সফর-১৪৩৩   ||   জানুয়ারি-২০১২

আমাদের রাজ্যশাসন

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা

তোমরা সবাই আজ আরবের নাম জান। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের আগমনের আগে কেউ তাদেরকে চিনত না। ঐ সময় গোটা আরব ছিল গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। আরবের মানুষ আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে অসংখ্য দেব-দেবীর উপাসনায় লিপ্ত হয়েছিল। এমনকি কাবাঘরের ভিতর তারা স্থাপন করেছিল ৩৬০টি মূর্তি। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গোত্র ও বংশের; বরং প্রতিটি পরিবারের ছিল আলাদা আলাদা মূর্তি। 

এরা মত্ত ছিল দুনিয়ার জীবন নিয়ে। পরকালের কথা তাদের স্মরণ হত না। তারা মনে করত, একদিন মরে পঁচে যাবে। মৃত্যুর পর আর কোনো জীবন নেই। আযাব ও পুরস্কার নেই, কিয়ামত নেই, জান্নাত-জাহান্নাম কিছুই নেই। কেউ এসবের কথা বললে তাকে নির্বোধ মনে করা হত।  

দুনিয়ার এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করত না। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এবং একে অপরের রক্তপাত করা তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। কখনো তা এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করত যে, যুগ যুগ ধরে তা চলতে থাকত।

লুটতরাজ এত ব্যাপক ছিল যে, কারো পক্ষে একা একা বের হওয়া সম্ভব ছিল না। মানুষ চলাফেরা করত বড় বড় কাফেলার সাথে। এরপরও নিরাপদে ঘরে ফেরা ছিল কঠিন।

চুরির প্রচলন ছিল খুবই ব্যাপক। উঁচু ঘরের লোকেরাও এতে জড়িত ছিল। গণ্যমান্য লোকও চুরি করত এবং গর্বভরে তা বলে বেড়াত।

সারা দেশে যিনা ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়েছিল। কবিরা নিজেদের কবিতায় সেসব বর্ণনা করত এবং মজা করে করে গেয়ে বেড়াত।

জুয়া ও মদপান এত অধিক ছিল যে, আল্লাহ হেফাযত করুন! কিছু লোক একত্র হলেই মদ ও জুয়ার আসর বসত। টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, এমনকি স্ত্রী-সন্তানকেও বাজি ধরা হত। 

নির্দয়তা ও নির্মমতার অবস্থা এই ছিল যে, জীবিত প্রাণী বেঁধে তাকে তীরন্দাজির নিশানা বানানো হত। গর্ভবতী নারীর পেট ফেঁড়ে দেওয়া হত। শত্রুকে হত্যা করে নাক, কান কেটে ফেলত এবং মালা বানিয়ে গলায় পরত। শত্রুর মাথার খুলিতে মদ পান করত। কন্যাসন্তান ভূমিষ্ট হলে জীবিত পুঁতে ফেলত।

সারা আরবে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতেগোণা।

পানাহারের বিষয়ে ভালো-মন্দের বাছবিচার ছিল না। যা পেত তা-ই খেয়ে ফেলত। পোকা-মাকড় থেকে নিয়ে গুঁইসাপ, টিকটিকি পর্যন্ত সাবাড় করে ফেলত। মৃত প্রাণী খাওয়ার বেলায়ও কোনো ইতস্তত করত না। রক্ত জমিয়ে তা কেটে কেটে মজা করে খেত। মোটকথা, ঐ সময়টা ছিল একটা অন্ধকার সময়। দুনিয়ার সব ধরনের খারাপ কাজই তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল।

আর এটা শুধু আরবেরই অবস্থা নয়; গোটা দুনিয়ার একটা বিশাল অংশের অবস্থা এমনই ছিল। আল্লাহর ভয় মানুষের মন থেকে একেবারেই বের হয়ে গিয়েছিল। কোথাও মূর্তির পূজা করা হত, কোথাও আগুনকে সিজদা করা হত কোথাওবা গাছপালা ও প্রাণীর সামনে মাথা নত করা হত। বাদশাহ তার প্রজাদের উপর জুলুম করত, বড় ছোটকে কষ্ট দিত, ধনীরা গরীবদের শোষণ করত। মোটকথা, সর্বত্র নেকের পরিবর্তে গুনাহ আর ভালোর পরিবর্তে মন্দ ছড়িয়েছিল। আর গোটা বিশ্বই ছিল মহা বিপদ ও হতাশায় নিমজ্জিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ ও তাঁর আগমন

উপরে তোমরা পড়েছ, ঐ সময় পৃথিবীর অবস্থা কত করুণ ছিল, কত অন্যায়-অনাচারে মানুষ তখন লিপ্ত ছিল এবং পৃথিবীর পরিবেশ কত দুষিত হয়ে গিয়েছিল।

আল্লাহ তাআলা তো বান্দার জন্য অতি মেহেরবান। তিনি তাদের কল্যাণ চান। তাই পৃথিবীর মানুষকে বিপথগামিতা থেকে ফেরানোর জন্য তিনি পাঠালেন আমাদের রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।

রবিউল আউয়াল মাসের নয় তারিখে (ওফাত : ১২ রবিউল আওয়াল) তিনি এই দুনিয়ায় আগমন করলেন। জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছিলেন। ৬ বছর বয়স না হতেই মা আমিনাও মৃত্যুবরণ করলেন। তিনি তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে লালিত পালিত হতে থাকেন। ৯ বছর বয়সে দাদাও দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। এখন তাঁর দেখাশোনার ভার চাচা আবু তালিব গ্রহণ করলেন।

ছোট থেকেই অন্যায় ও মন্দ কাজ তাঁর অপছন্দ ছিল এবং ন্যায় ও ভালো কাজে তিনি নিয়োজিত থাকতেন। তিনি যখন তরুণ তখন আরবের কিছু ভালো মানুষ শপথ করল, তারা সমাজ থেকে খুন-খারাবি, লুটতরাজ এবং এ ধরনের সকল অন্যায় বন্ধ করবে। আমাদের নবীজীও তাদের সাথে যোগ দিয়ে ছিলেন।

সততা ও বিশ্বস্ততায় তিনি এত প্রসিদ্ধ ছিলেন যে, সবাই তাঁকে আলআমীন বলে ডাকত।

একবার মক্কায় ঢলের পানিতে কাবাঘরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হল। কুরাইশ তা নতুন করে নির্মাণ করতে শুরু করল। যখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় এল তখন তাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। সবাই চায় এই পাথরটি নিজ হাতে স্থাপন করবে। বিবাদ যখন মারাত্মক আকার ধারণ করল, এমনকি লড়াই বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হল তখন কিছু প্রবীণ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই বলে মিমাংসা করলেন যে, আগামীকাল ভোরে যে সবার আগে এই ঘরে আসবে আমরা তার উপরই মিমাংসার ভার ছেড়ে দেব। সে যে সিদ্ধান্ত দিবে আমরা তা মেনে নিব।

ভোরবেলায় লোকেরা যখন কাবাঘরে এল তখন দেখা গেল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত। তাঁকে দেখামাত্র সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠল যে, আলআমীন এসেছেন। তার চেয়ে ভালো ফয়সালা আর কে করতে পারে?

নবীজী তখন কী করলেন?

নবীজী তাদেরকে একটি চাদর বিছাতে বললেন এবং তাতে নিজের হাতে হাজরে আসওয়াদ  রাখলেন। এরপর বললেন, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে এসে এই চাদরের প্রান্ত ধর এবং সবাই মিলে তা দেয়ালের কাছে নিয়ে এস। সবাই মিলে হাজরে আসওয়াদ দেয়ালের কাছে নিয়ে গেল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এবার তোমাদের সবার পক্ষ থেকে আমি পাথরটি তার স্থানে রেখে দিচ্ছি। তাঁর এ কৌশলে সকল গোত্রের লোক খুশি হল এবং ঝগড়া মিটে গেল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

 

advertisement