রবিউল আওয়াল-১৪৩৩   ||   ফেব্রুয়ারি-২০১২

অ মা নু ষ : হায়! লাশের উপরও বর্বরতা

খসরূ খান

গুয়ান্তানামো-বে, আবু গারিব ও বাগরাম মিডিয়ায় বার বার উচ্চারিত তিনটি কারগারের নাম। প্রথমটি কিউবার একটি দ্বীপে, দ্বিতীয়টি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে এবং তৃতীয়টি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে অবস্থিত। মিডিয়ায় এ কারাগারগুলোর নাম বার বার এসেছে একটি বিশেষ কারণে। সেটি হচ্ছে বন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন। কারাগারগুলো গত কয়েক বছর ধরে মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণে এবং মার্কিন সেনারাই এই কারাগারগুলোতে মুসলিম বন্দিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন করে এসেছে। অমানুষিক প্রহার, বৈদ্যুতিক শক, গরম পানি বর্ষণ, বন্দিদের নগ্ন করে স্ত্তপ করে রাখা আর পবিত্র কুরআনের অবমাননাসহ যন্ত্রণাদায়ক নানা আচরণে বন্দিদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে মার্কিন সেনারা। মাঝে মাঝে  গোপনে ধারণ করা স্থির ছবি ও ভিডিও চিত্র প্রকাশ হওয়ায় এসব ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তারপর আবার সব চুপচাপ হয়ে গেছে। তবে প্রতিপক্ষ মুসলিম বন্দিদের প্রতি মার্কিন সেনাদের এসব বর্বর আচরণে পৃথিবীব্যাপী মুসলমানরা বিভিন্ন সময় বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও পর্যুদস্ত করার জন্যই যে এসব নির্মম নির্যাতন চালানো হয়, এটা সবার কাছেই পরিষ্কার। সবাই বুঝতে পারেন, এসব নির্যাতনের মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে কষ্ট দিয়ে দুর্বল করা কিংবা নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করাই মার্কিনীদের মূল উদ্দেশ্য। সন্দেহ নেই, মার্কিনীদের চারিত্রিক নিকৃষ্টতা ও বর্বরতা এসবের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। কিন্তু গত ১২ ও ১৩ জানুয়ারির সংবাদপত্রে বিবিসি ও সিএনএন-এর সূত্রে মার্কিন সেনাদের এমন এক বর্বর ঘটনার সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে, যার সাধারণ কোনো মানবীয় ব্যাখ্যা নেই। এটাকে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা বললেও তার স্বরূপ পরিষ্কার হয় না। খবরে প্রকাশ, আফগানিস্তানে তিনজন তালেবান সদস্যের লাশের উপর কয়েকজন আমেরিকান মেরিন সেনা প্রশ্রাব করেছে। তালেবান সদস্যদের রক্তাক্ত ও নিথর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে লাশগুলোর উপর প্রশ্রাবরত অবস্থার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় মার্কিনের নীতিনির্ধারকরা প্রথমে হকচকিয়ে যায়। মার্কিন সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে প্রথমদিকে বলা হয়-যেহেতু ইন্টারনেটে আপলোড করা ভিডিওটির উৎস ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি সেহেতু মার্কিন সেনাবাহিনীর নীতি অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না এবং প্রমাণিত হওয়ার আগে ওই ঘটনা মার্কিন সেনাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও প্রকাশ করে না। পরে অবশ্য বলা হয়-এ ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে একটি বিবৃতিও দেন। তারও পর দুজন মেরিন সেনা চিহ্নিত করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়। এরপর আবার মিডিয়া নীরব হয়ে যায়। এ লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে, তার দু-চারদিনের মধ্যে এ বিষয়ক আর কোনো তথ্য মিডিয়ায় দেখা যায়নি।

প্রতিপক্ষ মুসলিমদের লাশের ওপর মার্কিন সেনাদের এই প্রশ্রাব করার ঘটনার মানবীয় ব্যাখ্যা কী? এখানে তো শত্রুরা সব মৃত। অত্যাচার ও অপমান করলে তারা কষ্ট পাবে কিংবা পর্যুদস্ত হবে-এমন পর্যায়ে তো তারা নেই। তারপরও কেন এটা করা হল? এর একটিই উত্তর বা ব্যাখ্যা হতে পারে। আর সেটি হচ্ছে, মার্কিন সেনারা সব অমানুষ এবং কাপুরুষ। বীভৎস বিদ্বেষে ভরা এদের বুক। এদের ভেতরে মনুষ্যত্বের লেশও নেই। অসভ্যতা ও পাশবিকতার চূড়ান্ত করে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের স্বরূপটাকেই তারা ল্যাংটা করে দিয়েছে। তারা দেখিয়েছে, জীবিত বন্দি কিংবা মৃত প্রতিপক্ষ কারো জন্যই তাদের আচরণ মনুষ্যত্বের সীমার মধ্যে থাকে না। তামাশার বিষয় হচ্ছে, এরাই আবার গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও সভ্যতার ইজারাদার হয়ে দেশে দেশে স্বনিয়োজিত পাহারাদারের ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

পৃথিবীর বড় মোড়লের সৈনিকদের এই অসভ্য চিত্রের পাশাপাশি আঞ্চলিক মোড়লের সৈনিকদের আরেকটি বর্বরতার খবর এরই মধ্যে পত্রিকার পাতায় চলে এসেছে। জানুয়ারির ১৯ ও  ২১ তারিখের পত্রিকায় দেখা গেছে, ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী-বিএসএফ-এর সদস্যরা বাংলাদেশী হাবিবুর রহমানকে নগ্ন করে চরম নির্যাতন করেছে।

নির্যাতিত হাবিব চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সতের রশিয়া গ্রামের বাসিন্দা। গত ৯ ডিসেম্বর তাকে নগ্ন করে তার ওপর নারকীয় নির্যাতন চালায় বিএসএফ। ঘটনাটি ঘটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাহারাপাড়া চরমৌরুসী সীমান্তে। নির্যাতনের পর তাকে মৃত ভেবে ফেলে গেলে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে দেশে ফিরে আসেন। বিএসএফ-এর এক সদস্যের মোবাইলে ধারণ করা নির্যাতনের ভিডিও চিত্রটি ঘটনাচক্রে প্রকাশ হয়ে গেলে এ খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানতে পারে। তারপরই শুরু হয় তোলপাড়। একটি পত্রিকায় উলঙ্গ করে নির্যাতনের প্রায় নয়টি হৃদয়বিদারক ছবি ছাপিয়ে লেখা হয়েছে-একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য দুনিয়াকে আবারও লজ্জা দিয়েছে বিএসএফ। এবার বর্বরতা, নৃশংসতা, পাশবিকতার এমন কলঙ্কজনক নজির দেখাল ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার।

কিন্তু আমাদের জানা মতে এবং বিবিসির খবর অনুযায়ী এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার তিন দিন পর পর্যন্তও আমাদের বর্তমান সরকার এ ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ জানায়নি।

একই রকম ঘটনা চারদিকে। একই রকম প্রতিক্রিয়া চারদিকে। কোথাও ইহুদী-খ্রিস্টানরা মুসলমানদের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। কোথাও মুশরিক-মুলহিদরা মুসলমানদের উলঙ্গ করে পেটাচ্ছে। কোথাও জীবিত বন্দিদের, কোথাও নিহত নিথর মুসলমানদের। অথচ সংশ্লিষ্ট মুসলিম দেশের সরকার বাহাদুররা এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে সাহস পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত এটাকে আমরা কী বলব? সহিষ্ণুতা, উদারতা, বন্ধুত্ব না অপারগতা? অথবা কেউ যদি শেষের এই আচরণটাকেও বর্বরতা ও মনুষ্যত্বহীনতার একটি নমুনা বলে খেদোক্তি করেন তাহলে তাকে আমরা কী বলে শান্ত করার চেষ্টা করব? 

 

 

advertisement