যিলকদ-১৪৩২   ||   অক্টোবর-২০১১

জা তি সং ঘ : ওবামার ভাষণ নিষ্ফল হবে না

খসরূ খান

 

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়ে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদের আবেদন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনটি করেছেন ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাস। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে দেখা করে গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার লিখিত আবেদনটি তিনি হস্তান্তর করেন। এরপর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে মাহমুদ আববাস বলেন, আমরা শান্তির জন্য হাত বাড়িয়ে রেখেছি। শান্তি আলোচনাতেও অংশ নিয়েছি, কিন্তু ইহুদী বসতি স্থাপন অব্যাহত থাকায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অধিবেশনে উপস্থিত বিশ্বনেতারা তাদের নিয়ম অনুযায়ী দাঁড়িয়ে ও করতালি দিয়ে তার এ ভাষণকে স্বাগত জানান। একই অধিবেশনে আববাসের ভাষণের পর পর বক্তব্য দেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এরও আগে ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আবেদন বিষয়ে ভেটো দেবেন বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন।

 

নিয়ম অনুযায়ী মাহমুদ আববাসের এই আবেদন অনুমোদনের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে পাঠাবেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। সেখানে প্রস্তাবটি পাস হতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ সদস্যের সমর্থন লাগবে। তবে এ পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যের কেউ ভেটো দিলেই বিষয়টি আটকে যাবে। নিরাপত্তা পরিষদে পাস হলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পেতে হবে ফিলিস্তিনকে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে চীন ও রাশিয়া ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে এ স্বীকৃতি দেওয়ার তালিকায় রয়েছে বসনিয়া হারজেগোভিনা, ব্রাজিল, গ্যাবন, ভারত, নাইজেরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১২২টিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

স্থায়ী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবির বিষয়ে ভেটো দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ কারণে এখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে।

অবশ্য বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদে আটকে গেলেও ফিলিস্তিনের আবেদন সাধারণ পরিষদে যদি পাস হয় তাও তাদের দাবিকে একটি বৈধতা দেবে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। আর তা-ই অর্জন করতে চাইছেন আববাস। ফিলিস্তিন কর্মকর্তা নাবিল সাথ বলেন, ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া নৈতিক, আইনগত ও সর্বমহলে স্বীকৃত দাবি।

এদিকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দাবির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে কূটনৈতিক অঙ্গন ও মিডিয়ায় চলছে তোলপাড়।

কোনো কোনো মিডিয়ায় ওবামাকে পৃথিবীর সেরা ইহুদী হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ব্যক্তিটিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যু নিয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বহু মনভোলানো কথাবার্তা বলেছিলেন। এখন তিনিই ইসরাইলের সুরে গলা চড়িয়ে কথা বলছেন।

(পাঠকের হয়তো মনে আছে, ওবামার কায়রো ভাষণের পর আলকাউসারের একটি শিরোনাম ছিল-আমরা পরাজিত হলেও যেন প্রতারিত না হই।)

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬ তম অধিবেশনের প্রথম দিনে (২১ সেপ্টেম্বর) ওবামা ২০ মিনটের বক্তৃতার বেশির ভাগ সময় জুড়েই ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলেছেন। নগ্নভাবে ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জাতিসংঘের স্বীকৃতির পরিবর্তে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ফিলিস্তিনীদের আহবান জানান। তার বক্তব্যে এ তিক্ত সত্যটি ফুটে ওঠেছে যে, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের দয়া না হলে ফিলিস্তিন নামক স্বাধীন কোনো রাষ্ট্রের দাবির পক্ষে সম্মতি জানানো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মাহমুদ আববাসের আনুষ্ঠানিক এই দাবির কোনো ভবিষ্যৎ হয়তো নেই। কেউ মনেও করেন না যে, এতে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার সুযোগ ফিলিস্তিন পাবে। কিন্তু এ দাবি উত্থাপনের আগে-পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা দেখা গেছে, এর একটি ভবিষ্যৎ অবশ্যই আছে।

আরব মুসলিম ও বিশ্ব মুসলিমের যে কোনো ইস্যুতে বুশ আর ওবামা যে আলাদা কেউ নন আরেকবার বড় রকমভাবে এ সত্যটি এতে ধরা পড়েছে। এ ঘটনা যুগ যুগ ধরে চলা ইসরাইলী বর্বরতা ও নির্মমতার পেছনে মার্কিনীদের ঐক্যবদ্ধ পৃষ্ঠাপোষকতার চেহারা থেকে ঘোমটা খুলে দিয়েছে। ইসরাইল ও ইহুদী শয়তানীর বিরুদ্ধে পৃথিবীর শত কোটি মুসলিমের ঘৃণার পাত্র এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রও হতে থাকবে নিশ্চিতভাবে।

এ কারণে সামনের দিনগুলোতে এ যুক্তিটিই শাণিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হবে যে, মার্কিনীদের স্বার্থের ক্ষতি হওয়া মানেই মুসলমানদের কল্যাণ হওয়া এবং ইসরাইলের ক্ষতি হওয়া এবং হতে পারে শাণিত এ যুক্তির পক্ষেই শত কোটি মানুষের মনোভাব ও কর্মধারা প্রবাহিত হতে থাকবে। তখন কারো কোনো প্রবোধে হয়তো কেউ সান্ত্বনা বোধ করবে না। সুতরাং আববাসের আবেদন নিষ্ফল হলেও ওবামার ভূমিকা নিষ্ফল হবে না। দীর্ঘ মেয়াদী ফল ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসবে ওবারমার ভাষণ ও ভূমিকা।

 

 

 

advertisement