শাবান-রমযান ১৪৩২   ||   জুলাই-আগস্ট ২০১১

সাদাকাতুল ফিতর আধা সা গম : হাদীস ও সুন্নায়, আছার ও ইজমায়

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ

সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কিত এই প্রবন্ধটি আমার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রস্ত্তত হয়েছে। মারকাযুদ দাওয়াহর আততাখাসসুস ফিলফিকহি ওয়ালইফতাবিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মৌলভী ইমদাদুল্লাহ তা লিখেছে। মাশাআল্লাহ অত্যন্ত সুন্দরভাবে এতে প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি একত্রিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাসআলাটির জটিল দিকসমূহ সহজ ভাষায় দলিলসহ আলোচনা করাা হয়েছে।

প্রবন্ধের শেষে আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীলদের প্রতি একটি জরুরি পরামর্শ। সুখের বিষয় এই যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গত ২১ জুন ২০১১ ঈ., মঙ্গলবার উলামা-মাশায়েখের সাথে এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার মতবিনিময় করেছে এবং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এটি একটি পুরানো বিষয়। এতে নতুন ইজতিহাদের প্রয়োজন নেই। তাই পূর্বের ন্যায় হাদীস ও ফিকহে বিদ্যমান সাদকাতুল ফিতরের দুটি পরিমাপের কথাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হবে। অর্থাৎ খেজুর, কিসমিস, পনির এবং যবের ক্ষেত্রে কোনো একটির এক সা অথবা তার মূল্য এবং গমের ক্ষেত্রে আধা সা বা তার মূল্য। দুটির যে কোনো একটিকে পরিমাপ ধরে আদায় করলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য যিনি সামর্থ্য অনুযায়ী যত বেশি আদায় করবেন তিনি তত বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবেন।  

এই সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য আমরা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশলীদের মুবারকবাদ জানাই। আশা করি, প্রবন্ধটি পাঠকদের এ বিষয়ে ইলমী (তথ্য ও জ্ঞানগত) প্রশান্তি দান করবে।  والتوفيق بيد الله تعالى 

প্রবন্ধটিতে বারবার হাদীস ও ফিকহে বর্ণিত কিছু পরিমাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচলিত পরিমাপ অনুযায়ী সে পরিমাণগুলোর হিসাব বুঝে নেওয়া দরকার। এতে প্রবন্ধটির পাঠোদ্ধার সহজ হবে।-তত্ত্বাবধায়ক

 সাদাকাতুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রমযানুল মুবারকের শেষে ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করতে হয়। এটি যাকাতেরই একটি প্রকার, যার দিকে সূরাতুল আ’লায় (৪-১৫) ইশারা করা হয়েছে- 

قد افلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস ও সুন্নাহয় তা আদায়ের তাকীদ করেছেন এবং এর নিয়ম-নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণেই নবী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ ইসলামের পাঁচ রোকন ও দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক আমল ও ইবাদতের মতো ছদাকাতুল ফিতরও নিয়মিত আদায় করে আসছে। আমাদের এ অঞ্চলে তা পরিচিত ‘ফিতরা’ নামে।  

একটি যয়ীফ হাদীসে এই ইবাদতের দুটি হিকমত ও তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।   

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাকাতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন। অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোযার যে ক্ষতি তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকের আহার যোগানোর জন্য। (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৭) 

তাই সকলের কর্তব্য, খুশিমনে এই ইবাদতটি আদায় করা, যাতে আল্লাহর গরীব বান্দাদের খেদমত হয় এবং নিজের রোযার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হয়। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি ইবাদত আদায়ের সৌভাগ্য অর্জিত হয়।  

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সুন্নাহর আলোকে এই ইবাদতের বিস্তারিত আহকাম ও বিধান ফিকহের কিতাবে সংকলিত হয়েছে। সাদাকাতুল ফিতর কার উপর ওয়াজিব হয়, কাদের পক্ষ থেকে আদায় করতে হয়-এইসব বিবরণ হাদীস ও ফিকহের কিতাবে বিস্তারিতভাবে আছে।  

এই সাদাকার পরিমাণ সম্পর্কে হাদীস ও সুন্নাহয় দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে : তা হচ্ছে, صاع  (‘সা’) ও  نصف صاع   (নিসফে সা’)।

যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা আদায় করলে এক ‘সা’ এবং গম দ্বারা আদায় করলে ‘নিসফে সা’ প্রযোজ্য হবে।

 

শরীয়তের দলীলে একথাও প্রমাণিত যে, উপরোক্ত খাদ্যবস্ত্তর পরিবর্তে সেগুলোর মূল্য আদায় করারও অবকাশ আছে। সেক্ষেত্রে উল্লেখিত খাদ্যবস্ত্তগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটিকে মাপকাঠি ধরে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে। অর্থাৎ ঐ খাদ্যবস্ত্তর জন্য শরীয়তে যে পরিমাণটি নির্ধারিত-‘সা’ বা ‘নিসফে সা’ সে পরিমাণের বাজারমূল্য আদায় করলেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা উচিত যে, মূল্যের দিক থেকে ঐ খাদ্যবস্ত্তগুলোর মধ্যে তফাৎ আছে, কোনোটির দাম বেশি, কোনোটির কম। তো সবচেয়ে কমদামের বস্ত্তকে মাপকাঠি ধরে কেউ যদি সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে তাহলেও আদায় হায়ে যাবে। তবে উত্তম হল, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের খাদ্যবস্ত্তকে মাপকাঠি ধরে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা।

যেহেতু সহীহ হাদীসে গমকেও একটি মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আধা সা’ তাই আধা সা গম বা তার মূল্য আদায় করলে নিঃসন্দেহে সাদাকাতুল  ফিতর আদায় হয়ে যাবে।

বর্তমান বাজার দর হিসাবে যেহেতু গমের দামই সবচেয়ে কম, তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর আধা সা গমকে মাপকাঠি ধরে ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ ঘোষণা করা হয়। টাকায় অংকটি নির্ধারিত হয় আধা সা গমের ঐ সময়ের বাজার-দর হিসাবে।

গত বছর অর্থাৎ ১৪৩১ হিজরী রমযানে হঠাৎ করেই একটি নতুন ঘোষণা এল। ফাউন্ডেশনের এতদিনের নিয়ম ও তাদের প্রকাশিত ফিকহ ও ফতোয়ার কিতাবে উল্লেখিত মাসআলার বিপরীত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রচার করা হল যে, এবারের ফিতরা একশ টাকা। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল যে, ফিতরা কমিটি চালকে মাপকাঠি ধরেছে এবং খেজুর ইত্যাদির জন্য নির্ধারিত পরিমাণ-‘সা’ কে এর উপর প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এক ‘সা’ চাল ফিতরা হিসেবে আদায় করতে হবে। আর মধ্যম মানের এক ‘সা’ চালের বাজার-দর যেহেতু একশ টাকা তাই ফিতরা একশ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছর এবং এ বছরও যেহেতু আধা সা গমের বাজার-মূল্য থেকে চালের বাজার-মূল্য বেশি তাই কেউ ঐ হিসাবে ফিতরা আদায় করে থাকলে অবশ্যই তার ফিতরা আদায় হয়েছে; বরং যাদের সামর্থ্য আছে তারা যদি খেজুর, পনির ও কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করেন তাহলে তো খুবই ভালো। কিন্তু এর কোনোটিকে সর্বনিম্ন ফিতরা বা একমাত্র ফিতরা সাব্যস্ত করার অবকাশ কোথায়?

ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ তো সেটিই, যা সুন্নাহয় উল্লেখিত খাদ্যবস্ত্তগুলোর মধ্যে পরিমাণ ও বাজার-দরের বিচারে সর্বনিম্ন। টাকার অংকে সর্বনিম্ন ফিতরা ঘোষণা করতে হলে এই মানদন্ডের ভিত্তিতেই করতে হবে। অন্যথায় সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত কোনো একটি পরিমাণকে অকার্যকর সাব্যস্ত করা হবে, যার অধিকার কারো নেই।

ফলে ঐ সময়, ফাউন্ডেশনের ঐ ঘোষণার উপর আপত্তি উঠেছিল। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার পক্ষ থেতে এবং ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে আরো অনেকে তখন আপত্তি করেছিলেন। সুখের কথা, ইসলামিক ফাউন্ডেশ উলামা-মাশায়েখের উপস্থিতিতে এ  বিষয়ে পুনরায় চিন্তা-ভাবনা করেছিল এবং আগের মতোই আধা সা গমের মূল্য হিসাবে ফিতরা ঘোষণা করেছিল। সাথে সাথে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, ঘোষিত পরিমাণটি ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ। যার সামর্থ্য আছে, তিনি এক সা পরিমাণের খাদ্যবস্ত্তগুলোর কোনো একটিকে মানদন্ড ধরেও ফিতরা আদায় করতে পারবেন এবং এটিই তার জন্য উত্তম।

এই পুনঃঘোষণার ফলে আলহামদুলিল্লাহ ঐ বিভ্রান্তির নিরসন হয়ে যায়। কিন্তু তখন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু নিবন্ধ এবং কারো কারো মৌখিক কিছু প্রশ্ন থেকে অনুমান করেছি যে, এ প্রসঙ্গে তাদের কিছু অমূলক ধারণা রয়েছে, সম্ভবত পুনরায় চিন্তা-ভাবনা করলে তা আর থাকবে না।

তাদের ধারণাগুলো নিম্নরূপ :

1.  হাদীস শরীফে ফিতরার নির্ধারিত পরিমাণ একটিই। তা হল এক সা। আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় হওয়ার বিধান কোনো সহীহ হাদীসে নেই।

2. হাদীস শরীফে; বরং যে কোনো খাদ্যবস্ত্ত থেকে এক সা দেওয়ার কথা আছে, যার মাঝে গমও অন্তর্ভুক্ত।

3. আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা সর্বপ্রথম বলেন হযরত মুআবিয়া রা.। অথবা সর্বোচ্চ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এ কথা বলেছেন। আর এটি তাঁরা নিজেদের ইজতিহাদ থেকেই করেছেন। এজন্য একে ফিতরা আদায়ের মাপকাঠি ধরা যায় না। তবে কখনো যদি আধা সা গমের মূল্য এক সা খেজুর ইত্যাদির সমান হয়ে যায় তখন হয়তো এর দ্বারা ফিতরা আদায় হতে পারে!

4. হাদীস শরীফে যে চারটি খাদ্যবস্ত্তর কথা বলা হয়েছে তা এজন্য বলা হয়েছে যে, ঐ সময় এগুলোই ছিল মদীনা শরীফে সাধারণ খাদ্যবস্ত্ত। এজন্য অন্য দেশের মানুষ, যাদের সাধারণ খাবার অন্য কিছু, তারা তাদের খাদ্যবস্ত্ত অনুযায়ী ফিতরা আদায় করতে পারবে; বরং এটিই করণীয়।

মোটামুটিভাবে সদকাতুল ফিতরকে এক সা ধরার ক্ষেত্রে এই চারটি ধারণা বা যুক্তি তারা পোষণ করেন। কিন্তু ঐ সব বন্ধুদের জেনে রাখা উচিত যে, আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের বিধান একাধিক সহীহ হাদীসে রয়েছে। এটি খোলাফায়ে রাশেদীন রা.-এর সুন্নাহ দ্বারাও প্রমাণিত। যদি কোনো সাহাবী ইজতিহাদ দ্বারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে থাকেন তবে তার সিদ্ধান্ত হাদীস ও সুন্নাহয় বর্ণিত বিধানের সাথে মিলে গিয়েছে এবং অন্যান্য সাহাবীও তার সাথে একমত হয়েছেন। এটি কোনো সাহাবীর একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, যাকে ইজতিহাদ; বলে খাটো করার চেষ্টা করা যায়। অথচ সাহাবীর ব্যক্তিগত ইজতিহাদও (যদি সেটি স্পষ্ট মারফূ হাদীসের পরিপন্থী না হয়) শরীয়তের দলীল।  

ঐ সকল বন্ধুদের আরো জানা দরকার যে, কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত কোনো শরঈ পরিমাপের কোনো একটি তাৎপর্য নিজে থেকে নির্ধারণ করে সেই তাৎপর্যটিকেই মানদন্ড বানিয়ে নেওয়া এবং কুরআন-হাদীসে বর্ণিত পরিমাপকে অকার্যকর করে দেওয়া প্রকৃতপক্ষে কুরআন-সুন্নাহর তাহরীফ ও বিকৃতি সাধন এবং গোটা উম্মতের ইজমা ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার বিরুদ্ধাচরণ।

বর্তমান নিবন্ধে বিষয়গুলোর উপর কিছুটা বিশদ ও বিশ্লেষমূলক আলোচনা করার ইচ্ছা আছে।

আধা সা সম্পর্কে হাদীস, সুন্নাহ ও আছার

1. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা করে যে-জেনে রেখো! প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর সদকায়ে ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা অন্য খাদ্যবস্ত্ত।

 أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث مناديا ينادي في فجاج مكة : ألا إن صدقة الفطر واجب على كل مسلم، ذكر أو أنثى، حر أو عبد، صغير أو كبير، مدان من قمح، أو صاع مما سواه من الطعام.

(জামে তিরমিযী ১/৮৫)। ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন, হাদীসটি হাসান।

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রমযানের শেষ দিকে বসরার মিম্বারের উপর খুতবা দানকালে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন এক সা খেজুর বা যব কিংবা আধা সা গম; গোলাম-স্বাধীন, নারী-পুরুষ ও ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর।

 فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم هذه الصدقة صاعا من تمر أو شعير، أو نصف صاع من قمح على كل حر أو مملوك، ذكر أو أنثى، صغير أو كبير.

 (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৯। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আল হাম্বলী রাহ. বলেন, হাদীসটির সকল রাবী প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। আল্লামা যাহাবী রাহ. বলেছেন, হাদীসটির সনদ শক্তিশালী।)

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ছালাবা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের একদিন বা দুদিন আগে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিয়েছেন। সে খুতবায় তিনি বলেছেন, তোমরা প্রতি দু’জনের পক্ষ থেকে এক সা গম অথবা ছোট-বড় প্রত্যেকের মাথাপিছু এক সা খেজুর বা এক সা যব প্রদান করো।

أدوا صاعا من بر أو قمح بين اثنين، أو صاعا من تمر، أو صاعا من شعير على كل أحد صغير أو كبير.

(মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৮। আল্লামা যাইলাঈ রাহ. বলেন, এই হাদীসটির সদন সহীহ ও শক্তিশালী।)

৪. হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, যে মুদ (পাত্র) দ্বারা তোমরা খাদ্যবস্ত্ত গ্রহণ করে থাক এমন দুই মুদ (আধা সা) গম আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যমানায় সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।

كنا نؤدي زكاة الفطر على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم مدين من قمح، بالمد الذي تقتاتون به.

(মুসনাদে আহমদ ৬/৩৪৬। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, হাদীসটি সহীহ এবং এ সনদটি হাসান। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. বলেছেন, এই হাদীসের সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ, সহীহ।)

ইমাম তহাবী রাহ. এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন-

 فهذه أسماء تخبر أنهم كانوا يؤدون في عهد النبي صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر مدين من قمح، ومحال أن يكونوا يفعلون هذا إلا بأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم، لأن هذا لا يؤخذ حينئذٍ إلا من جهة توقيفه إياهم على ما يجب عليهم من ذلك.

 হযরত আসমা রা. জানিয়েছেন যে, নবী-যুগে সাহাবায়ে কেরাম সদকাতুল ফিতর দিতেন আধা সা গম। এ তো সম্পূর্ণ অসম্ভব যে, রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছাড়া তাঁরা এই কাজ করতেন। কারণ দ্বীনের বিষয়ে তাঁদের কর্তব্য কী তা জানার একমাত্র সূত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা।

৫. হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন দুই মুদ (আধা সা) গম।

فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر مدين من حنطة.

 (মারাসীলে আবু দাউদ পৃ. ১৬। আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আলহাম্বলী রাহ. বলেন, এ হাদীসের সনদ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট, সহীহ। তবে তা মুরসাল। আর সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.-এর মুরসাল রেওয়ায়েতও দলিলযোগ্য হয়।)

৬. ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. বলেন, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান ও উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ রা. প্রমুখকে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর আদায়ের আদেশ করেছেন এক সা খেজুর বা দুই মুদ (আধা সা) গম।

أمر رسول الله صلى الله عليه وسلم  بزكاة الفطر بصاع من تمر، أو بمدين من حنطة.

(শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। নুখাবুল আফকার ৫/২২৫)

৭. সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ, কাসেম ও সালেম রাহ. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন সদকাতুল ফিতরে এক সা যব বা দুই মুদ (আধা সা) গম আদায় করার।

أمر رسول الله صلى الله عليه وسلم في صدقة الفطر بصاع من شعير أو مدين من قمح.

(শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, এটি সহীহ ও মুরসাল।)

৮. সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এবং আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারূক রা.-এর শাসনামলে সদকাতুল ফিতর দেওয়া হত আধা সা গম।

كان الصدقة تعطى على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبي بكر وعمر نصف صاع من حنطة.

(শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০। আল্লামা ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেছেন, এটি সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ. থেকে ছিকা রাবীগণ বর্ণনা করেছেন। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, হাদীসটির সকল রাবী ছিকা ও নির্ভরযোগ্য। আল্লামা আইনী রা. বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।)

৯. হযরত আবু উবাইদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রাহ. বর্ণনা করেন, আবদুল খালেক ইবনে সালামা আশশাইবানী রাহ. বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.কে সদকাতুল ফিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে তা ছিল মাথাপিছু এক সা খেজুর বা আধা সা গম।

حدثنا إسماعيل بن  إبراهيم عن عبد الخالق بن سلمة الشيباني قال : سألت سعيد بن المسيب عن الصدقة. فقال : كانت على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم صاع تمر، أو نصف صاع حنطة عن كل رأس.

(কিতাবুল আমওয়াল পৃ. ৫৬৪)

ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা রাহ.ও বর্ণনা করেছেন যে, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.কে সদকাতুল ফিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ছোট-বড়, গোলাম-স্বাধীন প্রত্যেকের মাথাপিছু আধা সা গম বা এক সা খেজুর বা যব।

هشيم عن سفيان بن حسين، عن الزهري عن سعيد بن المسيب يرفعه أنه سأل عن صدقة الفطر. فقال : عن الصغير والكبير، والحر والمملوك نصف صاع من بر، أو صاع من تمر أو شعير.

(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০১। শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা মুসান্নাফের টীকায় বলেন, এটি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.-এর মুরসাল হাদীস, যা মুহাদ্দিসগণের নিকট বিশুদ্ধতম মুরসালের অন্তর্ভুক্ত।

খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ

১০. আবু কিলাবা রাহ. বলেন, স্বয়ং ঐ ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, যিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর নিকট এক  সা গম দ্বারা দুই ব্যক্তির সদকাতুল ফিতর আদায় করেছেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৬)

অন্য বর্ণনায় আছে, মামার রাহ. বলেন, আমার কাছে তথ্য পৌঁছেছে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. দুই মুদ (আধা সা দ্বারা) ফিতরা আদায় করেছেন।

بلغني أن أبا بكر أخرج زكاة الفطر مدين.

(মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৬)

১১. নাফে রাহ বলেন, তিনি হযরত উমর রা.কে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি একজন ক্রীতদাস। আমার সম্পদের কি কোনো যাকাত আছে? উমর রা. বলেছেন, তোমার যাকাত তো তোমার মনিবের উপর। সে তোমার পক্ষ থেকে প্রতি ঈদুল ফিতরে এক সা যব বা খেজুর কিংবা আধা সা গম প্রদান করবে।

إنما زكاتك على سيدك أن يؤدي عنك عند كل فطر صاعا من شعير أو تمر أو نصف صاع من بر.

 (শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০; শরহু মুশকিলুল আছার ৯/৩৮)

হযরত ছালাবা ইবনে আবু সুআইব রা. বলেন, আমরা উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর খেলাফত আমলে সদকাতুল ফিতর দিতাম আধা সা গম।

كنا نخرج زكاة الفطر على عهد عمر بن الخطاب نصف صاع.

(শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০; শরহু মুশকিলুল আছার ৯/৩৯)

১২. আবুল আশআছ রাহ. বলেন, খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উসমান রা. আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিলেন। ঐ খুতবায় তিনি বলেছেন, তোমরা যাকাতুল ফিতর আদায় কর দুই মুদ (আধা সা) গম।

أدوا زكاة الفطر مدين من حنطة.

 (শরহু মুশকিলিল আছার ৯/৩৯। আল্লামা আইনী রাহ. বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ ও শক্তিশালী। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, এ হাদীসের সনদ ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।)

১৩. হযরত আলী রা. বলেন, সদকাতুল ফিতর (এর পরিমাণ) হল, এক সা খেজুর বা এক সা যব কিংবা আদা সা গম। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৩; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৫; সুনানে দারা কুতনী ২/১৫২; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনাহ ১/৩৩৬)

অন্য সাহাবীদের অভিমত

১৪. আলকামা ও আসওয়াদ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, (সদকাতুল ফিতর হচ্ছে) দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা খেজুর বা যব।

مدان من قمح أو صاع من تمر أو شعير.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০২; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৪; সুনানে দারা কুতনী ২/১৫২)

১৫. হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, প্রত্যেক গোলাম-স্বাধীন, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-গরীবের উপর সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য। মাথাপিছু এক সা খেজুর বা আধা সা গম।

زكاة الفطر على كل حر أو عبد، ذكر أو أنثى،  صغير أو كبير، غني و فقير صاع من تمر أو نصف صاع من قمح. قال معمر : وبلغني أن الزهري كان يرفعه إلى النبي صلى الله عليه وسلم.

 (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১১। আল্লামা হাইসামী রাহ. এবং আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ এবং মাওকূফ।)

১৬. আমর ইবনে দীনার রাহ. বলেন, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.কে মিম্বারের খুতবায় বলতে শুনেছেন, সদকাতুল ফিতর হল দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা খেজুর বা যব। গোলাম-স্বাধীন এই বিধানে সমান।

زكاةالفطرمدانمنقمح،أوصاعمنتمرزكاة الفطر مدان من قمح، أو صاع من تمر أو شعير، الحر والعبد سواء.

(মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৩; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০২। আল্লামা আলাউদ্দীন ইবনুত তুরকুমানী রাহ. বলেন, এটি একটি মর্যাদাপুর্ণ সহীহ সনদسهذا سند صحيح جليل)

১৭. ইমাম আবদুর রাযযাক রাহ. আমর ইবনে দীনার থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন,  সদকাতুল ফিতর হল দুই মুদ (আধা সা) গম অথবা এক সা খেজুর বা যব। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৩।)

১৮. হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, মারওয়ান ইবনুল হাকাম হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা.-এর নিকট দূত পাঠান যে, আপনার গোলামের সদকায়ে ফিতর আমার কাছে পাঠান। আবু সাঈদ খুদরী রা. দূতকে বললেন, মারওয়ানের তো (বিধান) জানা নেই। প্রতি ঈদুল ফিতরে আমাদের প্রদেয় হচ্ছে, মাথাপিছু এক সা খেজুর বা আধা সা গম।

إن مروان بعث إلى أبي سعيد : أن ابعث إلي بزكاة رقيقك، فقال أبو سعيد للرسول : إن مروان لا يعلم، إنما علينا أن نعطي لكل رأس عند كل فطر صاعا من تمر أو نصف صاع من بر.

 (শরহু মাআনিল আছার ১/৩৪৯; শরহু মুশকিলুল আছার ৯/২৬। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, এ সনদটি সহীহ। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, এই হাদীসের সকল রাবী ছিকা ও বিশ্বস্ত।)

১৯. আবু যুবাইর রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা.কে বলতে শুনেছেন, ছোট-বড়, গোলাম-স্বাধীন সকলের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা অপরিহার্য, দুই মুদ (আধা সা) গম অথবা এক সা খেজুর বা যব।

 

صدقة الفطر على كل مسلم صغير وكبير، عبد أو حر، مدان من قمح، أو صاع من تمر أو شعير.

(মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৫; মুসন্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০২; সুনানে দারা কুতনী ২/১৫১)

বিশিষ্ট তাবেয়ীদের অভিমত

২০. সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ. বলেন, রোযাদারের অবশ্য কর্তব্য সদকাতুল ফিতর আদায় করা; দুই মুদ (আধা সা) গম অথবা এক সা খেজুর।

زكاة الفطر على من صام مدان من حنطة أو صاع من تمر.

(মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৮; শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫১। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, এ সনদটি সহীহ।)

২১. ইসমাঈল ইবনে সালেম রাহ. ইমাম শাবী রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, (সদকাতুল ফিতর হল) আধা সা গম অথবা এক সা খেজুর বা যব।

نصف صاع من بر، أو صاع من تمر أو شعير.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০১)

২২. মুজাহিদ রাহ. বলেন, প্রত্যেকের প্রদেয় হচ্ছে গমের ক্ষেত্রে আধা সা। আর গম ছাড়া অন্যান্য খাদ্য যেমন খেজুর, কিসমিস, পনির, যব ইত্যাদিতে পুরা এক সা।

 عن كل إنسان نصف صاع من قمح، وما خالف القمح من تمر أو زبيب أو أقط أو شعير أو غيره فصاع تام.

(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০১; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৫। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, রেওয়ায়েতটি সহীহ। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, এ রেওয়ায়েতের সকল রাবী ছিকাহ ও নির্ভরযোগ্য এবং বুখারী-মুসলিমের রাবী।)

২৩. হাসান বসরী রাহ. থেকেও অনুরূপ বক্তব্য বর্ণিত আছে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০১। আল্লামা ইবনুত তুরকুমানী রাহ. বলেন, এটি সহীহ সনদ, এতে কোনো আপত্তি নেই।)

২৪. হযরত তাউস রাহ. বলেন, আধা সা গম অথবা এক সা খেজুর।

نصفصاعمنقمحنصف صاع من قمح أو صاع من تمر.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৩; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৪)

২৫. আতা রাহ.বলেন, দুই মুদ গম অথবা এক সা খেজুর বা যব।

مدان من قمح أو صاع من تمر أو شعير.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০২; সুনানে দারা কুতনী ২/১৪২)

২৬. ইমাম শুবা রাহ. হাকাম ও হাম্মাদ রাহ. কে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে তাঁরা বলেছেন, نصف صاع حنطة আধা সা গম। শুবা রাহ. বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম এবং সাআদ ইবনে ইবরাহীমকেও এ প্রশ্ন করেছি, ,  فقالا مثل ذلك তারাও একই কথা বলেছেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৩; শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫১। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, এটি একটি সহীহ সনদ।)

২৭. ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. বলেন, ছোট-বড়, গোলাম-স্বাধীন প্রত্যেকের পক্ষ থেকে প্রদেয় হচ্ছে আধা সা গম।

 عن الصغير والكبير، والحر والعبد، عن كل إنسان نصف صاع من قمح.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০১। শায়খ শুআইব আরনাউত এর সকল রাবীকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।)

 ২৮. আবু হাবীব রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ রাহ.কে সদকাতুল ফিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছেন,نصف صاع من حنطة أو دقيقن. আধা সা গম বা আটা। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৩)

 

২৯. আউফ রাহ.বলেন, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. উমর ইবনে আরতাত রাহ.-এর নিকট পত্র লেখেন, যা বসরার মিম্বারে পঠিত হয়েছে, যাতে তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল-তুমি তোমার অধীনস্থ মুসলমানদেরকে এক সা খেজুর বা আধা সা গম সদকাতুল ফিতর আদায়ের আদেশ কর।

 

أماأما بعد، فمر من قبلك من المسلمين أن يخرجوا صدقة الفطر صاعا من تمر، أو نصف صاع من بر.

 (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৩। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, হাদীসটির সকল রাবী নির্ভরযোগ্য ও সহীহ-এর রাবী।’

অপর একটি বর্ণনায় আছে, কুবরা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের নিকট সদকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর পত্র পৌঁছেছে, যাতে একথা ছিল যে, প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আধা সা বা তার মূল্য আধা দিরহাম ফিতরা (আদায় করতে হবে)।

 جاءنا كتاب عمر بن عبد العزيز في صدقة الفطر : نصف صاع عن كل إنسان أو قيمته : نصف درهم.

(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৮)

৩০. আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি সকলকে ঈদগাহে যাওয়ার আগেই এক সা খেজুর বা আধা সা গম ফিতরা দেওয়ার আদেশ করতেন।

 كان يأمر أن يلقي الرجل قبل أن يخرج صاعا من تمر، أو نصف صاع من قمح.

 (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৭)

বিশিষ্ট তাবে তাবেয়ীগণের অভিমত

৩১. ইমাম আওযাঈ রাহ. বলেন, 

يؤديكل إنسان مدين من قمح بمد أهل بلده.প্রত্যেকে প্রদান করবে নিজ দেশের মুদ (পাত্র) দ্বারা দুই মুদ। (আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ৪/১৩৯)

৩২. ইমাম লাইস রাহ. বলেন, গমের ক্ষেত্রে হিশামের মুদে (পাত্র) দুই মুদ আর খেজুর, যব ও পনিরের ক্ষেত্রে চার মুদ (বা এক সা)।

 بمد هشام، وأربعة أمداد من التمر والشعير والأقط.مدين من قمح

(আততামহীদ ৪/১৩৯)

 

বিশুদ্ধতা ও প্রসিদ্ধির ক্ষেত্রে আধা সা বিষয়ক হাদীসসমূহের অবস্থান

এ পর্যন্ত উল্লেখিত আধা সা সম্পর্কিত হাদীস ও আছারের উপর চিন্তা করলে যে বিষয়গুলো পরিষ্কার বোঝা যায় তাই এই-

১. আধা সা সম্পর্কে একাধিক মারফূ হাদীস রয়েছে, যেগুলোর সনদ সহীহ বা হাসান।

এ প্রবন্ধে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর সাথে হাদীস বিশারদগণের মন্তব্যও উল্লেখ করা হয়েছে।

২. আধা সা সম্পর্কে সাইদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.-এর মুরসাল হাদীসটি দলীল হিসেবে যথেষ্ট ছিল। অথচ সেই মুরসাল হাদীসের সাথে শুধু এই প্রবন্ধেই উল্লেখ করা হয়েছে নয়টি মারফূ হাদীস, যার চারটি মুত্তাসিল এবং পাঁচটি মুরসাল; আরো উল্লেখ করা হয়েছে এগারটি আছারে সাহাবা এবং তেরজন তাবেয়ীর ফতোয়া। এই সকল হাদীস ও আছারের কারণে মূল বিষয়টিকে মাশহুর-মুস্তাফীয তো বটেই, মুতাওয়াতির বলা হলেও অতিশয়োক্তি হবে না। মুহাদ্দিস আহমদ আল গুমারী রাহ., যিনি বিগত শতাব্দীর হাতে গোনা কয়েকজন হাফেযে হাদীসের অন্যতম ছিলেন, তিনি এমন মন্তব্যই করেছেন।

 

উল্লেখ্য, এ প্রবন্ধে উল্লেখিত বেশ কিছু হাদীস ও আছার একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। সনদের ভিন্নতার কারণে প্রত্যেকটি আলাদা হাদীস বলে গণ্য হবে।

৩. উপরোক্ত হাদীস ও আছারে বর্ণিত বিধানটির (অর্থাৎ খেজুর, যব ইত্যাদির এক সা আর গমের আধা সা) একটি বিশেষত্ব এই যে, তা ঘোষণা করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষক পাঠিয়েছিলেন, যা একাধিক রেওয়ায়েতে আছে। এ থেকে বোঝা যায়, বিধানটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি তা ব্যাপকভাবে অবগত করতে চেয়েছেন। এ থেকে আরো বোঝা যায়, এক সা ও আধা সা শরীয়তের দৃষ্টিতে দুটি স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপ। এজন্য উপরোক্ত হাদীসগুলোতে بعثبعث مناديا(ঘোষক পাঠিয়েছেন) أمر مناديا (ঘোষককে আদেশ করেছেন) ইত্যাদি শব্দগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

৪. এ বিধানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তা বর্ণনা করার জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর একাধিক খলীফায়ে রাশেদ এবং কয়েকজন সাহাবী ঈদুল ফিতরের আগে আলাদাভাবে ভাষণ দিয়েছেন। পূর্বোক্ত হাদীস ও আছারে বর্ণিত  خطب (ভাষণ দিয়েছেন) শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রকৃত উত্তরসূরী আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এ বিষয়ের বিধান সম্বলিত লিখিত ফরমান জারি করেছিলেন। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, তাঁর একটি ফরমানে শুধু আধা সা গম বা তার মূল্যের কথাই বলা হয়েছিল।

৫. খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল ও ফতোয়াও এই ছিল যে, গম দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করলে আধা সা দিবে। আর হাদীসে বর্ণিত বিধানের অনুকূলে যখন খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল ও সুন্নাহ পাওয়া যায় তখন তার অর্থ হয়, বিধানটি অটল ও মোহকাম, তা

মানসূখ বা রহিত নয়; এবং তাতে ভিন্ন ব্যাখ্যারও অবকাশ নেই। তা নবী-নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত-عليكمعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدينا (তোমাদের জন্য অপরিহার্য, আমার সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাদেশীনের সুন্নাহকে অনুসরণ করা)।

৬. খোলাফায়ে রাশেদীন ছাড়া অন্যান্য ফকীহ সাহাবীও এই ফতোয়া দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এবং হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাহ.-এর ব্যক্তিগত আমল ভিন্ন হলেও তাঁরা কেউ এ কথা বলেননি, আধা সা গম আদায় করলে ফিতরা আদায় হবে না। তাঁরা আগ্রহী ছিলেন হাদীসে বর্ণিত খাদ্যবস্ত্ত দ্বারাই ফিতরা আদায় করতে। আর ঘটনাক্রমে আধা সা সংক্রান্ত মারফূ হাদীস জানা না থাকায় তাঁরা সেটি দ্বারা ফিতরা আদায় করতে চাইতেন না। কিন্তু কখনোই তাঁরা এই ফতোয়া দেননি যে, আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় হবে না; বরং ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আবু সায়ীদ খুদরী মারওয়ান ইবনুল হাকামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-

إن مروان لا يعلم، إنما علينا أن نعطي لكل رأس عند كل فطر صاعا من تمر أو نصف صاع من بر.

মারওয়ানের তো জানা নেই। প্রতি ঈদুল ফিতরে আমাদের প্রদেয় হচ্ছে মাথাপিছু এক সা খেজুর অথবা আধা সা গম। (শরহু মাআনিল আছার ১/৩৪৯)

তেমনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকেও বর্ণিত আছে যে, আবু মিজলায রাহ. তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন-

إنإن الله قد أوسع، والبر أفضل من التمر؟

আল্লাহ তাআলা স্বচ্ছলতা দিয়েছেন আর গম খেজুরের চেয়ে শ্রেয়। (অতএব আপনি গম দিয়ে ফিতরা আদায় করছেন না কেন?) উত্তরে ইবনে উমর রা. বলেছেন-

إن أصحابي سلكوا طريقا، وأنا أحب أن أسلكه

আমার সঙ্গীরা যে পথে চলেছেন আমিও সে পথে চলতেই পছন্দ করি। অর্থাৎ তাঁদের মতো খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করাই আমার কাছে পছন্দনীয়। তো প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজের পছন্দের কথা বলেছেন। প্রশ্নকারীর কথাকে খন্ডন করেননি কিংবা এ কথাও বলেননি যে, তা দ্বারা ফিতরা আদায় হবে না।

সারকথা এই যে, আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় হয়- এ বিষয়ে সকল সাহাবীর ইজমা ছিল। তো যে হাদীসের অনুকূলে ফকীহ সাহাবীগণ আমল করেছেন ও ফতোয়া দিয়েছেন, এরপর শীর্ষস্থানীয় মনীষী তাবেয়ীগণ আমল করেছেন ও ফতোয়া দিয়েছেন, যাদের মধ্যে মদীনা শরীফের সাত ফকীহ ও মুসলিম জাহানের বড় বড় ফকীহ তাবেয়ীও অন্তর্ভুক্ত, সে হাদীস যে متلقى بالقبول তথা সর্বজনগৃহীত সে বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? আর এতো জানা কথা যে, ‘খবরে ওয়াহিদ’ শ্রেণীর কোনো হাদীসও যখন  متلقى بالقبول(সর্বজনগৃহীত) হয়ে যায় তখন জুমহুর ফকীহ, মুহাদ্দিস ও উসূলবিদদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এই যে, তা মুতাওয়াতিরের মতো قطعي ও সন্দেহাতীত বলে গণ্য হয়। তাহলে যে হাদীস সনদের বিচারেও মাশহুর ও মুস্তাফীয তা যদি খাইরুল কুরূনের ফকীহদের নিকট تقلى بالقبول ও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তার বিশুদ্ধতার বিষয়ে কি কারো প্রশ্ন তোলারও  অবকাশ থাকে?

 

এজন্য কেউ যদি আধা সা বিষয়ক হাদীসসমূহের উপর আপত্তি করে তবে সেটা হবে তার বিচ্যুতি, যদি না তার আপত্তি বিশেষ কোনো সনদের ক্ষেত্রে হয়। বলাবাহুল্য, কোনো বিষয়ে যদি বহু সংখ্যক হাদীস বিদ্যমান থাকলে আর সেগুলোর কোনো একটি হাদীস যয়ীফ হলে ঐ বিষয়টি প্রামাণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সংশয় প্রকাশ করা যায় না। তেমনি কোনো হাদীসের যদি অনেকগুলো সহীহ সনদ থাকে আর তা কোনো যয়ীফ রাবীও রেওয়ায়েত করে তাহলে তার রেওয়ায়েতের কারণে মূল হাদীসটিকে যয়ীফ বলা যায় না।

আধা সা গম দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায়ের মাসআলায়ও তাই ঘটেছে। এ বিষয়ে অনেক হাদীস, আছার এবং সেগুলোর বহু সনদের মধ্যে দু’ একটি হাদীস এবং সনদ যয়ীফও রয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কেবল এগুলোই ধরা পড়েছে ফলে তিনি বলতে শুরু করেছেন যে, আধা সা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়!! অন্যথায় যাদের দৃষ্টি বিস্তৃত এবং যাদের এ বিষয় সম্পর্কিত সকল হাদীস এবং রেওয়ায়েত সম্পর্কে নিরীক্ষণের সুযোগ হয়েছে তাদের মধ্য থেকে কোনো হাদীস বিশারদ আধা সা-এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি।

 

বিশিষ্ট মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য

এখানে আমরা নমুনাস্বরূপ কয়েকজন মুহাদ্দিস এবং ফকীহর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, যারা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, আধা সা সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সহীহ সূত্রে প্রমাণিত এবং গ্রহণযোগ্য। শেষের দিকে কয়েকজন সমকালীন আলেমের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। কেননা, আমাদের দেশে যারা উক্ত বিষয়টিকে নতুন করে আলোচ্য বিষয় বানিয়েছেন তাদেরকে এদের ভক্ত লক্ষ্য করা যায়। আশা করি, এদের বক্তব্য দ্বারা তাদেরও আধা সা বিষয়ক হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইতমিনান এবং প্রশান্তি হাসিল হবে।

১. ইমাম ত্বহাবী রাহ. আধা সা গম সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস ও আছার রেওয়ায়েত করার পর বলেন, এ পরিচ্ছেদে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে, তারপর তাঁর সাহাবীগণ থেকে এবং তাঁদের পর তাবেয়ীদের থেকে যেসব রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছি, তা প্রমাণ করে যে, সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হল গম থেকে আধা সা আর গম ছাড়া অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী থেকে এক সা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবী ও কোনো তাবেয়ী থেকে এর বিপরীত কিছু বর্ণিত আছে বলে আমাদের জানা নেই। সুতরাং এর বিরোধিতা করার অবকাশ কারো নেই। কারণ তা ছিল ইজমায়ী ও সর্বসম্মত বিষয়, হযরত আবু বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক, উসমান ও আলী রা.-এর যমানা থেকে উপরোক্ত তাবেয়ীদের যামানা পর্যন্ত।

هذاكلهذا كل ما روينا في هذا الباب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم وعن أصحابه من بعده وعن تابعيهم من بعدهم كلها على أن صدقة الفطر من الحنطة نصف صاع ومما سوى الحنطة صاع، وما علمنا أن أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا من التابعين روي عنه خلاف ذلك، فلا ينبغي لأحد أن يخالف ذلك، إذ كان قد صار إجماعا في زمن أبي بكر وعمر وعثمان و علي إلى زمن من ذكرنا من التابعين.

 

২. ইমাম আবু উবাইদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রাহ. (মৃত্যু : ২২৪ হি.) বলেন, গম, যব, খেজুর ও কিসমিস এগুলোর যে কোনোটি দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। খেজুর, কিসমিস বা যব দ্বারা আদায় করলে এক সা প্রদান করবে। আর গম দ্বারা আদায় করলে আমার মতে উত্তম হল, এক সা থেকে কম না দেওয়া। তবে আধা সা দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। কারণ এক জামাত আলিম এই ফতোয়া দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

وأما زكاة الفطر فإن صاحبها فيها بالخيار، إن شاء جعلها برا، وإن شاء جعلها تمرا، أو شعيرا أو زبيبا، فإن اختار التمر، أو الشعير، أو الزبيب فإن هذا المكوك يجزئ عن نفسين ونصف، لأنه صاعان ونصف، وإن اختار البر، فإن أحب الأمرين إلي له أن لا ينتقص من مكيلة الصاع شيئا، لأن أكثر الآثار عليه، وهو أفضل عندي من التمروالشعير،

وإن جعله نصف صاع بر كان مجزيا عنه، لأنه قد أفتى به عدة من أهل العلم، وصاع تمر أو صاع شعير أحب إلي من نصف صاع بر، وإن كان مجزيا، لأنه هو أشد موافقة للاتباع.

৩. ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহ. (মৃত্যু : ৩৭০ হি.) বলেন, আধা সা গম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এবং হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জাবির, আয়েশা, ইবনুয যুবাইর, আবু হুরায়রা, আসমা বিনতে আবু বকর, কাইস ইবনে সাআদ রা. প্রমুখ সাহাবী ও অধিকাংশ তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে। কোনো সাহাবী থেকে এ কথা বর্ণিত হয়নি যে, আধা সা গম প্রদান করলে ফিতরা আদায় হবে না।

روي نصف صاع من بر عن النبي صلى الله عليه وسلم وأبي بكر وعمر وعثمان وعلي وابن مسعود وجابر وعائشة وابن الزبير وأبي هريرة وأسماء بنت أبي بكر وقيس بن سعد رضي الله عنهم أجمعين، وعامة التابعين، ولم يرو عن أحد من الصاحابة بأنه لا بجزئ نصف صاع من بر.

 (শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/২৩৪৫)

৪. ইমাম ইবনুল মুনযির রাহ. সম্ভবত আধা সা গম দিয়ে ফিতরা আদায় সংক্রান্ত মারফূ হাদীসমূহ তার নিকট পৌঁছেনি বা পৌঁছলেও সেগুলোর সনদের বিশুদ্ধতার দিকটি তাঁর নিকট স্পষ্ট হয়নি, ফলে তিনি সেগুলো প্রমাণিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর অভিমত ও সিদ্ধান্তের কারণে আধা সা-এর মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং নিজে তা গ্রহণ করেছেন।

ফাতহুল বারীতে তাঁর বক্তব্য এভাবে উল্লেখিত হয়েছে-

 لا نعلم في القمح خبرا ثابتا عن النبي صلى الله عليه وسلم يعتمد عليه، ولم يكن البر بالمدينة ذلك الوقت إلا الشيء اليسير منه، فلما كثر في زمن الصحابة رأوا أن نصف صاع منه يقوم مقام صاع من شعير، وهم الأئمة، فغير جائز أن يعدل عن قولهم إلا إلى قول مثلهم، ثم أسند عن عثمان وعلي وأبي هريرة وجابر وابن عباس وابن الزبير وأمه أسماء بنت أبي بكر بأسانيد صحيحة أنهم رأوا أن في زكاة الفطر نصف صاع من قمح. انتهى، وهذا مصير منه إلى اختيار ما ذهب إليه الحنفية.

 

অর্থাৎ গমের ক্ষেত্রে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীস আমাদের জানা নেই এবং তাঁর সময়ে মদীনায় গমের ফলন খুব সামান্য ছিল। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামের যামানায় যখন গমের ফলন বৃদ্ধি পায় তখন তাঁরা আধা সা গমকে এক সা যবের স্থলাভিষিক্ত বলে মত দিলেন। আর তাঁরা হলেন উম্মতের অনুসরণীয় ব্যক্তি। সুতরাং তাঁদের বক্তব্য উপেক্ষা করে তাঁদের সমতুল্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য কারো মত গ্রহণ করা জায়েয নয়। এরপর ইবনুল মুনযির রাহ. বিশুদ্ধ সূত্রে হযরত উসমান, আলী, আবু হুরায়রা, জাবির, ইবনে আববাস, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর এবং তাঁর মাতা আসমা বিনতে আবু বকর রা. থেকে রেওয়ায়েত করেছেন যে, তাঁরা সকলেই সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ আধা সা গম মনে করেন। ইবনুল মুনযির রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করার পর ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, এটা প্রমাণ করে, এ বিষয়ে তিনি হানাফীদের মত গ্রহণ করেছেন। (ফতাহুল বারী ৩/৪৩৭)

৫. আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আল হাম্বলী রাহ. (মৃত্যু : ৭৪৪ হি.) বলেন, ওয়াজিব ফিতরার ক্ষেত্রে আধা সা গমের সিদ্ধান্তটি একটি শক্তিশালী সিদ্ধান্ত এবং তা অনেক দলিল দ্বারা প্রমাণিত।

 

القولبإيجابالقول بإيجاب نصف صاع من بر قول قوي، وأدلته كثيرة.

(তানকীহু তাহকীকি আহাদীসিত তালীক ২/২৪৫)

৬. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.ও মনে করেন, আধা সা গম দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় হবে। তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ আল্লামা ইবনে মুফলিহ রাহ. কিতাবুল ফুরূতে স্বীয় উস্তাদের অভিমত এভাবে উল্লেখ করেছেন-

 

واختار شيخنا بأنه يجزئ نصف صاع من بر، وقال : وهو قياس المذهب في الكفارة، وإنه يقتضيه ما نقله الأثرم.

অর্থাৎ আমাদের শায়খ (ইবনে তাইমিয়া রাহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন যে, আধা সা গম দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় হবে। তিনি বলেন, কাফফারার ক্ষেত্রে হাম্বলীদের যে মাযহাব তা একথাই বলে এবং ইমাম আছরাম রাহ. এর বর্ণনাও তা নির্দেশ করে। (আলফুরূ ১/৭০৯; যাদুল মাআদ ২/২০; আরো দেখুন : তামামুল মিন্নাহ ৩৮৬)

৭. আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. ‘‘যাদুল মাআদ’’ কিতাবে (২/১৮-২০) বলেন, আধা সা গমের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক মুরসাল ও মুসনাদ হাদীস বর্ণিত আছে, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে শক্তিশালী।

 

وفيه عن النبي صلى الله عليه وسلم آثار مرسلة ومسندة يقوي بعضها بعضا.

 

এরপর কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, আমাদের শায়খ (ইবনে তাইমিয়া রাহ.) এ মতটিকে শক্তিশালী আখ্যা দিতেন এবং বলতেন,  কাফফারার ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ রাহ.-এর বক্তব্য যা বলে তা এই যে, গম থেকে সদকায়ে ফিতরের ওয়াজিব পরিমাণ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর অর্ধেক।

وكان شيخنا رحمه الله تعالى : يقوي هذا المذهب ويقول : هو قياس قول أحمد في الكفارات، أن الواجب فيها من البر نصف الواجب من غيره.

 তিনি শুধু আধা সা গমের হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন এবং শাইখের অভিমত উল্লেখ করে ঐ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

৮. আল্লামা ছালেহ ইবনে মাহদী আলমাকবিলী রাহ. (মৃত্যু : ১১০৮ হি.) বলেন, এমন অনেক রেওয়ায়েত আছে, যা সম্মিলিতভাবে প্রমাণ করে যে, গমের ক্ষেত্রে ওয়াজিব ফিতরা হচ্ছে দুই মুদ বা আধা সা।

 وردت روايات يعمل بمجموعها أن الواجب من الحنطة مدان.

(আল মানার ফিল মুখতার ১/৩৩১)

৯. আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সিদ্দীক আলগুমারী রাহ. বলেন, কেউ যদি বলে যে, আধা সা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়, যেমনটি ইবনুল মুনযির ও বাইহাকী রা.বলেছেন তাহলে এর উত্তরে আমরা বলব যে, বরং তা প্রমাণিত। কারণ তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীদের থেকে এত অধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এরপর আর কোনো সংশয় থাকে না; বরং একে যদি মুতাওয়াতির বলা হয় তবুও অত্যুক্তি হবে না।

فإن قيل : إن نصف صاع لم يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم كما قال ابن المنذر والبيهقي؟ قلنا : بل هو ثابت لو روده عن النبي صلى  الله عليه وسلم والخلفاء الراشدين وغيرهم من الصحابة والتابعين، من طرق كثيرة لا يبقى معها شك في ثبوته، بل لا يبعد القول بتواتره.فقد ورد من حديث عبد الله بن عمرو بن العاص، وعبد الله بن عباس، وعائشة، وعبد الله بن ثعلبة، وأسماء بنت أبي بكر، وعبد الله بن عمر بن الخطاب، وجابر بن عبد الله، وزيد بن ثابت، وعصمة بن مالك، وعلي بن أبي طالب، وأبي هريرة، وأبي سعيد الخدري موصولا.

وعن سعيد بن المسيب وأبي سلمة بن عبد الرحمن، وعبيد الله بن عبد الله بن عتبة بن مسعود، والقاسم بن محمد، وسالم بن عبد الله مرسلا.

وعن أبي بكر، وعمر وعثمان وعلي وجابر وابن مسعود وابن الزبير وابن عباس ومعاوية وأبي سعيد الخدري موقوفا.

وعن مجاهد وعطاء والشعبي وعمر بن عبد العزيز والحسن البصري وطاؤس وعبد الله بن شداد وإبراهيم النخعي والحكم وحماد مقطوعا.

 (তাহকীকুল আমাল ফী ইখরাজি যাকাতিল ফিতরি  বিল মাল ৬৩)

১০. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. বলেন, আধা সা সম্পর্কে কয়েকটি মারফূ হাদীস রয়েছে এবং এ বিষয়ে অনেক মুরসাল ও মুসনাদ আছর রয়েছে, যেগুলো সমষ্টিগতভাবে শক্তিশালী। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. ‘‘যাদুল মাআদ’’ কিতাবে এমনটি বলেছেন এবং তিনি ঐসব আছার উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, গমের ওয়াজিব ফিতরা হল আধা সা। আর এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া  রাহ.-এর অভিমত এবং ইবনুল কাইয়িম রাহ. এ দিকেই ঝুঁকেছেন। ইনশাআল্লাহ এটিই সঠিক মত।

 

زادفيه أحاديث مرفوعة إلى النبي صلى الله عليه وسلم وفي الباب آثار مرسلة ومسنده يقوي بعضها بعضا، كما قال ابن القيم في الزاد وقد ساقها فيه، فليراجعها من شاء، وخرجتها أنا في التعليقات الجياد. فثبت من ذلك أن الواجب في صدقة الفطر من القمح نصف صاع، وهو اختيار شيخ الإسلام ابن تيمية كما في الاختيبارات. ص : ٦٠ وإليه مال ابن القيم كما سبق، وهو الحق إن شاء الله تعالى.

 

 (তামামুল মিন্নাহ ৩৮৬)

১১. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ হুসাইন ইবনে আউদাহ আলআওয়াইশাহ বলেন, গমের ক্ষেত্রে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ হল আধা সা। এটি ইমাম আবু হানীফা ও রাহ.-এর অভিমত এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহ. ও আমাদের শাইখ (নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ.ও) এই মত পোষণ করতেন।

 

তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই -

وأماوأما من البر : فنصف صاع، وهو قول أبي حنيفة، وقياس أحمد في بقية الكفارات، وبه يقول شيخ الإسلام وشيخنا رحم الله الجميع.

عن عروة بن الزبير : أن أسماء بنت أبي بكر كانت تخرج على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أهلها الحر منهم والمملوك ـ مدين من حنطة، أو صاعا من تمر بالمد، أو بالصاع  الذي يقتاتون به، أخرجه الطحاوي واللفظ له، وابن أبي شيبة وأحمد وسنده صحيح على شرط الشيخين، كما في تمام المنة.

قال شيخنا فيه (٣٨٧) عقب أثر عروة ابن الزبير : فثبت من ذلك أن الواجب في صدقة الفطر من القمح نصف صاع، وهو اختيار شيخ الإسلام ابن تيمية كما في الاختيارات وإليه مال ابن القيم ... وهو الحق إن شاء الله تعالى.

 (আলমাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলমুয়াসারাহ ৩/১৬৩)

১২. ড. মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার আশশরীফ বলেন, হানাফী ইমামগণ আধা সা গম ফিতরা সম্পর্কে অনেক হাদীস ও আছার দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। দলীলের প্রাচুর্য্য ও বিশুদ্ধতার কারণে আমার নিকট হানাফী ইমামদের বক্তব্যই অগ্রগণ্য। আর হানাফী ইমাম ছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদীন, ইবনে মাসউদ, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, আবু হুরায়রা, আসমা বিনতে আবু বকর রা. প্রমুখ সাহাবী এবং উমর বিন আবদুল আযীয রাহ.সহ বড় বড় তাবেয়ীগণ এ সিন্ধান্তই দিয়েছেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদ এবং ইবনুল মুনযির রাহ.সহ আরো অনেকেরই এই সিদ্ধান্ত ছিল।

واستدل الحنفية بأحاديث وآثار كثيرة لوجوب نصف صاع من بر، ... والراجح عندي مذهب الحنفية، لكثرة أدلتهم وصحتها ... وقد قال بهذا القول عدا الحنفية الخلفاء الراشدون، وابن مسعود، وجابر بن عبد الله، وأبو هريرة، وأسماء بنت أبي بكر، وعمر بن عبد العزيز، وكبار التابعين وأحمد في رواية وابن المنذروغيرهم.

 (বুহুছ ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা ১/২৭৬)

১৩. শায়খ মাহমুদ সাঈদ মামদূহ বলেন, আধা সা বিষয়ে একাধিক শক্তিশালী মুসনাদ হাদীস এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহীহ অনেকগুলো মুরসাল হাদীস রয়েছে। ইমাম তাহাবী রাহ. তাঁর দুই কিতাব ‘‘শরহু মাআনিল আছার’’ ও ‘‘শরহু মুশকিলিল আছাওে’’ তা রেওয়ায়েত করেছেন। ইবনে আবদুল হাদী রাহ. ‘‘আততানকীহ’’ গ্রন্থে বলেছেন, আধা সা গম ওয়াজিব হওয়ার বক্তব্যটি শক্তিশালী এবং অনেক দলিল দ্বারা প্রমাণিত।

وفي الباب مسندات قوية، ومراسيل غاية في الصحة أخرجها الإمام الطحاوي في كتابيه شرح معاني الآثار وشرح مشكل الآثار. وقد قال ابن عبد الهادي في التنقيح : ٢/١٤٧القول بإيجاب نصف صاع من بر قول قوي، وأدلته كثيرة.

 (আততারীফ বিআউহামি মান কাসসামাস সুনানা ইলা সহীহিন ওয়া যয়ীফিন ৫/৩৮৯)

 

আধা সা-এর পরিমাপটি কি নবী-যুগের পর নির্ধারিত হয়েছে?

পূর্বোক্ত মাশহুর ও মুতালাক্কা বিলকবুল তথা প্রসিদ্ধ ও খাইরুল কুরূনের ইমামগণের মাঝে স্বীকৃত হাদীস ও আছারসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কেউ কেউ এই বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, আধা সা-এর পরিমাপ হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে অথবা হযরত উমর রা.-এর যুগে নির্ধারিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করুন।

1.         যে রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, হযরত ওমর রা. আধা সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য সাব্যস্ত করেছেন এবং মানুষ সে অনুযায়ী আমল করতে শুরু করে তা একটি ‘মালূল রেওয়ায়েত’ তথা ভুল বর্ণনা। ইমাম মুসলিম রাহ. কিতাবুত তাময়ীযে সেটিকে বর্ণনাকারীর ওয়াহম ও ভ্রান্তি বলে চিহ্নিত করেছেন।

ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. ইবনুল জাওযী রাহ. শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. এবং হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.ও উক্ত রেওয়ায়েতকে যয়ীফ বা মালূল বলেছেন।

(দেখুন : আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১৪/৩১৭-৩১৮; আততাহকীক লিআহাদীসিত তালীক, ইবনুল জাওযী ২/২৪৩; আততানকীহ ১/৪৮০; ফাতহুল বারী ৩/৪৩৫)

2.         এ কথা ঠিক যে, কোনো কোনো সহীহ হাদীসে আছে, হযরত মুআবিয়া রা. তাঁর খেলাফত-আমলে হজ্ব বা উমরার এক সফরে মদীনা আগমন করেন। তখন তিনি বলেছিলেন-

 إني أرى أن مدين من سمراء الشام تعدل صاعا من تمر.

আমার মতে শামের দুই মুদ (আধা সা) গম এক সা খেজুরের সমতুল্য। (সহীহ মুসলিম ১/৩১৮)

এ বর্ণনা থেকে কিছু লোক মনে করেছে, আধা সা গম আদায়ের বিধানটির প্রচলন হযরত মুআবিয়া রা.-এর উক্ত প্রস্তাবনার পর থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু তারা ভেবে দেখেননি যে, এ রেওয়ায়েতটি যেমন সহীহ, আধা সায়ের মারফূ হাদীসগুলো তো আরো বেশি সহীহ। তো এর কারণে ওগুলোকে অস্বীকার করা কিভাবে সঠিক হতে পারে? তাহলে তো কেউ এমনও বলে বসতে পারে যে, সহীহ মারফূ হাদীসে যেহেতু আধা সার কথা আছে তাই ঐ রেওয়ায়েতটি সহীহ নয়, যাতে বলা হয়েছে, আধা সা-এর (পরিমাণ) হযরত মুআবিয়া রা.-এর আগে ছিল না।

কেউ কেউ বলে থাকে, আধা সায়ের হাদীস বুখারী-মুসলিমে নেই। পক্ষান্তরে এই পরিমাপ হযরত মুআবিয়া রা. শুরু করেছেন তা বুখারী-মুসলিমে আছে। তাই অগ্রগণ্য বর্ণনা হল, মুআবিয়া রা.ই আধা সা-এর উদ্ভাবক!!

এই দাবি নিতান্তই বালখিল্যতা। কারণ যে সকল হাদীসের বিষয়বস্ত্ত সাহাবা-তাবেয়ীনযুগের মনীষী-মহলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়ে যায় তাকে শুধু এই অজুহাতে গৌণ বা নগণ্য সাব্যস্ত করা যে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে সংকলিত হয়নি, এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে? তবে কি ফকীহ সাহাবী ও তাবেঈদের স্বীকৃতি এমনই তুচ্ছ বিষয় যে, পরবর্তীযুগে বুখারী-মুসলিমে সংকলিত হওয়া ছাড়া তার কোনো মূল্য নেই; বরং তা যয়ীফ বা গৌণ (অপরটির তুলনায় অগ্রহণযোগ্য) হয়ে যাবে? জেনে রাখা দরকার, এ জাতীয় চিন্তা-ভাবনা হাদীস অস্বীকারকারীদের জন্য রসদ যুগিয়ে থাকে!

আর এই দু’ একটি রেওয়ায়েতের কারণে আপনি কতগুলো রেওয়ায়েতকে অস্বীকার করবেন? আধা সায়ের মারফূ হাদীস এবং এ সংক্রান্ত সাহাবা-তাবেয়ীদের আছারের সংখ্যা তো এসব রেওয়ায়েত থেকে অনেক গুণ বেশি। এই সকল রেওয়ায়েতকে শুধু এ কারণে প্রত্যাখ্যান করে দিবেন যে, কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে, উক্ত পরিমাপটি হযরত মুআবিয়া রা.-এর যামানায় নির্ধারিত হয়!?

হযরত মুআবিয়া রা.-এর আগে যদি এই পরিমাপের কোনো অস্তিত্ব না থেকে থাকে তাহলে খোলাফায়ে রাশেদীন ও বড় বড় সাহাবী তা কোথায় পেলেন, যারা হযরত মুআবিয়া রা.-এর খেলাফত আমলের বহু আগেই ইন্তিকাল করেছিলেন? তাঁরা কীসের ভিত্তিতে এক সা যব ও খেজুরের সাথে আধা সা গমের ফায়সালা ও ফতোয়া দিতেন?

আসল কথা এই যে, বুখারী-মুসলিমের ঐ রেওয়ায়েতের সাথে আধা সায়ের হাদীস ও আছারের এমন কোনো সংঘাত নেই যে, একটির কারণে অন্যটিকে অস্বীকার করতে হবে। ওই রেওয়ায়েতে শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে, হযরত মুআবিয়া রা. এই প্রস্তাব দিয়েছেন যে, আধা সা গম এক সা খেজুরের সমতুল্য। অন্যরাও তাঁর সাথে একমত হয়েছেন। তাঁর প্রস্তাবের সরল অর্থ হচ্ছে, আধা সা সংক্রান্ত মারফূ হাদীসগুলো তাঁর জানা ছিল না। আর এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি হাদীস প্রত্যেক সাহাবীর জানা থাকবে তা না অপরিহার্য, না বাস্তবে সম্ভব। এ কারণেই উসূলে হাদীসের কিতাবে এটি একটি স্বীকৃত বিষয়।

হযরত মুআবিয়া রা.-এর প্রস্তাবের সাথে কেউ এজন্যই দ্বিমত পোষণ করেননি যে, বিশিষ্টদের জানা ছিল, তাঁর প্রস্তাব নতুন কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর দ্বারা তা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, আধা সা সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীস ও আছার হচ্ছে মৌখিক বর্ণনা। অর্থাৎ বিধানটি মুখে বর্ণনা করা হত, কিন্তু ঐ সময় মক্কা মদীনায় গমের প্রচলন কম থাকায় তা আমলের সুযোগ হত কম। সাধারণত খেজুর ও যব দ্বারাই ফিতরা আদায় করা হত, যার নির্ধারিত পরিমাণ এক সা।

হযরত মুআবিয়া রা.-এর যামানায় গমের প্রচলন বৃদ্ধি পেলে তিনি মিম্বারের দাঁড়িয়ে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের উৎসাহ দিয়েছেন, তখন সাধারণ মানুষও তা জেনেছে এবং ব্যাপকভাবে আমলও করেছে। এর অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আধা সায়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অস্তিত্বই যদি না থাকবে তাহলে এতগুলো সহীহ হাদীস এবং সাহাবা-তাবেয়ীনের এত আছার ও ফতোয়া এল কোত্থেকে?! (ফাতহুল কাদীর ২/২২৮; ফায়যুল বারী ৩/৫৯; ইলাউস সুনান ৯/১০৭; মাআরিফুস সুনান ৫/৩০৫-৩১০)

 

 

আধা সা কি আলাদা পরিমাপ নয়?

কেউ কেউ বলেন যে, সাহাবায়ে কেরাম আধা সা গম এক সা খেজুরের সমমূল্যের মনে করার কারণে তা দ্বারা ফিতরা আদায়ের ফতোয়া দিয়েছিলেন। আসলে তা ফিতরা আদায়ের আলাদা কোনো পরিমাপ নয়। বর্তমানে যেহেতু গমের দাম খেজুর ইত্যাদির চেয়ে কম তাই এখন আধা সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় হবে না।

এই বক্তব্যও ঐ ভুল ধারণা থেকেই উৎসারিত যে, আধা সা গমের পরিমাপ মারফূ হাদীসে নেই। অথচ ইতিপূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, সায়ের মতো আধা সাও একটি আলাদা পরিমাপ হিসেবে মারফূ হাদীসে বিদ্যমান আছে। খোলাফায়ে রাশেদীন ও খায়রুল কুরূনের ফকীহগণের ফতোয়াও তা-ই।

 

দ্বিতীয় কথা এই যে, সাহাবায়ে কেরামের যুগেই যখন গমের দাম কমে গেল তখনও তাঁরা আধা সা গমই আদায় করেছেন। ঐ সময় হযরত আয়েশা রা. এবং হযরত আলী রা. পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেহেতু দাম কমে গেছে তাই এখন গমও এক সা-ই আদায় কর। উম্মুল মু’মিনীনের বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-

 

أحب إلي أن إذا وسع الله على الناس أن يتموا صاعا من قمح عن كل إنسان.

আমার নিকট পছন্দনীয় হল, আল্লাহ তাআলা যখন মানুষকে প্রাচুর্য দিয়েছেন তখন তারা মাথাপিছু এক সা গম সদকায়ে ফিতর আদায় করুক। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৫০৫; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনাহ ১/৩৩৬)

 

হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, হযরত আলী রা. এসে যখন মূল্য সস্তা দেখলেন তখন বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে প্রাচুর্য দান করেছেন। সুতরাং তোমরা যদি সব জিনিসই এক সা করে আদায় করতে (তবে তা উত্তম হত।)

فلما قدم علي ورأى رخص السعر قال : قد أوسع الله عليكم فلو جعلتموه صاعا من كل شيء.

 (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৯)

বোঝা গেল যে, তাঁরা পুরা এক সা দেওয়া জরুরি বলতেন না, উৎসাহিত করতেন। আর এতে দোষের কিছু নেই। মানুষ নফল হিসেবে যত বেশি আদায় করতে চায় করতে পারে।

আর এখন তো এক সা গমের মূল্যও এক সা খেজুরের চেয়ে কম তাহলে কি এখন এই ফতোয়া দেওয়া হবে যে, এক সা গম দ্বারাও ফিতরা আদায় হবে না?

তৃতীয়ত ফিতরার ক্ষেত্রে মূল্যকে মানদন্ড ধরা হয়েছে-এ চিন্তা গোড়াতেই প্রশ্নবিদ্ধ।

মূল্যই যদি মূল মাপকাঠি হত তাহলে সায়ের বদলে ছামান বা মুদ্রাই পরিমাপ হিসেবে নির্ধারিত হত। কিন্তু শরীয়ত তা করেনি। ছামান বা মুদ্রার স্থলে كيل বা মাপের ভান্ডকে মানদন্ড ধরা হয়েছে। আর كيل (পাত্র) এর পরিমাণ নির্দিষ্ট। তাতে কমবেশি হয় না। মূল্যই যদি প্রকৃত বিবেচ্য হত তাহলে নবী-যুগে এক সা খেজুরের স্থলে এক সা খেজুরের দাম দীনার-দিরহামে নির্ধারণ করে তাকে মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হত। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো দুই তিন সাও আদায় করতে হত।

চতুর্থত ফকীহদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, নবী-যুগে এক সা খেজুর, যব, কিসমিস বা পনিরের মূল্য ও আধা সা গমের মূল্য সমান ছিল না। যথেষ্ট তফাত ছিল। সুতরাং সদকায়ে ফিতরের উক্ত পরিমাপের ক্ষেত্রে মূল্যকেই প্রকৃত বিবেচ্য সাব্যস্ত করা খুবই আপত্তিকর। (দেখুন : শরহু মুশকিলিল আছার, ইমাম তহাবী ৯/৩৫; আততাজরীদ, ইমাম কুদূরী ৩/১৪১৫)

পঞ্চমত কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট কোনো বিধানে তত্ত্ব ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে রদবদল করার কোনো অবকাশ নেই। এ কারণে মূল্যের ওঠানামার ভিত্তিতে শরীয়তের একটি মাপকাঠিকে অকার্যকর করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

 

মাসলাহাত ও উপযোগের ভিত্তিতে মানসুস আলাইহি তথা কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বিধানে রদবদল সম্পূর্ণ অবৈধ

শরীয়তের আহকাম ও বিধিবিধানের হিকমত ও মাসলাহাত তথা বিভিন্ন উপকার-উপযোগ সম্পর্কে যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয় তাকে ‘ইলমু আসরারিশ শরীয়া’ বলে। এটি অতি সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল শাস্ত্র। এ প্রসঙ্গে একটি স্বীকৃত কথা এই যে, শরীয়তের অধিকাংশ বিধানের উপযোগ কুরআন-সুন্নাহয় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি; বরং এ বিষয়ের মনীষী লেখকরা নিজ নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী ঐসব মাসলাহাত আলোচনা করেছেন। সুতরাং তাদের আলোচনা সম্পূর্ণ ভুলত্রুটিমুক্ত বা শরীয়তের সকল মাসলাহাত তারা আলোচনা করে ফেলেছেন-এমনটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত বিষয় এই যে, আল্লাহ প্রদত্ত আহকামের পিছনে হাজারো মাসলাহাত ও উপযোগিতা থাকতে পারে, যা পুরোপুরি মানুষের বুঝে আসাও জরুরি নয়।

এরপর কোনো বিধানের হিকমত ও মাসলাহাত যদি সুস্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে জানাও যায় তারপরও মূলনীতি এই যে, এসব হিকমত ও মাসলাহাত আহকাম ও বিধানের মানদন্ড নয়। বিধানের মানদন্ড হচ্ছে দলিল। সুতরাং শরীয়তের দলিল থেকেই শরীয়তের বিধান আহরিত হবে, মাসলাহাত বা উপযোগ থেকে নয়।

আর এ সকল মাসলাহাতের কারণে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত বিধানকে পরিবর্তন করা বা কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত শরয়ী পরিমাপের মধ্যে রদবদল করা তো সম্পূর্ণ অবৈধ।

ইলমু আসরারিশ শরীয়াহ বিষয়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হল শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. (মৃত্যু : ১১৭৬ হি.) কৃত ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। গ্রন্থকার তার গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় একথাগুলো পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তাঁর আরবী আলোচনার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি।

نعم كما أوجبت السنة هذه، وانعقد عليها الإجماع، فقد أوجبت أيضا : أن نزول القضاء بالإيجاب والتحريم سبب عظيم في نفسه، مع قطع النظر عن تلك المصالح. لإثابة المطيع وعقاب العاصي، وأنه ليس الأمر على ما ظُنَّ من أن حسن الأعمال وقبحها، بمعنى استحتقاق العامل الثواب والعذاب، عقليان من كل وجه ... كيف ولو كان كذلك لجاز إفطار المقيم الذي يتعانى كتعاني المسافر، لمكان الحرح المبني عليه الرخص. ولميجز إفطار المسافر المترفّ. وكذلك سائر الحدود التى حدها الشرع.

 

সামনে গিয়ে আরো বলেন, আর হাদীস শরীফ একথাও প্রমাণ করেছে যে, শরীয়তের আহকাম পালনের জন্য যখন তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয় তখন মাসলাহাত জানার অপেক্ষায় থাকা বৈধ নয়।

কারণ বহু মানুষ নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা শরীয়তের বহু মাসলাহাত বুঝতে অক্ষম আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের বিদ্যা ও বুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ আশ্রয়। এ কারণে এ শাস্ত্রের বিষয়ে অযোগ্য লোকের প্রতি কখনো ‘উদারতা’ প্রদর্শন করা হয়নি। এখানেও ঐ সকল শর্ত প্রযোজ্য, যা আল্লাহর কালামের তাফসীরের ক্ষেত্রে রয়েছে। এবং আছার ও সুনানের সহায়তা ছাড়া নিছক যুক্তির আলোকে এ শাস্ত্রে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম।

 

কিতাবের প্রথমাংশের শেষে باب الفرق بين المصالح والشرائع শিরোনামে একটি আলাদ পরিচ্ছেদে তিনি এ বিষয়টি আরো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। সেখানে পরিষ্কার লিখেছেন যে, সকল ফকীহ এ বিষয়ে একমত যে, মাসলাহাত ও উপযোগের ভিত্তিতে কিয়াস করা সহীহ নয়।

তালিবুল ইলমগণ শাহ সাহেব রাহ.-এর এই ইলমী আলোচনাগুলো হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ’ থেকে (১/১০৮-১১১, ২/৪৫৩-৪৬৭) পাঠ করতে পারেন।

যাইহোক, ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, এই নীতিটি একটি সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি। শাহ ছাহেব রাহ.ও বলেছেন, এই নীতি হাদীস ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত এবং এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম একমত।

সারকথা সদকাতুল ফিতরের পরিমাণের ক্ষেত্রে একটি মুজতাহাদ ফীহ হিকমতের আশ্রয় নিয়ে কিয়াস ও ইজতিহাদের অবকাশ নেই। আর এর  পরিমাণ সংক্রান্ত হাদীসের স্পষ্ট কোনো বক্তব্যকে অকার্যকর করে দেওয়া যে  সম্পূর্ণ অবৈধ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

উপকার-উপযোগকে আহকাম ও বিধানের বুনিয়াদ বানানো সম্ভবও নয়

শরীয়তের দলিল-প্রমাণ হচ্ছে আহকাম ও বিধানের বুনিয়াদ। আর উপকার-উপযোগ জানার সুফল হচ্ছে, এর দ্বারা চিন্তাশীল মানুষের ঈমান মজবুত হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়। তবে, আগেই বলা হয়েছে যে, শরয়ী বিধানের কার্যকারণকে আহকামের ভিত্তি বানানোর কোনো অবকাশ নেই। আর বাস্তবে তা সম্ভবও নয়। কারণ সেক্ষেত্রে শরীয়ত বা শরীয়তের হুকুম থাকবে না, স্বেচ্ছাচারিতা ও মনগড়া মতামতে পর্যবসিত হবে।

উদাহরণস্বরূপ যে পরিমাণ সদকায়ে ফিতর আদায় করা আবশ্যকীয় করে দেওয়া হয়েছে তার হিকমত ও বাহ্যিক উদ্দেশ্য সম্পর্কেই চিন্তা করা যায়। কিছু দুর্বল বর্ণনার উপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে যে, এই বিধানের হিকমত ও উদ্দেশ্য হল, ঈদের দিন গরীব-মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা করা।  উক্ত বর্ণনার শব্দ  طعمة للمساكين দ্রষ্টব্য।

২. ঐ দিন তাদেরকে দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতা থেকে রক্ষা করা। অন্তত তাদের ঐ দিনের প্রয়োজন পূরণ করা। একটি রেওয়ায়েতের শব্দ-

 

 

أغنوهم عن المسألة في هذا اليوم

 

এখন যদি কেউ এই হিকমত ও উদ্দেশ্যকে বুনিয়াদ বানিয়ে বলতে থাকে, আমাদের আসল খাবার যেহেতু চাল তাই খেজুর বা গমের স্থলে চাল দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। আর তা হতে হবে এক সা। তাহলে প্রশ্ন হবে যে, খেজুর ও রুটি তো তরকারি ছাড়াও খাওয়া যায়, কিন্তু ভাত তো তরকারি ছাড়া খাওয়া যায় না। কাজেই এক সা চালের সাথে পরিমাণ মতো তরকারিরও ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা মাছের তরকারি হলে উত্তম হয়।

এছাড়া অনেক গরীব লোকের পরিবার বড়। পরিবারের সকল সদস্যের দু’ বেলা বা তিন বেলা খাবারের জন্য এক সা চাল যথেষ্ট নয়; বরং দুই, তিন সা প্রয়োজন। অতএব সামর্থ্যবানদের উপর ওয়াজিব, যে সকল গরীব পরিবারের নিকট ঈদের দিনের খাবারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পৌঁছেনি তাদের জন্য অতিরিক্ত চালের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের পক্ষে যদি এক সা রও বেশি চাল দিতে হয়  তা তাদেরকে দিতে হবে। কথা এখানেই শেষ নয়। ঐ দিন গরীবদেরকে অমুখাপেক্ষী করাই যদি ফিতরার বিধানের মূল নিয়ন্ত্রক হয় তবে তো বর্তমান সমাজের রেওয়াজ অনুযায়ী গরীব-পরিবারের নতুন কাপড়, নতুন জুতা ও বিবিধ প্রকারের মিষ্টান্তের ব্যবস্থাও ফিতরার মাধ্যমে করত হবে। এভাবে আরো নতুন নতুন প্রস্তাব আসতে পারে। তো আসল কথা এই যে, হিকমত ও উপকারিতাকে বিধানের নিয়ন্ত্রক বানানো অসম্ভব।

গত রমযানে (১৪৩১ হি.) দৈনিক নয়া দিগন্তে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে জনৈক প্রফেসরের একটি প্রবন্ধ নজরে পড়েছিল। তাতে তিনি লিখেছেন-‘সদকাহর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল স্পিরিট হল গরীবদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এর পাশাপাশি আদায়কারীর সামর্থ্যকেও বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। অতএব এই দুই মূলনীতির আলোকে আমরা বলতে পারি, আদায়কারীর সামর্থ্যকে বিবেচনায় রেখে এবং গরীবদের স্বার্থ সংরক্ষণের খাতিরে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ পলিসি গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।

ক. ধনীদের জন্য এসব বস্ত্তর মধ্যে যার মূল্য সর্বোচ্চ তার এক সা পরিমাণ। যেমন কিসমিস।

খ. উচ্চ মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্ত্তর মূল্য মাঝামাঝি তার এক সা পরিমাণ। যেমন-খেজুর।

গ. নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে যে বস্ত্তর মূল্য সর্বনিম্ন তার এক সা পরিমাণ। যেমন-গম বা যব হবে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণের ভিত্তি। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, শুক্রবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ ঈ., ২৩ রমযান, ১৪৩১ হি.)

এ প্রস্তাব নিছক প্রস্তাবমাত্র। একে শরীয়তের বিধান বানিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। অন্যথায় নতুন নতুন ‘শরীয়ত’ অস্তিত্ব লাভ করবে। কারণ ‘যুক্তি’র তো অভাব নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ যুক্তিতে নতুন নতুন প্রস্তাব পেশ করতে থাকবে। তো কুরআন-হাদীসের বিধানের বদলে এমন এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা ঘটবে, যার রাশ টেনে ধরার কোনো উপায় থাকবে না।

 

চাল দ্বারা যদি ফিতরা দেওয়া হয়

চাল দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা হাদীস শরীফে নেই। এজন্য চালকে মানদন্ড ধরে ফিতরা আদায় জরুরি বলার অবকাশই নেই। তবে কেউ যদি ফিতরায় চাল দিতে চায় তাহলে তাকে অন্তত এ পরিমাণ চাল দিতে হবে, যার মূল্য আধা সা গম কিংবা এক সা খেজুর, কিসমিস, পনির বা যবের সমপরিমাণ হয়, এরচেয়ে বেশি চাল দিলে তা নফল দান বলে গণ্য হবে।

এই কথা ঠিক নয় যে, আমাদের সাধারণ খাবার যেহেতু চাল আর ফিতরের পরিমাণ হল এক সা খাদ্যবস্ত্ত তাই চাল ও এক সা-ই দিতে হবে। কারণ কোনো সহীহ হাদীসে বলা হয়নি সকল অঞ্চলের লোকদের তাদের নিজ নিজ সাধারণ খাবার দ্বারা ফিতরা আদায় করতে হবে। তেমনি একথাও কোনো সহীহ হাদীসে নেই যে, প্রত্যেক খাদ্যবস্ত্ততে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ এক সা। বরং একাধিক সহীহ হাদীসে আছে, গম দ্বারা ফিতরা আদায় করলে তার পরিমাণ হল আধা সা। এজন্য যে কোনো অঞ্চলের, যেকোনো ব্যক্তি আধা সা গম বা তার মূল্য প্রদান করলে তার ফিতরা আদায় হবে।

কেউ যদি শরীয়তের দলিল-প্রমাণ ছাড়া শুধু যুক্তির ভিত্তিতে চালের ক্ষেত্রেও এক সা দেওয়াকে জরুরি বলে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যকে বাতিল করে আধা সা গম ফিতরা আদায় থেকে বাধা দেওয়ার অধিকার সে কোথায় পেল? আর তার ঐ দলিলহীন যুক্তির-ই বা কী মূল্য?

এরপর যদি কোনো সময় এক সা চালের মূল্য আধা সা গমের বরাবর বা এর চেয়ে কম হয় তখন তাদের ফতোয়া কী হবে?

 

 

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রতি

পরিশেষে আমরা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীলদের কাছে নিবেদন করতে চাই যে, এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এর নামের সাথে ‘ইসলামিক’ শব্দটি যুক্ত আছে। এদেশের মুসলমানদের অনেক আশা-ভরসা এ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে। সঙ্গত কারণেই এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের উপর দায়িত্ব আরোপিত হয় যে, এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে কোনো সিদ্ধান্ত প্রচার করার আগে তারা অন্তত দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন এং নিশ্চিত হবেন : এক. সিদ্ধান্তটি কুরআন ও সুন্নাহর কোনো বিধান বা কোনো ইজমাঈ বিধানের পরিপন্থী নয়। দুই. সিদ্ধান্তটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য বিনা কারণে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী নয়।

 

এ ভূ-খন্ডে যখন থেকে ইসলামের আগমন, তখন থেকেই এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধিবাসী হানাফী মাযহাব অনুসারে আমল করে আসছে। স্বয়ং ফাউন্ডেশন ফিকহে হানাফী মোতাবেক ফতোয়া ও মাসায়েল এবং সেগুলোর দলিল-প্রমাণের উপর বহু গ্রন্থ ও বইপত্র প্রকাশ করেছে। তাই ফাউন্ডেশনের জন্য

ফিকহে হানাফীর কোনো দলীলভিত্তিক মাসআলার পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আদৌ সমীচীন নয়। ভবিষ্যতেও এদেশের মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশলীদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়া আবশ্যক।

শরীয়তের সীমার ভেতরে থেকে শরীয়তের হিকমত ও মাসলাহাতের ভিত্তিতে ফাউন্ডেশন কোনো পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যমানা থেকে চলে আসা উম্মতের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা দ্বারা প্রমাণিত কোনো মাসআলায় কোনোরূপ পরিবর্তন সাধনের অধিকার তার নেই। এদেশের মুসলমান কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী এবং ইজতিহাদী মাসআলাসমূহে ফিকহে হানাফী মোতাবেক আমলকারী। কারো নিজস্ব ইজতিহাদ বা ব্যক্তিগত মতামত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না আর তা হওয়া জরুরিও নয়। এ কারণে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর স্বার্থেই ফাউন্ডেশনের কর্তব্য, সর্বসম্মত নীতি থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং সকল সিদ্ধান্তে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা।

আল্লাহ তাআলা সর্বদা এ প্রতিষ্ঠানটিকে ইসলাম ও মুসলমানদের উপকারে নিয়োজিত রাখুন। আমীন ইয়া আরহামার রাহিমীন।

১৬ রজব, ১৪৩২ হি.।

 

 

আধুনিক হিসাবে  সা ও নিসফে সা

 
১ সা = ২৮০.৫০ তোলা
১  তোলা = ১১.৬৬ গ্রাম (প্রায়)
 
অতএব 
১ সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়) 
অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি।
এবং আধা সা = ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম বা ১.৬৩৫৩১৫ কেজি (প্রায়) 
অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি।
 
[সূত্র : আওযানে শরইয়্যাহ, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. পৃ. ১৮; মেট্রিক/আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ (জনসাধারণের জন্য) ১৯৮২; বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স ইনস্টিটিউশন পৃ. ৩]

 

 

 

 

 

advertisement