মসাৎ করা, মজদুরের মজুরি আদায় না করা বা মজুরি আদায়ে টালবাহানা করা সবই গছব ও আত্মসাতের বিভিন্ন প্রকার।

৮. উত্তম ব্যবহার

স্বয়ং আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন-

وانك لعلى خلق عظيم

তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।-সূরা কলম (৬৮) : ৪

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বলেছেন-

إنما بعثت لأُتَمِّمَ مكارِمَ الأخلاق.

মহত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৮৯৫২; মুয়াত্তা মালেক ২/৯০৪; আততামহীদ ২৪/৩৩৩

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন-

كان خلقه القرآن

কুরআনই হল তাঁর চরিত্র।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৭৪৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীস : ১৬০০

অর্থাৎ কুরআন যে কাজে উৎসাহ দেয় কিংবা কুরআনে যা প্রশংসিত তা গ্রহণ করা আর কুরআন যে কাজ নিষেধ করে বা কুরআনে যা নিন্দিত তা থেকে বিরত থাকাই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ ও শিআর। আর এই আদর্শের উপরই তিনি সাহাবায়ে কেরামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

তাঁর উত্তম চরিত্র সম্পর্কে উপরোক্ত আসমানী ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও তিনি নামাযে দুআ করতেন-

اللهم اهدني لأحسن الأخلاق ولا يهديني لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سَيِّئَها ولا يصرف عني سيِّئَها إلا أنت.

হে আল্লাহ! আমাকে সুন্দরতম চরিত্রের দিকে পথপ্রদর্শন করুন। আপনি ছাড়া কেউ আমাকে সুন্দরতম চরিত্রের নির্দেশনা দিতে পারে না।

আর মন্দ চরিত্র আমার থেকে দূরে রাখুন। আপনি ছাড়া কেউ তা আমার থেকে দূরে রাখতে পারে না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৭৭১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭৬০

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের সারকথা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে একজন নারী সম্পর্কে বলা হল, সে খুব নফল নামায পড়ে, রোযা রাখে এবং অনেক দান-সদকা করে। কিন্তু তার মুখের ভাষা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী।

ঐ ব্যক্তি আরেকজন এক নারী সম্পর্কে বলল, যার নফল নামায, নফল রোযা ও দান-সদকার ক্ষেত্রে তেমন প্রসিদ্ধি নেই। কখনো হয়ত সামান্য পনিরের টুকরা সদকা করে। তবে সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কেউ তার মুখের ভাষায় কষ্ট পায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতী।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৯৩৮৩; শুআবুল ঈমান, হাদীস : ৯৫৪৬

উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সর্বাধিক অধিকার পিতামাতার। রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এমনও বলেছেন-

الزَمها، فإن الجنة تحت رجليها.

মায়ের খেদমতে নিয়োজিত থাক। কারণ জান্নাত তাঁর পদতলে রয়েছে।-সুনানে নাসাঈ, হাদীস : ৩১০৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৫৩৮

আরো ইরশাদ করেছেন-

رضا الرب في رضا الوالد، وسخط الرب في سخط الوالد.

আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে পিতার সন্তুষ্টিতে। আর আললাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসস্ত্তষ্টিতে।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৮৯৯; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪২৯

তবে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নীতি

لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل

আল্লাহর অবাধ্যতায় কোনো মাখলুকের আনুগত্য নয়-সব সময় প্রযোজ্য। এই মূলনীতির দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা জরুরি। আর এই মূলনীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে উত্তম ব্যবহারও সম্ভব। সুতরাং উত্তম ব্যবহারের ছুঁতায় আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার সুযোগ নেই।

৯. নারীর প্রতি সম্মান ও সন্তানের তরবিয়ত

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সমগ্র বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির জন্যই রহমত। আমার মতে তাঁর রহমতের সবচেয়ে বড় অংশ পেয়েছে নারীজাতি। নারীর সম্মান ও মর্যাদা এবং তাদের হক ও অধিকার প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে নবুওয়তে মুহাম্মাদীর অনেক বড় অনুগ্রহ। সব শ্রেণীর নারীর অধিকার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথকভাবে তাকিদ করেছেন এবং নিজের কথা ও কাজে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মুসলিম উম্মাহ যদি ইসলামের বিধান এবং প্রিয় নবীর সুন্নাহর অনুসারী হয়ে থাকে তাহলে এটা সম্ভব নয় যে, তাদের দ্বারা নারীর অমর্যাদা ও অধিকার হরণ হবে। এটা তো ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নববী সুন্নাহর সংস্কারমূলক কাজের তালিকায় এটি শীর্ষস্থানীয়।

এ সংক্রান্ত ঘটনাবলি ও শামায়েলের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখানে শুধু প্রিয় নবীর কয়েকটি বাণী উল্লেখ করা হল।

এক.

خياركم خياركم لنسائكم، وأنا خياركم لنسائي.

তোমাদের মধ্যে উত্তম মানুষ তারা, যারা তাদের নারীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের সবার চেয়ে উত্তম।-সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃ. ১৪২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬২

আরো ইরশাদ করেছেন-

استوصوا بالنساء خيرا

নারীদের বিষয়ে কল্যাণের উপদেশ আমার কাছ থেকে গ্রহণ কর।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬৩

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে ইরশাদ করেছেন-

اتقوا الله في النساء، فإنكم أخذتموهن بأمان الله، واستحللتم فروجهن بكلمة الله.

তোমরা নারীর বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ তাদেরকে তোমরা গ্রহণ করেছ আল্লাহর নিরাপত্তায় আর তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ আল্লাহর কালিমা দ্বারা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস :১২১৮/১৪৭

কন্যাসন্তান সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

لا تكرهوا البنات فإنهن المؤنسات الغاليات

তোমরা মেয়েদের অপছন্দ করো না। কারণ তারা অন্তরঙ্গতা দানকারী মূল্যবান সম্পদ।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৩০৬

আরো ইরশাদ করেছেন-

من كان له ثلاث بنات، أو ثلاث أخوات، أو ابنتان أو أختان فاتقى الله فيهن، وأدَّبهن، وزوَّجهن، وأحسن إليهن فله الجنة.

যার তিনটি কন্যাসন্তান বা তিনজন বোন কিংবা দুইটি কন্যাসন্তান বা দুইজন বোন আছে আর সে তাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করেছে, তাদেরকে আদব শিখিয়েছে, পাত্রস্থ করেছে এবং তাদের প্রতি দয়া করেছে তবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১০৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১১৩৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪৪৬

তিনি শুধু কন্যা আর বোন সম্পর্কেই বলেননি; বরং দাসী সম্পর্কেও ইরশাদ করেছেন-

رجل كانت عنده أمة فأدبها فأحسن تأديبها، وعلمها فأحسن تعليمها، ثم أعتقها فتزوجها فله أجران.

কারো যদি একটি দাসী থাকে আর তাকে সে আদব শেখায়, জ্ঞান শিক্ষা দেয় এরপর তাকে আযাদ করে এবং বিয়ে করে তবে তার জন্য রয়েছে দুই প্রতিদান।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৯৭

শিক্ষাদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নামাযের আদেশ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

مروا أولادكم بالصلاة وهم أبناء سبع سنين، واضربوهم عليها وهم أبناء عشر، وفرِّقوا بينهم في المضاجع.

সাত বছর বয়সেই সন্তানকে নামাযের আদেশ কর। আর দশ বছরে উপনীত হলে (প্রয়োজনে) নামাযের জন্য প্রহার কর আর তাদের পরস্পরের শয্যা পৃথক করে দাও।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৯৫; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৭৫৬

মোটকথা নারী জাতির প্রতি সম্মান ও সদাচার, তাদের অধিকার আদায়, সন্তান-সন্ততি, বিশেষত কন্যাসন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা, দ্বীন ও দুনিয়ার আদব-কায়েদা শেখানো, তাদের অধিকার আদায় করা ও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা-সবকিছুই সুন্নাহ ও নবী-আদর্শের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসব বিষয়ে অবহেলা করে কেউ কখনো সুন্নাহর অনুসারী হতে
পারে না।

১০. সৃষ্টির সেবা

সৃষ্টির সেবা নবী-জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবুওয়তের প্রথম দিন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রা.-এর পবিত্র মুখে উচ্চারিত হয়েছিল-

كلا، لا يخزيك الله أبدا، إنك تصدق الحديث، وتؤدي الأمانة، وتحمل الكل، وتكسب المعدوم، وتصل الرحم، وتقري الضيف، وتعين على نوائب الحق.

কখনো নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো বিব্রত করবেন না। আপনি তো সত্য কথা বলেন, আমানত রক্ষা করেন, অসহায়ের ভার বহন করেন, নিঃস্বকে উপার্জনের ব্যবস্থা করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, মেহমানদারী করেন এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের সহযোগিতা করেন।-বুখারী, হাদীস : ৩

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর ভাষায়-

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس، وكان أجود ما يكون في رمضان، يحن يلقاه جبريل وكان يلقاه في كل ليلة من رمضان، فيدارسه القرآن، فلرسول الله أجود بالخير من الريح المرسلة.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ বদান্যশীল ছিলেন। তার এই বদান্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ হত রমযানে। যখন জিব্রীল আ. তার সাথে সাক্ষাত করতেন। জিব্রীল আ. রমযানের প্রতিরাতে আগমন করতেন এবং পরস্পর কুরআন শুনাতেন। আল্লাহর রাসূল তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়ে অধিক কল্যাণবর্ষী ছিলেন।-সহীহ বুখারী ৫

খেদমতে খালকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ধর্মীয় সেবা। ইকামতে দ্বীনের সকল কাজই আল্লাহর মাখলুকের সেবা; বরং এটিই প্রধান সেবা। এ ছাড়া মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ব্যক্তি ও পরিবারের শুদ্ধি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি, শাসক ও বিচারকের সংশোধন, ঈমান ও কুরআনের তালীম এবং আত্মশুদ্ধি ও তরবিয়তসহ দ্বীন প্রতিষ্ঠার সকল কাজই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান দায়িত্বের মধ্যে শামিল ছিল। আর এ ক্ষেত্রে তাঁর আত্মনিবেদন এ আয়াত থেকেই অনুমান করা যায়-

فلعلك باخع نفسك على آثارهم إن لم يؤمنوا بهذا الحديث أسفا.

তারা এই বাণী বিশ্বাস না করলে সম্ভবত তাদের পিছনে ঘুরে তুমি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে।-সূরা কাহাফ (১৮) : ৬

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতকে সাধারণভাবে আর তাঁর ওয়ারিছদেরকে বিশেষভাবে খেদমতে খালকের উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর উত্তরাধিকারের হক আদায় করা অপরিহার্য।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement