রবিউল আউয়াল ১৪৩২   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১১

ইংরেজি পড়ব কি পড়ব না

ইসহাক ওবায়দী

পৃথিবীতে যত ভাষায় মানুষ কথা বলে, সব আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তাই কোনো ভাষা শিক্ষা করা শরীয়তে অবৈধ নয়। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর কয়েকজন চৌকস সাহাবীকে হিব্রু ভাষা শেখার আদেশ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন জাগে, ইংরেজ বেনিয়ারা ভারতবর্ষ দখল করার পর আমাদের আকাবিররা কেন ইংরেজি শেখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন?

পাশ্চাত্যের বস্ত্তবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আমাদের পূর্বসূরী আকাবিররা তা প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর কৌশল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ বিপদ আসার আগে তা রোধ করার চেষ্টা আর বিপদ এসেই গেলে তার মোকাবিলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আকাবির যখন ইংরেজি পড়াকে হারাম ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন বিপদ সবেমাত্র আসছিল। তাঁরা তা রোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন যেহেতু মুসিবত পুরাদমে এসেই গেছে তখন এই বিপদের মোকাবেলা করা জরুরি। আর তার উপায় হল, ইংরেজি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করে একে বাতিলের মোকাবিলায় ব্যবহার করা।

তবে এক্ষেত্রেও নির্বাচন ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাপকভাবে না হয়ে কিছু মেধাবী ও দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আলেমকে বাছাই করে দাওয়াত ও তাবলীগ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির মোকাবেলার জন্য তৈরি করতে হবে। তাদের অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে ইংরেজি ভাষা।

হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী রাহ. যখন ইংরেজদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবেলা করতে গিয়ে নতুন পদ্ধতি দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসার ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন তখন ফারেগীনরা যাতে দ্বীনী শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত কলেজ-ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে সেজন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে ভর্তির বয়সসীমা বাড়ানোরও আবেদন করিয়েছিলেন। (দেখুন : সাওয়ানেহে কাসেমী, সৈয়দ মানাযের আহাসন গিলানীকৃত) এ থেকে অুনমান করা যায় যে, হযরতের চিন্তা ছিল একজন মুসলিম ছাত্র প্রথমে মাদরাসায় পড়ে ঈমান-আমলে পাক্কা হওয়ার পর ইচ্ছা করলে যেন ইংরেজি পড়ার সুযোগ নিতে পারে। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের হাতেই থাকবে সমাজের নিয়ন্ত্রণভার।

জীবনীকার সৈয়দ মানাযের আহসান গিলানী রাহ. এ কথাও বলেছেন যে, হযরত নানুতুবী রাহ. কওমী মাদরাসার কারিকুলামে ইংরেজি ভাষাসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কুদরতের ফয়সালা. এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।

হযরত যদি আরো কিছুদিন হায়াত পেতেন তাহলে হয়ত কওমী মাদরাসার নেসাব আজ অন্যরকম হত। কোনো এক ভক্ত তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, দেওবন্দ মাদরাসার ভবিষ্যত কী? হযরত নানুতুবী রাহ. বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা যদি পঞ্চাশ বছর টিকে থাকে তাহলেই যথেষ্ট। এ সকল বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, হযরত নানুতুবী রাহ.-এর চিন্তায় এমন অনেক কিছুই ছিল, যা তিনি বাস্তবায়ন করে যাওয়ার মতো সময়-সুযোগ পাননি।

গত বছর যখন হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী সাহেব বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন তাঁর সান্নিধ্যে অধম লেখকের দুই দিন থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। নামাযবাদ হযরতের ঘরোয়া মজলিসগুলো হত খুব প্রাণবন্ত। এমনি এক জলসায় হযরত বলেছিলেন, সম্প্রতি আমার ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল সফরের সুযোগ হয়েছে। ওখানকার আলেমদের দেখলাম, তারা অরিজিনাল ব্রাজিলীয়, বাইরের আগন্তুক নন। দাওয়াতের জন্য ব্রাজিলের মাটি এত উর্বর যে, দশজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলে পাঁচজনই মুসলমান হয়ে যান। তবে দায়ীদের ভাষা প্রাঞ্জল ইংরেজি না হওয়াতে কাজটা ধীরগতিতে হচ্ছে বলে মনে হল। তাবলীগ জামাত অহরহ যাচ্ছে, কিন্তু আলেমদের ভাষা ইংরেজি না হওয়ায় দোভাষীর সাহায্য নিতে হচ্ছে। ফলে কাজের গতি বেশ ধীর। তিনি বলেন, তাই আমার খেয়াল, কিছু মেধাবী আলেমের ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হওয়া খুব প্রয়োজন। তাহলে বহিঃর্বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতে আরো বেশি গতির সঞ্চার হবে ইনশাআল্লাহ। হযরত মাওলানা আরো বলেন, কোনো মুসিবত আসার আগে তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা এক রকম হয়। পক্ষান্তরে মুসিবত এসে গেলে তার মোকাবিলার কৌশল ভিন্ন হয়ে থাকে।

আগে ইংরেজির মুসিবত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে আমাদের আকাবির মনীষীরা তা না পড়ার কথা বলেছেন। আর এখন যেহেতু গোটা বিশ্বে ইংরেজি ভাষার শাসন চলছে তাই ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। আর তা হচ্ছে, কিছু আলেমকে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শীতা অর্জন করা। গ্রীক দর্শনের বিষক্রিয়া থেকে মুসলিম উম্মাহকে বাঁচানোর জন্য তখনকার বলেণ্য ওলামায়ে কেরাম তার পঠন-পাঠন এবং অনুবাদ সবকিছুই নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তা অনুবাদ হয়ে যখন গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ল এবং বিষফল ফলতে আরম্ভ করল ইমাম নসফী ও মাতুরিদীসহ ইমাম গাযালীর মতো মনীষীরা গ্রীক দর্শন মন্থন করে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন এবং গোটা মুসলিম উম্মাহকে ওই ফেতনা থেকে রক্ষা করেছিলেন। পশ্চিমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। তবে এ কাজটি সবার জন্য উন্মুক্ত না হয়ে নির্বাচিত কিছু আলেমের জন্য হওয়া বাঞ্চনীয়।

ইংরেজির শিক্ষককেও দ্বীনদার হওয়া চাই এবং পরিবেশও দ্বীনী হওয়া বাঞ্চনীয়। বর্তমানে এটা খুব দুরূহ বিষয় নয়।  এ সকল শর্তসাপেক্ষে দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ইংরেজি পড়া বর্তমানে অনেক জরুরি বলে মনে হচ্ছে। আল্লাহই ভালো জানেন এবং তিনিই আমাদের হেফাযতকারী। ষ

 

 

advertisement