রবিউল আওয়াল-১৪৩৩   ||   ফেব্রুয়ারি-২০১২

পড়া মনে না থাকা :আকাবিরের দৃষ্টিতে তার প্রতিকার

মাওলানা মুহাম্মাদ আনসারুল্লাহ হাসান

 

পড়া ভুলে যাই, পড়া বুঝে আসে না, মুখস্থ করা পড়া মনে থাকে না, পড়ালেখায় মন বসে না-এ অভিযোগ আমাদের অনেকেরই আছে। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ও মেধাহীনতা ছাড়া এর আর কী কারণ থাকতে পারে এবং এর প্রতিকার কী-এ সম্পর্কে আকাবির ও আসলাফের কিছু বাণী ও ঘটনা উল্লেখ করছি। যাতে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ ও সঠিক নির্দেশনা রয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, অবশ্যই আমি মনে করি, মানুষ তার শিক্ষা করা ইলম ভুলে যায় তার কৃত গুনাহর কারণে।-জামিউ বয়ানিল ইলম ১/১৯৬

হযরত ইবনে আববাস রা. মানুষের বাহির ও ভিতরে নেক কাজ ও অসৎ কাজ কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, নেক আমলের কারণে অন্তরে নূর পয়দা হয়, দেহের শক্তি বাড়ে, চেহারায় শোভা বৃদ্ধি পায়, রিযিক প্রশস্ত হয় এবং মানুষের অন্তরে তার জন্য ভালবাসা সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে গুনাহ অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে, চেহারাকে বিবর্ণ ও মলিন করে, দেহকে শক্তিহীন ও অলস করে দেয়। রিযিক সঙ্কুচিত করে এবং মানুষের অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।

হযরত ইমাম আবু হানীফা রাহ-এর সামনে কোনো মাসআলা যখন জটিল হয়ে যেত এবং তার সমাধান বের হত না তখন তিনি সাথীদের বলতেন, এটা আমার কোনো গুনাহর কারণে হচ্ছে। অতপর তিনি ইস্তেগফার করতেন। কখনো কখনো নামাযে মশগুল হতেন। তারপর সমাধান বের হওয়ার পর বলতেন, আশা করি আমার তওবা কবুল হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রা.-এর এই আমলের কথা যখন হযরত ফুযাইল ইবনে আয়ায রাহ.-এর নিকট পৌঁছল তখন তিনি খুব কাঁদলেন এবং বললেন, এটা তার গুনাহ কম হওয়ার প্রমাণ। অন্যরা তো এদিকে ভ্রুক্ষেপও করে না।-তবকাতুল হানাফিয়্যাহ ২/৪৮৭

বিখ্যাত ইমাম ও হাফিযে হাদীস ওয়াকী ইবনুল জাররাহ আলকুফী রাহ. সম্পর্কে হযরত ইসহাক ইবনে রাহোয়া রাহ. বলেন, লোকেরা পরিশ্রম করে মুখস্থ করে আর তার মুখস্থ হয়ে যায় স্বভাবগত স্মৃতিশক্তির কারণে। তেমনি আলী ইবনে খাশরাম রাহ. বলেন, আমি ওয়াকীকে দেখেছি তবে তার হাতে কখনো কিতাব দেখিনি; বরং তিনি শুধু মুখস্থই করেন। আমি তাকে এ অসাধারণ স্মৃতিশক্তির রহস্য জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা। স্মৃতিশক্তির পক্ষে এর মতো কার্যকর আর কিছু দেখিনি। -তাহযীবুত তাহযীব ১১/১২৯

ইমাম শাফেয়ী রাহ. তাঁর নিকটই স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করেছিলেন। তখন তিনি গুনাহ ত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইলম হল আল্লাহর নূর আর আল্লাহ তাঁর নূর কোনো গুনাহগারকে দান করেন না।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহ. গুনাহের ক্ষতি ও কুপ্রভাব সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর প্রায় একশ পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনা থেকে কয়েকটি কথা এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেন, গুনাহ মুখস্থ করা ইলম ভুলিয়ে দেয় এবং ইলম থেকে বঞ্চিত করে। রিযিকের অভাব এবং পেরেশানি-দুশ্চিন্তার সম্মুখীন করে। অন্তরকে কঠোর ও কলুষিত করে। বিবেক-বুদ্ধি বিনষ্ট করে। আমল-আখলাক ধ্বংস করে। আল্লাহর রহমত হতে দূরে সরিয়ে দেয়, কল্যাণের পথ রুদ্ধ করে এবং নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করে। ইবাদত ও নেক আমলের শক্তি কমিয়ে দেয় এবং কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। গুনাহর প্রভাবে মানুষের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে থাকে। গুনাহ মানুষের দেহ ও মনে যে আরো কত খারাপ প্রভাব বিস্তার করে এবং কত ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।-আলফাওয়ায়েদ ও আলজাওয়াবুল কাফী

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এ প্রসঙ্গে খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। তিনি ইলমের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইলম ঐ জিনিসকে বলে, যা গুনাহর কারণে দূর হয়ে যায় এবং যা কোনো গুনাহগার অর্জন করতে পারে না। ইলম যদি হয় কিছু শব্দ জানার নাম তাহলে তা গুনাহর মাধ্যমেও অর্জন করা যায়। এমনকি কাফির-মুশরিকরাও তা অর্জন করতে পারে। বৈরুত ও জার্মানিতে অনেক খৃষ্টান আরবী সাহিত্যিক রয়েছে, যাদের মেধা ও স্মৃতিশক্তিও খুব ভালো। কিন্তু তার নাম ইলম নয়। প্রকৃতপক্ষে ইলম একটি নূর। যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে এক জ্যোতি এবং এমন এক কিতাব, যা সত্যকে স্পষ্ট করে।-সূরা মায়েদা : ১৫

এই নূর তথা ইলমকে আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে রূহ শব্দে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিজ রূহ দ্বারা সাহায্য করেছেন।-সূরা মুজাদালা : ২২

অর্থাৎ অদৃশ্য নূর দান করেছেন, যার দ্বারা তারা এক বিশেষ রকমের শক্তি ও পবিত্রতা লাভ করে।

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর অন্তরে আল্লাহ তাআলা একটি নূর দান করেছিলেন। যার ফলে তিনি যাই বর্ণনা করতেন, সম্পূর্ণ বিশুদ্ধভাবেই বর্ণনা করতেন।

তাই ইলমের প্রকৃত রূপ ও আসল বৈশিষ্ট্য হল একটি নূর, যার সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) আমি তার জন্য এক আলোর ব্যবস্থা করেছি, যা নিয়ে সে মানুষের মাঝে চলে।-সূরা আনআম : ১২২

এই নূর অর্জনকারী ব্যক্তির অবস্থা এমন হয় যে, যদি তার চতুর্দিকে তলোয়ার নিয়ে ঘিরে ফেলা হয় তবুও তার অন্তরে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি হয় না।-আলইলম ওয়াল ওলামা

এ সম্পর্কে বর্তমান সময়ের মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, লেখাপড়াকে মহববত করতে হবে। মন থেকে তীব্র আকর্ষণ থাকতে হবে। আন্তরিকভাবে বিষয়টাকে গ্রহণ করতে হবে। যদি সে রকম না হয় তাহলে কোনো পড়াই মনে রাখতে পারবে না। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সারা দিন ধরে পড়ছে। তাৎক্ষণিকভাবে পড়াটি হয়ত শিখছেও। আবার পরক্ষণে ভুলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পূর্ণ মনোযোগের অভাবে এমনটি হয়। তাই লেখাপড়ার সময় মনোযোগ বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। 

 

 

 

advertisement