শাওয়াল-১৪৩২   ||   সেপ্টেম্বর-২০১১

সাবধানতা কাম্য

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

কিছুদিন আগে একটি ওয়াজ-মাহফিলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পল্লী গাঁয়ের ছোট মাহফিল এবং সময়টা ছিল আসরের পর। তাই হাজিরীনের সংখ্যা বেশি ছিল না। গ্রাম দেশের মাহফিল সাধারণ সন্ধ্যার পর থেকে জমতে থাকে এবং রাত যত গভীর হয় মাহফিলও তত জমজমাট হয়ে ওঠে।

একজন তরুণ আলিম ওয়াজ করছিলেন। কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফের উদ্ধৃতির পাশাপাশি উর্দূ-ফার্সী বয়েতও পাঠ করছিলেন। সুতরাং ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি তিনি যে সুমধুর ওয়াজেরও একজন রসিক সমঝদার তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আমরা একটু দূরে ছিলাম তবে ওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। ওয়াজের মাঝে তিনি বিক্ষিপ্ত লোকজনকে শামিয়ানার নীচে আসারও আহবান জানাচ্ছিলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে যখন তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন তখন আমরা জিবে কামড় দিলাম।

ومن اعرض عن ذكرى فان له معيشة ضنكا ونحشره يوم القيمة اعمى قال رب لم حشرتنى اعمى وقد كنت ...

(তরজমা) আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাব অন্ধ করে। সে বলবে, হে রব! তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুসমান ছিলাম! আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে। যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন করে ও নিজ প্রতিপালকের নিদর্শনাবলিতে ঈমান আনে না তাকে আমি এভাবেই শাস্তি দেই। আর আখেরাতের আযাব বাস্তবিকই বেশি কঠিন ও অধিকতর স্থায়ী। (সূরা ত্বহা : ১২৪-৭)

তাঁর বক্তব্যের খোলাছা ছিল, যারা এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করছেন, চা-স্টলে ও দোকানপাটে বসে আছে তারা যেহেতু ওয়াজ-মাহফিলের শামিয়ানার নীচে এসে বসেননি তাই উপরোক্ত আয়াত তাদের সম্পর্কে প্রয়োগ করা যায়। (নাউযুবিল্লাহ!) অথচ সামান্য

চিন্তা করলেই বোঝা যায়, আয়াতটিতে বলা হয়েছে কাফেরদের অবস্থা, যারা কুরআন মজীদের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করে। বলাবাহুল্য, যে কোনো ওয়াজ-মাহফিলে শামিয়ানার নীচে না আসার অর্থ কুরআন-হাদীসের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন নয়, এমনকি তা ঐ ওয়াজ মাহফিলের প্রতিও বিমুখতার দলিল নয়। কারণ হতে পাওে, ঐ ব্যক্তি এখন ব্যস্ত, কিছুক্ষণ পরে আসবে, কিংবা শামিয়ানার নীচে না আসলেও যেহেতু মাইকের আওয়াজ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তা-ই নিজের জায়গায় বসে সে ওয়াজ শুনছে। যদি এগুলোর কোনোটাই না হয়, কেউ যদি ঐ বিশেষ মাহফিলের প্রতি বিমুখ হয়েই শামিয়ানার নীচে না আসে তবুও কি একে কুরআন-সুন্নাহর প্রতি বিমুখতা বলা যাবে? যাবে না। কারণ হতে পারে ঐ মাহফিলে যিনি ওয়াজ করছেন তার প্রতি ঐ ব্যক্তির আস্থা নেই। বক্তা কুরআন-হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা করছেন এই আস্থা না থাকলে তিনি আসবেন কেন? তেমনি মাহফিলের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে যে কারণে তিনি এখানে আসেননি। মোটকথা, এমন হতে পারে যে, এই বিশেষ মাহফিল থেকে বিমুখ হলেও তিনি কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিমুখ নন।

 তো মাহফিলের আওয়াজ যতদূর পর্যন্ত যাবে সবাইকেই শামিয়ানার নীচে আসতে হবে নতুবা তারা উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে পড়ে যাবেন-এটা কক্ষনো ঠিক নয়।

এ জাতীয় অসতর্কতা খুবই মারাত্মক। অনেক সময় তা সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত ও হঠধর্মী করে তোলে এবং তাদের দ্বীন ও ঈমানের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। 

এ ধরনের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। বেশ কিছুদিন আগের কথা। কোনো প্রয়োজনে সায়েদাবাদ হয়ে খিলগাঁর দিকে যাচ্ছিলাম। সে সময় পল্টন ময়দানে একটি রাজনৈতিক দলের সংবর্ধনা জাতীয় অনুষ্ঠান ছিল। নগরীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ছোট ছোট অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল সেইসব কেন্দ্র থেকে। মাইকে বিকট শব্দে বিভিন্ন শ্লোগান দেওয়া হচ্ছিল। আমি বাসে বসে আছি, এমন সময় দেখি, দুজন তরুণ খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে বাসে উঠল। তাদের কথা থেকে জানা গেল, তারা যখন মোড় পার হচ্ছিল তখন মাইকের বিকট শব্দের কারণে কানে হাত দিয়েছিল। মাইকধারীর তা চোখে পড়ে যায় এবং মাইকে বলে ওঠে-ইসলামের কথা শুনে কানে হাত দেয়; কাফের নাকি!

বিজ্ঞ পাঠক হয়তো অনুমান করতে পারছেন, কুরআন মজীদের কোন আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা নূহের ৭ নং আয়াতে কাফিরদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, হযরত নূহ আ. আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিলেন, ... আমি যখনই তাদেরকে আহবান করেছি যেন তুমি তাদের ক্ষমা কর, তারা তাদের অঙ্গুলিসমূহ তাদের কানে প্রবিষ্ট করেছে এবং তাদের কাপড় দ্বারা (মুখম ল) আবৃত করেছে ...।

ঐ তরুণ দুটি খুব উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিল যে, মাইকের আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে, তাই কানে আঙ্গুল দিলাম, আর সে আমাদের কাফের বলে কটাক্ষ করল! এরপর যা আশঙ্কা করেছি তা-ই হল। প্রথমে ঐ রাজনৈতিক দল, এরপর আলিম-উলামা, দ্বীনদার শ্রেণী, এরপর ইসলাম ও মুসলমান সবাই আলোচনার বিষয়বস্ত্ত হয়ে গেল। বলাবাহুল্য, সেইসব আলোচনা প্রীতিপূর্ণ ছিল না।

তো আমাদের নবীন আলিম ও তালিবে ইলমদের অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। জুমার আলোচনায় বা ওয়াজ-নসীহতে কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফ পাঠ করার অভ্যাস যেমন করা চাই তেমনি সাবধানতাও অবলম্বন করা চাই। আলোচনায় কোন কোন আয়াত এবং কোন কোন হাদীস পাঠ করা হবে তা নির্ধারণ করে তার অর্থ ও মর্ম ভালোভাবে দেখে নেওয়া জরুরি। কুরআন মজীদ খুলে আয়াতটির পূর্বাপর মনোযোগের সাথে পাঠ করলে এবং কোনো সহজ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাব থেকে আয়াতের অর্থ, মর্ম ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি দেখে নিলে ইনশাআল্লাহ এ ধরনের ভুল হবে না। এই সাবধানতাটুকু না থাকলে অজান্তেই-আল্লাহ না করুন-কুরআন মজীদের তাহরীফে মানবী বা অর্থ-বিকৃতির মতো মারাত্মক গুনাহয় লিপ্ত হওয়ার সমূহসম্ভাবনা থাকে। অন্যান্য কুফল তো আছেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন এবং তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

 

advertisement