যিলক্বদ ১৪৩০   ||   নভেম্বর ২০০৯

হজ্ব ব্যবস্থাপনাঃ নিজের নিচের লোকদের দায় উপরের লোকদের ওপরও পড়ে

আবু তাশরীফ

হজ্ব মৌসুম আসলেই হাজ্বী সাহেবানদের হৃদয়ের নিভৃতে জেগে উঠতে থাকে ইশকে ইলাহীর জযবা। তারা প্রায় পাগলপারা হয়ে আল্লাহর ঘরের পানে ছুটে যেতে থাকেন। আর এ সময়ই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তাদের খেদমতের দায়িত্ব গ্রহণকারীদের অসততা ও অব্যবস্থাপনার নানাবিধ মন খারাপ করা খবর সংবাদপত্রে ছাপা হতে থাকে। একদিকে সক্রিয় থাকে নীরব প্রেমের আকুতি, আরেকদিকে চলে বাণিজ্যিক লাভালাভের কসরত ও কুৎসিত ধাপ্পাবাজির মহড়া। সচিবালয়ের বারান্দা থেকে নিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি পর্যন-, প্লট-ফ্ল্যাটের বুকিং থেকে নিয়ে কাঁচা মরিচের বোঁটা পর্যন- যে দেশে মুনাফা ও ব্যবসার উৎপীড়ক সংস্কৃতি বিদ্যমান, সে দেশেরই কিছু অতি মুনাফা সন্ধানী মানুষের হাতে প্রতিবার আল্লাহর ঘরের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া পবিত্র কাফেলার সাদা দিল মানুষেরা নিপীড়িত হয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসান। এরচেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে! বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই উৎপীড়নে সরকারি আয়োজনের লোকেরাও যুক্ত হয়ে যান।

গত ১৭ অক্টোবর শনিবারের একটি দৈনিকের প্রথম পাতার ৮ এর কলামের রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল-পিয়ন, গুদামরক্ষকসহ আনকোরা লোকজন হজ্ব গাইড হয়েছেন। ওই রিপোর্টের প্রধান অংশটি হুবহু তুলে দেওয়া হল- ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের অফিস সহকারী (পিয়ন), সাবেক গুদামরক্ষক, এমএলএসএস, মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারীরা এবার হজ্ব গাইড হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সব মিলিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭৯ জনের মধ্যে অধিকাংশেরই এই পদে নিয়োগের যোগ্যতা নেই। কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আছে।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ্বযাত্রীদের সুষ্ঠুভাবে হজ্ব করতে সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য সরকার প্রতি বছর হজ্ব গাইড নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাদের নিয়োগ বিষয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২২ জুন একটি পরিপত্রও জারি করে। এতে গাইড হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। প্রার্থীদের ন্যূনতম একবার হজ্বে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, হজ্বের আরকান-আহকাম, অর্থাৎ হজ্বযাত্রীদের জেদ্দা, মক্কা, মদীনা, মিনা, আরাফা প্রভৃতিতে করণীয় সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান, হজ্বনীতি, হজ্ব প্যাকেজ, সৌদি আরবের আইনকানুন, নাগরিক জ্ঞান সম্পর্কে দক্ষ হতে হবে।

কিন্তু এমন অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের হজ্ব করার অভিজ্ঞতা নেই। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগ পাওয়া ১৭৯ জনের মধ্যে ১৬৫ জন কখনো হজ্ব করেননি। ১১৯ জন আলেমও নন। কেবল ১৪ জনের যথাযথ যোগ্যতা ছিল।

এই রিপোর্ট ছাপা হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে অপর এক দৈনিকে এমন একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল যে, সরকারিভাবে হজ্ব গাইড নিযুক্ত হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরকে অর্ধ লক্ষাধিক টাকা পর্যন- ‘খরচ’ দিতে হচ্ছে। এসব দেখে শুনে এই অনুমান করা কঠিন নয় যে, সরকারের উঁচু মহলকে অন্ধকারে রেখে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একশ্রেণীর টাউট রাজনীতিকের যোগসাজশে হাজ্বীদের খেদমতে নিয়োগের বিষয়টিকেও আকর্ষণীয় কামাই-রোজগারের উপায়ে পরিণত করে নিয়েছেন। আর এরই ফলে অদক্ষ, অযোগ্য ও খেদমতে অনুপযুক্ত লোকদের বেছে বেছে হজ্ব গাইড বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর দায় এবং এজন্য উত্থিত দীর্ঘশ্বাস থেকে সরকার কি বাঁচতে পারবেন? নিজের নিচের লোকেরা যে অসদুপায় গ্রহণ করে তা বন্ধ না করলে তার দায় অবশ্যই উপরের লোকদের ওপরেও গিয়ে বর্তাবে। বার বার বিষয়টি মিডিয়াতে আসার পর উপরের লোকেরা নিশ্চয়ই এ দাবি করতে পারবেন না যে, বিষয়টি তাদের জানাই ছিল না।

এতো গেল সরকারি ব্যবস্থাপনার বিষয়। হজ্বের নির্ধারিত দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে ততই চোখে পড়তে থাকে বিভিন্ন হজ্ব এজেন্সির প্রতারণার দৃশ্য। সব নিশ্চিত জেনে ইহরাম বেঁধে বিমান বন্দরে এসেও বিমানে উঠতে না পেরে আল্লাহর ঘরের বহু মুসাফিরকে রাস-ায় এসে দাঁড়াতে হয় কেবল তাকে আল্লাহর ঘর পর্যন- যাওয়ার ব্যবস্থা করার দাবি নিয়ে। এসব প্রতারক এজেন্সি-ব্যবসায়ী সম্পর্কে সরকারের উঁচু মহল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর শাসি-র ধমক দেওয়া হয়। তারপরও প্রতিবারই এই জঘন্য ঘটনাটি ঘটেই যায়। এ ব্যাপারেও সরকারের আগাম করণীয় নির্ধারণ ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা দুআ করতে পারি, এখন থেকে নিয়ে সামনের বছরগুলোতে কখনো যেন এদেশের হাজ্বী সাহেবানদের কোনো বিড়ম্বনা ও কষ্টে না পড়তে হয়। কিন্তু প্রতিটি কাজেরই বাহ্যিক বিচার-বিবেচনার দিকটি সামনে নিয়ে আমাদের এ-ও বলতে হবে যে, হজ্ব-ব্যবস্থাপনা ও হাজ্বী সাহেবানদের যথোপযুক্ত সেবার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে একটি নির্বিঘ্ন, নিরাপদ ও আস্থাযোগ্য পরিবেশ তৈরিতে প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নীতি ও পদক্ষেপে দক্ষতা, সততা ও ক্ষিপ্রতা থাকলে হজ্ব নিয়ে মন ও মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা হয়তো এদেশে ইনশাআল্লাহ আর ঘটবে না।

 

advertisement