তওবার জন্য কি অযু জরুরি
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কলামে লেখা হয়েছে, ‘গ্রামের প্রচলিত বিশ্বাস, তওবা পড়ানো হলে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। তওবা পড়ানোর জন্য মুন্সী আনা হল। সাফিয়া বিবি বললেন, না গো! আমি তওবার মধ্যে নাই। তওবা করতে হইলে অযু করা লাগবে। শইল্যে পানিই ছোঁয়াতে পারি না, অযু ক্যামনে করব।
সাফিয়া বিবির মনে হয়তো ভয় ঢুকে গিয়েছিল, তওবা মানেই মৃত্যু। তিনি মৃত্যু চান না ...।
কলামটির উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি ধারণার উল্লেখ রয়েছে। এক. তাওবা করলে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ধারণা। ইতিপূর্বে এ বিভাগে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। ঐ লেখায় বলা হয়েছিল যে, তওবা মানে জীবনের অবসান নয়; বরং তওবা মানে গোনাহমুক্ত নতুন জীবন লাভ।
দুই. তওবার জন্য অযু লাগে। এটিও ভুল ধারণা।
তিন. তওবা নিজে করার বিষয় নয়; বরং এর জন্য মুন্সী ডাকতে হয়। এই ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ অজ্ঞতা ও জাহালত। তওবা কাকে বলে তা জানা থাকলে এইসব ভিত্তিহীন ধারণা সৃষ্টি হয় না। এখানে তওবা সম্পর্কে কিছু কথা বলা হল।
তওবা মানে গোনাহ ত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা এবং অন্তর থেকে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তওবা হল আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন।
বান্দার যখন গোনাহ হয়ে যায় তখন তার কর্তব্য, আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা। অপরাধটি হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক সম্পর্কিত হলে চারটি কাজ করতে হবে। তাহলে তওবা পূর্ণাঙ্গ হবে। ১. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া। ২. লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া। ৩. ভবিষ্যতে এই ধরনের গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা। ৪. কোনো ফরয-ওয়াজিব ছুটে গিয়ে থাকলে মাসআলা অনুযায়ী তার কাযা-কাফফারা আদায় করা।
আর অপরাধটি যদি হয় হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক সংক্রান্ত তাহলে আরো একটি কাজ করতে হবে। যার হক্ব নষ্ট করা হয়েছে তার হক্ব আদায় করে কিংবা ক্ষমাগ্রহণ করে দায়মুক্ত হওয়া। এভাবে আল্লাহর কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য কান্নাকাটি ও অনুতাপের অশ্রু ফেলার নামই তওবা।
আল্লাহর দরবারে রোনাজারি ও ক্ষমাপ্রার্থনা নিজের ভাষায়ও করা যায়। তেমনি হাদীস শরীফে তাওবা-ইস্তিগফারের যে দুআগুলো আছে সেগুলো পড়েও তওবা-ইস্তিগফার করা যায়।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে যে কথাগুলো বোঝা যায়, তা এই -
এক. তওবা করা তারই দায়িত্ব, যে গোনাহ করেছে। নিজের গোনাহর জন্য নিজেকেই অনুতপ্ত হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। যদিও আল্লাহর কোনো নেক বান্দার কাছ থেকে তওবা-ইস্তিগফারের নিয়ম জেনে নিয়ে তার বলে দেওয়া শব্দ উচ্চারণ করেও তওবা করা যায়, কিন্তু তওবার জন্য এটা জরুরি নয়। তাই তওবা নিজে করা যাবে না, কারো মাধ্যমেই করাতে হবে এই ধারণা ঠিক নয়। তদ্রূপ তওবার ক্ষেত্রে উল্লেখিত শর্তগুলো পালন না করে শুধু কারও বলে দেওয়া তওবার বাক্যগুলো উচ্চারণ করলেই তওবা হয়ে যায় না। তওবা হল মুমিন-জীবনের সার্বক্ষণিক আমল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দিনে সত্তর থেকে একশত বার ইস্তিগফার করতেন বলে হাদীসে এসেছে।
দুই. আরো বুঝা গেল যে, তওবার জন্য অযু অপরিহার্য নয়। তবে কেউ যদি সালাতুত তাওবা বা তওবার নামার আদায় করতে চায়, তাহলে অন্যান্য নামাযের মতোই তাকে অযু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কেউ কোনো গুনাহ করে ফেলে অতপর পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করে নামাযে দাঁড়ায় এবং আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চায় তাহলে আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দিবেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মজীদের আয়াত তিলাওয়াত করলেন, (তরজমা) ‘এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো মন্দ কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর কে আছে আল্লাহ ছাড়া, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাঁদের কৃত-কর্মের উপর অবিচল থাকে না।’-সূরা আলইমরান : ১৩৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩০০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৫২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৩৯৫
তবে সাধারণ তওবার জন্য অযু জরুরি নয়।
অতএব তওবাকে মৃত্যু মনে করা, অযু ছাড়া তওবা হয় না কিংবা অন্যের সহযোগিতা অপরিহার্য ইত্যাদি হচ্ছে কিছু ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণা। তওবা কী তা জানা থাকলে এ জাতীয় ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না ইনশাআল্লাহ।