যিলহজ্ব-১৪৩২   ||   নভেম্বর-২০১১

বাবরি মসজিদ-৬

সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান

[সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান সংকলিত বাবরী মসজিদ তারীখী পাস্-মানযার আওর পেশ-মানযার কী রৌশনী মেঁ কিতাবের ধারাবাহিক অনুবাদ। অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ]

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আরেকটি বিবাদ হয়েছিল মসজিদের দেয়াল ও ফটক নিয়ে। এ বিষয়ে আদালতে যে আর্জি পেশ করা হয় তা এই-

محمد اصغر 1870 ء رگهوبير منعقدہ جنورى 1884 ء محمد اصغر خطيب وموذن مسجد بابرى واقع جنم استهان اوده

در جواب صدور حكم جائے دروازہ  متعلق سائل ... تيار كيا ہے تو اس كا ... سائل ... نا منظورى ديديا جائے ... دروازہ سے متعلق نہيں ہے.

عادل زمان، غريب پردرسلامت ... مسجد بابرى واقع جنم استهان اوده ميں حكم ... دروازہ جديد جانب اتر ... تيار ہو رہا ہے ... ديوار اس كى شكست كروا دى گئى ہے، اب بہ نظر چالاكى كے ... دكهن منھ چبوترہ واسطے قائم كرنے ملكيت اسى ديوار مسجد كى طرح تيار كى ... پاس ہے، ... منصب خاندانى سائل ... خلاف عمل در آمد قائم ہوئى ہے، كيونكہ لكهيم واس مہنت وديگر مہنتان ما سبق كو سوائے چبوترہ كے دوسرے ميں مداخلت نہين ہے، ديوار احاطہ مسجد كى ہے، كچه چبوترہ كى نہيں ہے، اس ميں اكثر احكام عدالت ہيں كہ كوئى امر جديد نہ ہو نے پائے، اس صورت ميں مدعى عليہ كو حكم ہو وے كہ وہ كنارہ كش دروازہ كے ہو ويں، وسائل كو اجازت موجود ہووے كہ دروازہ وكنجى دروازہ پاس سائل كے رہے كہ وقت كثرت ميلہ آمد ورفت دروازہ كهول ديا كريں واگر ضرورت جانيں تو سائل سے دلوايا جائے ورنہ ... سے ديا جائے، تاكہ باعث رفع تكرار كا ہو جائے، ليكن كنجى متعلق سائل سے رہے، مہنت سے نہ رہے، واجب جان كر عرض كيا،

فدوى سيد محمد اصغر، خطيب ومتولى مسجد بابرى واقع اوده، مورخہ 3 اپريل 1877ء

আলোচনা : এই আর্জি থেকে বোঝা যায়, মোহান্তরা চেষ্টা করছিল, মসজিদের একটি দেয়াল ভেঙ্গে তাদের দেয়াল নির্মাণ করবে এবং তাতে একটি দরজা রাখবে। কারণ মেলার সময় পূর্বদিক থেকে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে হাঙ্গামার আশঙ্কা ছিল। তাই মসজিদের উত্তর দিকে দরজা বানানোর পরিকল্পনা তাদের ছিল। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, বেদিটি মোহান্তদের মালিকানায় নিয়ে আসা। মসজিদের খতীব ও মুয়াজ্জিনের পক্ষ থেকে আবেদন করা হল, দেয়ালটি মসজিদের, এতে মোহান্তদের কোনো অধিকার নেই। তারা চেষ্টা করলেন, যেন দরজা মসজিদের থাকে এবং এর চাবিও মসজিদের খতিবের কাছে সংরক্ষিত থাকে। মেলার সময় তিনি দরজা খুলে দিবেন যাতে কোনোরূপ ঝগড়া-বিবাদ না হয়। এই মোকদ্দমার কী ফয়সালা হয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। আবেদনটি সম্ভবত ১৮৭০ সালের।

এভাবে হিন্দু-মুসলিমের মাঝে মামলা-মোকদ্দমার এক অন্তহীন ধারা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজ্য-ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়েছে। এখন হিন্দু-মুসলিম সংঘাতকে আরো স্থায়ী ও প্রলম্বিত করার সকল উপায়-উপকরণ তাদের হাতে।

ইতিমধ্যে অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে বিভেদ-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছিল। এখন তাদের প্রয়োজন ছিল বাবরি মসজিদ বনাম রাম জন্মস্থানের বিবাদ আরো জোরদার করা। এ পর্যন্ত জন্মস্থান ধ্বংসের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ কেউই উপস্থিত করতে পারেনি, না হিন্দু, না ইংরেজ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠি কিছু লিখিত দলীলের তাগিদ অনুভব করল।

পি. কার্নেগির রিপোর্ট ১৮৭০ ঈ.

১৮৭০ সালে যখন ফয়েজাবাদ তহশিলের বন্দোবস্ত হচ্ছিল তখন এর সেটেলম্যান্ট অফিসার ও ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার পি. কার্নেগি একটি রিপোর্ট প্রস্ত্তত করেন, যার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল।

স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করানো হয়, মুসলিম-অভিযানের সময় এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ছিল : জন্মস্থান, স্বর্গদুয়ার মন্দির ও ত্রেতার ঠাকুর। জন্মস্থান হচ্ছে ঐ জায়গা, যেখানে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন, স্বর্গদুয়ার হচ্ছে ঐ ফটক, যা দিয়ে তিনি বৈকুণ্ঠ গমন করেন, এটি ঐ জায়গাও হতে পারে যেখানে তাকে দাহ করা হয়। (স্বর্গদুয়ারকে রাম দরবারও বলা হয়।) আর ত্রেতার ঠাকুর হচ্ছে যে স্থানে রামচন্দ্র নৈবেদ্য দিয়েছিলেন। এরই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিনি এখানে স্থাপন করেছিলেন নিজের তিনটি ও সীতার একটি মূতি।

বাবরের রোযনামচার লিডনের সংস্করণে আছে, সম্রাট বাবর ২৮ মার্চ ১৫২৮ খৃ. অযোধ্যা থেকে দুই বা তিন ক্রোশ দূরে সরজু ও ঘাগরা নদের সঙ্গমস্থলে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি এখানে একটি শিকারগাহের কথা বলেছেন, যা আওয়াধ থেকে সাত-আট ক্রোশ দূরে সরজু নদীর তীরে অবস্থিত। মনে রাখা দরকার, বাবরের রোযনামচার কোনো সংস্করণেই তাঁর অযোধ্যা-আগমনের কথা নেই। রোযনামচার ঐ পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া যায় না।

বাবরি মসজিদের দুই জায়গায় পাথরের ফলকে নির্মাণের তারিখ খোদিত আছে-৯২৫ হিজরী মোতাবেক ১৫২৮ ঈ.। তাতে বাবরের শান-শওকতের কথা বলা হয়েছে।

হনুমানগাড়ির কয়েকশ কদম দূরে জন্মস্থান অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। হিন্দুরা জোরপূর্বক হনুমানগাড়ি কব্জা করে। আর মুসলমান অধিকার করে জন্মস্থান। মুসলমানরা হনুমানগাড়ির সিড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সাথে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। হিন্দুরা সফলভাবে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকে এবং তৃতীয় প্রচেষ্টায় তারা জন্মস্থান উদ্ধার করে। ফটকের সামনে পঁচাত্তর জন মুসলমান নিহত হয়। তাদেরকে গঞ্জে শহীদাঁতে সমাহিত করা হয়। বাদশাহর একাধিক বাহিনী ছিল এই ঘটনার নীরব দর্শক। তাদের উপর হুকুম ছিল কোনোরূপ হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার।

লোকে বলে, এ যাবৎ হিন্দু-মুসলমান ঐ মসজিদ-মন্দিরে ইবাদত ও পূজা করে আসছিল। বৃটিশ আমলে মাঝে বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে ঝগড়া-বিবাদ না হয়-মসজিদে মুসলমানরা নামায পড়ে এবং হিন্দুরা বেড়ার বাইরে তাদের চবুতরায় পূজা করে।

(ইংরেজি উদ্ধৃতি থেকে তরজমা; মুসলিম ইন্ডিয়া ইংরেজি, মার্চ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১১৯)

আলোচনা : এই উদ্ধৃতিটির পর্যালোচনা একটু সতর্কতার সাথে করতে হবে। কারণ পরে ফয়েজাবাদের নতুন গেজেটিয়ারগুলোতেও এরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।

শুরুতে বলা হয়েছে-স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করানো হয় যে, মুসলিম-অভিযানের সময় এখানে বিশেষ তিনটি মন্দির ছিল, যেগুলোতে অল্প কজন পূজারী বসবাস করত। অযোধ্যা তখন বিরাণ হয়ে গিয়েছিল।

এ কথাগুলোর সূত্র জনশ্রুতি, একজন ঐতিহাসিকের কাছে যার কোনো মূল্য নেই। এ ধরনের বর্ণনা যদি গ্রহণ করা যায় তাহলে বর্জনও করা যায়। কারণ এ জাতীয় বর্ণনার যথার্থতা নিশ্চিত নয়। তাছাড়া বলা হয়েছে, অযোধ্যা তখন বিরাণ হয়ে গিয়েছিল। সামান্য কিছু পূজারী সেখানে বসবাস করত। এ থেকে বোঝা যায়, সে সময়ের অযোধ্যা তীর্থভূমির পর্যায়ে ছিল না। ফলে তা বিরাণ হয়ে পড়েছিল। তা ছিল অল্প কিছু পূজারীর আবাস। এহেন বিরাণ ভূমির কোথাও যদি একটি মসজিদ নির্মিত হয় তাতে কী অপরাধ হয়ে গেল?

এরপর জন্মস্থান, স্বর্গদুয়ার ও ত্রেতার ঠাকুরের কথা বলা হয়েছে। এগুলোরও সূত্র জনশ্রুতি।

এরপর বলা হয়েছে বাবরের আওয়াধ আগমনের কথা। এখানে স্বীকার করতে হয়েছে যে, বাবরের রোযনামচায় অযোধ্যা আগমনের কথা নেই। তিনি যখন অযোধ্যায়ই আসেননি তখন তাঁর মসজিদ নির্মাণেরও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এ তথ্যটিকে এ কথা বলা অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, রোযনামচার ঐ পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া যায় না, যাতে বাবরের অযোধ্যা আগমনের উল্লেখ থাকতে পারে।

এ জাতীয় অনুমান একজন ঐতিহাসিকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ শুধু বিবাদে ইন্ধন দেওয়ার জন্য লেখা হয়েছে। উপরের উদ্ধৃতিতে কোথাও রামজন্মভূমি ধ্বংসের কথা নেই, তবে ইশারা-ইঙ্গিতে সে ধারণাই দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হয়নি। কারণ এর সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।

যখন এ কথা লেখা হল যে, এই মসজিদ তার ফলক-লিপির বিবরণ অনুযায়ী ১৫২৮সালে নির্মিত এবং তাতে বাবরের কথাও বলা হয়েছে তখন এ কথা স্বীকার করে নিতে দ্বিধার কী কারণ থাকতে পারে যে, এটি বাবরের আমলেই নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এটা স্বীকার করে নিলে বিবাদ কীভাবে জিইয়ে রাখা যাবে?

পি. কার্নেগির রিপোর্টে ১৮৫৫র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা আছে। কিন্তু সংঘর্ষের মূল কারণ বলা হয়নি। মনে হতে পারে, এই সংঘর্ষ বাবরি মসজিদের কারণে হয়েছিল, কিন্তু ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল হনুমানগাড়ির একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে, যা হিন্দুরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।

ঐ সংঘর্ষের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, প্রথমে হিন্দুরা জোরপূর্বক হনুমানগাড়ি কব্জা করে-এ তথ্য সঠিক, কিন্তু এরপর লেখা হল, মুসলমানরা জন্মভূমি অধিকার করে। এ থেকে মনে হতে পারে, ঐ সময় পর্যন্ত জন্মভূমি বিদ্যমান ছিল এবং মুসলমানরা তা অধিকার করেছিল। অথচ এখানে জন্মভূমি বলে বাবরি মসজিদকেই নির্দেশ করা হয়েছে। আগেও বলা হয়েছে, ঐ সংঘর্ষে বাবরি মসজিদের ফটকের সামনেই পঁচাত্তর জন মুসলমান লড়াই করে শহীদ হন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাবরি মসজিদ না বলে জন্মভূমি কেন বলা হল? শুধু হিন্দুদেরকে বিশ্বাস করানোর জন্য যে, মসজিদটি রামজন্মভূমির উপরই নির্মিত! বিবাদে উসকানী দেওয়া ছাড়া এর আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

আরো বলা হয়েছে, বাদশাহর বাহিনী ছিল এই ঘটনার নীরব দর্শক, তাদের উপর হুকুম ছিল কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার। বাদশাহ অর্থ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। এই অসত্য তথ্য পরিবেশনের উদ্দেশ্য ইংরেজ কমান্ডার বারলোর নির্বিচার গুলিবর্ষণকে ধামাচাপা দেওয়া। এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে।

আর এ তো নির্জলা মিথ্যা যে, কথিত আছে, এ যাবৎ হিন্দু-মুসলমান ঐ মসজিদ-মন্দিরে ইবাদত ও পূজা করত। কোনো মুসলমান কি মেনে নিতে পারে যে, একই জায়গায় মূর্তিপূজাও হবে, নামাযও পড়া হবে। আর আগে থেকেই যদি এই রীতি চলে আসবে তাহলে হিন্দু-মুসলমানের বিবাদই কেন হল আর তা মীমাংসার জন্য বৃটিশ আমলে বেড়াই বা কেন দিতে হল?

উপরন্তু হিন্দুরা কীভাবে মেনে নিল যে, আজ থেকে বাবরি মসজিদে শুধু নামাযই পড়া হবে, পূজা করা যাবে না? পূজা হবে মসজিদের বাইরে!! এই মিথ্যাচারেরও উদ্দেশ্য হিন্দুদের উসকানী দেওয়া।

এই তথ্যও সঠিক নয় যে, মসজিদ ও চবুতরার মাঝে বৃটিশ শাসনামলে দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল। কায়সারুত তাওয়ারীখের লেখক বলছেন, নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহ-ই সর্বপ্রথম মসজিদ ও চবুতরার মাঝে জংলা দিয়ে দুটোকে আলাদা করে দিয়েছিলেন, যা ১৮৫৫ সালে বৈরাগীরা ভেঙ্গে ফেলে। (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১২)

এটা ভিন্ন কথা যে, পরে আবার এখানে দেয়াল তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement