রবিউল আউয়াল ১৪৩২   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১১

নেয়ামতের শোকরগোযারি

আবিদা

 

لئن لئن شكرتم لازيدنكم ولئن كفرتم ان عذابى لشديد

لئن كفرتم ان   [আপনার শিশুকে শিক্ষা দিন যে, নেয়ামতের শোকর করলে নেয়ামত স্থায়ী হয়। আর না-শোকরি করলে আল্লাহ নেয়ামত ছিনিয়ে নেন। নেয়ামতের কদরদানী করাও শোকরগোযারির অন্তর্ভুক্ত। অতএব নিজেও জিনিসপত্রের যত্ন করুন এবং ছোট ছোট জিনিসকেও অবহেলা করা থেকে বিরত থাকুন। বিশেষত শিশুদের সামনে জিনিসপত্রের প্রতি অবহেলাকে কখনো প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।]

আমি এখন নিশ্চিত করে বলতে পারব না যে, শিরোনামে উল্লেখিত বিষয়টিও নানাজীর বিশেষ তরবিয়ত না তা শামের অধিবাসীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

যে পৃথিবীতে নানাজীর শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে তা ছিল আমাদের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তখন দামেশকে উঁচু উঁচু ভবন ছিল না, প্রশস্ত রাজপথ ছিল না, এমনকি বিজলি বাতিও ছিল না। অতএব রেডিও, টেলিভিশন, গ্যাসের চুলা, এয়ারকন্ডিশন ইত্যাদির কথা তো বলাই বাহুল্য।

গোটা শামে ছোট ছোট পাঁচটি মোটরগাড়ি ছিল। বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা তখনও শামবাসীর হয়নি। এককথায় বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির যে সুফল আমরা ভোগ করছি সেসব ছিল সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যেন একটি বিপ্লব ঘটে গেল। নানাজী ছিলেন এই যুগ -সন্ধিক্ষণের সচেতন সাক্ষী।

আইনস্টাইন, মাদামকুরি, মার্কনি ও সমসাময়িক বিজ্ঞান-পথিকৃতদের যুগ তিনি পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন যে, পাঁচ শ বছরেও সমাজ-জীবনে যে পরিবর্তন ঘটেনি বিগত পঞ্চাশ বছরে তার বহু গুণ বেশি ঘটেছে। সময় যেন চলছিল ঘড়ির কাটার মতো টিক টিক করে। এরপর তা ঘুরতে লাগল বিমানের প্রপেলারের মতো।

প্রযুক্তিবিহীন শ্লথ ও শ্রমসাধ্য জীবন আর প্রযুক্তির আশির্বাদপ্রাপ্ত সহজ ও গতিশীল জীবন দুটোরই অভিজ্ঞতা যেহেতু তার ছিল তাই বস্ত্ত ও জীবনোপকরণের মূল্য তার সামনে পরিষ্কার ছিল। নিজ হাতে কাপড় কাচার এবং দূর দূরান্তে পায়ে হাঁটা সফরের অভিজ্ঞতা যার আছে শুধু তিনি বুঝবেন মোটরগাড়ি ও ওয়াশিং মেশিনের তাৎপর্য। কিন্তু আমরা তো সেই কষ্টের যুগ প্রত্যক্ষ করিনি তাই আমাদের মাঝে খামখেয়ালির মরয পয়দা না হয় এজন্য তিনি আমাদেরকে বস্ত্ত-সামগ্রির মূল্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন। ...

জিনিসপত্র যত্নের সাথে ব্যবহার করলে তা দীর্ঘ সময় ব্যবহারের উপযোগী থাকে।

শৈশব থেকেই নানাজী আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন নিজেদের জিনিস ও ঘরের সকল জিনিসের প্রতি যত্নবান থাকি। যে জিনিস যে কাজের জন্য তা যেন সে কাজেই ব্যবহার করি এবং সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক সময়ে ব্যবহার করি। যেমন চৌকি ঘুমানোর জন্য, চেয়ার বসার জন্য এবং টেবিল জিনিসপত্র রাখার জন্য। এই জিনিসগুলো আমরা এই কাজেই ব্যবহার করব। ঘরের আসবাবপত্র খেলাধুলায় ব্যবহার করে নষ্ট করব না।

বড় ও মূল্যবান জিনিসপত্রের মতো ছোট ছোট জিনিসেরও তার কাছে একই রকম গুরুত্ব ছিল।  কোনোরূপ বেপরোয়া ভাবকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। কারণ অনুচিত আচরণ যদি প্রথম থেকেই সংশোধন না করা হয় তাহলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে। দু একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, কথা বলার সময় কারো কারো অভ্যাস আছে টেবিলে রাখা শোপিস ইত্যাদি নিয়ে নাড়াচাড়া করার। নানাজী তা অপছন্দ করতেন। কারণ অসাবধানতাবশত জিনিসটি হাত থেকে পড়ে যেতে পারে এবং ভেঙ্গে যেতে পারে। কিছুই না হোক, এটা তো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার জন্য রাখা হয়নি। তেমনি অনেকে টেলিফোনের রিসিভার টেনে অনেক দূরে নিয়ে যায়, কিংবা মাটিতে রাখা টেলিফোনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলে। এটা তাঁর অপছন্দ ছিল। কারণ এতে রিসিভারের তারটি আগের মতো থাকে না। ঢিলে ও অসুন্দর হয়ে যায়।

আমরা কখনো কোনো জিনিস নিয়ে লোফালুফি করিনি। কিংবা কাউকে কোনো কিছু দিতে হলে ছুড়ে দেইনি? এটা  তো একটা অসুন্দর আচরণ। আমরা এই নিয়মগুলো মেনে চলতাম বলেই আমাদের ঘরের প্রতিটি জিনিস সাজানো গোছানো ও ব্যবহারের উপযোগী ছিল।

কোনো জিনিস ভেঙ্গে গেলে বা ত্রুটিযুক্ত হয়ে গেলে তা মেরামত করা হত যেন তা পুনরায় ব্যবহার করা যায়। কাপড় চোপড়, হাড়িপাতিল, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদির রং চটে গেলে বা দীর্ঘ ব্যবহারের কারণে বেশি পুরানো হয়ে গেলে তা গরীবদেরকে দিয়ে দেওয়া হত। এতে তাদের প্রয়োজন পূরণ হত এবং ইনশাআল্লাহ আমরাও ছওয়াব পেতাম।

নানাজীর এই ছোট ছোট শিক্ষা আমরা সারাজীবন অনুসরণ করেছি। সকল শিক্ষার মূল কথা ছিল, আল্লাহর নেয়ামতের কদর কর, তাহলে তা তোমাদের উপকারে আসবে। আর নেয়ামতের কদর করার অর্থ হল নেয়ামতের মূল্য দেওয়া ও যত্ন করা। যে বান্দা নেয়ামতের কদর করে ও আল্লাহর শোকরগোযারি করে আল্লাহ তার জন্য নেয়ামতকে বাড়িয়ে দেন। তেমনি তিনি বলতেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্রের মাধ্যমে গরীব-দুঃখীকে সাহায্য কর। তাহলে যেমন মানুষের কৃতজ্ঞতা পাওয়া যাবে তেমনি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও রেযামন্দিও হাসিল হবে। ষ

 

 

advertisement