যিলহজ্ব-১৪৩২   ||   নভেম্বর-২০১১

যে অঙ্গনেই থাকুন, আদর্শের সঙ্গে থাকুন

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

গত ২৭ শাবান ১৪৩২ হিজরী জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান হাইআতু আবনাইল জামিয়ার সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম মূল্যবান আলোচনা করেছিলেন।

গুরুত্ব বিবেচনা করে তাঁর নজরে ছানীর পর বয়ানটি আলকাউসারের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল।-বি. স.

প্রিয় বন্ধুগণ!

সম্প্রতি হযরত মাওলানা তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর আসান তরজমায়ে কুরআন-এর বাংলা তরজমা তিন খন্ডে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডের শুরুতে গ্রন্থকারের কীর্তিমান শাগরিদ হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের লেখা অত্যন্ত মূল্যবান, সারগর্ভ ভূমিকা আছে। ওই ভূমিকা পড়ার পর থেকে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত আমাকে নতুনভাবে শুরু করতে হয়েছে। সকলের প্রতি ভূমিকাটি পড়ার অনুরোধ থাকল। তা পড়লে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব উপলব্ধির সাথে সাথে কুরআন তিলাওয়াতের আদব জানা যাবে এবং কিভাবে তিলাওয়াত করলে কুরআনের নূর ও হিদায়াত বেশি বেশি হাসিল করা যাবে তার নির্দেশনা লাভ হবে। সেই সঙ্গে মহববতের সাথে তিলাওয়াতের আগ্রহ-উদ্দীপনাও সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ।

বন্ধুগণ!

সূরা হিজরের শেষের যে আয়াতগুলি আমি পড়লাম এর ভেতর আমাদের কর্মজীবনের জন্য যথেষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। বৃহৎ কলেবরের তাফসীরগ্রন্থসমূহ না পড়লেও কেবল আমাদের আকাবিরে দ্বীনের যে টীকা-টিপ্পনী আছে, সেগুলোও যদি মনোযোগ দিয়ে পড়া যায় কিংবা একদম সরাসরিও যদি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতে থাকি এবং গভীর মনোনিবেশের সাথে এ আয়াতগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা এখান থেকে একটা সুন্দর ও সার্থক কর্মজীবনের ভালো দিক-নির্দেশনা পেয়ে যেতে পারি।

এ আয়াতগুলোতে তো অনেক কথাই বলা হয়েছে। তবে তার ভেতর থেকে মোটা দাগের কয়েকটি কথার প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমেই আসে আত্মসম্মানবোধের কথা। সমষ্টিগতভাবে এ আয়াতগুলো গভীর মূল্যবোধ-জাগানিয়া। এগুলোর শিক্ষা হল, একজন আলেমে দ্বীনকে আপন সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। টনটনে মূল্যবোধের সাথে তাকে কর্মজীবনে পা রাখতে হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা আত্মসম্মানবোধ এমনই এক জিনিস, যা মানুষ মাত্রেরই থাকা চাই। ইজ্জত ও সম্মান তো জান-মালের মতোই মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৌলত, যা রক্ষার জন্য প্রাণপাত হলে শাহাদতের মর্যাদা লাভ হয়। এদিক থেকে

من قتل دون عرضه فهو شهيد

হাদীসটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আত্মসম্মান যে অতীব মূল্যবান সম্পদ এবং সে সম্পদের প্রতি যে প্রত্যেকেরই সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত, সে সবক এ হাদীসে সুস্পষ্ট।

তো মানুষমাত্রেরই যখন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হওয়া দরকার, তখন আল্লাহ তাআলা যাকে তাঁর দ্বীনের আলেম বানিয়েছেন, যাকে কুরআন-সুন্নহা তথা ওহীর ইলমের জন্য মনোনীত করেছেন তার আপন মর্যাদা সম্পর্কিত চেতনা কতটা গভীর ও সজীব থাকা উচিত।

কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যমতে মানুষের মধ্যে উলামায়ে দ্বীনের জামাত সর্বশ্রেষ্ঠ জামাত। এ জামাতের প্রথম সারিতে আছেন আম্বিয়া আ.। আর তাদের মধ্যমণি হলেন সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর যে তুঙ্গীয় মর্যাদা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে, সে সম্পর্কে উম্মতের তো বটেইে, খোদ তাঁরও চেতনায় নাড়া দেওয়া হয়েছে। যে মহামূল্যবান সম্পদ দ্বারা তাঁকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করা হয়েছে বারবার সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ এ কথারই জানান দেয় যে, এ সম্পদের অধিকারীকে আপন সম্পদের মহিমা ও সেই সুবাদে প্রাপ্ত মর্যাদার প্রতি সচেতন থাকতে হবে।

সে মহাসম্পদের অংশবিশেষের নাম আস-সাবউল-মাছানী (সূরা ফাতিহা)। মাত্র সাত আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা। অথচ আল্লাহ তাআলা এটিকেও তাঁর একটি মহিয়ান দান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) (আমি তো তোমাকে দিয়েছি এমন সাত আয়াত যা বারবার পড়া হয় এবং মহা কুরআন।)। পরিমাণে ক্ষুদ্র এ সূরা মানে যে কত বড় তা পরের আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে কিছুটা অনুমান করা যায়। বেঝা যায় এর মূল্য দুনয়া ওয়ামা ফীহা অপেক্ষাও বেশি। কাজেই সূরা ফাতিহা যে পেয়ে গেছে সে সারা দুনিয়ার তাবৎ সম্পদের মালিক (যদি কারও পক্ষে তা হওয়া সম্ভব হয়) অপেক্ষাও বেশি ঐশ্বর্যশালী।

তাই ইরশাদ করা হয়েছে, (তরজমা) আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে যে ভোগ-বিলাসের উপকরণ দিয়েছি, তার দিকে তুমি কখনো তোমার দৃষ্টি বিস্তার করো না। (সূরা হিজর : ৮৮)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আস-সাবউল মাছানীর অধিকারী সে এত বড় ঐশ্বর্যবান যে, তার অন্য কিছুর দিকে ফিরে তাকানো শোভা পায় না। তাকে দুনিয়াদারদের রাজকীয় বাড়ি, আলিশান গাড়িকে নিজ সম্পদের সামনে তুচ্ছ গণ্য করতে হবে; বরং গোটা দুনিয়াকেই নিজ ঐশ্বর্যের সামনে নাস্তি মনে করতে হবে। এবার চিন্তা করুন, যে ব্যক্তি সমগ্র কুরআন পেয়ে গেছে, হাদীস-ভান্ডারের হিস্যাদার হয়েছে, ইলমে ওহীর ডুবুরি হতে পেরেছে, সে কত বড় সৌভাগ্যবান। সে যে এমন এক জ্ঞানের ধারক, যা মানুষকে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদায় উন্নীত করে, যার শিক্ষার্থীর চলার পথে ফিরিশতা ডানা বিছিয়ে দেয়, যার তালিব-এর জন্য সাগরের মাছ পর্যন্ত দুআ করে, যার বিভায়-পাশব-অন্ধকার দূর হয়ে যায়, যার উদভাসে মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ সাধিত হয়, যা মানবতার জাগতির উদ্বোধক, যা মানব সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তার নির্দেশক এবং সে এমনই এক জ্ঞানের ধারক, যা আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিকে শিক্ষা দিয়েছেন, যে জ্ঞানকে কোনো রকম মিথ্যা ও সংশয় স্পর্শ করতে পারেনি, যে জ্ঞান যুগ-পরম্পরায় নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, যে জ্ঞানের চর্চা করেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, যাদের জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে ছিল অপূর্ব সমন্বয়, যাদের কর্ম ছিল তাদের জ্ঞানের বাস্তব রূপ।

তো আপন জ্ঞান সম্পর্কে এই মূল্যবোধ ও আপন মর্যাদা সম্পর্কে এই চেতনা নিয়ে যখন একজন আলেমে দ্বীন আপন কর্মক্ষেত্রে তৎপর থাকবে, তখন তার কথা ও কর্ম, তার আচার-আচরণ ও লেনদেন, তার ওঠা-বসা ও চলাফেরা, তথা তার প্রতিটি গতি ও যতি হবে স্বতন্ত্র। আর দশজন থেকে ব্যতিক্রম এবং তা হবে এমনই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যা দেখে জগতের সবকিছু সরবে-নীরবে বলে উঠবে-

هل يستوى الذين يعلمون والذين لا يعلمون؟

যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?!

তো এ আয়াত থেকে আমরা একটি শিক্ষা পাই এই যে, আমাদেরকে গভীর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হতে হবে এবং আপন আপন ক্ষেত্রে সে বোধ ও বিশ্বাসের পরিচয় দিতে হবে।

 আর দ্বিতীয় বিষয় হল, দায়িত্বশীলতা।

وقل إني أنا النذير المبين

এরপরই আছে-

فاصدع بما تؤمر

আলেমে দ্বীন হিসেবে যে দায়িত্ব আমার উপর বর্তায় তা এই যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন আমার ভেতরে ইলম দিয়েছেন। এই ইলম হল মানুষকে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। মানুষ যেন সত্যিকার মানুষ হতে পারে তার দিক-নির্দেশ। অর্থাৎ এই শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু। কাজেই যেখানেই থাকব না কেন, যে হালতেই থাকব না কেন, এ দায়িত্ববোধ ভেতরে থাকতে হবে যে, আল্লাহ আমাকে যে ইলম দিয়েছেন সে ইলমের দায়িত্ব আমার দ্বারা আদায়  হচ্ছে কি না। আমার দ্বারা মানুষ দ্বীনের আলো পাচ্ছে কি না। আখলাকে হাসানাহ শিখছে কি না। আমার দ্বারা মানুষ হক ও বাতিলের মাঝে যে ইমতিয়ায, সেটা বুঝতে পারছে কি না। গোমরাহী থেকে হেদায়েতের পথে চলার উৎসাহ মানুষ আমার দ্বারা পাচ্ছে কি না।

উল্লেখ্য, আলেমে দ্বীন হিসেবে এ দায়িত্ব পালনের জন্য মাদরাসায় পড়ানো জরুরি নয়। আলেমে দ্বীন যেখানে যে অবস্থাতেই থাকে, সে অবস্থাতেই খেদমত করতে পারে। ব্যবসায়ী হয়েও খেদমত করতে পারে। যদি ব্যবসায়ী হয়ে থাকে তবে তার ব্যবসায়ী সমাজে, তার খরিদ্দারদের ভেতরে,তার এই ইলমের আলো বিচ্ছুরিত করতে পারে।

কালও নতুন করে স্মরণ করিয়েছিলাম আমাদের প্রিয় ছাত্র মাওলানা যাকারিয়ার কথা। আলকাউসারের দায়িত্ব যে পালন করছে। যখন তাকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন এই কথাটা উঠেছিল যে, মুদাররিস না হয়ে যদি এই কাজটা করে তাহলে কেমন হবে? সরাসরি ইলমের খেদমত থেকে দূরে থাকা হল কি না? তখন বলা হয়েছিল না; বরং ঐ লাইনে যদি খিদমত করতে পারে, ঐ পথে যদি নিজেকে তৈরি করতে পারে তাহলে তার দ্বারা দ্বীনী ইলমের আরো বড় খেদমত হতে পারে। এর একটা জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হযরত মাওলানা মানযূর নুমানী রাহ.। তিনি আলফুরকান দ্বারা যে খেদমত করেছেন, আমার মতো লক্ষ আলেম দ্বারাও সে খেদমত হওয়া কঠিন। এক আলফুরকান ইলম ও আমলের জগতে, আখলাকের জগতে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে ভারত উপমহাদেশে এর নযীর পাওয়া কঠিন। আলহামদুলিল্লাহ, মাওলানা যাকারিয়া এ খেদমতে লাগার পর লক্ষ্য করছি, উত্তরোত্তর তাঁর ইলমে, ইলমের প্রকাশে ভালো উন্নতি ঘটছে। আশা করি, ইনশাআল্লাহ এভাবে লেগে থাকলে ভবিষ্যতে তার দ্বারা উম্মতের অনেক বড় ফায়েদা হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে কবুল করুন। আমীন।

যাই হোক কথা হচ্ছিল দায়িত্বশীলতা নিয়ে। একজন আলেমে দ্বীনকে এ ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। এর সঙ্গে জওয়াবদিহিতা। মানুষের কাছে জওয়াবদিহিতা নয়, নিজের কাছে জওয়াবদিহিতা। যে দায়িত্ব নিয়ে আমি রয়েছি সে দায়িত্ব আমার দ্বারা কতটুকু পালন হচ্ছে-নিজের কাছে তার জওয়াব দেওয়া। মাদরাসার মুহতামিমের কাছে তার জওয়াব দেওয়া নয়, প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে তার জওয়াব দেওয়া নয়, সমাজের কাছে জওয়াব দেওয়া নয়। ওসব তো আনুষ্ঠানিক ব্যাপার। ওগুলোরও দরকার আছে, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে নিজের কাছে জওয়াব দেওয়া যে, আমার দ্বারা আমার দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না।

তৃতীয় যে শিক্ষা আমরা আয়াত দ্বারা পাচ্ছি, তা হচ্ছে আলেমে দ্বীনকে হতে হবে উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। মন হতে হবে বিশাল, সাগরের মতো বিস্তৃত।

فاصفح الصفح الجميل، واخفض جناحك للمؤمنين واعرض عن المشركين

শিক্ষা দিচ্ছে এ কথার-মনটাকে বিশাল করে ফেলো। হৃদয়টাকে সাগর করে ফেলো। মহান উদার হয়ে যাও। তা না হলে তোমার পক্ষে আপন কাজ যথাযথভাবে করা সম্ভব হবে না। অল্পতেই শ্রান্ত হবে, হতোদ্যম হবে ও ভেঙ্গে পড়বে। এই উদারতার বিভিন্ন দিক আছে। এক উদারতা হলো, যে কথা আমি পলিটেকনিকে বলি। পলিটেকনিকের তাবলীগের ছেলেরা প্রতিবছর যখন ফারেগ হয়ে যায় আমাকে বলে কিছু কথা বলতে। ওদেরকে আমি বলি, দ্বীনের কাজ বহুজন করছে। মাদরাসা করছে, মসজিদ করছে, খানকাহ করছে। মুবাল্লিগীন করছে, দাওয়াত ও তাবলীগের লাইনে খেদমত হচ্ছে। সব লাইনেই হচ্ছে। 

তো আমার একার পক্ষে তো সবগুলো করা সম্ভব না। কাজ তো সবগুলোই। যারা যে ক্ষেত্রে কাজ করছে তার সবগুলোই জরুরি। আমার একার দ্বারা তো সবটা করা সম্ভব না। কাজ যখন সবগুলোই জরুরি আর আমি করছি মাত্র একটা, তাহলে বাকি যারা করছে তারা সবাই দ্বীনী কাজে আমার সহযোগী। দ্বীনী কাজে যারা যেখানে যেভাবে আছে সবাই আমার সহযোগী। তারা একটা করছে, আমি একটা করছি। সবাই মিলে পরিপূর্ণ হচ্ছে। কাজেই তাদের সঙ্গে আমার সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। তাবলীগের দ্বারা যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে তবে তার ইসলাহ করার চেষ্টা করব। কিন্তু তাবলীগকে আমি আমার প্রতিপক্ষ ভাবব না। এমনিভাবে খানকাহ দ্বারা যে কাজ হচ্ছে, কোন ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু তারা আমার সহযোগী। তাযকিয়ার কাজ তারা করছে। তাদেরকে আমি আমার প্রতিপক্ষ ভাবব না। কাজেই তাদের সমালোচনা কখনোই করব না। সমস্ত মাদরাসা আমার সহযোগী। কারো সমালোচনা করব না। সবার সহযোগিতা করব। আমি কিছুতেই ফেরকাবন্দীর শিকার হব না। এই ফেরকাবন্দী আজ আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আমরা এত বিশাল জামাত, আমাদের শক্তি ছিল অনেক বড়। দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষুদ্রতা আমাদেরকেহ ছিন্নভিন্ন করে আমাদের শক্তিকে একেবারে তছনছ করে ফেলেছে। কাজেই ওসব আর নয়, আমাদের মাঝে কোনো ফেরকাবন্দী হতে পারবে না। সহীহ নাহজে আমরা যারা কাজ করছি, যে লাইনেই কাজ করছি না কেন, সবাই আমরা পরস্পরে পরস্পরের সহযোগী। তাই সবার ক্ষেত্রেই উদার দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। সবার দিকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

এমনিভাবে উদার দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে নিজের কর্মক্ষেত্রে। আচার-আচরণে। কারো আচরণে, অতি সহজে মনটাকে খারাপ করা চলবে না।

ولقد نعلم انك يضيق صدرك بما يقولون

মানুষ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে, সহকর্মীর দ্বারা হতে পারে কিংবা আমার প্রতিপক্ষ যারা তাদের দ্বারা হতে পারে। যারা নিচে আছে তাদের দ্বারা হতে পারে। সমাজের দ্বারা হতে পারে। সমাজ আমাকে কাঠমোল্লা বলে, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বলে, নানাভাবে উত্যক্ত করতে পারে। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তো সবই বলেছে। শায়ের বলেছে, সাহের বলেছে, এমনভিাবে জাদুগ্রস্ত বলেছে। কত কিছুই তো বলেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, এগুলো বললে মনটা সংকুচিত হয়ে উঠতে পারে। তখন আল্লাহর দিকে রুজু হও। ওখান থেকে আছর গ্রহণ কর।

আল্লাহ তাআলা খালিক, অথচ মানুষ আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করে। আল্লাহর কোনো সন্তান নেই, বলে আল্লাহর সন্তান আছে। হাদীসে আছে না যে, আল্লাহর চেয়ে বড় ছাবের, বড় হালীম আর কে আছে? মানুষ আল্লাহ তাআলার সাথে শরীক করে, তার জন্য পুত্র-কন্যা সাব্যস্ত করে, কত রকমের নাফরমানী করে। তারপরও আল্লাহ তাআলা সবটাকে সয়ে নিচ্ছেন। আছরটা ওখান থেকে গ্রহণ করতে হবে। মানুষ আমার সাথে যে রকম আচরণ করুক না কেন, সহনশীলতা ও উদারতার আচরণ আমাকে করতে হবে। মন যদি সাগর সদৃশ হয়ে যায় তাহলে কোনও রকম পঙ্কে তা পঙ্কিল হবে না। সাগর কখনো পঙ্কিল হয় না।

তো প্রথম কথা ছিল আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত থাকতে হবে।  দায়িত্বশীল হতে হবে। মনটাকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে ফেলতে হবে।

আর হল সৎসাহস। উঁচু হিম্মত। আমাদের হযরত মাওলানা শুরুতেই বলেছেন, অনেক বড় হিম্মতওয়ালা হতে হবে। আমাদের তো হিম্মত করাটা স্বাভাবিক। এ সূরা বলছে আমাদেরকে

فاصدع بما تؤمر، انا كفيناك المستهزئين، واعرض عن المشركين

যদি আমি আমার কাজে লেগে থাকি

ولينصرن الله من ينصره، ان الله لقوى عزيز

আল্লাহ তাআলা কী তাকীদের সাথে বলেছেন, যে আল্লাহর সাহায্য করবে, আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, দ্বীনের কাজে থাকবে আল্লাহ তাআলা তাকে অবশ্যই অবশ্যই সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাআলা তার জন্য কাফী হয়ে যাবেন। আল্লাহর ওয়াদার কোনো ব্যত্যয় নেই।

আমার সঙ্গে যে আচরণ করুক না কেন, সারা জাহান যদি আমার বিরুদ্ধে চলে যায় তারপরও আল্লাহ তাআলা আমার জন্য কাফী হয়ে যাবেন। আর আল্লাহ তাআলা যদি কাফী হয়ে যান তবে কিসের পরোয়া, কিসের ভয়? আমার ভেতর হিম্মত আনার জন্য এ-ই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা আমার জন্য কাফী। আমি শক্তি ওখান থেকে পাব। ওখান থেকে আমার শক্তি লাভ হবে। আমি অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ। কিন্তু যেহেতু আল্লাহর কাজে লেগে আছি, আল্লাহ আমাকে তার কাজে লাগিয়েছেন, সুতরাং সবকিছুর যোগান তিনিই দিবেন। সাহায্য তিনিই করবেন। তাওফীক তার কাছ থেকে হবে। এভাবে নিজের ভেতর হিম্মতকে জাগ্রত রাখতে হবে। যার যত বেশি হিম্মত তার দ্বারা ততবেশি কাজ হয়। হিম্মত যার ভেতর আছে, কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ তার জন্য সহজ হয়ে যায়।

আর যেটা আমাদের কর্মজীবনের জন্য আমি বড় জরুরি মনে করি, তা হল শৃঙ্খলাবোধ। শৃঙ্খলাবোধ অতি জরুরি জিনিস। শৃঙ্খলাবোধ যার ভেতর আছে, তার সবকিছুতে বরকত হয়। তার সময়ে বরকত হয়। তার অর্থ-সম্পদে বরকত হয়। তার কাজে বরকত হয়।

এই যে রাস্তাঘাটে গাড়ি চলে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রত্যেকে আগে যেতে চায়। আর আগে চলতে গিয়ে শৃঙ্খলা নষ্ট করে। ফলে আর কারো আগে যাওয়া হয় না। জট পাকিয়ে যায়। যখনই একজন আরেকজনকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে টপকে যেতে চায়, শৃঙ্খলা নষ্ট করে ফেলে তখন সবাই পিছিয়ে পড়ে, জট পাকিয়ে যায়।

শৃঙ্খলাবোধ বড় জরুরি জিনিস। আমাদের ভেতর এর বড় অভাব। সবকিছু শৃঙ্খলার সাথে করব। অর্থসম্পদের ব্যয় শৃঙ্খলার সাথে করব। এমনিতেই তো আলেমসমাজের অর্থ সম্পদের কমতি। কারণ আল্লাহ দিয়েছেনই এমন। আল্লাহ তাআলা তো তাকসীম করেছেন। ওদের দিয়েছেন টাকা, আমাদের দিয়েছেন ইলম। পয়সা কম, এখানে যদি উশৃঙ্খল হই তাহলে তো মহামুসিবত হয়ে যাবে। আর যদি শৃঙ্খলার সাথে ব্যবহার করি, বিবেচনা  করে করে যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে এই অল্প টাকাতে অনেক বরকত হবে। এমননিভাবে সময়কে যদি শৃঙ্খলার সাথে ব্যবহার করি, যে সময়ের যে কাজ সে সময় সেটা করি এবং প্রতিদিন একইভাবে করি তাহলে আমাদের সবকিছুতে বরকত হবে। দেখা যাবে, পড়াশুনা অনেক এগিয়ে গেছে। শৃঙ্খলাহীন পড়াশোনা খুব বেশি দূর এগুবে না। আমরা যদি আমাদের সময়টাকে শৃঙ্খলার সাথে কাজে লাগাই তাহলে দেখা যাবে আমাদের পড়াশোনা প্রচুর হয়ে গেছে। এমনিভাবে পড়াশোনা ছাড়া অন্যান্য কাজ যদি শৃঙ্খলার সাথে করি তাহলে অনেক অনেক বরকত তার ভেতরে হবে। আল্লাহ রাববুল আলামীন সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন। 

 

 

advertisement