মাওলানা শাহ জমির উদ্দিন নানুপুরী রাহ.
চট্টগ্রামের নানুপুর জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়ার প্রধান পরিচালক, খ্যাতনামা ওয়ায়েয, বরেণ্য আধ্যাত্মিক রাহবার শাহ সূফী মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১১ টায় আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে চলে যান (ইন্না লিল্লাহি ....রাজিউন)। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪। তিনি স্ত্রী, ৭ ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাদরাসা ময়দানে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার নামাযের ইমামতি করেন হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা.বা.)। দূর দূরান্ত হতে লক্ষাধিক ভক্ত, অনুরক্ত ও সাধারণ মানুষ জানাযার নামাযে শরীক হন। মাদ্রাসা চত্বর ও এর বাইরের রাস্তা ঘাটে তখন তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। এ বিপুল সমাবেশ তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে।
১৯৩৭ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার নানুপূর গ্রামের এক দ্বীনদার পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবার নাম মৌলভী আবদুল গফুর ও মায়ের নাম আমেনা বেগম। স্থানীয় মক্তব ও মাদরাসায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। ১৯৬০ সালে হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস ডিগ্রীপ্রাপ্ত হন। শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে তিনি চট্টগ্রামের নজুমিয়া হাটস্থ বাথুয়া কওমী মাদরাসায় শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি নানুপুর ওবায়দিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ওই মাদরাসার প্রধান পরিচালক পদে অভিষিক্ত হন। মাওলানা শাহ জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.)-এর ২৫ বছরের বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্বে জামিয়া ওবাইদিয়া অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। তাঁর কঠোর মেহনতের ফলে মাদরাসার লেখা পড়ার কাঙ্খিত মান অর্জন, নতুন বিভাগ চালু, ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছে। কুতবে আলম হযরত শাহ মাওলানা সোলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) এর নিকট হতে তিনি খিলাফতপ্রাপ্ত হন। গোটা বাংলাদেশে তাঁর অসংখ্য মুরিদ ও শীষ্য ছড়িয়ে আছে। চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সোনারগাঁসহ বিভিন্ন এলাকায় তিনি বহু মাদরাসা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মুরিদানগণ বিভিন্ন স্থানে ১১৩টি নতুন মাদরাসা তাঁর নামে (জমিরিয়া মাদরাসা) নামকরণ করেন। এ ছাড়া ৪০০ মাদরাসা ও হিফযখানা তাঁর পরামর্শে পরিচালিত হতো।
শাহ সূফী মাওলানা জমির উদ্দীন নানুপুরী (রহ.) বৃহত্তম চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব ও বন্দিত মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন সাধারণের মাঝে অসাধারণত্বের ঐশ্বর্যে মহীয়ান। জ্ঞান গভীরতা, তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি, অধ্যাত্ম সাধনা, মানবসেবা, অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর ইলম, ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক প্রভাবে বহু মানুষের জীবন ধারায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একজন দক্ষ ওয়ায়েয হিসেবে দেশ জুড়ে রয়েছে তাঁর খ্যাতি। তাঁর সুললিত কণ্ঠের যুক্তিপূর্ণ দ্বীনি আলোচনা শোনার জন্য মাহফিলে বিপুল লোকের সমাগম হতো। সাধারণত ওয়াযে তিনি বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে যেতেন। তাঁর ওয়ায ও নসীহতে শিরক, বিদ’আত, সুন্নাত, ইবাদত, আখিরাত, সমাজসেবা সম্পর্কীয় বিষয়াবলী প্রাধান্য পেত।
দলমত নির্বিশেষ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ব্যাপক। বহু বিজ্ঞ আলিম-উলামা তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের খ্যাতি দেশের সীমানা পেরিয়ে বহিঃর্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। মুরিদানদের নিমেণাক্ত নসিহত প্রদান করতেন :
‘প্রত্যেক নামায ওয়াক্তমত (জামাতে) আদায় করবেন। চলা-ফেরা, উঠা-বসা সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ করবেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুন্নাত মত আমল করে চলবেন। গুনাহ থেকে বেঁচে চলবেন। পরিবারের মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা করবেন। গান-বাদ্য ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবেন। মহিলাগণ স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী এবং সন্তানদের খিদমত আমত্মরিকতার সাথে আদায় করবেন। চলাফেরার সময় বেশি বেশি যিকির ও দরূদ শরীফ পড়বেন।’’
অধ্যাত্মিক জগতে তিনি ছিলেন উচুঁমার্গের বুযুর্গ ও সাধক। বৃহত্তর চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষ তাঁর পুতঃ সংস্পর্শে এসে সত্য পথের সন্ধানপ্রাপ্ত হন। ওয়ায, নসীহত, বাইয়াত, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সহীহ আকীদার প্রচার প্রসারে তিনি সারা জীবন উৎসর্গ করেন। বহুবিধ গুণাবলী তাঁর জীবনকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। অত্যন্ত উচুঁ মাপের আলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বিনয়ী, ভদ্র ও অতিথিপরায়ন। তাঁর চেহারায় অদ্ভুত এক নূরাণী আভা লক্ষ্য করা যেত। তাঁকে দেখলে অন্তরে শ্রদ্ধা জাগতো। তিনি ছিলেন আগাগোড়া সুন্নাতে রাসূলের বাস্তব ও প্রতিচ্ছবি। যিকির, আযকার, দু’আ, মুনাজাতে তিনি সব সময় তন্ময় থাকতেন। নামাযের একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা আগের যামানার বুযুর্গদের জীবনধারার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রামাযান মাস আসলে তিনি নিজকে খাস ইবাদতের জন্য প্রস্ত্তত রাখতেন। অযথা গল্প গুজব করে তিনি সময় নষ্ট করেননি। সময়কে সর্বদা কাজে লাগিয়েছেন। সারা জীবনের রাতের শেষ প্রহরগুলো তিনি অতিবাহিত করেন আল্লাহ তা’আলার ইবাদতে। পরহিত, সহিষ্ণুতা ও স্থৈর্য ছির তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ।
আল্লাহর রাহে সমাহিত চিত্ত যাঁরা, তাঁদের জীবনধারায় আছে অমোঘ শক্তি ও স্পর্শমণির অত্যাশ্চর্য মাহাত্ম্য। এর ছোঁয়ায় ক্ষুদ্র মহৎ হয়, সাধারণ চিত্ত মহৈশ্বর্যে বিনম্র হয় এবং মানব হৃদয় আত্মার রহস্যের সন্ধান পায়। পরার্থে উৎসর্গিত মহৎপ্রাণ ব্যক্তি বিশ্ব মানবের সম্পদ। যাদের জীবনাশ্রয়ী মূল্যবোধ জাতিসত্তার ভিত্তিকে দৃঢ়তর করে শাহ সূফী মাওলানা জমির উদ্দীন নানুপুরী রাহ. তাঁদেরই একজন। তাঁর মতো কীর্তিমান ব্যক্তির মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই, শেষ নেই। পৃথিবীতে তিনি নিজস্ব কীর্তির মহিমায় অমর ও অবিনশ্বর। কাল পরম্পরায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর কর্মের মাঝে। আমরা এ বুযুর্গ মনীষীর রূহের মাগফিরাত ও দরাজাতের বুলন্দি কামনা করি আল্লাহ তায়ালার দরবারে।