রবিউল আখির ১৪৩২   ||   মার্চ-২০১১

দেশের প্রতি ভালবাসা : প্রয়োজন দ্বীন ও ঈমানের রাহবরি

আদদ্বীনু আননাসীহা, দ্বীন হল কল্যাণকামিতা। হাদীস শরীফের এই মূলনীতি অনুযায়ী দেশ ও জনগণের কল্যাণকামী হওয়াও মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ। সুতরাং যেসব চিন্তা ও প্রবণতা দেশের জনসাধারণের জন্য ক্ষতিকর তা অকপটে প্রকাশ করা আমাদের দ্বীনী ও ঈমানী দায়িত্ব।

স্বাধীনতার মাসে দেশপ্রেমের কথা অনেক বেশি উচ্চারিত হয়। আর দেশের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালবাসা ও অনুরাগও মিথ্যা নয়। কারণ মাতৃভূমির প্রতি আবেগ ও ভালবাসা মানুষের স্বভাবজাত। তবে দায়িত্বশীলদের কর্তব্য এই আবেগ ও ভালবাসার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। একটি জনগোষ্ঠির সম্মিলিত আবেগ এমন এক শক্তি, যা তাদের সৌভাগ্যের সূচনা যেমন করতে পারে তেমনি লক্ষচ্যুত হলে তাদের জন্য আত্মঘাতীও হয়ে যেতে পারে।

এটা এ দেশের দুর্ভাগ্য যে, দেশপ্রেমের বিপুল শক্তিকে দেশের উন্নতি ও সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়নি। দেশ ও জনগণ আলাদা দুটি সত্ত্বা নয়। জনগণের উন্নতিই দেশের উন্নতি, আর জনগণের অধঃপতনেই দেশের অধঃপতন। তাই জনগণের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করা সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের অপরিহার্য কর্তব্য।

বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং স্বভাবগত ও পরিবেশগত কারণে অন্য অনেক দেশের মানুষের চেয়ে অধিক ধর্মভীরু। তাই বিপুল সম্ভাবনা ছিল মুসলিম জনগণের বিশ্বাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের কর্ম ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের। সর্বস্তরে খোদাভীতি ও আখেরাতে জবাবদিহিতার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করা হলে এমন বহু সমস্যার মূলোৎপাটন করা সম্ভব হত যেগুলোর কারণে সবার আরাম হারাম হয়ে গিয়েছে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও নারী নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো শত চেষ্টা করেও রোধ করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, আইন, বিচার, দন্ড কোনো দাওয়াই প্রয়োগ করেই এই মহামারি ঠেকানো যাবে না। এরপরও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মতো সৎসাহস ও বিচক্ষণতা আমরা অর্জন করে উঠতে পারিনি।

এখন এই জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন এমন সাহসী নেতৃত্বের, যা তাদের বিশ্বাসের শক্তিকে জাগ্রত করবে এবং ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। ঈমান ও তাকওয়ার শক্তিই এ সমাজকে পুনরায় বাসযোগ্য করতে পারে। এটা নিছক অনুমান নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা পরীক্ষিত। কিন্তু সামাজিক পর্যায়ে এর সুফল এই জন্যে পাওয়া যাচ্ছে না যে, দ্বীন ও ঈমানের চর্চার তুলনায় দ্বীন ও ঈমান বিরোধী চর্চাই এখন অধিক শক্তিশালী। সাম্প্রতিক কিছু দৃষ্টান্ত তো আমাদের সামনেই রয়েছে। একদিকে পার্শ্ববর্তী দেশের নায়ক-নায়িকাদের এনে উদ্দাম নৃত্যের আয়োজন, অন্যদিকে বিভিন্ন অজুহাতে ইসলামের হুকুম-আহকাম বর্ণনা তথা ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অপপ্রয়াস। দ্বীন ও ঈমানের সাথে দেশের নাগরিকদের বিদ্যমান সম্পর্কটুকুও ছিন্ন করে দেওয়া ছাড়া এসব কর্মকান্ডের আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

এরপর বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন কি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য? যে দেশে সমস্যার কোনো শেষ নেই এবং দুর্নীতির কারণে সিংহভাগ সমস্যারই কোনো সমাধান নেই, সেই দেশে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? বাংলাদেশে যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট চলছে ঠিক সেই সময় লন্ডনভিত্তিক একটি সংগঠনের গবেষণা-রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হচ্ছে পৃথিবীর বসবাসের অনুপযুক্ত শহরগুলির মধ্যে দ্বিতীয়! বিশ্বকাপের আয়োজন করেই কি আমরা পৃথিবীর দরবারে মর্যাদার আসন লাভ করতে পারব?

আমাদের এই দুরবস্থা তো কুরআন মজীদের অমোঘ ঘোষণারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। মানবজাতির সূচনাতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, আমার পক্ষ থেকে দেওয়া হেদায়াত ও নির্দেশনার যারা অনুসরণ করবে তারা যেমন পথভ্রষ্ট হবে না তেমনি কষ্টে নিপতিত হবে না। পক্ষান্তরে যারা আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তাদের জীবন হবে সংকীর্ণ আর আখিরাতে তাদেরকে উপস্থিত করব দৃষ্টিহীন অবস্থায়!-সূরা ত্বহা : ১২৩-১২৪

এদেশের জনগণকে এই বিশ্বাসে বলিয়ান করা সম্ভব ছিল যে, একমাত্র দ্বীন ও ঈমানের পথেই আমাদের শান্তি ও সফলতা। আখিরাতের মুক্তির মতো দুনিয়ার শান্তিও তো রাববুল আলামীন ঈমান ও তাকওয়ার সাথেই যুক্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) যদি ঐসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারি ইখতিয়ার করত তাহলে আমি খুলে দিতাম তাদের উপর আসমান-যমীনের বরকত ও প্রাচুর্য। কিন্তু তারা অস্বীকার করেছে। সুতরাং তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কর্মের কারণে।-সূরা আরাফ : ৯৬

আমরা উদাত্ত আহবান জানাই, দেশবাসীর ঈমানী চেতনাকে জাগ্রত করুন এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে তাকওয়া ও দ্বীনদারি নিশ্চিত করুন। মাতৃভূমির প্রতি দেশের জনগণের যে আবেগ-অনুভূতি তা যদি ঈমান ও তাকওয়ার সাথে যুক্ত করা যায় তাহলে এই দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কেউ প্রতিহত করতে পারবে না। পক্ষান্তরে এই আবেগ ও অনুভূতিকে যদি দ্বীন ও ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়  তাহলে এই দেশের দুর্ভাগ্যও কেউ রোধ করতে পারবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন। 

 

advertisement