রজব ১৪৩২   ||   জুন ২০১১

নারীর নাফাকা ও পরিপোষণ : বিধান ও কল্যাণ

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

ইসলামের বিধান ও আহকামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ইনফাক বা  সম্পদ ব্যয়। কিছু ইনফাক নফল বা ঐচ্ছিক আর কিছু ইনফাক ফরয বা অবশ্যপালনীয়। এই নফল ও ফরয ইনফাকের ক্ষেত্র, বিধান ও নীতিমালা কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে। জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো আয় ও ব্যয়ের একটি সুসংহত ও সুসমঞ্জস ব্যবস্থা আল্লাহ তাআলা মানুষকে দান করেছেন।

ফিক্হের কিতাবে ইমাম ও ফকীহগণ এসংক্রান্ত বিধান ও নীতিমালা সুবিন্যস্ত আকারে সংকলন করেছেন। এরই একটি ক্ষুদ্র অংশ হলো পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের নাফাকা ও প্রতিপালন। এ আলোচনা এত বিশদ ও বিস্তৃত যে, কোন প্রবন্ধের কলেবরে তা পরিবেষ্টন করা সম্ভব নয়; এজন্য প্রয়োজন সুদীর্ঘ গ্রন্থের। বস্ত্তত এটি ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা, স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং মহান পূর্বসূরীদের সাধনা ও মুজাহাদার এক সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অথচ আমাদের অবস্থা এই যে, নাফাকার মৌলিক বিধানগুলোর সঙ্গেও যেমন অনেকের পরিচয় নেই তেমনি এটি যে কত বড় নেক আমল সে সম্পর্কেও সচেতনতা নেই। ফল কী হয়? মাসায়েলের ইলম না থাকায় ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব হক আদায় করা হয় না, আবার ফাযায়েলের ইলম না থাকায় খরচ করে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের চিন্তা আসে না। এরপর তৃতীয় ক্ষতিটি হচ্ছে ইসলাম-বিদ্বেষী চক্রের মিথ্যা প্রচারণায় ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।

 

নারী-অধিকারবিষয়ক প্রচার-প্রচারণার অসারতা বুঝতে আমাদের কিছুই বাকি থাকত না, যদি ইসলামের নাফাকাত ও পরিপোষণব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের পর্যাপ্ত ইলম থাকতো। বর্তমান নিবন্ধের এ সংক্ষিপ্ত আলোচনার মূল উদ্দেশ্যে এই যে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ নাফাকা-ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যেন জানার আগ্রহ জাগে এবং সঠিক নিয়মে হকদারের হক আদায়ের চেতনা সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাফাকার যে ছওয়াব ও ফযীলত ইরশাদ করেছেন তা জেনে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই যেন খরচ করি। শত ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের কোনো একটি আমল যদি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়, এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে।

এ নিবন্ধের বিষয়বস্ত্ত হলো নারীর নাফাকা ও পরিপোষণ। এখানে আলোচনায় আসবে স্ত্রীর পরিপোষণ, কন্যার পরিপোষণ, মায়ের পরিপোষণ, বোনের পরিপোষণ এবং অন্যান্য আত্মীয়ার পরিপোষণ

স্ত্রী-কন্যার প্রসঙ্গ মায়ের আগে আসার কারণ এই যে, পরিপোষণের ক্ষেত্রে নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব আগে, যদিও সদাচারের ক্ষেত্রে মায়ের হক সবার আগে ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ইখলাসের সাথে বলার এবং আমলের নিয়তে শোনার তাওফীক দান করুন। আমীন।

স্ত্রীর পরিপোষণ : আহকাম ও ফযীলত

আল্লাহ তাআলা বলেন-

 

 

 

 

 

 

পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক, ঐ (বিশেষত্বের) কারণে, যার দ্বারা আল্লাহ তাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং ঐ সম্পদের কারণে, যা তারা ব্যয় করেছে। সুতরাং সৎ নারীরা হল অনুগত, (স্বামীর) অবর্তমানে (নিজের সতিত্ব ও স্বামীর সম্পদ) রক্ষাকারী, আল্লাহ রক্ষা করার কারণে ... -সূরা নিসা : ৩৪

এখানে            -এর তরজমা করা হয়েছে অভিভাবক। মুফাসসিরীনের ব্যাখ্যামতে তা হচ্ছে,

 

 

 

 

 

 

 

 অর্থাৎ শাসন ও ব্যবস্থায়ন এবং রক্ষা ও নিরাপত্তাবিধানের মাধ্যমে নারীর দেখভাল করা এবং আদেশ ও নিষেধের মাধ্যমে তার অবস্থার সংশোধন করা, যেমন শাসকগণ প্রজাসাধারণের দেখভাল করে। তো পুরুষ হচ্ছে নারীর প্রধান ও উপরস্থ;নারীর শাসক ও সংশোধক, যদি সে বেঁকে যায়।-আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৮৮; আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী ২/৪১৬; তাফসীরে কাশশাফ ১/৫০৫; তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৪৯১

এই আয়াতে স্ত্রীর উপর স্বামীর অভিভাবকত্বের দুটো কারণ বলা হয়েছে : প্রথমত দৈহিক শক্তি-সামর্থ্য ও বিচার-বিচক্ষণতার মতো গুণাবলি, দ্বিতীয়ত মোহরানা ও পরিপোষণের জন্য ব্যয়বহন।

এই আয়াতে পুরুষের ব্যয়কৃত সম্পদ মানে স্ত্রীর মোহরানা, খোরপোষ ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ, কুরআন ও সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী যা বহন করা অবশ্যকর্তব্য। এ আয়াত প্রমাণ করে, স্ত্রীর নাফাকা ও খোরপোষ স্বামীর উপর ফরয। -তাফসীর ইবনে কাছীর ১/৪৯২; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৮৮

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মায়েরা তাদের সন্তানদের স্তন্যদান করবে পূর্ণ দুই বছর। এটা তার জন্য, যে দুধপানের সময় পূর্ণ করতে চায়। আর সন্তান যার (অর্থাৎ পিতা) তার কর্তব্য হলো যথাবিধি তাদের খোর-পোষ বহন করা। কাউকেই তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় না। আর যেন কষ্ট না দেওয়া হয় কোনো মাকে তার সন্তান দ্বারা এবং কোন পিতাকেও তার সন্তান দ্বারা। আর (মাহরাম) ওয়ারিছের উপরও বর্তায় অনুরূপ (দায়িত্ব)  ...।-সূরা বাকারা : ২৩৩

এ আয়াতে মায়ের প্রতি আদেশ হলো স্তন্যদানের, আর পিতার প্রতি আদেশ হলো (সন্তানের) মায়ের খোরপোষ বহনের।

মারূফ শব্দ থেকে বোঝা যায়, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানের মায়ের খোরপোষ বহন করা পিতার কর্তব্য। সুতরাং সামর্থ্য  সত্ত্বেও স্বাভাবিক খোরপোষে কার্পণ্য করা স্বামীর জন্য জায়েয নয়, তেমনি স্ত্রীর জন্যও বৈধ নয় স্বামীর সামর্থ্যের অধিক বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খোরপোষ দাবি করা।

বিবাহের অবস্থায় তো দাম্পত্য সম্পর্কের কারণেই স্ত্রীর পরিপোষণ স্বামীর দায়িত্বে  থাকে। একই কারণে স্ত্রীর কর্তব্য হয় শিশুকে স্তন্যদান। তবে বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ইদ্দত শেষ হওয়ার পর মা যদি সন্তানকে স্তন্যদান করেন তাহলে তখনো তাকে স্বাভাবিক পরিপোষণ বা পারিশ্রমিক দিতে হবে। এটা তাঁর স্তন্যদানের বিনিময়।

তালাকপ্রাপ্তা নারীর পরিপোষণ

আল্লাহ তাআলা বলেন-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তোমরা তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ো না, আর তারাও যেন বের না হয়ে যায়। তবে যখন তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট গর্হিত কর্মে। ... তোমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে বাসস্থান দাও যেখানে তোমরা থাক, আর তাদেরকে কষ্ট দিয়ে অতিষ্ঠ করো না (যে, বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাক)। তারা গর্ভবতী হয়ে থাকলে তাদের খোরপোষ দাও সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া   পর্যন্ত। এরপর তারা যদি তোমাদের জন্য (সন্তানকে) স্তন্যদান করে তাহলে তোমরা তাদের প্রাপ্য আদায় কর এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ কর। আর যদি পরস্পর জেদাজেদি কর তাহলে অন্য স্ত্রীলোক তাকে দুধ দিবে।

সচ্ছল ব্যক্তি যেন নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে, আর যার জীবিকা সীমিত সে যেন আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ যা দিয়েছেন তার অধিক ভার কারো উপর দেন না। আর আল্লাহ তাআলা শীঘ্রই দান করবেন অসচ্ছলতার পর সচ্ছলতা।-সূরা তালাক : ৬-৭

এই আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা নারীর বিধান দিয়ে বলা হয়েছে, ইদ্দতের অবস্থায় তাদের বাসস্থান দেয়া এবং খোরপোষের ভার বহন করা স্বামীর দায়িত্ব।

তালাকপ্রাপ্তা নারী গর্ভবতী না হলে তার ইদ্দত তিন হায়েয বা তিন মাস। অর্থাৎ যার হায়েয আসে তার ইদ্দত তিন হায়েয আর যার হায়েয আসে না তার ইদ্দত তিন মাস। আর গর্ভবতী নারীর ইদ্দত সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত। ইদ্দতের সময়কালে তার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান স্বামীকে দিতে হবে। গর্ভবতী নারীর ইদ্দত যেহেতু সন্তান প্রসবের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় তাই পরবর্তী সময়ের খোরপোষ ও বাসস্থানের দায়িত্ব স্বামীর উপর থাকে না। তবে স্তন্যদান করলে তাকে বিনিময় দিতে হবে, আর তা ধার্য হবে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে।

এ আয়াতগুলো থেকে সাধারণ অবস্থায়ও স্ত্রীর  খোরপোষ ও বাসস্থানের অধিকার প্রমাণ হয়। কারণ তালাক এমন কোনো বিষয় নয়, যা দ্বারা স্ত্রী নতুন করে এসব বিষয়ের অধিকার লাভ করতে পারে।

খোরপোষ সংক্রান্ত এই কোরআনি বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

১. হযরত জাবির রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

 

 

 

 

 

 

তোমরা স্ত্রীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ তারা তোমাদের আশ্রিতা, তাদের তোমরা গ্রহণ করেছ আল্লাহর নিরাপত্তা দ্বারা এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ আল্লাহর কালিমা দ্বারা। তাদের স্বাভাবিক খোরপোষ তোমাদের উপর অপরিহার্য। -সহীহ মুসলিম ২/৮৮৯-৮৯০

হযরত আমর ইবনুল আহওয়াস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাবধান, তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের উপর রয়েছে কিছু অধিকার, আর তোমাদের স্ত্রীদের জন্যও তোমাদের উপর রয়েছে কিছু অধিকার। তোমাদের অধিকার এই যে, স্ত্রীরা কোনোভাবেই তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে পদার্পণের সুযোগ দিবে না, যাকে তোমাদের পছন্দ নয়। এবং তোমাদের ঘরে এমন কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিবে না, যাকে তোমাদের অপছন্দ।

সাবধান, তোমাদের উপর তাদের অধিকার এই যে, খোরপোষের বিষয়ে তাদের প্রতি সদাচার করবে।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৫১

৩. হিন্দ বিনতে উতবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। সে আমার ও আমার সন্তানের প্রয়োজনীয় খোরপোষ দেয় না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-

 

 

 

নিজের ও সন্তানের স্বাভাবিক প্রয়োজন পরিমাণ খোরপোষ তুমি নিতে পার।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৬প্ত সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৩/১৩৩৮

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ স্বামীর অবশ্য-কর্তব্য এবং এটি তাদের প্রাপ্য। এ কারণেই স্বামীর অগোচরে হলেও আবু সুফিয়ান রা.-এর স্ত্রীকে তা নিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এই হাদীস থেকে আরো বোঝা যায়, স্বামীর উপর স্ত্রী-সন্তানের ঐ পরিমাণ খোরপোষ ওয়াজিব, যা দ্বারা তাদের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ হয়।

মাসআলা : স্ত্রীর ভরণ-পোষণ স্বামীর উপর সর্বাবস্থায় ফরয, স্ত্রীর নিজের সম্পদ থাকুক বা না থাকুক। পক্ষান্তরে সন্তানের ভরণ-পোষণ পিতার উপর তখনই ওয়াজিব হয় যখন তার নিজের সম্পদ থাকে না।

৪. মুআবিয়া কুশাইরী রাহ. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্ত্রীদের বিষয়ে আমাদের প্রতি আপনার আদেশ কী? তিনি বললেন-

 

 

 

 

তোমরা যেমন খাও তাদেরকেও তেমন খাওয়াও, তোমরা যেমন পর, তাদেরকেও তেমন পরাও। তাদেরকে প্রহার করো না ও কটু কথা বলো না।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪১৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১৪২

স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ফযীলত

১. হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

 

 

 

 

 তুমি একটি দীনার আল্লাহর রাস্তায় খরচ  করেছ, একটি দীনার গোলাম আযাদ করার জন্য, একটি দীনার অভাবীর প্রয়োজন পূরণের জন্য এবং একটি দীনার পরিবারের জন্য খরচ করেছ তো ঐ দীনারের ছওয়াব সবচেয়ে বেশি, যা পরিবারের পিছনে খরচ করেছ।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৯৯৫

২. হযরত আবু মাসউদ বাদরী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

পুরুষ যখন পরিবারের জন্য ছওয়াবের আশায় খরচ করে, (আল্লাহর দরবারে) তা সাদাকা হিসেবে গণ্য হয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০০২

৩. মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

 

 

 

যা তুমি নিজে খাবে তা সদকা, যা সন্তানকে খাওয়াবে তা সদকা, স্ত্রীকে যা খাওয়াবে তা-ও সদকা এবং তোমার সেবককে যা খাওয়াবে তা-ও সদকা।-মুসনাদে আহমদ ৪/১৩২, হাদীস : ১৬৮৪৯-১৬৭২৭

কন্যার ভরণ পোষণ

কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেন-

 

 

 

আর সন্তান যার (অর্থাৎ পিতা) তার কর্তব্য হলো যথাবিধি তাদের খোর-পোষ বহন করা।-সূরা বাকারা : ২৩৩

অন্য আয়াতে বলেন-

 

 

 

এরপর তারা যদি তোমাদের জন্য (সন্তানকে) স্তন্য দান করে তাহলে তোমরা তাদের প্রাপ্য আদায় কর।-সূরা তালাক : ৬

এই দুই আয়াতের মূল বিধান    সন্তানের ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত। পিতার দায়িত্ব সন্তানের ভরণ-পোষণের মাধ্যমে তার বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা। এজন্য সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার দুধের ব্যবস্থা করা পিতার দায়িত্ব। অনিবার্য কারণে মা যদি সন্তানকে বুকের দুধ দিতে না পারেন তাহলে পিতাকে দুধের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আর এজন্য আলাদা খরচ হলে তা-ও তাকে বহন করতে হবে। তেমনি বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হওয়ার পর যদি তিনি শিশু   সন্তানকে বুকের দুধ দেন তাহলে ঐ সময় তার ভরণ-পোষণের ভার পিতাকে বহন করতে হয়। মোটকথা, এই আয়াতগুলিতে বিধান দেওয়া হয়েছে যে, পিতাকে তার        সন্তানের দুধের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এটি হচ্ছে সন্তানের ভরণ-পোষণের অংশ। সুতরাং দুধের বয়সে দুধের ব্যবস্থা এবং দুধ ছাড়ার পর স্বাভাবিক ভরণ-পোষণ পিতার কর্তব্য। এই বিধানে পুত্র-কন্যার ভেদাভেদ নেই।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, হিন্দ বিনতে ওতবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। তার অগোচরে যদি কিছু নিই তাহলে নিতে পারি নতুবা সে আমার ও আমার সন্তানের প্রয়োজনীয় খরচ দেয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

 

 

তোমার নিজের ও সন্তানের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ হয় এ পরিমাণ তুমি নিতে পার।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৬৪ আরো দেখুন : সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৩৮

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পিতার সম্পদ থেকে প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ পাওয়া সন্তানের হক। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের (রা.) স্ত্রীকে নিজের খরচের সাথে সন্তানের প্রয়োজন পরিমাণ খরচ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। যদি তা শরীয়তের পক্ষ হতে সন্তানের হক ও প্রাপ্য না হত তাহলে এই অনুমতি দিতেন না। কারণ অন্যের সম্পদ তার অনুমতি ছাড়া গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অবৈধ।

তাছাড়া সন্তান হচ্ছে পিতার অংশ। সুতরাং নিজের প্রয়োজন পূরণের মতো সন্তানের প্রয়োজনও পিতাকেই পূরণ করতে হবে।

মাসআলা : এ বিষয়ে উম্মাহর ইজমা রয়েছে যে, সম্পদহীন    শিশু-  সন্তানের ভরণ পোষণ পিতার দায়িত্ব।-আলমুগনী ১১/৩৭৩

মাসআলা : সুস্থ পুত্রের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব বালিগ হওয়া পর্যন্ত আর কন্যার ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত।-আদ্দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার ৩/৬১২; ফতহুল কাদীর ৪/২১৭; আলমুফাসসাল ফী আহকামিল মারআহ ১০/১৭০

মাসআলা : পিতার ওপর সন্তানের ভরণ-পোষণ তখনই ওয়াজিব হয় যদি সন্তানের নিজের সম্পদ না থাকে। অন্যথায় তার ভরণ- পোষণ নিজের সম্পদ থেকে হবে। পিতার উপর তা ওয়াজিব থাকবে না। পুত্র-কন্যা উভয়ের ক্ষেত্রে একই বিধান।-বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৬; ফাতহুল কাদীর ৪/২২০

মাসআলা : কন্যা বালিগ হলেও তাকে উপার্জনে বাধ্য করার অবকাশ পিতার নেই। তবে কন্যা যদি সিলাই ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জন করে তাহলে তার ভরণ-পোষণ নিজের উপার্জন থেকেই হবে। তবে তা যথেষ্ট না হলে বাকীটুকু পিতার জিম্মায় ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার ৩/৬১২)

মাসআলা : বিয়ের পর কনের ভরণ-পোষণ স্বামীর জিম্মায়। আর কোনো কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটলে ইদ্দত শেষ হওয়ার পর কন্যার ভরণ-পোষণ পুনরায় পিতার উপর অর্পিত হয় যদি না কন্যার নিজের সম্পদ থাকে। (ফতহুল কাদীর ৪/২১৭)

পিতার অবর্তমানে কিংবা তার দারিদ্য ও অক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের উপর সম্পদহীন নারীর ভরণপোষণ ওয়াজিব হয়। কোন ক্ষেত্রে কোন আত্মীয়ের উপর এই দায়িত্ব বর্তায় এর সুনির্দিষ্ট নীতি ও বিধান ফিকহে ইসলামীতে আছে। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে তা উল্লেখ করা হল না।

কন্যার ভরণ-পোষণের ফযীলত

৪. হযরত কাব ইবনে উজরা রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করল। তার চলার ভঙ্গি থেকে সাহাবায়ে কেরামের মনে হল সে খুব কর্মঠ ও উদ্যমী। তাঁরা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি সে আল্লাহর রাস্তায় এভাবে চলত! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তার এই পথ চলা যদি হয় শিশু-সন্তানদের জন্য উপার্জনের খাতিরে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় আছে। যদি হয় বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য উপার্জনের খাতিরে তাহলেও সে আল্লাহর রাস্তায় আছে, যদি হয় অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষিতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাহলেও সে আল্লাহর রাস্তায় আছে। আর যদি হয় মানুষকে দেখানোর জন্য ও গর্ব-অহংকারের জন্য তাহলে সে আছে শয়তানের রাস্তায়।-আলমুজামুল কাবীর তবারানী ১৯/২৮২

এ হাদীসে পুত্র-কন্যার কোনো ভেদাভেদ নেই। যার জন্যই পিতা উপার্জনে বের হবে, নিয়ত যদি সহীহ থাকে, তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় রয়েছে। এছাড়া অনেক হাদীসে কন্যা-সন্তানের ভরণ-পোষণের বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আনাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

 

 

 

 

অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুটি মেয়ের ভরণ-পোষণ করে তাদের বালিগ হওয়া পর্যন্ত, কিয়ামতের দিন আমি ও সে একসাথে থাকব।

অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমি ও সে একসাথে জান্নাতে প্রবেশ করব।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬৩১; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৯৪৮

হযরত জাবির রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যার তিনটি কন্যা আছে এবং তাদের সে ঘরে স্থান দিয়েছে, তাদের প্রতি রহম করেছে এবং তাদের প্রয়োজনসমূহের জিম্মাদার হয়েছে তার জন্য বেহেশত অবধারিত। কেউ জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কারো যদি দুটি কন্যা থাকে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুটি থাকলেও। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীদের ধারণা, এক কন্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ফযীলত ইরশাদ করতেন। -মুসনাদে আহমদ ৩/৩০৩

মুজামে আওসাত তাবরানীর (হাদীস : ৬১৯৫) রেওয়ায়েতে আছে, এবং তাদের বিয়ে দিয়েছে।

এছাড়া আরো অনেক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যা-সন্তানের ভরণ-পোষণের এবং তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহারের অনেক ফযীলত ইরশাদ করেছেন।

মার ভরণ-পোষণ : বিধান ও ফযীলত

প্রয়োজনের সময় পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সামর্থ্যবান        সন্তানের। কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেন-

 

 

 

আর আপনার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁকে ছাড়া আর কারো উপাসনা করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করো।-সূরা ইসরা : ২৩

বলাবাহুল্য,পিতা-মাতার প্রয়োজনের মুহূর্তে সামর্থ্যবান সন্তান যদি তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তবে তা উত্তম আচরণ নয়; বরং অতি নিন্দনীয় কাজ।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আমি মানুষকে তার পিতামাতার বিষয়ে আদেশ করেছি-কষ্টের পর কষ্ট করে মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, আর তার দুধ ছাড়াতে লেগে যায় দু বছর-যে, কৃতজ্ঞ হও আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি। আমার কাছেই তো প্রত্যাবর্তন। আর তারা যদি তোমাকে চাপ দেয় আমার সমকক্ষ দাড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো। এরপর আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে। তখন তোমাদেরকে জানাব যা তোমরা করতে।-সূরা লুকমান : ১৪-১৫

পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল প্রয়োজনের সময় তাদের ব্যয়ভার বহন করা।

অন্য আয়াতে বলেছেন-

 

 

 

 

তোমার জীবদ্দশায় তাদের একজন বা দুজনই যদি বার্ধক্যে পৌঁছায় তাহলে তাদেরকে উফ বলো না, ধমক দিয়ো না; তাদের সাথে সম্মানের সাথে নম্রভাবে কথা বলবে।-সূরা ইসরা : ২৩

উফ শব্দ উচ্চারণ করেও যখন পিতামাতাকে কষ্ট দেওয়া নিষেধ তখন প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের খাদ্য-বস্ত্রের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করা যে নিষেধ ও হারাম তা তো বলাই বাহুল্য।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার (কিছু) সম্পদ আছে এবং একজন পিতা আছেন। কিন্তু পিতা আমার সকল সম্পদ নিয়ে যেতে চান! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

 

 

 

 

তুমি ও তোমার সম্পদ দুটোই তোমার পিতার। তোমাদের সন্তানরা হচ্ছে তোমাদের উত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা নিজ সন্তানের উপার্জন ভোগ কর।-সুনানে আবু দাউদ ৩/৮০১, হাদীস : ৩৫৩০, ৩০৬৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ২/৭৬৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৮২৬-৬৯৬২

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়,   সন্তানের উপার্জন পিতামাতার উপার্জন বলেই গণ্য। সুতরাং নিজের উপার্জন থেকে যেমন ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ হয় তেমনি সন্তানের সম্পদ থেকেও পিতামাতার প্রয়োজন পূরণ হবে।

এ ধরনের আরো অনেক দলীলের কারণে মুসলিম মনীষীগণ এ বিষয়ে একমত যে, পিতামাতা দরিদ্র হলে এবং পিতার নিজের কোনো উপার্জন না থাকলে তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সচ্ছল সন্তানের। (মুগনিল মুহতাজ ৩/৫৬৯; আলমুগনী ১১/৩৭৩)

মাসআলা : পিতামাতা দরিদ্র হলে তাদের ভরণ পোষণ সন্তানের উপর ফরয হয়, অন্যথায় নয়।-বাদায়ে ৩/৪৪৬

মাসআলা : পিতা উপার্জনক্ষম হলেও সামর্থ্যবান সন্তানের কর্তব্য, পিতামাতার ভরণ পোষণের ভার বহন করা। যেন উপযুক্ত সন্তান থাকা অবস্থায় পিতাকে উপার্জনের জন্য কষ্ট করতে না হয়।-মাবসূত সারাখসী ৫/২২২; বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৭; ফাতহুল কাদীর ৪/২২০

মাসআলা : যার উপর যাকাত ফরয সে শরীয়তের দৃষ্টিতে সচ্ছল। তাকে দরিদ্র পিতামাতার ভরণ-পোষণ করতে হবে।-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫৬৪; ফাতহুল কাদীর ৪/২২৬

মাসআলা : পুত্র অসচ্ছল হলে যদি তার উপার্জনের ক্ষমতা থাকে তাহলে তার কর্তব্য পিতামাতার জন্যও উপার্জন করা। নিজের প্রয়োজন এবং স্ত্রী-সন্তান থাকলে তাদের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের পর অবশিষ্ট সম্পদ পিতামাতার জন্য খরচ করা ওয়াজিব। যদি কোনো কিছুই উদ্বৃত্ত না থাকে তাহলে অভাবী পিতামাতাকে নিজের পরিবারে শামিল করে নিবে। কারণ গোটা পরিবারের খাদ্য-বস্ত্রে একজন বা দু জন মানুষকে শামিল করা অসম্ভব নয়।-আলমুফাসসাল ১০/১৯৫

মাসআলা : দরিদ্র সন্তানের যদি স্ত্রী-পুত্র না থাকে এবং যে পরিমাণ সে উপার্জন করে তাতে শুধু নিজের অপরিহার্য প্রয়োজনটুকু পূরণ হয় সেক্ষেত্রেও অভাবী মাকে নিজের সঙ্গে শামিল করা ওয়াজিব। পিতা উপার্জনে অক্ষম হলে তার ক্ষেত্রেও একই বিধান। আর উপার্জনে সক্ষম হলে অধিকাংশ ফকীহ বলেন, এ অবস্থায় নিজের খোরপোষে পিতাকে যুক্ত করতে দুনিয়ার আদালত তাকে বাধ্য করবে না বটে তবে আল্লাহর ভয় থাকলে এই অবস্থাতেও পিতাকে নিজের সাথে শামিল রাখা কর্তব্য।-প্রাগুক্ত ১০/১৯৪

মাসআলা : পিতা থাকা অবস্থাতেও প্রয়োজনের সময় অভাবী মায়ের খোরপোষ সন্তানের উপর ওয়াজিব হয়।-রদ্দুল মুহতার ৩/৬১৬

মাসআলা : মা যদি অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাহলে তার খোরপোষের ভার দ্বিতীয় স্বামী বহন করবে। ঐ স্বামী দরিদ্র বা নিরুদ্দেশ হলে পুত্রকে মায়ের খোরপোষ বহন করতে হবে। তবে তার ফিরে আসার পর, আর দরিদ্র হয়ে থাকলে সচ্ছল হওয়ার পর পুত্র যা খরচ করেছে তা ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে ফেরত নিতে পারবে।-আলমুফাসসাল ১০/১৯৬

মাসআলা : পিতা-মাতা কাফির হলেও প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের ভরণ পোষণের ভার সন্তানকে বহন করতে হবে।-সূরা লুকমান : ১৫; বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৯; হেদায়া-ফাতহুল কাদীর ৪/২২০

মাসআলা : একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা থাকলে সচ্ছল বা উপার্জনক্ষম    সন্তানের সকলের উপর অভাবী পিতামাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তায়।

মাসআলা : দাদা-দাদী, নানা-নানীও পিতা-মাতার মতোই। সুতরাং প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের ভরণ-পোষণের ভার পৌত্র-পৌত্রি ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের উপর অর্পিত হয়। -মাবসূত সারাখসী ৫/২২২; হিদায়া-ফাতহুল কাদীর ৪/২২০; আলমুগনী ১১/৩৪৭

মায়ের সেবাযত্নের ফযীলত

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সেবা ও সদাচারের সর্বাধিক হকদার কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, এরপর কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, এরপর কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। চতুর্থবার জিজ্ঞাসা করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার বাবা।-সহীহ বুখারী, হা : ৫৯৭১; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৪৮

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন কাজ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সময়মতো নামায আদায় করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরপর কোন আমল? তিনি বললেন, পিতামাতার সেবা করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরপর কোন আমল? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮৫

এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিধবা ও দরিদ্রের জন্য যে দৌড়ঝাঁপ করে সে যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত কিংবা যেন দিনভর রোযা ও রাতভর নামাযে রত।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৫৩

সাধারণ অভাবী ও বিধবার  প্রয়োজন পূরণের যখন এত বড় ছওয়াব তখন সেই বিধবা যদি হন নিজের মা তাহলে ছওয়াব ও ফযীলত কত বড় হবে। 

বোন ও অন্যান্য আত্মীয়ার ভরণ-পোষণ

কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেন-

 

 

 

 

 

এবং দাও আত্মীয়কে তার হক এবং মিসকীন ও মুসাফিরকে। আর বিরত থাক অপচয় থেকে।-সূরা বনী ইসরাইল : ২৬

আরো বলেন-

 

 

 

 

 

আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালংঘন থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।-সূরা নাহল : ৯০  

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের প্রয়োজন পূরণ করা কখনো নফল ও মুস্তাহাব থাকে আর কখনো তা ওয়াজিব ও অপরিহার্য হয়ে যায়।

ত্বরিক আলমুহাবিরী রা. বলেন, আমরা মদীনায় এলাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। ঐ খুতবায় তিনি বলেছেন-

 

 

 

 

অর্থাৎ দানকারীর হাত উঁচুতে। প্রথমে নিজের  পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ কর। মা ও বাবার জন্য খরচ কর। বোন ও ভাইয়ের জন্য খরচ কর। এরপর পর্যায়ক্রমে নিকটতর আত্মীয়দের জন্য খরচ কর।-সুনানে নাসায়ী ৫/৬১; সহীহ ইবনে হিববান ৮/১৩০-১৩১

কুলাইব ইবনে মানফাআ তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কার সেবা করব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

 

 

 

 

অর্থাৎ মা ও বাবার সেবা করবে; বোন ও ভাইয়ের সেবা করবে। এই হক আদায় করা ও আত্মীয়তার দাবি পূরণ করা অপরিহার্য। -সুনানে আবু দাউদ ৫/৩৫১

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে বোঝা যায়, কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজন এমন আছে যাদের ভরণ-পোষণ বিশেষ অবস্থায় ওয়াজিব হয়ে পড়ে। শরীয়তের বিভিন্ন দলীলের আলোকে ফকীহগণ ঐ আত্মীয়-স্বজনের তালিকা পেশ করেছেন। হানাফী ফকীহগণ বলেন, রক্ত-সম্পর্কের ঐসব আত্মীয় যাদের পরস্পর বিয়েশাদী বৈধ নয়; তাদের ভরণ-পোষণ বিশেষ ক্ষেত্রে ওয়াজিব ও অপরিহার্য হয়। যেমন ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নী, চাচা-ফুফু, মামা-খালা। যারা বংশীয় আত্মীয়, তবে মাহরাম নয়, যেমন চাচাতো ভাই, চাচাতো বোন, ফুফাতো ভাই, ফুফাতো বোন, মামাতো ভাই, মামাতো বোন, খালাত ভাই, খালাত বোন এবং তাদের সন্তান-সন্ততি এদের ভরণ পোষণ ঐ আত্মীয়র উপর ওয়াজিব নয়। তেমনি যারা মাহরাম তবে রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় নয় যেমন দুধ-সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন ও বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়-স্বজন, তাদের ভরণ-পোষণও আত্মীয়তার কারণে ওয়াজিব নয়। এদের ভরণ-পোষণ সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের উপর।

এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, প্রয়োজনের মুহূর্তে বোনের ভরণ-পোষণ ভাই-বোনের উপর, ফুফু-খালার ভরণ-পোষণ ভাগ্নে-ভাগ্নীর উপর ওয়াজিব হয়। তবে এর জন্য কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো এই -

ক. খোরপোষ গ্রহণকারী অভাবী হওয়া। সুতরাং ঐ আত্মীয় সম্পদশালী হলে বা প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করলে তাদের ভরণ-পোষণ নিজেদের সম্পদ থেকেই হবে। তাদের ব্যয়ভার বহন করা ভাই-বোন বা ভাগ্নে-ভাগ্নীর উপর ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৬; রদ্দুল মুহতার ৩/৬২৭-৬২৮

খ. ভরণ-পোষণকারীর সামর্থ্য থাকা। অর্থাৎ এ পরিমাণ সচ্ছলতা থাকা, যা দ্বারা নিজের ও পরিবারের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের পর ঐ আত্মীয়দের জন্য খরচ করা যায়।-বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৭; মাবসূত সারাখসী ৫/২২৪; হেদায়া ও ফাতহুল কাদীর ৪/২২৬

গ. ভরণপোষণকারী ও তার আত্মীয় উভয়ে মুসলমান হওয়া। -বাদায়েউস সানায়ে ৩/৪৪৯

বোনের ভরণ-পোষণের ফযীলত

হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

 

 

 

 

 

 

 

যে ব্যক্তি দুজন বা তিনজন কন্যার ভরণ-পোষণ করে কিংবা দুটি বোন বা তিনটি বোনের ভরণ-পোষণ করে এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বা তারা তার নিকট থেকে আলাদা হয় তো আমি ও সে এভাবে জান্নাতে থাকব। একথা বলে শাহাদত ও মধ্যমাকে একত্র করলেন।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪৪৮

হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

 

 

 

 

 

 

যার তিনটি কন্যা বা তিনজন বোন আছে, কিংবা দুটি কন্যা বা দুজন বোন আছে এবং সে তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করে এবং তাদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করে সে জান্নাতের হকদার হবে।-জামে তিরমিযী, হাদীস :    ; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪৪৭

আবু দাউদের রেওয়ায়েতে আছে

 

 

 

অর্থাৎ সে যদি তাদেরকে শিক্ষা দান করে, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করে এবং তাদেরকে পাত্রস্থ করে তাহলে সে জান্নাতের হকদার হবে।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১৪৭

ভরণ-পোষণ ওয়াজিব না হলেও দান করা

উপরের আলোচনায় ওয়াজিব ইনফাক বা অপরিহার্য ভরণপোষণের কথা বলা হয়েছে। তবে যেসব আত্মীয়ের ভরণ-পোষণ ওয়াজিব নয় তাদের জন্য কিংবা যেসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব নয় ঐসব ক্ষেত্রেও কেউ যদি খরচ করে তাহলে আলাদা ছওয়াব পাবে। সাধারণ দানের চেয়ে আত্মীয়-স্বজনের জন্য খরচ করার ছওয়াব ও ফযীলত বেশি। তবে ওয়াজিব ইনফাক তথা অপরিহার্য ভরণপোষণে কোনোরূপ ত্রুটি করা যাবে না। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

 

 

 

তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, কী তারা খরচ করবে? আপনি বলুন, অতিরিক্ত সম্পদ।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, পরিবারের ভরণপোষণের পর অতিরিক্ত সম্পদ ব্যয় করবে।

হাসান বসরী রাহ. বলেন, এমন যেন না হয় যে, তুমি তোমার সমুদয় সম্পদ দান করে দিলে, এরপর অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে গেলে। অর্থাৎ ব্যক্তির মূল সম্পদ যেমন চাষবাশের জমি, কিংবা ব্যবসার মূলধন, যার উপার্জন থেকে তার নিজের ও পরিবার-পরিজনের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ হয় তা দান করার আদেশ করা হয়নি। অর্থাৎ মূল সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তা দান করবে।  (দেখুন : ফাতহুল বারী ৯/৪০৮)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

প্রথমে তোমার পরিবারে ভরণপোষণ কর।

এই দুই শর্ত পূরণ করে যত দান করা যায় ততই ফায়েদা। এক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের জন্য দান করার ছওয়াব আরো বেশি।

হযরত সালমান ইবনে আমির রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

 

 

 

 

অভাবীকে দান করা সদকা আর বংশীয় আত্মীয়কে দান করা সদকা ও সিলা (আত্মীয়তার হক আদায়)। সুনানে নাসায়ী ৫/৯২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৬৫৮; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৩৩৩

সহীহ ইবনে খুযাইমার রেওয়ায়েতে আছে, অভাবীকে দান করা এক সদকা আর আত্মীয়কে দান করা দুই সদকা। অর্থাৎ তা হচ্ছে সদকা ও আত্মীয়তার হক আদায়।-সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৩৮৫

হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসেও এই ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। (আলমুজামুল কাবীর তবারানী ২৪/৭৩১)

হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রা. ও হযরত উম্মে কুলছুম বিনতে উকবা রা. থেকে বর্ণিত দুটি হাদীসে ঐ আত্মীয়দের দান করার অধিক তাকীদ করা হয়েছে, যাদের অন্তরে এই ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে। একে আফযালুস সাদাকা বা সর্বোত্তম সদকা বলা হয়েছে। (দেখুন : আততারগীব হাদীস : ১৩১৪, ১৩১৫)

মোটকথা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য দান সদকা ও সম্পদ ব্যয়ের কথা      বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে।

এর সাথে যদি ঐসব হাদীসকেও মিলিয়ে পাঠ করা যায়, যা ইয়াতীম, বিধবা, পীড়িত ও প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রয়োজন পূরণের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে তাহলে বোঝা যাবে, এটা কত বড় নেক আমল। কারণ আত্মীয় বা আত্মীয়দের মাঝে এমন কেউ থাকলে তাদের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে যেমন আত্মীয়তার হক আদায়ের ছওয়াব পাওয়া যাবে তেমনি দুর্বলের সহযোগিতার ফযীলতও হাসিল হবে।

এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হয়েছে তা ইসলামের নিযামুন নাফাকা বা পরিপোষণ ব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র অংশ। এই ব্যবস্থায় আদালত ও প্রশাসনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াজিব ভরণ-পোষণের অধিকাংশ ক্ষেত্রে হকদারকে হক পাইয়ে দেওয়া আদালত ও প্রশাসনের কর্তব্য। কিছু বিষয় এমনও আছে, যা আদালতের রায়ের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইলমে দ্বীনের চর্চা না থাকায় না হকদার তার হক সম্পর্কে সচেতন, না হকদাতা হক আদায়ে আগ্রহী। ফলে প্রশাসন ও আদালতেরও তেমন কোনো তৎপরতা নেই। সুতরাং সবার আগে আমাদেরকে ওয়াজিব হক সম্পর্কে ইলম অর্জন করতে হবে এবং এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। 

 

advertisement