শাবান-রমযান ১৪৩২   ||   জুলাই-আগস্ট ২০১১

মাহে রমযান : পারস্পরিক সহযোগিতা বিবেচনা দায়িত্ব ও ছাড়ের কিছু কথা

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

অনন্য ইবাদতের মাস রমযান। এ মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য মাসব্যাপি রোযা পালন করা। মাসের প্রতিটি দিন উপোস করে, সংযমের সঙ্গে কাটানো। এর সঙ্গে উতপ্রোতভাবে জড়িত সাহরী ও ইফতার-রোযার সূচনা ও শেষের খাবার-উপলক্ষ, আছে তারাবীহ। ফরয নামায ও জরুরি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি নফল ইবাদত, তেলাওয়াত এবং দান-খায়রাতের সম্পর্কও এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এজন্য দ্বীনী প্রয়োজন ও নিয়মসহ স্বভাবজাত ও   বাস্তব নানা কারণে এ মাসটিতে মুসলমানদের জীবনে কিছু ব্যতিক্রমী রুটিন, প্রস্ত্ততি, উপলক্ষ ও প্রবণতা ফুটে ওঠে। এর প্রভাব মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে অ-মুসলিমদেরও স্পর্শ করে যায়। এজন্য রমযানের রোযা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আমল হওয়া সত্ত্বেও এ উপলক্ষে পারস্পরিক নির্ভরতা, সহযোগিতা ও একের প্রতি অন্যের বিবেচনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সামনে  চলে আসে। এ বিষয়গুলো আসে      বিভিন্ন দিক থেকে। মনোযোগ, বিবেচনা ও সচেতনতা না দিলে এতে বিভিন্ন ধরনের বিপত্তি ও সংকটের সৃষ্টি হতে পারে ও হয়ে থাকে। মাহে রমযানে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি এ বিষয়গুলোর প্রতি তাই সচেতন হওয়া আমাদের প্রত্যেকের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুই.

প্রথমেই চলে আসে মুসলিম রোযাদার পরিবারগুলোর ঘরণী বা নারী সদস্যদের কথা। রমযানে ঘরের প্রয়োজনীয় সম্মিলিত আয়োজনগুলোতে তারাই সবচেয়ে বেশি শ্রম ও সময় দিয়ে থাকেন। সংসারের কঠিন কাজগুলোর পাশাপাশি ইফতার, সাহরী, রাতের খাবারের প্রস্ত্ততিসহ পরিবারের রোযাদার সদস্যদের নানা চাহিদা মেটানোর পেছনে অকাতরে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। আবার তারা রোযাও রাখেন। ফরয, ওয়াজিব, নফল ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার আবশ্যকতা ও আগ্রহ তাদের মাঝেও থাকে। রোযাজনিত অবসাদ ও ক্লান্তিও তারা বোধ করেন। কিন্তু পরিবারের পুরুষ-সদস্যরা অনেক সময়ই পরিবারের নারীদের সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার এই দিকটির প্রতি চোখ রাখেন না। চাহিদা অনুযায়ী কিংবা মনমতো কিছু একটার ঘাটতি ঘটে গেলে তারা বিরক্তি বা ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেন না। এটা রমযান ও রোযার সংযমনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে মানসিক জুলুমের ঘটনাও ঘটে যায়-যেটা রমযান-অ-রমযান কোনো অবস্থাতেই অনুমোদিত নয়।

এজন্য এ বিষয়টির প্রতি পূর্ণ সতর্কতা ও সর্বোচ্চ বিবেচনা বজায় রাখা রোযাদার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিলে সমস্যার মাত্রা কমে যাবে বলে আশা করা যেতে পারে। এক. রমযানে নারীদের ঘরোয়া আয়োজনগত সেবার মূল্যায়ন করা। কারো পক্ষ থেকে উপকৃত হলে মানুষ যেমন তাকে কথায়-আচরণে খুশি করার চেষ্টা করে, রমযানে ঘরের নারীদের প্রতি তেমন সৌজন্য ও সদাচার প্রকাশ করা উচিত। দুই. সাহরী-ইফতার ও অন্য যে কোনো আয়োজন এবং সেবায় কখনো কখনো মন ও রুচিমাফিক কিছু না পেলে সয়ে যাওয়া ও ধৈর্য্য ধরা। এ কারণে ঘরণীর প্রতি কোনো রকম তিক্ত আচরণ করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা উচিত। তিন. নিজে রোযাদার হয়েও ঘরণী যে শ্রম ও সময় দিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা নেওয়া। এটা প্রত্যক্ষভাবে নিজে হাত লাগিয়েও করা যায়। আবার সহযোগী কাজের মানুষের ব্যবস্থা করেও তার কষ্ট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়। সময়, পরিস্থিতি ও সুবিধা অনুযায়ী সহযোগিতার ধরণটা ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে। চার. রমযানে শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া নফল-মুস্তাহাব পর্যায়ের সেবার জন্য নারীদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়া। যেমন পরিবারের কর্তার মনে হল, আজ কয়েকজনকে দাওয়াত করে ইফতারের বিশেষ মেহমানদারি করবেন। এজন্য তিনি ঘরণীর সুবিধা-অসুবিধা, ক্লান্তি ও আয়োজনের শ্রম-কোনোদিকেই খেয়াল করলেন না। তার সঙ্গে আলোচনা করে আগেই তাকে মানসিকভাবে তৈরি করা সম্ভব হল না। তাকে শুধু জানিয়ে দিলেন, এতজন মেহমান আসছেন, এই এই আয়োজন করতে হবে। মেহমানদারির এ পদ্ধতি ঠিক নয়। রমযানে ইফতার করানো অনেক ছওয়াবের কাজ। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। ঘরণীর ওপর চাপিয়ে না দিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে সেটা করতে উদ্বুদ্ধ করা এটিও স্বতন্ত্র বিষয়। দুটির মাঝে সমন্বয় করেই এ ধরনের পুন্যের উপলক্ষগুলো সমাধা করতে হবে। কিংবা অন্য উপায়ও তো খোলা আছে। বাইরে থেকে ইফতার কিনে এনেও এটা করা যায়। আবার ঘটনা যদি এমন হয় যে, দাওয়াত কিংবা বিশেষ মেহমানদারির কোনো ব্যাপার নেই, মেহমান নিজেই বাসায় চলে এসেছেন, সেক্ষেত্রে পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যেইে সেটি পড়ে যায়। তখন আয়োজন নিয়ে অস্থিরতারও কিছু নেই। যা আছে এবং যতটুকু করা গেল, তাতেই ইফতার করানোর হক আদায় হয়ে যায়।

ঘরণীর প্রতি, পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি সদাচার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের দাবি। রমযানুল মুবারকে এ দাবির জোর ও প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। সেজন্য রমযানে এ বিষয়টির প্রতি সবার বিশেষ মনোযোগ থাকা দরকার।

তিন.

রমযানে রোযা রাখা তো প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষেরই আমল। আর রোযার অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে, শারীরিক অবসাদ ও    ক্লান্তিবোধ। এ জন্য রমযান মাসে গৃহকর্মীদের প্রতি বিশেষভাবে সদয় ও ছাড়ের দৃষ্টি থাকা উচিত পরিবারে কর্তা-কর্ত্রীদের। পরিবারের সামর্থ ও সুবিধাভেদে গৃহকর্মীদেরও থাকতে পারে নানা পর্যায়। কাজের সহযোগী মহিলা, নিরাপত্তাকর্মী, গাড়ি চালক এবং এ রকম আরও অনেকেই। কোনো কোনো পরিবারে গৃহকর্মী মাত্র একজন থাকতে পারেন, কোথাও হয়ত দিনের খন্ড সময়ের জন্য একজন। তারা যদি রোযাদার হন তাহলে তাদের প্রতি গৃহের অভিভাবকদের কিছু দায়িত্ব চলে আসে। সেটি হচ্ছে, কাজেকর্মে তাদের সহযোগিতা করা। অর্থাৎ যে কাজটি সে একা করত, সেটিতে নিজেও হাত লাগানো যায়। এছাড়া রোযা অবস্থায় নির্ধারিত দায়িত্ব থেকে তার সেবা কিছু কম গ্রহণ করেও এটা করা যায়। অর্থাৎ অন্যান্য সময়ের হিসাব ধরে রমযানে তাকে সবটুকু কাজ করতে বাধ্য না করা। রমযানে তার সেবার বিনিময়ে অন্যান্য মাসের তুলনায় পারিশ্রমিকও কিছু বাড়িয়ে দেওয়া যায়। গৃহকর্মীও আল্লাহর বান্দা, তাকদীর ও তাকসীমে রিযিকের কুদরতী সিদ্ধান্তে সে এখন আমার অধীনস্থ-এ অনুভূতি  অন্তরে জাগ্রত রেখে রমযানে তার প্রতি যতটুকু সদয় হওয়া যায়, ততই কল্যাণ। রমযানুল মুবারক ও রোযার প্রতি সম্মানের ছওয়াব এবং অধীনস্থদের প্রতি সদয় ও সদাচারী হওয়ার ছওয়াব হাসিলের সৌভাগ্য এভাবে হাসিল হতে পারে।

একইভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রমযানে রোযাদার কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা যায়। একজন সুস্থ-সবল ও প্রাণচঞ্চল কর্মীর কাছে যতটুকু সময়ে যতটুকু কাজ নেওয়া হয়ে থাকে, রমযানে রোযাদারের জন্য সেক্ষেত্রে রোযাজনিত ক্লান্তিবোধের প্রতি কিছুটা হলেও সদয় হওয়া অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ হবে। মানবিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ হিসেবেও সেটা গণ্য হবে। এটা অন্যভাবেও করা যায়। কাজের সময়-পরিমাণটাই কমিয়ে দিয়ে তাতে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করানোর ব্যবস্থা করা যায়। এতে রোযাদারের প্রতি সদয় আচরণের সুফল ও বরকত প্রতিষ্ঠানটি অন্যভাবে লাভ করতে পারবে বলেই আশা করা যায়-ইনশাআল্লাহ।

আমাদের সমাজে অনেক সময় অর্থ-অপচয়, সময়-অপচয় নিয়ে সচেতনতার প্রসঙ্গ উঠিয়ে একশ্রেণীর মানুষ কেবল ধর্মীয় বিষয়গুলো টেনে আনেন। হজ্ব-কুরবানীর অর্থ-খরচ নিয়ে লম্বা কথা বলেন। অফিস চলাকালে নামাযের বিরতি কিংবা রমযানে রোযাজনিত ক্লান্তির কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার গল্প ফাঁদেন। এটা মূলত ধর্মীয় জীবন থেকে দূরে সরে থাকার একটি স্বাভাবিক অথচ অবাস্তব প্রবণতা। কারণ এ সমাজে নেতিবাচক কাজে ও গুনাহর খাতে দৈনিক কোটি কোটি টাকার অপচয় হয়। সেটা তারা ভুলে যান। ফাঁকিবাজি, ইউনিয়ন, অপরাজনীতি ইত্যাদি নেতিবাচক কারণে অফিস-আদালত, কলকারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। সেদিকে তাদের চোখ যায় না। তাই তাদের ভুলযুক্তির পেছনে না ছুটে ধর্মীয় জরুরি আচরণ-অনুষ্ঠান ও আল্লাহর ইবাদতে কর্মীদের নিমগ্নতার সময়টাকে প্রতিষ্ঠানের জন্য রহমতের কারণ মনে করা উচিত। অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে তেমনটিই ঘটতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে জরুরি অপর একটি বিষয়ের উল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে, রমযানে কাজের ক্ষেত্রে কর্মীদের মাঝে ইচ্ছাকৃত কোনো ধরনের ঢিলেমি না থাকা চাই। গৃহকর্মী বলি আর প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মী বলি, নির্ধারিত সময় ও চুক্তিতে পুরো কাজ করার মানসিকতা ও প্রস্ত্ততি নিজেদের মাঝে লালন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের কর্তার দায়িত্ব হচ্ছে রমযানে রোযাদার অধীনস্থদের প্রতি সদয় হওয়া। এটা তার কাজ। কিন্তু কর্মীদের মনে রাখতে হবে, কর্মীদের জন্য এটা অধিকার নয়। তারা তাদের কাজ যথা সময়ে, যথা নিয়মে করার চেষ্টা করবেন। মূলত দু দিক থেকে পরস্পরের প্রতি বিবেচনা থাকলে বিষয়টির বিবেচনা ও ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়ে যায়।

চার.

রমযানের খাবার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটি জটিল ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা রমযানুল মুবারকে রোযাদার ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার করবেন-এটাই তো ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সুবিচার ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে পাওয়া যায় না। অথচ এসব ব্যবসায়ী ভাইয়ের অধিকাংশই মুসলিম ও রোযাদার। তারপরও কেন এমন হয়-ভাবলে সবারই মন বিষিয়ে উঠে। এটা কি ব্যবসায়ীদের উপরতলার কয়েকজনের সিন্ডিকেটেই সীমাবদ্ধ, নাকি সুবিধার ভাগ নিতে গিয়ে উপর-নিচের সবাই সমান আকাঙ্খী, সাধারণ রোযাদারদের পক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এটা বের করা কঠিন। কিন্তু ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ী সমাজ এখানে রোযাদারদের হা-হুতাশ ও কষ্টের তীরে যে প্রতিমুহূর্তে বিদ্ধ হন-এটা আমরা অনুভব করি। রমযান মাসে রোযাদারদের সঙ্গে চালাকি করে ব্যবসা না করলে ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। চোখে দেখা নগদ লাভের বাইরেও লাভ-ক্ষতির অন্য অংক আল্লাহ তাআলার হিসাবে চালু আছে। অনেক সময় সে হিসাব এ দুনিয়াতেও তার দাপট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তাই রমযানে রোযাদারদের ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা বাড়তিবিশেষ মৌসুমী মুনাফার চেষ্টা বন্ধ রাখলে প্রকৃত হিসাবে তারাও লাভবান হবেন। আর রোযাদাররাও স্বস্তি পাবেন। এর ফলে রমযানে রোযাদার ভাইদের বিক্রেতা ও ভোক্তা-দুটি শ্রেণীর মাঝে পরস্পরের হক ও ভ্রাতৃত্বের দাবিও কিছুটা পূরণ হবে।

রমযানে পারস্পরিক সহযোগিতার সঙ্গে জড়িত এরকম আরো বহু ক্ষেত্র সামনে চলে আসে। চলার পথ, কেনাকাটা, যানবাহনে উঠা-বসা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে অনেক সময়ই পরিস্থিতি এমন হয় যে, কোনো একজনের অনঢ় অবস্থান কিংবা একগুঁয়েমির কারণে জটিলতা তৈরি হয়। এতে অনেকেই ভোগান্তির শিকার হন। এসব ক্ষেত্রে সহনশীলতাই প্রধান অবলম্বন। কেউ হয়তো ভুল করছেন, অপরজন নরম হয়ে, অন্য কেউ কোমলভাবে বুঝিয়ে পরিস্থিতি সহজ করতে উদ্যোগী হলে সবার জন্যই কল্যাণ হয়।

পাঁচ.

রমযানুল মুবারকে সব মুসলিমেরই রোযা রাখার কথা। সে হিসেবে রাস্তায় বের হলে রোযাহীন কোনো মানুষের সাক্ষাত পাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা এরকম নয। রমযানে প্রথম পাঁচ-সাত দিনের পরই রাস্তাঘাটে দেখা যায় রোযাহীন মানুষের উৎকট খাবার-দাবারের আয়োজন। কিছুদিন আগেও এ দৃশ্যটা কেবল ঢাকা শহরের কিছু কিছু জায়গায় সীমিত ছিল। এখন মফস্বলের ছোট শহরগুলোতেও এ জাতীয় লজ্জাহীন খাবার-দাবারের ধুম চোখে পড়ে। রমযানে দিনের বেলায় খানাপিনার এই প্রকাশ্য ও আধা-প্রকাশ্য ব্যবস্থা বা মহড়া শুধু মারাত্মক গুনাহর কাজই নয়, চরম অমানবিক ও বর্বরতাতুল্য কাজ।

আলোচনার জন্য ধরে নিতে পারি এদেশে অ-মুসলিম যারা আছেন তারা তো আর রোযা রাখেন না। তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ-নারীরা বাসার বাইরে এলে বা পথে থাকলে তাদের তো কোথাও না কোথাও খেতে হয়। একই সঙ্গে এ তর্কও ওঠানো যায় যে, মুসলমানদেরও তো অনেকে মুসাফির থাকতে পারেন, কেউ কেউ রোযা না রাখার মতো অসুস্থতায় আক্রান্তও থাকতে পারেন। তারাও তো কোথাও না কোথাও খাবেন। এসব তর্ক আসলে শুধুই তর্ক। এগুলো যুক্তির সীমানার মধ্যে পড়ে না। এই তর্কের বাইরে গিয়ে একথাও বলা যায় যে, বহু লোক তো কোনো কারণ ছাড়াও রোযাহীন থাকতে পারেন, এটাও তো তার অধিকার (!) তাই তারও তো খেতে হবে। হ্যাঁ, আল্লাহ তাকে খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ দিয়েছেন, পেটে ক্ষুধা দিয়েছেন, আল্লাহর বিধান দিয়েছেন রোযা রাখার। কিন্তু এর জন্য আল্লাহ কোনো কুদরতি চাপ প্রয়োগ করেন না। বান্দা পয়সার জোরে, সুস্থতার জোরে নিজের ক্ষমতা দিয়ে জাহির করেছেন, তিনি রোযাহীন থাকতে পারেন।  তিনি তা করেছেন। তার ফল অবশ্যই তিনি ভোগ করবেন। 

অমুসলিম, অসুস্থ, মুসাফির কিংবা অকারণ রোযাহীন যে-ই হোন, তার রোযা না রাখাটাকে হাজার হাজার রোযাদারের সামনে জাহির করার কী আছে! রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে খেতে থাকা, হোটেলগুলো প্রকাশ্যে খুলে রাখা, বিড়ি-সিগারেট, চা-পান প্রকাশ্যে চালিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন! এটা হচ্ছে স্বভাবজাত নির্লজ্জতার পরিচায়ক একটি আচরণ। ইচ্ছা করে মাহে রমযানের অবমাননা, সচেতনভাবে রোযাদারদের কষ্ট দেওয়া ও অসম্মান করার মহড়া এটি।

বাংলাদেশের মতো দেশে রমযান মাসে প্রকাশ্যে যারা খানাপিনা করেন, তারা কেবল ক্ষুধা মেটানোর জন্য এমন করেন না। এর সঙ্গে অত্যন্ত নীচুমানের জীঘাংসা ও ছোটলোকী মেজাজ জড়িত। তাই যারা না বুঝে অন্যের দেখাদেখি এমন করছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, যে কোনো কারণেই হোক রমযান মাসে নিজে রোযা রাখতে না পারলেও রমযানুল মুবারক ও সিংহভাগ মানুষ -রোযাদারদের প্রতি সম্মান দেখান। এতে হতে পারে, একদিন আল্লাহ তাআলা আপনাকে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দেবেন। আর যারা বুঝেশুনেই এমন করছেন তাদেরকে শুধু বলতে পারি, সামর্থ আর স্বাস্থ্যের জোরে রোযার দিনে প্রকাশ্যে উদরপূর্তির এই ফুটানি আল্লাহ তাআলা সহ্য করেন না। এমন দিন তাদের না আসুক যে, টাকা থাকবে, খাবার থাকবে, ক্ষুধা থাকবে, খাওয়ার তীব্র আগ্রহও থাকবে, কিন্তু কিছুই খেতে পারছেন না এবং এভাবেই বছরের পর বছর হর রোজ রোযা রেখে পার করতে হবে।

ছয়.

এ পর্যায়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম কর্মকর্তাদের বিবেচনার জন্য একটি বিষয় আলোচনা হওয়া দরকার। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে শালীনতা-অশালীনতা প্রশ্নে বেশির ভাগ গণমাধ্যমের উপস্থাপন সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও মুবারক রমযান মাসে এ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থাপন ও পরিবেশনা একটা সংযমী অবয়ব ধারণ করতে পারে। এটা রমযান মাসের দাবি। এটা রোযাদারদের সংযম চেতনার দাবি। দাবি করেই বলা যায়, রমযানে গণমাধ্যমগুলো অপেক্ষাকৃত সংযমী পরিবেশনা রাখলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বৈ কমবে না। জরুরি খবরাখবর জানতে গিয়ে, দেশ-বিদেশের অবস্থা দেখতে গিয়ে কবীরা গুনাহর হাতছানির মধ্যে পড়ে যাওয়াটা রোযাদারের জন্য চরম ক্ষতিকারক ও অস্বস্তিকর। রোযাদারও তো মানুষ। রমযানের সংযমের মাঝেও তার পেছনে রিপুর প্ররোচনা চলতে থাকে। সেখানে তার চেষ্টা ও প্রয়োজন থাকে রিপুর ওপর জয়ের। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো যদি রিপুর সহায়ক শক্তি হয়ে রোযাদারের সংযমের দূর্গে আঘাত করতে থাকে, সেটাতো সমীচীন কাজ হয় না। রিপুর সহযোগী না হয়ে শুদ্ধ সংযমী আত্মার সহায়ক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যমগুলো ভূমিকা রাখুক। অন্তত রমযান মাসে। রমযান মাসে কোটি রোযাদারের এমন একটি নির্দোষ প্রত্যাশার মূল্য দিলে গণমাধ্যমের কর্তারাও কল্যাণের ভাগিদার হবেন বলে আমরা আশা করতে পারি।

মাহে রমযানের পবিত্রতার সঙ্গে নানা প্রয়োজনে প্রকাশ্যে বিচরণশীল নারীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম নারীকে পর্দা করে চলার নির্দেশ দিয়েছে। আবরণের মধ্যে নিজেকে ঢেকে চলতে নারীদের ওপর ইসলাম ফরয করে দিয়েছে। এটা সব সময়ের জন্য, বাইরে বের হলে নারীর এভাবেই চলা উচিত। কিন্তু যারা এ নির্দেশটা পালন করেন না, এদেশে তাদের একটি অংশ অ-মুসলিম হলেও বড় অংশটি আসলে মুসলিম। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অবাধ্যতার এই আমলটি সেই মুসলিম বোনেরা অন্তত রমযান মাসে যদি বন্ধ রাখতে শুরু করেন তাহলে তাদের সামনে কল্যাণের দরজা খুলে যেতে পারে। মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, নারীর পর্দাহীনতা শুধু নারীর নিজের একটি করণীয় আমল পরিহারের বিষয় নয়, এর সঙ্গে পুরুষেরও চোখ ও অন্তরের আমল নষ্ট হওয়ার বিষয় জড়িত। পর্দা না করার গুনাহটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হলে এক ব্যাপার ছিল। কিন্তু এটি তো সংক্রামক একটি গুনাহ। পর্দা না করে যারা আরেকটু খোলামেলা কিংবা টাইটফিট পোশাক পরে বাইরে বের হন তাতে তাদের কোনো মঙ্গল না হলেও স্বভাবগত কারণেই বহু পুরুষের ক্ষতি হয়ে যায়। এজন্য উগ্র-বেপর্দা নারীদের প্রতি অনুরোধ, আপনাদের গুনাহময় নিজস্ব লাইফ-স্টাইলের মাধ্যমে অন্যদের রমযানের সংযমে চিড় ধরানো থেকে বিরত থাকা আপনাদের দায়িত্ব। নিজের ধ্বংস নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না থাকলেও (হয়তো সেটা আপনার অধিকার (!)) অপরের ক্ষতি তো আপনি করতে পারেন না। রমযান মাসে লজ্জাশীলতার পরিচয় দিয়ে একটু সদয় হয়ে রাস্তায় বের হলে বহু রোযাদার পুরুষের জানটা বেঁচে যায়।

সাত.

রমযান মাসে রোযার প্রাণ ও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের    বিভিন্ন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা। তারা উদ্যোগী ও তৎপর হলে রমযানের সংযমী পরিবেশ গড়ে তোলা সহজ ব্যাপার। রমযানের বিভিন্ন জরুরি আনুষ্ঠানিকতাগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। উপরে আলোচিত বেশ কয়েকটি বিষয়ে রাষ্ট্র তৎপর হলে সমস্যাগুলোর সমাধান আপনা থেকেই হয়ে যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র দিন দিন যতই খোলাসা হচ্ছে ততই এসব ক্ষেত্রে তার অমনোযোগ ও উন্নাসিকতা বেড়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় এবং ধর্ম সংশ্লিষ্ট জরুরি নৈতিকতার ক্ষেত্রগুলোতে রাষ্ট্রকে ইদানীং দূরবর্তী দর্শকের ভূমিকাতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। তারপরও নাগরিক সুবিধা-অসুবিধার অতি সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় বিবেচনা থেকে কয়েকটি বিষয়ে রমযানে রাষ্ট্রের মনোযোগী ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।

এর একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কম, ঘাটতি প্রচুর। এগুলো পুরনো কথা। এর জন্য বর্তমান সরকার বহু হাঁকডাক করেও গত আড়াই বছরে কেন কিছু করতে পারেনি-সে তর্কেও যেতে চাই না। রমযানে লোডশেডিং-এর মাত্রাটা যেন কম থাকে শুধু এটুকুই নাগরিকদের এখনকার দাবি। বিশেষত সাহরী, ইফতার ও তারাবীহর সময়ে দু ঘণ্টা করে মোট ছয় ঘণ্টা সময় যেন দেশের কোথাও লোডশেডিং না হয়-এ বিষয়টি নিশ্চিত করা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এর সঙ্গে যুক্ত হবে যোহর ও আসরের নামাযের সময় আরো দু ঘণ্টা। গত দুটি বিশ্বকাপে শুধু টিভিতে খেলা দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশজুড়ে নিশি্ছদ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিভাগ তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। রমযানে সে সক্ষমতা না দেখাতে পারলে আগের দেখানো সব সক্ষমতার ভুল অর্থ দাঁড় করিয়ে নিতে বাধ্য হবেন রোযাদার নাগরিকরা।

অপর দুটি ক্ষেত্র হচ্ছে গ্যাস ও পানি। রমযান মাসে এ দুটি ক্ষেত্রে কোনো সংকট ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে রোযাদারদের সমস্যার অন্ত থাকে না। এ দুটি খাত নিয়ন্ত্রণে যারা ভূমিকা রাখেন, রমযানে তাদের মনোযোগ ও দক্ষ তৎপরতা দেখতে চায় দেশবাসী। যানজট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা যদি এসব বিষয়ে রমযানে তৎপর না থাকেন তাহলে রোযাদাররা ভোগান্তিতে পড়ে যাবেন, বিষয়টা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয় না। জনগণের ক্ষোভ ও বিক্ষোভের ঘটনাও রাষ্ট্র পরিচালকদের দুশ্চিন্তার কারণে পরিণত হতে পারে।  এজন্য এসব ক্ষেত্রে মনোযোগদান নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের দরকার।

মাহে রমযানের রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-আমলের মধ্য দিয়ে একটি সামগ্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। এজন্য রমযান ও রোযার বিষয়টিকে যার যার ব্যক্তিগত ধর্মপালনের পর্যায়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এর জন্য ব্যক্তির পর সমাজ, সমাজের পর রাষ্ট্রের পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতাকে সবারই গুরুত্বের চোখে দেখা উচিত। এটি কেবল এদেশীয় প্রেক্ষাপটের বিষয় নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের সবকটি দেশেই এ মাসের চিত্রে একটি উজ্জ্বল ভিন্নতা ফুটে ওঠে। অমুসলিম-প্রধান দেশগুলোতেও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে রমযানের পবিত্রতা ও জরুরি আনুষ্ঠানিকতা রক্ষায় জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে আমরা কেন সচেতন হব না? নিজেদের পরিমন্ডলে সহযোগিতা, সদয়তা ও ছাড়ের মধ্য দিয়ে সুন্দর ও কামিয়াব রমযান কাটানোর চেষ্টা আমাদের করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন। 

 

 

advertisement