সফর-১৪৩৩   ||   জানুয়ারি-২০১২

রাসূলের আদর্শেই গড়ে উঠে উন্নত সমাজ

ড. সাঈদ আহমদ সিদ্দীকী

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উত্তম আদর্শ ও শিক্ষার অর্থই হচ্ছে, কোনো আদর্শ সমাজের নমুনা। তাঁর শিক্ষা মানেই হচ্ছে পারস্পরিক একতা, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায় ও কল্যাণের মৌলিক মূল্যবোধের শিক্ষা। উজ্জ্বল ঐতিহ্যের মহৎ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজের চেতনাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। চরম হতাশাজনক ও ভেঙে পড়া একটি পরিবেশে আবির্ভূত হয়ে তিনি সমাজকে আবার গড়ে তুলেছেন। সামনে এগিয়েছেন তিনি একটি বিন্যস্ত পরিকল্পনা, চিন্তা ও কাজের একটি ছক, একটি নির্দিষ্ট পথনির্দেশনা এবং সর্বব্যাপী শুদ্ধির এক উজ্জ্বল ও সুগঠিত কর্মসূচি হাতে নিয়ে। পৃথিবীকে দিয়েছেন একটি নতুন সমাজব্যবস্থা, নতুন চিন্তা ও উপলব্ধি এবং উপমাতুল্য একটি চেতনাকাঠামো। আর এভাবেই তিনি সমাজকে সতর্ক ও শুদ্ধ করেছেন। আর এই ব্যবস্থার নামই হচ্ছে ইসলাম।

তাঁর আনিত এই দ্বীন মানুষের চেতনা ও কর্মপ্রয়াসের সব অঙ্গনকে এমন এক ঐক্যবদ্ধ কাঠামোতে নিয়ে আসে যে, তাতে এই দ্বীনের প্রত্যেক

অনুসারীর মাঝে সৃষ্টি হয় অভিন্ন লক্ষ্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের অনুভূতি। ভারসাম্য ও মধ্যপন্থার এক নিদর্শন এই দ্বীন,

সময় ও যুগের চড়াই-উৎরাইয়ে যা কখনো মলিন হয় না; বরং এ দ্বীনের আলোকিত শিক্ষার বদৌলতে মানুষের সমাজ ও সামাজিক সংকটগুলোর সর্বোত্তম সমাধান বের হয়ে আসে। এজন্যই এ দ্বীনকে বলা হয়ে থাকে দ্বীনে ফিতরাত বা স্বভাব-অনুকূল ধর্ম। এ দ্বীনের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সহজতা ও স্বাভাবিকত্ব; জটিলতা ও সংকীর্ণতা এতে অনুপস্থিত।

জাহেলিয়্যাত ও জাহালত-মূর্খত্ব ও মূর্খতার মাঝে ইসলাম একটি পরিষ্কার বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, জাহেলিয়্যাত হচ্ছে বিশেষ ওই আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা মিথ্যা অহংকার, গোত্রীয় আভিজাত্য ও প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব, অন্ধ আবেগ ও চেতনা এবং প্রতিশোধ ও চরমপন্থার এক সমন্বিত রূপ। জাহেলিয়্যাত হচ্ছে শক্তিপুজারী একটি আচরণব্যবস্থা। এতে ধৈর্য্য ও পরমত সহিষ্ণুতা গণ্য হয় দুর্বলতা হিসেবে। বুদ্ধি ও মেধার ক্ষেত্রে উন্মাদনা এবং সংলাপের জায়গায় প্রতিশোধের আওয়াজ উচ্চকিত করা জাহেলিয়্যাতের নীতি।

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৩ বছরের মক্কী জীবন কাটিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামের তরবিয়ত ও জীবন গঠনের পেছনে। এরপর যখন জিহাদের হুকুম এল তখনও এ নির্দেশনা প্রবল ছিল যে, সব শত্রুতা ও বৈরিতার মধ্যেও যেন ন্যায়ের নিশান হাতছাড়া না হয়। জিহাদ তো হচ্ছে হক্বের আওয়াজ উর্ধ্বে তুলে ধরা, প্রতিশোধের নাম জিহাদ নয়। তাওহীদের মর্ম একত্ববাদে বিশ্বাসী  হওয়া, অপর ধর্মানুসারীদের প্রভুদের গালাগাল দেওয়া নয়। মানবতার প্রতি সম্মান করার শিক্ষা দিয়েছেন নবীজী। নবীজীর শিক্ষায় বর্ণ, বংশ, ভাষা ও সম্পদের ভিত্তিতে কারো মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারিত হয় কেবল তাকওয়া, নেক আমল ও ন্যায়ানুগতার ভিত্তিতে। এটাই তাকওয়ার পথ।

নবীজীর মোবারক সীরাত মানুষকে অন্ধকার থেকে সরিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছে। নবীজীর মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা সাধিত হয়েছে এবং নবুওয়তের ধারা হয়েছে সমাপ্ত। আল্লাহ তাআলা আখেরী নবী ও আখেরী কিতাবের মাধ্যমে তার হুজ্জত (প্রমাণ) চূড়ান্ত করেছেন। এখন হেদায়েতে ও গুমরাহির পথ স্পষ্টভাবে ভিন্ন, নেকি ও বদির মাঝে পার্থক্য পরিষ্কার। এখন আর নতুন কোনো নবীর প্রয়োজন নেই।

রাসূলে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সীরাত অধ্যয়নে এ অনস্বীকার্য বাস্তবতা সামনে চলে আসে যে, ইসলাম হচ্ছে নিরাপত্তার ঘোষক, সততার পতাকাবাহী এবং মানবতার বার্তাবাহক। মানবজাতির প্রতিটি সদস্যই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্য ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। ইসলাম বর্ণ ও গোত্রের বিভাজনমালিন্য থেকে মুক্ত। মানবতার সব শ্রেণী ও স্তরের জন্য ইসলাম এসেছে রহমত স্বরূপ। অমুসলিম নাগরিকদেরও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি ইসলাম। ইসলামের দেওয়া অধিকার ও মর্যাদায় অমুসলিমরা এতটাই সম্মানিত বোধ করে যে, পূর্বে এর কোনো নজির তারা পায়নি।

সভ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে ইসলাম এসেছে একটি পশ্চাৎপদ সমাজে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই আরবদেরই পরিণত করেছেন পৃথিবীর উন্নত জাতিতে। মানবেতিহাসে তিনিই প্রথম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করেছেন, যা আত্মিক ও বস্ত্তগত উভয় দিক থেকে মানুষের সংকটমুক্তির দায়িত্ব নিয়েছে। ইসলাম পৃথিবীর সেই একক ও বৃহত্তম ধর্ম, যা নিঃস্ব ও দরিদ্র জীবনের মাঝে মর্যাদা ও তাৎপর্য দান করেছে। ইসলাম বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে পরস্পরে ভাইয়ের মতো থাকার এবং বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম মানব পৃথিবীতে একটি উন্নত সভ্যতা দান করেছে, যার ফলশ্রুতিতে ইসলামী সমাজের রূপ সামনে এসেছে। সে সমাজে মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের অনুসারীরাও সৃজনশীলতা ও পরিতৃপ্তির সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেছেন। ইসলাম তার অবস্থার প্রাচুর্য দিয়ে বিত্তবান বানিয়েছে পুরো পৃথিবীকে।

ইসলামী সমাজব্যবস্থার পরিধি অনেক বিস্তৃত। যে সমাজে ইসলামের সভ্যতা ও শরীয়তের প্রয়োগ হয় এবং কুরআন ও সুন্নতের অনুসরণ করা হয় সেটিই ইসলামী সমাজরূপে গণ্য। ওই সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-

ক) মানবজাতির ঐক্য খ) কল্যাণের বিকাশ ও মন্দের দ্বার রুদ্ধকরণ, গ) মানবচিন্তার ঐক্য, ঘ) মানবতার সম্মান, ঙ) সমতা, চ) রাসূলের আনুগত্য।

আজ পৃথিবীতে যে ধর্ম ও কর্মসূচির প্রয়োজন সেটি হচ্ছে আলোকজ্জ্বল দ্বীন-ইসলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত ও তাঁর সীরাত গোটা মানবজাতির জন্য একটি সমন্বিত সম্পদ। এখানে সবারই ভাগ রয়েছে। আল্লাহ তাআলার সব বস্ত্তগত নেয়ামত যেমন সব মানুষের জন্য অবারিত, ঠিক তেমনই এই রূহানী নেয়ামতও সকল মাখলুকের জন্য উন্মুক্ত। নবীয়ে আখেরুযযামান সম্পর্কে কুরআনে করীমে এরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি। আরেক জায়গায় আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, আপনি বলে দিন পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী কুরআন নিজ বান্দার ওপর অবতীর্ণ করেছেন, যেন তিনি সব মানুষকে শেষ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে পারেন।

আমরা সবাই রাসূলে আকরামের উম্মত। তিনি আমাদের কাছে বার্তা পৌঁছিয়েছেন বন্ধুত্ব, সহিষ্ণুতা, মানুষের সম্মাননা, নিরাপদ সহাবস্থান, পক্ষপাতমুক্ততা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার। নিরাপত্তা, সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের দায়িত্ব হল, এই সীরাতে তাইয়্যিবার প্রসার ঘটানো। নিজেরাও উসওয়ায়ে হাসানা বা উত্তম আদর্শ গ্রহণ করি এবং অন্যদেরও এর প্রতি উৎসাহিত করি। নবীজীর সীরাত ও তাঁর শিক্ষা আমাদেরকে এমন একটি সমাজ গড়তে অনুপ্রাণিত করে, যে সমাজের প্রতিটি সদস্য হয়ে উঠে সৎ মানুষ। এমন সৎ মানুষ, যার গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে সূরায়ে আসরে।

ইসলামের তত্ত্বগত দর্শন সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি সদস্যের অন্তরে থাকতে হবে দৃঢ় বিশ্বাস। মানুষকে পুরা করতে হবে আল্লাহ তাআলার বন্দেগীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। খেলাফতব্যবস্থা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তে অনুভূতি জাগ্রত থাকতে হবে আল্লাহর আনুগত্য, সুন্নতের অনুসরণ, তাকওয়া অবলম্বন এবং আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে। হেদায়েতের উলূম তথা দ্বীনী ইলমের চর্চা থাকতে হবে। পাশাপাশি চলতে হবে বৈষয়িক, আর্থিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা। দিতে হবে মানুষের শৈল্পিক ও পেশাভিত্তিক মেধা বিকাশের সুযোগ। যেন সে হালাল জীবিকা অর্জন করতে পারে। মানুষের অন্তরে, চরিত্রে ও জীবনে শুদ্ধি আনতে হবে। মানুষ যেন সত্যের আহবানকারী ও কল্যাণকাজের সঞ্চালক হয় সে উদ্যোগ নিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তাদেরকে পরিশ্রম ও কষ্ট সহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত করতে, ধৈর্য্য ও বরদাশত-যোগ্যতা অর্জন করাতে এবং আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রত্যয়ে বলিয়ান করতে। সর্বোপরি মানুষের মাঝে সময় ও নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সব ভিত্তির উপরই একটি আদর্শ সমাজের কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। এ সমাজই পৃথিবীর সব সমাজের ওপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল।

তাই বর্তমান যুগেও একটি আদর্শ সমাজের রূপায়ন সম্ভব হবে যখন আমরা মানবতার ত্রাণকর্তা হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও সীরাতকে জীবনোপায় বা কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করে নেব। যখন তাঁকে অনুসরণ করব। এতেই রয়েছে মানবতার মুক্তি। এটিই কল্যাণ ও সাফল্যের অব্যর্থ মন্ত্র।

[উর্দূ দৈনিক জং-এর সাপ্তাহিক ইসলাম পাতা ইক্বরার ৯ ডিসেম্বর ২০১১ সংখ্যা থেকে অনূদিত।]

অনুবাদ : আবু তাশরীফ

 

 

 

advertisement