জুমাদাল উলা-১৪৩৩   ||   এপ্রিল-২০১২

তোমার হামদ, ইয়া আল্লাহ! তোমার শোকর

 

হাদীস শরীফে আছে-

من لم يشكر القليل لم يشكر الكثير، ومن لم يشكر الناس لم يشكر الله

যে অল্প কিছুর উপর শোকরগোযারি করে না সে অনেক কিছুর উপরও শোকরগোযারি করে না। (কিংবা করলেও তাকে শোকরগোযার বলে গণ্য করা হয় না) যে মানুষের শোকরগোযারি করে না সে আল্লাহরও শোকরগোযারি করে না।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮৪৪৯, ১৯৩৫০

হাদীস অনুযায়ী প্রথমেই আমরা আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করছি। তাঁর হামদ ছানা করছি। নিজের কিছু কমযোর বান্দাকে তিনিওয়াহদাতুল উম্মাহ ওয়াত্তিবাউস সুন্নাহশিরোনামে ইলমের, ফিকরের এবং দাওয়াতের একটি মজলিস করার তাওফীক দান করেছেন। ইয়া আল্লাহ! এই সামান্য কাজকে, যা শুধু তোমারই তাওফীকে সম্পন্ন হয়েছে, জাহির-বাতিন সবদিক থেকে অসামান্য বানিয়ে দাও।

এরপর আমরা ঐসব বন্ধুর শোকরগোযারি করছি, যারা কোনোভাবে এই মজলিসকে কামিয়াব করার চেষ্টা করেছেন বা করবেন। সবচেয়ে বড় সহযোগিতা ঐসব মুরবিব, বন্ধু তলাবায়ে কেরামের, যারা কষ্ট স্বীকার করে, নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে, শুধু দ্বীনী মহববতের কারণে মজলিসে এসেছেন এবং দীর্ঘ সময় শান্ত সমাহিতভাবে অবস্থান করেছেন। আমরা তাঁদের অপরিহার্য খিদমতটুকুও করতে পারিনি। অনেক ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, অনেক ভাই মজলিস-কক্ষের বাইরে মেঝের বিছানায় বসে আলোচনা শুনেছেন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে নিজের শান মোতাবেক জাযায়ে খায়ের দান করুন এবং আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করুন। এরচেয়েও বড় সহযোগিতা সকল ভাই-বোন মুরববীদের, যাঁরা তাঁদের দুআর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন এবং তাদেরকেও, যারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং উত্তমরূপে তা পালন করেছেন। আমি সংক্ষেপে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের চিন্তা কর্মের প্রতিটি কণা সম্পর্কে সম্যক অবগত।

***

কুরআন মজীদের তিলাওয়াত এবং হামদ-নাতের মাধ্যমে মজলিসের সূচনা হল। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার মুদীরে মুআসসিস (প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক) এবং আততাখাসসুস ফিলফিকহি ওয়াল ইফতার মুশরিফ হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ-এর স্বাগত ভাষণের পর প্রবন্ধকার প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। এরপর  প্রবন্ধকারের পক্ষ হতে মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠ করেন। মাশাআল্লাহ, তাঁর পাঠ ছিল গতিশীল এবং শুদ্ধ   সাবলীল। আল্লাহ তাআলা তাঁর হৃদয় চিন্তায় এবং মুখের কলমের ভাষায় আরো বরকত দান করুন; তাঁকে সুস্থ, সুন্দর নিরাপদ জীবন-হায়াতে তাইয়েবা তবীলা নসীব করুন; দ্বীনের খিদমতের জন্য তাঁকে এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি বংশধরকে কিয়ামত পর্যন্ত কবুল করুন।

তিনি এজন্যও গভীর কৃতজ্ঞতার হকদার যে, একটি বিশুদ্ধ ইলমী প্রবন্ধ, যাতে অনেক সূক্ষ্ম শাস্ত্রীয় পরিভাষা এসেছে, অতি প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং অধিকাংশ জায়গাতেই আরবী পরিভাষাগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী বাংলা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরুচির পরিচয় দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে কবুল করুন এবং সকল অনিষ্ট অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন আমীন।

***

সামান্য বিরতির পর আলোচনা-পর্ব শুরু হল। আমরা দুঃখিত যে, সময়স্বল্পতার কারণে উপস্থিত সুধীবৃন্দের অভিব্যক্তি শোনার সুযোগ পাইনি-না উলামা-মাশায়েখের, না সাধারণ শিক্ষিত ভাইদের, যাঁদের অনেকেই নিজ নিজ অঙ্গনে খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাআলা সবাইকে সুস্থ নিরাপদ রাখুন।

শুধু তিনজন আলিমের আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছে। মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম প্রবন্ধের পূর্ণাঙ্গতা প্রামাণ্যতার প্রশংসা করে, এর চিন্তা আহবানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এই বিষয়ে জোর দিয়েছেন যে, একমুখী অধ্যয়ন খুবই ক্ষতিকর। এটা মানুষকে প্রান্তিকতার শিকার করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি পুস্তিকা থেকে কয়েকটি বাক্য পাঠ করে শোনান, যেটি লেখা হয়েছে খাইরুল কুরূন থেকে চলে আসা সুন্নতে মুতাওয়ারাছা, বিশ রাকাত তারাবী খন্ডন করার জন্য, লেখক আশ্চর্য ধরনের বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে এবং অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম প্রবন্ধের পূর্ণাঙ্গতার প্রশংসা করেছেন এবং এর চিন্তা আহবানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এরপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

. একটি শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ইসলাম কখনো স্বাভাবিক বৈচিত্রকে অস্বীকার করে না। এই বৈচিত্র আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন এবং সৃষ্টির জন্য অনেক বড় রহমত। এই স্বাভাবিক বৈচিত্রকে স্বস্থানে রেখে ইসলাম মানুষকে তাওহীদ জরুরিয়াতে দ্বীনের সূত্রে একতাবদ্ধ থাকার আদেশ করে এবং এই বৈচিত্র-বর্ণিলতার ভুল ব্যবহার নিষেধ করে।

. তিনি আরেকটি সুন্দর কথা বলেছেন যে, শরীয়তসম্মত মতপার্থক্য লজ্জা বা দোষের বিষয় নয়। তো এই উম্মতের গর্ব গৌরবের বিষয়। থেকে বোঝা যায়, ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতাকে কী বিপুলভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর দ্বারা এমন সমৃদ্ধ চিন্তাঘরানা-স্কুল অব থট বিকশিত হয়েছে এবং এমন সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছে, যার নজীর পৃথিবীর আর কোনো জাতির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। (তবে ইসলাম স্বাধীনতার নামে অরাজকতা অনুমোদন করে না। অরাজকতা অর্থ বুদ্ধির ভুল প্রয়োগ এবং ভুল ক্ষেত্রে প্রয়োগ। বুদ্ধির অরাজকতার অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে বাস্তবতার বিকৃতি এবং স্বীকৃত সত্যের প্রতি অবিচার।

তিনি বলেন, এখন যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হচ্ছে, মতপার্থক্যকে স্বস্থানে সীমাবদ্ধ রাখা, কোনো অবস্থাতেই একে কলহ-বিবাদের কারণ না বানানো।

. তিনি আরো বলেন, ‘ইখতিলাফে কিরাতেরহাদীসকেইখতিলাফে আরাবা মতভেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্পর্কে দ্বিতীয়বার চিন্তা করা যেতে পারে।

(তাঁর বক্তব্য সঠিক, এখানে প্রবন্ধের আলোচনা কিছুটা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। মূলত হাদীস দ্বারা ইখতিলাফে আরা বা মতভেদের বিষয় নয়; বরং ইখতিলাফে তানাওউ বা সুন্নাহর বিভিন্নতার ইখতিলাফ প্রসঙ্গে দলিল পেশ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে ইবনে তাইমিয়াও তাই করেছেন, যা যুক্তিযুক্তও বটে।)

তিনি আরেকটি বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সে সম্পর্কে প্রবন্ধের পরবর্তী সংস্করণে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে।

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী মুদ্দাযিল্লুহুমুল আলীকে আল্লাহ তাআলা সুন্দর উপস্থাপনার যোগ্যতা দিয়েছেন। কঠিন বিষয়কে সহজ ভাষায় বলার ক্ষেত্রে তাঁর পটুতা আছে। কিন্তু এদিন তাঁর উপর কিছুটা হাস্য-রস, আর কিছুটা আবেগ-জযবার প্রাবল্য ছিল। কারণে দীর্ঘ আলোচনার পরও তিনি মূল বিষয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। তবে তাঁর বিক্ষিপ্ত কথাগুলোর মাঝেও অনেক দরকারি কথা ছিল। যেমন তিনি অত্যন্ত তাকীদের সাথে প্রবন্ধটি বার বার পড়তে বলেছেন। প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্তর বিচারে এটি একটি উপযোগী প্রয়োজনীয় পরামর্শ।

***

মজলিস যদিও আলহামদুলিল্লাহ, নির্ধারিত সময়ে ঠিক সকাল নয়টায় শুরু হয়েছিল, কিন্তু আফসোস, সময়মতো সমাপ্ত করা যায়নি। সভাপতি সাহেবের অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর হাফেজ্জি হুজুর রাহ.-এর বড় ছাহেবযাদার দুআর মাধ্যমে, যিনি মজলিসে উপস্থিত ছিলেন, দুপুর দেড়টায় মজলিস সমাপ্ত হয়।

নিকটেই কাকরাইল মসজিদে জোহরের নামায বেলা দুইটায় হয়ে থাকে। আমরা জামাতে শরীক হয়েছি। অনেকে হলের নিচের নামায-কক্ষে জামাতের সাথে নামায পড়েছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই ত্রুটি ক্ষমা করুন।

সময়-সচেতনতা খুবই জরুরি। বিষয়ে শিথিলতা সমীচীন নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা ছিল সময়ের অভাবে প্রশ্নোত্তর পর্বটি হতে না পারা। প্রায় একশ চিরকুট জমা হয়েছিল। কিছু চিরকুটে অভিনন্দন পরামর্শ ছিল। অধিকাংশ চিরকুটেই নানা ধরনের প্রশ্ন ছিল। দায়িত্বশীলগণ সকল পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন এবং সাধ্যানুযায়ী বাস্তবায়নেরও চেষ্টা করবেন। আর সাধারণ প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে আলকাউসারেরআপনি যা জানতে চেয়েছেনবিভাগে এসে যাবে। ইনশাআল্লাহ প্রবন্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলোর জবাব ইনশাআল্লাহুল আযীয আগামী বর্ধিত সংস্করণে, প্রশ্নসহ বা প্রশ্ন ছাড়া, প্রকাশিত হবে।

অনেক মুরববী, দোসত-আহবাব এবং তলাবায়ে কেরাম লিখিতভাবে মৌখিকভাবে মারকাযের দায়িত্বশীলদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁদের এই দুআ তারগীবকে কবুল করুন এবং মজলিসকে মুআছ্ছির ফলপ্রসূ বানিয়ে দিন।

***

কিছু ভাই জিজ্ঞাসা করেছেন, এই মজলিসের পয়গাম কী। কী বার্তা নিয়ে আমরা এখান থেকে ফিরছি। আমি বলেছি, মজলিসের পয়গামপ্রবন্ধের সারসংক্ষেপশিরোনামে এবং প্রবন্ধের শেষেকিছু অনুরোধশিরোনামে বলা হয়েছে। সংক্ষেপে পুনরায় তা উল্লেখ করছি।

. তাওহীদ জরুরিয়াতে দ্বীনের বিষয়ে সামান্যতম অবহেলা শৈথিল্য প্রদর্শন থেকেও বিরত থাকি।

. আহলুস সুন্নাহ ওয়ালজামাআর নীতি আদর্শের উপর অটল অবিচল থাকি।

. সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে প্রত্যেককে তার সমাজে অনুসৃত সুন্নাহর উপর থাকতে দিই।

. ইজতিহাদী বিষয়ে অন্যান্য মুজতাহিদ তাঁদের অনুসারীদের উপর নাহী আনিল মুনকারের নীতি প্রয়োগ না করি।

. তলাবায়ে কেরাম, ওয়ায়েজীনে কেরাম এবং মসজিদের ইমাম খতীব ছাহেবান হিফযুন নুসূস তাফাক্কুহ ফিদ্দীন অর্জনের বিষয়ে সচেষ্ট হই।

. যোগ্য সমঝদার আলিম তালিবে ইলমের জন্য ফিকহী মাযহাবসমূহের ইখতিলাফী মাসাইল একতরফাভাবে অধ্যয়ন করা উচিত নয়। অসম্পূর্ণ অধ্যয়নের তো প্রশ্নই আসে না।

. কারো সাথে কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি রক্ষায় পূর্বের চেয়ে অধিক সতর্ক হই। কারণ দাবি রক্ষার এটিই প্রকৃত সময়।

. শরীয়তসম্মত মতপার্থক্যকে কলহ-বিবাদে পর্যবসিত করা থেকে বিরত থাকি। মতপার্থক্যের মাঝেও ঐক্য বন্ধুত্বের অনুশীলন করি।

. প্রজ্ঞা তাফাক্কুহ, আদব তাওয়াজু এবং ইতিদাল ভারসাম্য অর্জন করার জন্য আহলে দিল আহলে ফিকহ বুযুর্গদের সোহবত গ্রহণ করি।

১০. সর্বসম্মত বিধান সুন্নাহর প্রচার প্রশিক্ষণ এবং এর দাওয়াত আহবানে বেশি জোর দিই।

১১. আমানতদারি সমঝদারির সাথে উপরোক্ত পয়গামগুলো অন্যের কাছেও পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।

মুহাম্মাদ আবদুল মালেক  

 

 

 

advertisement