যিলক্বদ ১৪৩০   ||   নভেম্বর ২০০৯

বর্বরতাঃ একজনকে নিয়ে হুজুগের পরিবর্তে চাই গোটা পদ্ধতির শুদ্ধি

ওয়ারিস রব্বানী

একের পর এক করে এগারটি খুন করার পর অবশেষে ধরা পড়েছে একজন খুনী। ছোট্ট চুরির ঘটনায় ধরা পড়ার পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক নারী ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার কথা সে স্বীকার করে। তার নাম রসু খাঁ। টঙ্গী ও উত্তরা অঞ্চলের গার্মেন্টসে কর্মরত মেয়েদেরকে প্রেম ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন সময় সে চাঁদপুরের বিভিন্ন গহীন গ্রামে নিয়ে যায়। এরপর ধর্ষণ ও খুন করে তাদের নদীতে ভাসিয়ে দেয় কিংবা নির্জন স্থানে ফেলে রেখে যায়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে খুনের স্পটগুলো এখন তাকে নিয়ে প্রত্যক্ষ করে আসছে পুলিশ। তার খপ্পর থেকে বেঁচে যাওয়া দু’একজন নারীর জবানবন্দিও ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে ছাপানো হয়েছে। এখন পত্রপত্রিকায় তার সম্পর্কে প্রায় প্রতিদিন রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে এবং তাকে একজন ক্রমিক খুনী বা একের পর এক হত্যাকাণ্ডের সংগঠক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সন্দেহ নেই যে, সে একজন ভয়ংকর ব্যক্তি। তার ফাঁসির দাবিতে মিছিল অনুষ্ঠান, তাকে দেখে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ তাই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা বলেই প্রতীয়মান হয়।

রসু খাঁর আত্মস্বীকৃতির পর তাকে নিয়ে প্রচার-প্রতিক্রিয়ার যা যা কিছু প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে, এদেশে বড় রকম খুন জখমের ঘটনা কিংবা পরিবেশ ইতিপূর্বে আর ছিল না। সব অপরাধ এক রসু খাঁ-ই করেছে। এজন্য তার বিচারের দাবিতে সবাই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। অথচ বাস-বতা এরকম নয়। ডজন ডজন হত্যা মামলার আসামী এদেশে অনেক। প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুন করলে তার দায় থেকে বেঁচে থাকা এখানে অতি সহজ বিষয় হয়ে গেছে। কিছু চাতুর্য, কিছু ‘খরচ’ আর আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা থাকলে এখানে দিন দুপুরে খুন করেও রেহাই পেয়ে যাওয়া ডালভাতের মতো বিষয়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি নাগরিক পর্যায়ে নির্মমতার একটি বর্বর সংস্কৃতিকে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ধরনের ভেঙ্গে পড়া ও বিকৃত একটি পরিবেশে জন্ম হয়েছে রসু খাঁর মতো ক্রমিক খুনীর।

একথাটি মাথায় রাখলে এক রসু খাঁ ধরা পড়ায় অতি তৃপ্ত ও উল্লসিত হওয়ার কিছু থাকে না। পয়সা ও দাপটের জোরে এদেশে এরকম অগণিত রসু খাঁ এখনও ভিআইপির মর্যাদা ভোগ করছে। সচেতন নাগরিক মাত্রই এ তিক্ত সত্যটি বুঝেন ও মানেন। তাই ধরা পড়া রসু খাঁর বর্বর ঘটনাবলির জন্য সীমিত ও সীমাবদ্ধ দাবি দাওয়াতে সোচ্চার হলে কোনো সুফল আসবে না। বরং দেশের গোটা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, আইনী প্রক্রিয়া এবং অপরাধ মনস-ত্ব ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হবে। এরপর সবকিছুতেই একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের দাবি তুলতে হবে। এটি কেবল এ দল-সে দলের বিভক্ত বিষয় নয়, এর দায় পড়ে এদেশটাকে শাসন করা গত দু’-আড়াই দশকের সব পর্যায়ের রাজনীতিক ও নেতৃবৃন্দের ওপর। একজন অপরাধী এতটা নীচে এবং এত দুঃসাহস দেখানোর পর্যায়ে কেন ও কিভাবে নামতে পারল তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ না করে কেবল হুজুগে ঘৃণা প্রকাশ করে একজনের উপর সমস- আক্রোশ কেন্দ্রীভূত করলে একজন-দু’জন রসু খাঁ, এরশাদ শিকদার ফাসির দড়িতে ঝুললেও বহু ছদ্মবেশী এরশাদ শিকদার ও রসু খাঁ বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে। মনির, এরশাদ শিকদার, রসু খাঁদের অপরাধকে কেন্দ্র করে যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল ও হচ্ছে এগুলোতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হুজুগে প্রবণতার পরিবর্তে পদ্ধতি ও সংস্কৃতিগত ব্যাপক পরিবর্তন ও শুদ্ধি আনয়ণের প্রয়াস চালালে এর কিছু সুফল হয়তো দেশে প্রকাশ পেত, যা গোটা দেশ ও জাতির উপকারে লাগত। কিন' আমরা তাৎক্ষণিকতা, হুজুগ ও সহজ ঘৃণা প্রকাশের পরিবর্তে গঠনমূলক কোনো প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ায় যেতে চাই না। এর মাশুলও তাই দিতে হয় বছর জুড়ে, জীবন জুড়ে।

খুনী রসু খাঁর সর্বোচ্চ শাসি-র দাবি জানাই। তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটাতে গেলে একজন রসু খাঁ কেবল নয়, সব পর্যায় ও স-রের বর্বর অপরাধীর বুকের পানি যেন শুকিয়ে যায়-সে রকম আইনী ও প্রশাসনিক নিয়ম-নীতি গড়ে তোলারও আহ্বান জানাই। রসু খাঁর স্বীকারোক্তি ও ঘটনাবলি আমাদের চমকে দিয়েছে, হতবাক করেছে। কিন' বার বার এ রকম ঘটনার শ্রোতা কিংবা দর্শক হওয়া তো সম্ভব নয়!

 

advertisement