যিলহজ্ব-১৪৩২   ||   নভেম্বর-২০১১

স মা জ চি ত্র : কবে বন্ধ হবে এই নিষ্ঠুরতা

খসরূ খান

ক্যাপশনসহ ছপিটি দেখলে প্রচন্ড কষ্ট লাগে। লেগেছে অনেকেরই, শিশু-কিশোরদের তো অবশ্যই। এ দেশে এক শ্রেণীর মানুষ দিন দিন কতোটা নির্মম হয়ে ওঠছে তার চিত্রও এতে ফুটে ওঠেছে। গত ২১ অক্টোবর শুক্রবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার নিচের দিকে চারটি ছবিসহ এই সংবাদটি ছাপা হয়েছে। শিরোনাম দেওয়া হয়েছে নির্মমতা। সেখানে দেখা গেছে, প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে একটি আট-দশ বছর বয়সী শিশুকে নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন করছে এক যুবক। জিন্স ও টি শার্ট পরা যুবকটি বুট জুতা দিয়ে শিশুটির হাত-পা এমনকি মাথা পর্যন্ত চেপে ধরেছে। অসহায় ও কান্নারত শিশুটি যুবকটির পা জড়িয়ে ধরেও রক্ষা পায়নি। মোচড় দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে শিশুটির হাত। শিশুটির দোষ, সে নাকি চুরি করেছে। তাকে চোর হিসেবে সন্দেহ করেই ঘটানো হয়েছে নিষ্ঠুর এ ঘটনা।

২০ অক্টোবর ঢাকা পুরানা পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের সামনে ঘটেছে এ ঘটনা। মূলত এ রকম ঘটনা এ দেশে এখন হরহামেশাই ঘটছে। যে কোনো ছোটখাটো অভিযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একশ্রেণীর মানুষ। জিঘাংসা ও ছোটলোকী বীরত্ব দেখানোর সুযোগ যেন তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। মানবিকতার চূড়ান্ত অধঃপতনের এসব চিত্র দেখলে মন নানা কারণে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।

এক. আগে কেউ কেউ আইন হাতে তুলে নিত। এখন পোশাকপরা আইনের লোক এবং অভিজাত ও ক্ষমতাবান লোকেরা আইন বুটজুতার তলায় পিষে ফেলতে পছন্দ করছে বেশি। মানুষের মাথা-বুক বুটজুতা দিয়ে মাড়িয়ে নারকীয় উল্লাসে তৃপ্ত হচ্ছে তারা। ভদ্রতার আবরণের মধ্য দিয়ে এভাবে দেশে হিংস্র একটি পশু-মানুষ শ্রেণী গড়ে ওঠছে।

দুই. যে দেশে উপরতলায় রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ, শেয়ার মার্কেট, টেন্ডার সবখাতে হাজার কোটি টাকা  চুরি ও লুটপাটের ঘটনা প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে ঘটছে, সে দেশে ছোটখাটো চুরির সন্দেহে শিশু-কিশোরদের ধরে বুটজুতা দিয়ে মাড়িয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এ এক বিশ্রী ও অমানবিক অসমতার চিত্র। চুরির পাহাড়দের হাতেই এখন টিলা-টক্করদের সততার সবক নিতে হচ্ছে। এতে গরিব-অসহায়দের অসহায়ত্বকে বুটের তলায় পিষ্ট করে বিত্তবান চোরেরা আরও বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

তিন. দেশের ছিন্নমূল, হতদরিদ্র ও ভাসমান শিশু-কিশোরদের খাওয়া-পরা, শিক্ষা, নৈতিকতার নিয়মতান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ তাদের কারো দ্বারা অশোভন কিছু সংঘটনের আশঙ্কা হলেই নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। একদিকে তারা সমাজের অবজ্ঞার কারণে বিপথগামী হচ্ছে। অপরদিকে সমাজের নিষ্ঠুরতায় হচ্ছে চরম নির্যাতিত। দায়টা সমাজের হলেও ষোল আনার উপর সতের আনা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে কেবল হতদরিদ্র শ্রেণীটি। আল্লাহর বিচারে এর পরিণতি কিছুতেই শুভ হতে পারে না।

চার. সমাজে একশ্রেণীর ভুয়া ও মেকী বীরের অভ্যুদয় ঘটছে এসবের মধ্য দিয়ে। ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়, চুরি-ছিনতাই, লুটপাট এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভয়াবহ হুমকির সময়ে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না কাউকে। আত্মচিন্তা ও স্বনিরাপত্তা নিয়ে তৃপ্ত ও ভীরু প্রজন্মের বসবাস চলছে চারদিকে। এ সময়ই আবার কোনো ছুতা পেলে হতদরিদ্র কিংবা প্রতিরোধ-ক্ষমতাশূন্য দুর্বলদের ওপর চরম আক্রোশে হামলে পড়ার ঘটনা ঘটছে। টোকাই ও ভাসমানদের ওপর অমানবিকভাবে চড়াও হয়ে বীরত্ব দেখানোর উদ্ভট কসরত শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় সময় ভীতুর ডিম, কিন্তু নিরাপদ বীরত্বের সময় সিংহমূর্তি ধরা এক অদ্ভুত মেকী বীরের জগতে এখন আমরা বাস করছি। এই মেকী বীরেরা নরমের যম হয়ে কেবল ক্ষতি করতেই জানে। কখনো ভালো কোনো কাজে সাহস দেখাতে পারে না।

আসলে মানুষ ও দেশকে বাঁচাতে হলে সবাইকেই নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন ও সংযমী হতে হবে। বড় চোরদের ধরে বিচার করা এবং হতদরিদ্র মানুষের খাওয়া-পরা ও নৈতিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আক্রোশপ্রবণ মেকী ও ভুয়া বীরত্বের গতি থামাতে হবে। দুর্বলের ক্ষেত্রে সংযমী, প্রয়োজনীয় ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় সাহস এবং অবহেলার ক্ষেত্রগুলোতে দায়িত্বশীলতা অবলম্বন করতে হবে। এভাবে দ্বীনের পথে, দ্বীনী শিক্ষা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে চললে এই ভয়াবহতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। 

 

 

advertisement