রবিউল আখির ১৪৩৩   ||   মার্চ-২০১২

বিধবা, বিপত্নীকের পুনর্বিবাহ-প্রসঙ্গ : নির্মম সমাজ, নিঃসঙ্গ জীবন

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

বাবা বা মায়ের মৃত্যু সন্তানের পক্ষে নিদারুণ শোকের, তবে বাবা-মা যে বয়সেই মারা যান এবং সন্তানও তখন যে বয়সেই উপনীত হোক, এ এক জরামুক্ত চিরসবুজ সম্পর্ক। প্রশ্ন এ নিয়ে নয়, প্রশ্ন হচ্ছে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের কিংবা মায়ের মৃত্যুর পর বাবার মনোভূমে যে দুঃসহ রিক্ততার সৃষ্টি হয়, সন্তান তা ঠিক ততখানি উপলব্ধি করে কি? আর উপলব্ধি করলেও সেই রিক্ততা পূরণের জন্য সে কতটুকু আন্তরিক থাকে এবং তা পূরণের জন্য বাস্তবসম্মত কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে? বিপত্নীক বা বিধবা যে নরনারী আপনার ধারে কাছে আছে তাদের উপর বারেক নজর বুলালে এসব প্রশ্ন আপনাকে অবশ্যই নাড়া দিবে। সেই সঙ্গে এই অনুভূতিও জাগ্রত হবে যে, ক্ষেত্রবিশেষে আমরা কতই না হৃদয়হীন এবং আমাদের হৃদয়াবেগও কতই না স্থূল!

দীর্ঘ একটা জীবন বাবা-মা পরস্পর লতিয়ে-জড়িয়ে ছিলেন। তাদের পরস্পরের মধ্যে ছিল গভীর ভালবাসা ও বিশ্বস্ততা। ছিল অকৃত্রিম সহযোগিতা ও নির্ভরতা। সুনিবিড় সাহচর্যে তারা ছিলেন একশা-একাত্মা। তারপর হঠাৎ করেই যখন একজন চলে গেলেন তখন ভাবুন দেখি, অন্যজনের অবস্থাটা।

নিঃসঙ্গতার কি জগদ্দল পাষাণে তিনি চাপা পড়ে গেলেন। কিভাবে তিনি এর থেকে মুক্তি পাবেন? যে মমতাসিক্ত আনুকূল্য এতদিন তাকে সচল রেখেছিল তা যে ছিন্ন হয়ে গেল! এখন কে তার জীবনচক্রে গতি যোগাবে? যেই নিবিড় সাহচর্য তার মাঝে প্রাণশক্তি যোগাত, তা যে হারিয়ে গেল, ততে তার কর্মব্যস্ত জীবন নিস্তরঙ্গ, নিথর হয়ে গেল না কি? এই নিস্তরঙ্গতার উপশমের জন্য দরকার এক তীব্র প্রণয়াঘাত। তা তিনি কোথায় পাবেন? ব্যক্তি জীবনে তার ছিল এক পরম নির্ভরতা। সেই নির্ভরতায় দেহমন হয়ে উঠেছিল ঋজু-ঋদ্ধ এবং তা তাকে করেছিল বিচিত্র ভারবাহী। আজ সে নির্ভরতা অন্তর্নিহিত। ফলে মানসিকভাবে তিনি ভেঙ্গে চুরমার। এখন কোন অবলম্বনে তিনি তার অন্তর্জীবনের ঋজুতা ফিরে পাবেন? তার রয়েছে এক বিস্তীর্ণ জগত। সেখানে আছে তার দায়বদ্ধতা। সে জন্য চাই দুর্দান্ত উদ্যম ও দুর্মর প্রাণশক্তি। অথচ জীবনের দোসর ও একান্ত সহযোগী হারিয়ে এখন তিনি বিপর্যস্ত ও ভগ্নস্পৃহ।

তার সুবিন্যস্ত ও অভ্যস্ত জীবন জেরবার। মন স্মৃতিভারাক্রান্ত, দ্বিধাদীর্ণ। স্নায়ুতে গভীর ক্লান্তি। এ অবস্থা থেকে তার উদ্ধারের উপায় কী? আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশি এরূপ ক্ষেত্রে এসে পাশে দাঁড়ায় বটে। তারা বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং প্রত্যেকে আপন আপন বুদ্ধি-বিবেচনা ও সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতাও করে। কিন্তু তা তো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তাতে ক্ষণিকের জন্য বেদনা লাঘব হয় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে উপস্থিত প্রয়োজনটুকু মেটে। এখানে দরকার তো এমন কোনো ব্যবস্থা, যা দ্বারা তার বিধ্বস্ত জীবন পুনর্গঠিত হবে। এর জন্য চাই বিশ্বাস ও নির্ভরতার একটি স্থান। যেমন তার আগে ছিল। অর্থাৎ দাম্পত্য জীবন পুন:স্থাপনই হচ্ছে তার বর্তমান সমস্যাবলির প্রকৃত সমাধান। তিনি যা কিছু হারিয়েছেন তা লাভ তো হয়েছিল এ পথেই। সুতরাং পুনরায় তা পেতে হলে এ পথেই তার চলতে হবে। এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে তার জন্য স্বস্তি ও শৃঙ্খলা। এরই মাধ্যমে তিনি পেতে পারেন চলার প্রেরণা ও উদ্দীপনা। ইসলাম যে বৈবাহিক ব্যবস্থা দিয়েছে এই তো তার তাৎপর্য। ইরশাদ হয়েছে-

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

 (তরজমা) তাঁর এক নির্দশন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন রয়েছে সেইসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।-সূরা রূম (৩০) : ২১

বিবাহের তাৎপর্যের প্রতি ইঙ্গিত করার সাথে সাথে এ আয়াতে রয়েছে চিন্তার আহবান। চিন্তাশীলমাত্রই উপলব্ধি করতে পারবে যে, বিবাহের ভেতর যেসব উপকারিতা নিহিত তা কেবল বিবাহ দ্বারাই অর্জিত হতে পারে, অন্য কোনো উপায়ে নয়। কাজেই একবার বিবাহ করার পর যখন দাম্পত্য জীবনের সুফল ভোগ করা হয়েছে এবং সেই সুফলভোগে জীবন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তখন অন্য রকম জীবনের চিন্তা করা বৃথা। বরং স্ত্রী বা স্বামী বিয়োগের পর পুনর্বিবাহ হচ্ছে আপতিত সব জটিলতা নিরসনের প্রকৃষ্ট উপায়।

বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীরভাবে ভাবছি না কিংবা এ ভাবনাকে আমরা সমাজের ভেতর চারিত করতে পারছি না। যে কারণে মানুষ পুনর্বিবাহের বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা কঠিন বাধা ছেলেমেয়ে। মা কিংবা বাবার পুনর্বিবাহকে অধিকাংশ সন্তানই মেনে নিতে পারছে না। সমাজের সর্বস্তরেই এ অবস্থা বিরাজমান। বিখ্যাত এক ব্যক্তির জীবনীগ্রন্থে পড়েছিলাম, মা পুনর্বিবাহ করায় তিনি তার মুখদর্শন করতে রাজি ছিলেন না এবং মৃত্যু পর্যন্ত তা করেননি! বলিহারি তার মাতৃভক্তি! এমন কত পিতাই না আছেন, প্রিয় সন্তানদের প্রবল বাধার মুখে যারা বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগে বাধ্য হন। অথচ বিবাহই ছিল তাদের আসল সমাধান। কিন্তু কী করা যাবে।

সন্তান বলে কথা! তাদের ক্ষমতাই আলাদা। অপত্য স্নেহই তাদের সেই ক্ষমতার উৎস আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যত পার তাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে থাক। তারা একটুও চিন্তা করে না বাবার মানসিক অবস্থা কী? কী যাতনার ভেতর তার দিন কাটছে!

সন্তানদের আপত্তির একটা বড় কারণ হল পিতার সম্পদে অংশীদার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু ঈমানদারদের তো এই ভয় করা উচিত নয়। সে জানে সম্পদের বিষয়টি নিয়তি নির্ধারিত। প্রত্যেকের কিসমত স্থিরকৃত। একের কিসমতে অন্যে ভাগ বসাতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে-

أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَةُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

 (তরজমা) এরা কি আপনার প্রতিপালকের করুণা বণ্টন করে? আমিই তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করি। পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি। যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। এবং তারা যা জমা করে তা থেকে আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহ উৎকৃষ্টতর। (সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩২

আবার অনেক সময় পিতা পর হয়ে যায় কি না সেই আশঙ্কাও থাকে। সন্তান এমন কাউকে দেখেও থাকবে যে, দ্বিতীয় বিবাহের পর প্রথম পক্ষের সন্তানদেরকে অবহেলা করছে। তা কেউ করলে সেটা অন্যায়, তার সংশোধন জরুরি। কিন্তু কেউ তা করে থাকলে সকলেই যে করবে এমন কোনো কথা নেই। এর বিপরীতও তো চোখে পড়ে। আসলকথা ন্যায়নিষ্ঠতা। এটা সকলেরই থাকা উচিত। যেমন পিতার, তেমনি সন্তানদেরও। কোনো অন্যায় আচরণই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে সমাজেরও দায়িত্ব আছে। সমাজ যদি বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় তবে সহজেই সকল অন্যায়ের রোখথাম সম্ভব।

কিন্তু সমস্যা তো সেখানেও। ব্যক্তি থেকেই তো সমাজ। ব্যক্তির চিন্তা যেহেতু স্বচ্ছ নয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই সমাজ মানসও এ বিষয়ে অনুকূল নয়। আমাদের সমাজ বিপত্নীকের পুনর্বিবাহকে ভালো চোখে দেখে না। বলাই হয়, আগের বউকে ঠিক ভালবাসত না। ভালবাসলে শাহজাহানের মতো সেই স্মৃতি বুকে আগলে রাখত। দ্বিতীয় বিবাহের চিন্তা করত না। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মুসলিমের দৃষ্টি কেন শাহজাহানেই থেমে থাকবে? দৃষ্টি কেন আরও প্রসারিত হয় না? সব ব্যাপারে আমাদের নজর তো চলে যাবে সোনার মদীনায়। প্রিয়নবী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তো আমাদের আদর্শ এবং আদর্শ তাঁর সাহাবীগণও।

উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রা.কে তিনি কতই না ভালবাসতেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর তিনি ঠিকই বিবাহ করেছিলেন। আমাদের সেই মহিয়সী মায়ের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা নিয়ে কি কোনো প্রশ্নের অবকাশ আছে? কি গভীর ভালবাসাই তিনি জীবনভর তাঁর প্রতি লালন করেছিলেন। এমনকি আম্মাজান হযরত সিদ্দীকা রা. পর্যন্ত সেই ভালবাসার অনুযোগও করেছিলেন। সুতরাং স্ত্রী বিয়োগের পর পুনর্বিবাহ প্রথমা স্ত্রীর প্রতি বীতরাগের আলামত নয়। এটা একটা প্রয়োজন এবং সমস্যা নিরসনের উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। মরহুমা স্ত্রী যত অনন্যা সাধারণই হোক তারপরও এ ব্যবস্থা গ্রহণ অনাকাঙ্খিত নয়।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী রা.কে দেখুন না। তাঁর মতো স্ত্রীভাগ্য কার কখন হয়েছে, না হতে পারে? সেই মহিয়সী স্ত্রী নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমা যাহরা রা.-এর ওফাতের পর হযরত আলী রা.ও তো আবার বিবাহ করেছিলেন এবং তার পুত্র ইতিহাসের বীর ও বুযুর্গ মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ রাহ. সেই  পক্ষেরই সন্তান। তা হযরত ফাতিমা রা.-এর প্রতি তাঁর ভালবাসায় কি কোনো খামতি ছিল? তার শত্রুও কি এমন কথা মুখে আনবে? আসলকথা হচ্ছে প্রয়োজন। প্রয়োজনের তাগিদে এমন অনেক কাজই করতে হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে কারও কাছে ভালবাসার পরিপন্থী মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে এবং অর্ন্তদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে কাজটিকে সেই ভালবাসার সাথে সাংঘর্ষিক মনে হবে না। প্রয়োজনের সাথে ভালবাসার কিসের সংঘাত। প্রয়োজনের খাতিরেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনর্বিবাহ করেছিলেন এবং করেছিলেন তার সাহাবীগণও। কাজেই এটা তাদের সুন্নত। এতে আপত্তির অবকাশ নেই। বরং সুন্নত হিসেবে এ ব্যবস্থাকে সাদরে গ্রহণ করে নেওয়া উচিত। সন্তানদেরই উচিত নিজেরা উদ্যোগী হয়ে বাবাকে পুনর্বিবাহে প্রস্ত্তত করা। এটা তাদের কর্তব্য। এতে বাবার যেমন বহুবিধ সমস্যার নিরসন হবে, তেমনি তাদের নিজেদের পক্ষেও হবে

স্বস্তির কারণ। 

 

 

 

advertisement