সফর ১৪৩২   ||   জানুয়ারী ২০১১

বাইতুল্লাহর ছায়ায় - ৯

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

 (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আহ, দয়াময়ের অসীম দয়া! কমযোর বান্দার কী অপরিসীম সৌভাগ্য! মক্কার মুসাফির আবার চলেছে মক্কার পথে! পাপের কালিমায় মলিন এই চোখের দৃষ্টি আবার দেখতে পাবে আলোর মক্কা এবং মক্কার আলো! এই সুন্দর স্বপ্নের আবেশেই যেন পার হয়ে গেলো দীর্ঘ পথ। এই সুমধুর আচ্ছন্নতার মধ্যেই যেন সবার কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হতে লাগলো লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক ধ্বনি। আহা, কী সমধুর ধ্বনি! কৃতার্থ প্রেমিকের ব্যাকুল কণ্ঠে যেন প্রেম নিবেদনের উচ্ছ্বাসধ্বনি! বাইরে আকাশে তখন চাঁদ ছিলো না এবং ছিলো না চাঁদের জোসনা, কিন্তু আমাদের হৃদয়াকাশে যেন ছিলো পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ, আর ইহরামের সাদা লেবাস যেন ছিলো তারই জোসনা! স্বপ্নের তন্ময়তা ছাড়া, ছলছল ঝর্ণার সঙ্গীত ছাড়া এবং চাঁদের জোসনা ছাড়া মানুষ কি এত সুখী হতে পারে! তার হৃদয় কি এমন স্নিগ্ধ হতে পারে!

আমার ছোট্ট বাবা, সবার সঙ্গে সেও বলছে, ‘লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক ...। নিষ্পাপ কণ্ঠের লাববাইক ধ্বনি শুনতে সত্যি বড় মধুর লাগে! একটি পবিত্রতা, একটি শুভ্রতা আমাদের বড়দেরও যেন স্পর্শ করে। ছোট ছোট শিশুর কণ্ঠে লাববাইক ধ্বনি আরো শুনেছি, কিন্তু আজকের এ পবিত্র অনুভূতি আর কখনো হয়নি। হয়ত একারণে যে, এ কণ্ঠধ্বনি তো আমারই আত্মার প্রতিধ্বনি!

আমার হৃদয়ের গভীরে তখন উচ্চারিত হচ্ছিলো একটি নীরব প্রার্থনা, ‘সকল শিশুর নিষ্পাপ কণ্ঠের লাববাইক ধ্বনি যেন হয় আগামী দিনের তাওহীদী আহবানের বজ্রধ্বনি।’

দূর থেকে দেখা গেলো যেন জান্নাতের আলোকসজ্জা! রাতের এছাড়া আর কী বলতে পারি! রাতের অাঁধার ঘোচাতে সব শহরেই তো আলো থাকে, কিন্তু রাতের মদীনা এবং রাতের মক্কা ছাড়া এমন আলো বলো আর কোথায়! এ আলো শুধু রাতের অাঁধার দূর করে না, দূর করে মুসাফিরের মনের দ্বিধা-সংশয় ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারও অাঁধার! এ আলো তার অন্তরে জ্বেলে দেয় আশা ও আশ্বাসের আলো! এ আলোর উজ্জ্বলাতায়, এ আলোর স্নিগ্ধতায় আছে এমন কিছু যা শুধু তোমার চোখের দৃষ্টিসীমাকেই আলোকিত করে না, তোমার ভিতরের জগতকেও করে তোলে আলোর পরশে উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ!

গাড়ীর চালক আমাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। মিসফালার সারে’ ইবরাহীমের দিকে নেমে যাওয়ার আগে জাবালে উমরের ঢালুপথের পার্শ্বে সামান্য সময়ের জন্য গাড়ী থামালেন। নইলে সামানপত্র নিয়ে চড়াই পথে উঠে আসতে অনেক কষ্ট হতো। চালককে আন্তরিক  কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা গাড়ী থেকে নামলাম। আলোঝলমল হারাম তখন আমাদের সামনে! ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কণ্ঠে একই সঙ্গে ঝরে পড়লো একরাশ মুগ্ধ উচ্ছ্বাস, ‘এত সুন্দর!’

আমিও যেন সেই মুগ্ধ উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হলাম। তাই তো! এত সুন্দর! এত উজ্জ্বল! এত ঝলমল! ইয়া হারাম! লাববাইকা ইয়া হারাম!

যাকে বলে পথের ক্লান্তি ও সফরের শ্রান্তি, আমি বলবো না যে, তা আমাদের ছিলো না। তবে পৃথিবীর অন্য কোন সফরের সঙ্গে যদি তুলনা করো তাহলে তোমাকে বলতেই হবে, হিজাযের সফরে ক্লান্তি ও শ্রান্তির মধ্যেও মিশে থাকে আশ্চর্য এক সজীবতা! একথা আজ মসৃণ পথে আরামদায়ক গাড়ীর ক্ষেত্রে  যেমন সত্য, শুনেছি, সে যুগে মরুভূমির আগুনঝরা পথে উটের সফরে ছিলো একই রকম সত্য।  দীর্ঘ সফরের পর এই মধ্যরাতে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সবার চেহারায় ক্লান্তি ও শ্রান্তির মধে দেখতে পেলাম সেই সজীবতারই অপূর্ব মিশ্রণ। তাই আমার ফজর পর্যন্ত বিশ্রামের প্রস্তাব কারোই পছন্দ হলো না। তারা এখনই যাবে হারামে আল্লাহর ঘরে।

কালো গিলাফে ঢাকা চিরশান্তির সেই ঘর আবার দেখা হলো। লাখো আশিকানের সদাবহমান সেই জনতরঙ্গে মিশে গিয়ে আবার সেই ঘর তাওয়াফ করা হলো; আবার মুলতাযামে বুক লাগিয়ে সেই ঘরের স্নিগ্ধ স্পর্শ গ্রহণ করা হলো! যামযামের শীতল পানিতে আবার ...!

আহ, যামযাম! সুরা ও শারাবের কত কবিতা পড়েছি! পানীয় ও পানশালার কত গান শুনেছি! কিন্তু যামযাম!

সুরা ও শারাবের সকল কবিতার চেয়ে, পানীয় ও পানশালার সকল গানের চেয়ে, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী, ‘যামযাম’ এই শব্দের সুরঝঙ্কার আমার কানে বেশী মধুর লাগে।

পানের জলসায় এক পেয়ালা শারাবের নেশায় শুনেছি মানুষ সবকিছু লুটিয়ে দেয়। কিন্ত হে সাকী, এক পেয়ালা যামযামের জন্য আমি লুটিয়ে দিতে পারি তোমার সব সুরা ও শারাব, তোমার সকল মদ ও মদিরা। আজ যামযামের পাড়ে দাঁড়িয়ে তোমার কাছে হে আল্লাহ, আমার একটি মিনতি আছে; মৃত্যুর সময় তোমার ফিরেশতা যেন যামযামের পেয়ালা ধরে আমার দুই ঠোঁটের ফাঁকে! তারপর হাশরে হাউযের পাড়ে একটি পেয়ালা যেন পাই তোমার নবীর হাত থেকে, আমীন। এই রকম আকুতি নিয়ে যামযামের পাড়ে দাঁড়িয়ে সেদিন যামযাম পান করলাম এবং সালমানকে পান করালাম। এই প্রথম আমার হাতে ও যামযাম পান করলো। ফিরে আসবো, এমন সময় দেখি, একটি ছেট্ট শিশু এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। ওকে জিজ্ঞাস করি কত ভাষায়, তোমার বাবা কোথায়? ও শুধু তাকিয়ে থাকে। শেষে বলি, যামাযাম?! ও মাথায় দোলায়। বুঝলাম, যামযামের নিজস্ব কোন ভাষা ও বর্ণ নেই; যামাযাম সকল ভাষার, সকল দেশের, সকল বর্ণের, সকল পিপাসার্ত মানুষের। ওকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর খুব আদর করে এক পেয়ালা যামযাম পান করালাম। আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কত সুন্দর করে যামযাম পান করলো! শিশুদের সবকিছু সুন্দর। পানি পান করাও সুন্দর। সে পানি যদি হয় যামযাম তাহলে তো আরো সুন্দর, হয়ত সেই ‘যামযামী শিশুটি’র সঙ্গে দূরতম কোন সাদৃশ্যের কারণে।

মনে পড়ে, কোলে করে যখন পান করাচ্ছিলাম, আর ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনওর চোখের তারায় আমার ছায়া পড়েছিলো।

ছেলেটি কে ছিলো? কেন এসেছিলো? আমার পাশে কেন দাঁড়িয়েছিলো? ওর বাবা কোথায় ছিলো? একা একা এতগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে আসা তো তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না! তদ্রূপ সম্ভব ছিলো না, নিজে নিজে  যামযাম পান করা! তবে কি আমার সৌভাগ্যই ওকে টেনে এনেছিলো সেদিন সেখানে?! একটি নিষ্পাপ শিশুর জন্য যামযামের ‘সাকী’ হতে পারা কত বড় সৌভাগ্যের!

যামযামের পূর্ণ পেয়ালা পান করে শিশুটি কোল থেকে নামলো এবং দুই ঠোঁটে হাসির একটু আভা ফুটিয়ে চলে গেলো; চিরকালের জন্যই চলে গেলো, কিন্তু ওর ঠোঁটে সেই যে হাসির আভাটি, আজো তা আমার হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে, চিরকাল থাকবে একই রকম উজ্জ্বল।

আমার ছোট্ট ছেলেটি যামযাম পান করতে গিয়েছিলো মায়ের সঙ্গে। গিয়েছিলো মানে। আমিই পাঠিয়েছিলাম। যামযামের পাড়ে মায়ের হাতে যামযাম পান করার সৌভাগ্য তো আর বারবার আসে না! (এখন তো ভদ্রলোকেরা, কী যে তাদের মাথায় সওয়ার হয়েছে, যামযামের কাছে যাওয়ার পাশাপাশি দুটি সিঁড়ি ছিলো, সে পথটাই বন্ধ করে দিয়েছে!) সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আমি ছেলে, মেয়ে ও তাদের মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখান থেকে সোজা সামনে আল্লাহর ঘর দেখা যায়। আমি আল্লাহর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি; অন্তরে কৃতজ্ঞতার আবেগ ও শোকরের জাযবা, আর কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে, ‘শোকর আলহামদু লিল্লাহ’!

‘আববু, যামযাম পান করেছি!’  ছেলের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালাম। সবার চোখে-মুখে কী অপার্থিব এক তৃপ্তির আভা! যামযাম যারা পান করে, এমনই হয় তাদের!

হঠাৎ ভিতরে কী রকম একটি আবেগে তরঙ্গদোলায় আমি যেন আন্দোলিত হলাম। কিসের আবেগ! কিসের তরঙ্গদোলা! কেমন আলোড়ন ও আন্দোলন! শব্দের ভাষায় আমি তা প্রকাশ করতে পারবো না। সালমানকে শুধু বললাম, তোমরা তিনজন এখানে একটু দাঁড়াও।

তারপর আমার ছোট্ট বাবাকে নিয়ে আবার নীচে নেমে গেলাম। ঠিক আগের জায়গাটিতে ফিরে এসে বাবাকে বললাম, আমার হাতে একপেয়ালা যামযাম পান করবে? কাজটা ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। মায়ের হাতে এই মাত্র প্রাণভরে যামযাম পান করে আসা ছেলে তো ‘না’ বলতে পারতো! আল্লাহর শোকার, বাবা আমার বললো, জ্বি আচ্ছা।

বাবাকে কোলে তুলে নিলাম। যামযামভরা পেয়ালা হাতে তুলে দিলাম, আর বললাম ধীরে ধীরে পান করো বাবা! সে ধীরে ধীরে পান করছিলো, আর আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি তার চোখে দেখতে পেলাম আমার ছায়া! পুত্রের চোখের তারায় বাবার মুখের ছায়া! কী যে হলো তখন! ভিতরটাকে আলোড়িত করে দু’চোখ ছাপিয়ে নেমে এলো অশ্রুর ঢল। একদিন ফুরিয়ে যাবে আমার জীবন। তখনো হয়ত জীবিত থাকবে এবং জীবন্ত থাকবে এ চোখ দু’টো, এই চোখের তারা দু’টো! তখনো কি যামযামের পাড়ে, বাইতুল্লাহর ছায়ায় এই চোখের তারায় ...! হে আল্লাহ, মৃত্যুর পরো আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার বাবার চোখের তারায়! তখনো আমি আসতে চাই তোমার ঘরের ছায়ায়! হে আল্লাহ, আমার সন্তান যেন নেক হয়! তার আমলে আমার কবর যেন আবাদ হয়!

বাবাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। সামনে মসজিদুল হারামের গাত্রে উৎকীর্ণ ছিলো-

 

 

যেজন্য পান করা হয়, যামযাম সেজন্যই

চোখ দু’টো আবার ছলছল করে উঠলো শোকরে, কৃতজ্ঞতায়। বান্দার প্রতি আল্লাহর কত দয়া! উম্মতের প্রতি আল্লাহর নবীর কত মায়া!

যামযামের পেয়ালা হাতে নাও হে বান্দা! প্রাণভরে যামযাম পান করো হে উম্মতি! নিয়ত করো হে বান্দা! কাকুতি-মিনতি করো হে উম্মতি! যা নিয়ত করবে তাই পাবে হে বান্দা! তোমার সব মিনতি পূর্ণ হবে হে উম্মতি!  তোমার শোকর হে আল্লাহ! তোমাকে সালাম হে আল্লাহর নবী!

ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে গেলাম  সেই প্রিয় ছাফার নিকটে যেখনানে মা হাজেরা ...! যেখানে খালীলুল্লাহ ও যাবীহুল্লাহ ...! যেখানে আমাদের পেয়ারা হাবীব ...! যেখানে ছাহাবা কেরাম ও তাবেঈন-তাবয়ে তাবেঈন ...! যুগে যুগে উম্মতের আশেকান যেখানে ...!

কী বলবো! কীভাবে বলবো! কী করবো! কীভাবে করবো! আমার সামনে এখন যে দৃশ্য তা কি দুনিয়ার! হাশরের! জান্নাতের! দীদার হবে যে বাজারে সেই বাজারের! কী করবো এখন? আমার যে ইচ্ছে করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকি; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যের স্বাদ ও সৌন্দর্য অবলোকন করি! ইচ্ছে করে, চোখ দু’টোকে চুমু খাই! চোখের তারা দু’টোকে কৃতজ্ঞতা জানাই! তারপর মনে হলো, শুধু চোখদু’টো কেন আমার সর্বাঙ্গই তো অবগাহন করতে পারে জান্নাতি দৃশ্যের এই সরোবরে! আমি নিজেই যদি মিশে যাই শুভ্রতার এই জলতরঙ্গে!

ধীরে ধীরে নেমে এলাম ছাফা থেকে মারওয়ার উদ্দেশ্যে। জীবনের সুখে-দুঃখে যে সঙ্গে আছে তাকে সঙ্গে করে ছাফা থেকে নেমে আসা; আখেরাতের সফরে যারা পাথেয় যোগাবে তাদের সঙ্গে করে মারওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া কত যে সুখের! কত যে আনন্দের! কত যে সৌভাগ্যের তা কী করে বোঝাবো! এ সৌভাগ্য যারা অর্জন করেছো তাদের জন্য আমার অভিনন্দন; যারা অর্জন করতে চাও তাদের জন্য আমার শুভ কামনা।

মরণ হয়ত আমাদের বিচ্ছিন্ন করবে, কিন্তু আজ একসঙ্গে ছাফা-মারওয়ার এই পবিত্র তরঙ্গে মিশে যাওয়া এবং দুই সবুজের মাঝে ... জানি না, আমার মন কী বলতে চায়, আর মুখের ভাষা কী প্রকাশ করতে চায়! 

আমরা যখন স্ত্রী-কন্যাকে, শিশুপুত্রকে সঙ্গে আনি, মা হাজেরার পবিত্র আত্মার হয়ত তাতে আনন্দ হয়!

জীবনে সবকিছু শুরু হয় এবং সবকিছু শেষ হয়। এখানেও হলো। কত আনন্দের তাওয়াফ, কত সৌভাগ্যের সা‘ঈ শুরু হলো এবং শেষও হলো! তবে সান্ত্বনা এই যে, আমাদের আমল শেষ হয়, নিঃশেষ হয় না। সবকিছু সঞ্চিত থাকে সেই পরম সত্তার কাছে যিনি আছেন শুরুর আগে এবং শেষের পরে। সুতরাং আমাদের কোন দুঃখ নেই, আছে শুধু ব্যাকুল প্রতীক্ষা। এই যে তাওয়াফ-সাঈ শেষ হলো এবং দু’দিন পরে শেষ হবে এই মিলন-অভিসার, অনন্ত জীবনের শুরুতে সব তিনি ফিরিয়ে দেবেন বহু গুণ করে। তিনি ওয়াদা করেছেন, আমরা বিশ্বাস করেছি।

সাঈর শেষে মারওয়ায় কা‘বামুখী হয়ে দু‘আ করে যখন ফিরে এলাম এবং আল্লাহর ঘরের দুয়ার সামনে রেখে একসঙ্গে বসলাম তখন কেমন ছিলো দিলের জাযবা হৃদয়ের তরঙ্গ-জোয়ার! হৃদয়ের ছবি ও দিলের তাসবীর মুখের ভাষায় ও কলমের অাঁচড়ে হয়ত  প্রকাশ করা সম্ভব হতো, ফুলের প্রতিটি পাপড়ি যদি একটি করে শব্দ হতো, কিংবা আলোর প্রতিটি কণা যদি একটি করে বর্ণ হতো!

আর সবকথা প্রকাশ করার প্রয়োজনই বা কী?!

বসে ছিলাম, আল্লাহর ঘর দেখছিলাম, আর যামযামের পিপাসা অনুভব করছিলাম। হয়ত নিজের পিপাসা থেকেই সালমান বুঝলো আমাদের পিপাসা। তাই নিজেও যামযাম পান করলো, আমাদেরও পেয়ালা ভরে ভরে পান করালো। জাযাকাল্লাহ বলে আমরা পান করলাম। দেহ-মন আবার শীতল হলো, হৃদয় ও আত্মা আবার তৃপ্ত ও পরিতৃপ্ত হলো।

আল্লাহর ঘরের সামনে আমার স্ত্রী আবেগকম্পিত কণ্ঠে বললেন, আমাদের তুমি    আল্লাহর ঘরে এনেছো, তোমার জন্য কী দু‘আ করবো?

আমি আকাশের দিকে তাকালাম, শোনো হে আল্লাহ, তোমার বান্দীর কথা! তুমি কবুল করো হে আল্লাহ তোমার বান্দীর দু‘আ!

বান্দা কি বান্দাকে আনতে পারে, যদি মাওলার ডাক না আসে?! যদি মাওলা নিজে নিয়ে না আসে?! শুধু দু‘আ করো, জান্নাতে সবাই যেন একত্র হতে পারি!

জাবালে ওমরের বেশ উঁচুতে ছিলো আমাদের বাসস্থান। রাস্তায় দাঁড়ালে সেখান থেকে মসজিদুল হারাম দেখতে কী যে অপুর্ব ছিলো! চারদিক থেকে পর্বতের বেষ্টন, মাঝখানে সুন্দর এই উপত্যকা! এখন যদি এমন দেখায়, তখন কেমন দেখাতো, যখন আরো পাহাড় ছিলো, আরো নির্জনতা ছিলো! যখন শুধু আকাশ ছিলো, প্রখর রোদ ছিলো, মেঘের ছায়া ছিলো, আর ছিলো শুধু আল্লাহর ঘর! যখন এতো আলো ছিলো না, কিন্তু অনেক ‘আলো’ ছিলো!

আমার ঘর থেকে বের হয়ে যখনই ঢালু পথ বেয়ে হারামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম, দিনে বা রাত্রে, নীচের উপত্যকায় হারামের দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করতো। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে অভিভূত দৃষ্টিতে সে দৃশ্য আমরা উপভোগ করতাম।

দুপুরে ভাই মানছূর সবাইকে তার নাকাছার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার স্ত্রী আছেন, ছেলে-মেয়েরা আছে। সবাই গেলো, আমি হারামেই থেকে গেলাম, তবে রেহাই পেলাম না। রাতে গাড়ীতে করে সবাইকে দিয়ে গেলেন, আর আমার একার জন্য ‘শাস্তি হিসাবে’ রেখে গেলেন তিনজনের খাবার। যেন নষ্ট না হয়, সে চেষ্টায় যথাসাধ্য খেলাম, যখন আর পারি না তখনো রয়ে গেলো দু’জনের খাবার। যা বেঁচে যায়, এখানে তা ফেলে দেয়াই নিয়ম! আমি রেখে দিলাম পরবর্তী বেলার জন্য। সে খাবার ঠা হলো, শক্ত হলো এবং খেতে কষ্ট হলো! তুব খেলাম। ভাই মনছূর তাতে বেশ জব্দ হলেন। এর পরে যতবার খাবার এনেছেন হিসাব করে এনেছেন।

পরবর্তী রাতে এশার পরে ওমরার নিয়তে তানঈম গেলাম। মসজিদে আয়েশা থেকে ইহরাম গ্রহণ করা হলো। পুরো প্রাঙ্গন ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। ছেলেকে মেয়েকে একটা দোকান দেখিয়ে বললাম, এই যে এখান থেকে তোমার জন্য ইহরামের লেবাস, আর তোমার জন্য কালো উড়নাটি নিয়েছিলাম।

রাতের বেলা ঝিরঝির বাতাস ছিলো। সুন্দর করে ছেঁটে রাখা সবুজ গাছের পাশে সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকতে বড় ভালো লেগেছিলো।

এটা আমাদের হজ্বের সফর নয় এবং এখন যিলহজ্বের আট-নয়-দশ তারিখ নয়, তবু তো ইচ্ছে করে আরাফার ময়দানে যেতে, কাছে থেকে জাবালে রাহমাত দেখতে! তবু তো ইচ্ছে করে মুযদালিফা পার হয়ে মিনায় হাযির হতে, জামারাতের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে! ছেলের কথা না হয় থাক, কিন্তু মেয়ে ও তার মা! তাদের মনের ইচ্ছে তো পূর্ণ করতেই হয়, তার উপর যদি হয় তা মনের সুপ্ত ইচ্ছে! একটি টেক্সি ভাড়া করা হলো। বাঙ্গালী চালক। উত্তরবঙ্গের বেশ শান্ত- ভদ্র যুবক। নামটা মনে নেই, তবে তার আচরণ-সৌজন্য বেশ মনে আছে।

মিনা-মুযদালিফা পার হয়ে প্রথমে আরাফায়। আরাফার দিন সাদা লেবাসের নূরানিয়াতে ঢাকা থাকে জাবালে রাহমাত এখন তা একপ্রকার নির্জন। মৌসুমি ফলের স্বাদ আলাদা, ঠিক, তবে বে-মৌসুমি ফলেরও আছে অন্যরকম স্বাদ। সবার জাবালে রাহমাতে   উঠতে পারার আনন্দ দেখে তাই তো বিশ্বাস করতে হয়!

আরাফার বিশাল ময়দান সবটুকু এখন সবুজে ঢাকা। জাবালে রাহমাত থেকে তাকিয়ে দেখতে বড় মনোমুগ্ধকর! এমন সবুজ এই মরুভূমিতে, সত্যি অপূর্ব! ভাবতে ভালো লাগে, এই সবুজ এসেছে আমাদের সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ থেকে! যারা বলে, বাংলাদেশ থেকে শুধু ঝাড়ুদার আসে তারা তাহলে অর্ধসত্য বলে।

কয়েকটি উট এবং তাদের বেদুঈন মালিক এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে কে বলবে, এখানে মাটির নীচে আছে তরল সোনা, আর উপরে আছে রিয়াল ও ডলার! বলো দেখি, প্রাচুর্য ও দারিদ্রের এবং আলো ও অাঁধারের সহবাস কোথায় নেই? হারামের পাশে রাজপ্রাসাদটির মালিক যিনি, তিনি কি জানেন, এই উটগুলো থাকে অনাহারে, আর তাদের মালিক থাকে অর্ধাহারে! জানেন না; জানলেও তার মনে তা কোন দোলা দেয় না। নইলে আজো রাতের আধারে ঘুমন্ত জনপদে দেখা যেতো ওমরের ছায়া।

এই দেখো, কোথায় দাঁড়িয়ে কী ভাবতে লেগেছি! ওদিকে বেদুঈন কত মিনতি করে ডাকছে, পাঁচ রিয়াল দিয়ে দশ মিনিট উটের পিঠে চড়ে  বেড়াতে! আমার যে ইচ্ছে ছিলো না তা নয়, কিন্তু ‘পাছে লোকে কিছু বলে’! ছেলেকে চড়িয়ে দিলাম। সে উঠলো ভয়ে ভয়ে, তবে জাবালে রাহমাতের চারপাশটা ঘুরে এলো বেশ আনন্দে। আমার আনন্দ শুধু ছেলেকে উটের পিঠে দেখতে পেয়ে। এটুকু সাদৃশ্যও তো কম সৌভাগ্যের নয়!

স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে, এখানে আরাফায় এবং মিনার জামারায় তাদের মুখম লে যেমন ছিলো আনন্দের ছাপ তেমনি ছিলো বেদনার ছোঁয়া। আনন্দ এ জন্য যে, হোকনা আরাফার নির্জন ময়দান, তবু তো দু’চোখে তা দেখা হলো, তবু তো জাবালে রাহমাতের কাছে আসা হলো! হোক না তাঁবুর শহর মিনা এখন তাঁবুহীন, তবু তো তার বালু গায়ে মাখা হলো, তবু জামারার সামনে একবার দাঁড়ানো হলো! বেদনা এ জন্য যে, হাযির হয়েও হায়, হলো না হাযির হওয়া! কবে, কবে আসবে জীবনে সৌভাগ্যের সেই দিন? আসবে তো?

মুখে অবশ্য কেউ কিছু বলেনি, না মেয়ে, না মেয়ের মা। আমি শুধু অনুভব করেছি তাদের মুখের আভাস ও উদ্ভাস থেকে; জাবালে রাহমাতের সামনে তাদের উচ্ছ্বাস থেকে এবং মসজিদে খাইফের বদ্ধ দুয়ারের সামনে তাদের চোখে অশ্রু দেখে!

জামারায় দাঁড়িয়ে মেয়ে যখন চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করে, ‘কঙ্কর নিক্ষেপ করি?’ তখন ভিতরটা এমন তোলপাড় করে উঠলে বে-ইখতিয়ার বলে ফেললাম, ছবর করো মা, এখন যিনি এনেছেন তখনো তিনি আনবেন, ইনশাআল্লাহ।

এবং আল্লাহর শোকর, গোনাহগার বান্দার বিশ্বাসের লাজ তিনি রক্ষা করেছেন।

***

জাবালে ছাওর দেখা যায়, কিন্তু গারে ছাওর দেখা যায় না, কারণ তা অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে! শত শত মানুষ আসছে এবং অাঁকা-বাঁকা ও সঙ্কীর্ণ পথ ধরে উপরে উঠছে। আগে কোন পথ ছিলো না, এখন পথের আভাস তৈরী হয়েছে মানুষের আসা-যাওয়ার মাধ্যমে। আমরা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে থাকলাম এবং কল্পনার জগতে সময়ের পিছনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে, কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিলো তখন! কোরেশের রক্তপিপাসুদের হাতে নবীগৃহ অবরুদ্ধ। মউত ও যিন্দেগি থেকে বেপরোয়া হয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে হযরত আলী শুয়ে আছেন নবীর বিছানায়। আল্লাহর নবী মুশরিকদের চোখে ‘ধুল ছুঁড়ে’ বের হয়ে এলেন এবং হযরত আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে করে এখানে গারে ছাওরে আত্মগোপন করলেন। কোরেশ তখন ক্রোধে আত্মহারা। শুরু হলো ছোটাছুটি ও খোঁজাখুঁজি। এখানেও তারা এসে পড়লো ছুটতে ছুটতে এবং খুঁজতে খুঁজতে। ছিদ্দীকে আকবর (রা.) নিজের জন্য নয়, চিন্তিত হলেন আল্লাহর নবীর জন্য। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওরা তো এসে গেছে! উঁকি দিলেই দেখে ফেলবে! কিন্তু আল্লাহর নবী নিশ্চিন্ত মনে উত্তর করলেন, চিন্তা করো না, আল্লাহ তো আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ...

কী নাযুক ও ভয়াবহ পরিস্থিতি?! নবীর হিজরতের স্মৃতি বিজড়িত এই জাবালে ছাওর ও গারে ছাওর, কী জন্য এখানে আসি আমরা? কী আমাদের উদ্দেশ্য! শুধু ভ্রমণ! নিছক পর্যটন! না শিক্ষাগ্রহণ! কী প্রমাণ করে আমাদের বাহ্যিক অবস্থা? চিন্তার, ব্যথা ও বেদনার কোন ছাপ কেন নেই আমাদের মুখম লে? তার চেয়ে তো ভালো ছিলো এখানে নাই আসা! পেয়ারা নবীর হিজরতের মহান স্মৃতির প্রতি অসম্মানের কলঙ্ক থেকে তো মুক্ত থাকা যেতো!

***

মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে মিনার দিকে হেরা পর্বত, যার চূড়ায় আছে গারে হেরা। নবুয়তের পূর্বে আল্লাহর নবী এখানে গারে হেরায় নির্জনে ইবাদত করেছেন এবং আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। এখানেই তাঁর উপর নাযিল হয়েছিলো আসমানের প্রথম অহী এবং আলকোরআনের প্রথম আয়াত। তাই হেরা পর্বতের পরিচয় হলো জাবালে নূর, বা আলোর পর্বত। যারা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী তাদের মতে, হেরার চূড়ায় ও গারে হেরায় এখনো আছে ‘ইকরা বিসমি রাবিবকা’র আলো এবং ‘আল্লামা বিলকলমের নূর! সেখানে একটু যদি দাঁড়াতে পারো, একটু যদি তাকাতে পারো, সেই আলোর পরশে তুমিও হতে পারো আলোকিত, সেই নূরের ছোঁয়ায় তুমিও হতে পারো নূরান্বিত!

হজ্বের সময় বহু মানুষ আরোহণ করে, এখনো আরোহণ করছে কিছু মানুষ। কেউ একটু উপরে, কেউ অনেক উপরে; আবার চূড়ার কাছেও দেখা যাচ্ছে কিছু ছোট্ট ছায়া।

হজ্বের সফরে হযরত হাফেজ্জি হুযূরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কি জাবালে নূরে আরোহন করেছেন? গারে হেরায় গিয়েছেন? তিনি কিছু বলেননি, শুধু নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন! বুঝতে পারিনি, কী ছিলো সেই নীরব দৃষ্টির ভাষা! শুধু মনে হয়েছে, তাঁর চোখের তারায় ছিলো কিছু একটা রহস্যের ঝিলিমিলি।

মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ, আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন, সেবার তিনি গারে হেরায় গিয়েছিলেন এবং আমাকে সঙ্গী হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আমারও আকাঙ্ক্ষা ছিলো, কিন্তু যাওয়া হয়নি; হয়ত সেই নীরব দৃষ্টির কারণে।

এর পর আল্লাহর রহমতে যতবার আল্লাহর ঘরে আসা হয়েছে, জাবালে নূরের কাছে এসেছি এবং দেখেছি জাবালে নূরে মানুষের আরোহণ ও অবতরণ। দেখেছি, আর ভেবেছি, আহা, ঐ যে চূড়ার একেবারে কাছে ছোট্ট একটি ছায়া, কত সৌভাগ্য তার! সেই পবিত্র দৃশ্যের সঙ্গে সামান্য হলেও সাদৃশ্য আছে তার! আমিও তো পারি এই সৌভাগ্য অর্জন করতে! কেন করি না! মনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল থেকে প্রবল হতো, কিন্তু মনের পর্দায় ভেসে উঠতো সেই নীরব দৃষ্টি। তখন ভাবতাম, থাক: এখনো হয়ত সময় হয়নি আমার!

কিন্তু আজ কী যে হলো! মানুষ আরোহণ করছে, আর অবতরণ করছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, আর ভাবছি... জানি না কী ভাবছি! ভাবনার জগতে মানুষের নিমগ্নতা কখনো এমনও হয় যে, ভাবনারাও হারিয়ে যায়! যদি জিজ্ঞাসা করো, কী ভাবছো? কিছু বলতে পারে না, শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

জাবালে নূরের চূড়ায় সেই ভাগ্যবান কালো ছায়াগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন কিছু ভাবছি, কিংবা কিছু ভাবছি না, তখন হঠাৎ মনে হলো, ভিতর থেকে কেন যেন বলে উঠলো, দেহের শক্তি তোমার ফুরিয়ে আসছে; এবার যদি না পারো, আর পারবে না! যাও এগিয়ে যাও!

স্ত্রী উৎসাহ দিয়ে বললেন, যাও, আল্লাহর উপর ভরসা করে যাও।

সেই নীরব দৃষ্টির কথা আজ আর মনে পড়লো না। তাই বিসমিল্লাহ বলে এগিয়ে গেলাম।

প্রায় তিনশ গজের মত কিছুটা খাড়া পথ; শক্তিশালী ইঞ্জিনের গাড়ীগুলো ঐ পর্যন্ত উঠে যায়। ছেলে, মেয়ে ও সালমান নীচে থাকলো, আমি এবং আমার স্ত্রী  হেঁটে ঐ পর্যন্ত উঠতে লাগলাম, আর তখনি ঘটলো সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি যাতে ভয়ও পেলাম, সাহসও পেলাম।

একটি ছোট্ট ছেলে, উপর থেকে নীচে দৌড়ে আসছে। আসলে তা নয়, আসলে সে নিজের গতি রোধ করতে পারছে না। ছেলেটির বাবা উপরে দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি অবস্থায় দৃশ্যটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন। কী ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। অনেকটা অবচেতন মনে দু’হাত বাড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকলাম। ছেলেটি দৌড়ে এসে আমার বুকের সঙ্গে ধাক্কা খেলো এবং তার গতি থেমে গেলো। তবে আমি নিজে পড়ে গেলাম। চশমাটা দূরে ছিটকে পড়লো, হাতে, বুকে আঘাত লাগলো। ছেলেটিও সামান্য আঘাত পেলো, তবে আল্লাহর রহমতে অবধারিত পতন থেকে বেঁচে গেলো।

সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেলো। ছেলেটির বাবা দ্রুত নেমে এসে তাকে কোলে নিলেন, আর বারবার জাযকাল্লাহ বলে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। বাচ্চাটির বোরকা পরিহিতা মা উপরে গাড়িতে বসা। তার মনের অবস্থা তখন কী তা বুঝতে পারবে শুধু কোন সন্তানের মা! তিনি গাড়ী থেকে নেমে আমার স্ত্রীর কাছে এলেন এবং তাকে জাড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

পুরো দৃশ্যটা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। আল্লাহর শোকর, সেদিন জাবালে নূরের আরোহণে একটি মাসুম বাচ্চার প্রাণ রক্ষা পেয়েছিলো এবং আমি তার মা-বাবার দিলের দু‘আ  পেয়েছিলাম।

আমার স্ত্রী সেখানে বসলেন, আর আমি উপরে আরোহণ করতে শুরু করলাম। যত সহজ করে বলা হলো, আরোহণ করাটা তত সহজ ছিলো না, যথেষ্ট কঠিন ছিলো। তবু প্রথম দফায় বেশ কিছু দূর উঠলাম। পিপাসায় যখন গলা শুকিয়ে এলো তখন বুঝলাম, সঙ্গে পানি না আনা ছিলো কত বড় ভুল। দ্বিতীয় ভুলটা এই যে, পায়ে ছিলো স্যান্ডেল, যা পাহাড়ে ওঠার মোটেই উপযোগী নয়। আর যারা আরোহণ করছিলেন তাদের হাতে ছিলো পানির বোতল এবং পায়ে ছিলো পর্বত-আরোহণের উপযোগী জুতা। তারা অধিকাংশই পাকিস্তানী। এমনকি মহিলারাও স্বচ্ছন্দে উঠে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম। নীচে তাকিয়ে দেখি স্ত্রী বসে আছেন একই স্থানে এবং সম্ভবত আমারই দিকে তাকিয়ে। মনের ভিতরে এমন একটি অনুভূতি হলো, যেন আমার সফলতার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করছেন, আর সেই দু‘আ আমি শুনতে পাচ্ছি। এ অনুভূতিতে দেহ-মনে নতুন সজীবতা এলো এবং আমি আরো অনেক দূর উঠে গেলাম। আশ্চর্য, এত উচ্চতায়ও ঠা পানি ও পানীয়-এর দোকান আছে। দোকান ছিলো, ঠা পানি ছিলো,  শীতল পানীয় ছিলো এবং প্রচ  পিপাসা ছিলো, কিন্তু পকেটে পয়সা ছিলো না। কেউ যদি বিশ্বাস করতে চায় তাহলে বলতে চাই, হঠাৎ আমার মনে হলো, গলা দিয়ে যেন ঠা পানি নেমে গেলো এবং পিপাসা একেবারে দূর হয়ে গেলো। কীভাবে হলো, কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই, তবে এমন হয়েছিলো। আমি একেবারে তাজাদম হয়ে আরো উপরে উঠতে লাগলাম। অনেক দূর ওঠার পর দেখি। সমতল একটা বিরাট পাথর! প্রাকৃতিক পাথর, কিন্তু দেখে মনে হবে, কেউ যত্ন করে তৈরী করে রেখেছে জাবালে নূরে যারা আরোহণ করবে তাদের বিশ্রামের জন্য! আছরের সময় হয়ে গেছে, তাই সেখানে নামায পড়লাম এবং .. এবং সেখান থেকে আল্লাহর ঘর দেখতে পেলাম। দিলের তখন কী অবস্থা হলো, তা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই! আনন্দের আতিশয্যে কান্না এসে গেলো এবং আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।

জাবালে নূর থেকে দেখা আল্লাহর ঘর যেন আজ এক নতুন রূপে উদ্ভাসিত হলো। এত দিন দেখেছি নিকট থেকে। তাতে শান্তি ছিলো, প্রশান্তি ছিলো, তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি ছিলো, তবে শব্দ ছিলো, গুঞ্জন ছিলো এবং বহু মানুষের সঙ্গ ছিলো। আল্লাহর ঘর তখন সবার জন্য ছিলো, আমার একার জন্য ছিলো না। আজ জাবালে নূরের আশ্চর্য এই নৈশব্দের গভীরতা ও গম্ভীরতার মধ্যে বিলীন হয়ে একান্ততা ও একাত্মতার সেই দুর্লভ অনুভূতিটুকু যেন অর্জিত হলো। এখানে আমি ছাড়া আল্লাহর ঘরের জন্য আর কেউ নেই এবং আমাকে ছাড়া আল্লাহর ঘরের জন্য আর কেউ নেই।

জাবালে নূরের চূড়া এখন অনেক কাছে! এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। চারপাশে পাহাড়ের চূড়াগুলো এখান থেকে অনেক নীচে। যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ। নৈশব্দের ঢেউ। পৃথিবীর সকল নৈশব্দ যেন এখানে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এমন নৈশব্দ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। মক্কায় কত পরিবর্তন ঘটেছে! উঁচু উঁচু ইমারত হয়েছে, বিজলি বাতির আলো এসেছে, গাড়ী-ঘোড়ার শোরগোল যুক্ত হয়েছে। কিন্তু জাবালে নূরের নৈশব্দ প্রথম দিনের মতই এখনো একই রকম গভীর ও গম্ভীর।

***

এখানে পথ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। আসলে এখানে কোন পথ নেই, আছে শুধু পাথরের গায়ে পা রাখার সামান্য একটু জায়গা! পা যদি সামান্য পিছলে যায়....! তারপরো মানুষ উপরে উঠে এবং চূড়ায় উপনীত হয়। পৃথিবীর যে কোন পর্বত-আরোহণে দুর্ঘটনা আছে, মৃত্যু আছে, জাবালে নূরের আরোহণে কোন দুর্ঘটনার কথা কেউ শুনেনি। কুদরতের কারিশমা ছাড়া আর কী এটা!

এরকম একটি সঙ্কীর্ণ পথ পার হয়ে আরো কিছু উপরে ঊঠলাম। সেখানে এক পাকিস্তানী সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে, যেন পথ তৈরী করছে। মানুষও কিছু না কিছু দিচ্ছে। কত যে দেশের কত যে মুদ্রা তার সামনে! আমার কাছে কিছু ছিলো না। থাকলে আমিও দিতাম।

সালাম দিয়ে তাকে অতিক্রম করলাম, কিন্তু মাত্র কয়েক কদম। তারপর হঠাৎ থেমে গেলাম। পাদু’টো যেন অসাড় হয়ে আসছে, আর সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। হতে পারে মনের ভুল, কিংবা হতে পারে সত্য; মনে হলো, ভিতর থেকে যেন আওয়ায এলো, থামো! এখানে তুমি কেন?। এটা তো তোমার নবীর ‘খালওয়াতগাহ’!

ঠিক তখন মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেই নীরব দৃষ্টি, যা আজ ভুলে গিয়েছিলাম। ভয়ে তখন  বুকটা এমন ধরফড় করতে লাগলো যে...!

ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে এলাম। পাকিস্তানী শ্রমিকটি অবাক হয়ে বললো, এসেই তো পড়েছো! আর মাত্র সামান্য পথ! ঐ পাশেই তো গারে হেরা!

আমি কিছু বললাম না, ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলাম। কেন আমার এমন হলো! কিসের আওয়ায ছিলো! কিসের ভয় ছিলো! আমি কিছু জানি না, শুধু মনে হয়, আর এক কদম আগে বাড়লে সর্বনাশ হতো!

নীচে আমার স্ত্রী হঠাৎ কী এক অজানা আশঙ্কায় নাকি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে দেখে তবে শান্ত হলেন। ভাবছিলাম, তিনি যদি জিজ্ঞাসা করেন, কী বলবো?! কিন্তু আল্লাহর শোকর, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।

গাড়ীর চালক আমাকে ফেলে ফিরে যেতে কিছুতেই হয়নি। সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকবে, তবু আমাকে নিয়ে যাবে। তার প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। কিন্তু বাসায় এসে দেখা দিলো সমস্যা! সে পয়সা নেবে না, কিছুতেই না! যে নেবে না তাকে তো বেশী করে দিতে হয়! সালমানকে বললাম, ভাড়া দিয়ো না, হাদিয়া দাও। ‘হাদিয়া নেয়া সুন্নত’ এই ওয়ায করে তবে তাকে কাবু করা গেলো। এমন মানুষগুলো এই অল্প দিনের মধ্যেই কীভাবে যেন হারিয়ে গেলো! এখন আর এমন যুবকের দেখা পাওয়া যায় না।

এমন আরেকজন মানুষের কথা আজো আমি ভুলতে পারিনি। বিদায়ের আগের দিন আমার ছেলে একা একা ফিরে এলো আল্লাহর ঘর থেকে। হাতে একটি খাতা। এটা নাকি জাদুর খাতা! হোক জাদুর খাতা, পেলে কোথায়। নীচে রাস্তায় এক বাঙ্গালী যুবক বিক্রি করছে। ছোট্ট বাচ্চা দেখে মায়া লেগেছে, তো এমনি দিয়ে দিয়েছে!

আমি তো অবাক। এদেশে এধরনের লোকেরা কত কষ্টে আছে তা তো আমার ভালো করেই জানা আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে গেলাম, কিন্তু পেলাম না। পেলাম না তো পেলামই না। কে ছিলো সামান্য জাদুর খাতা বিক্রি করা সেই যুবক! আমার ছেলেকে আদর করে উপহার দিলো, অথচ আমি তাকে কিছুই দিতে পারলাম না! তখনো দু‘আ করেছি, এখনো করি, সারা জীবন তার জন্য আমি দু‘আ করে যাবো, আল্লাহ যেন তাকে সচ্ছলতা দান করেন, সুখ-শান্তি দান করে। তার সন্তানেরা যেন থাকে দুধে-ভাতে!

***

অবশেষে বিদায়ের দিন এসেই গেলো। মিলনের আনন্দ বিচ্ছেদের বেদনায় রূপান্তরিত হলো। আজ বারই শাওয়াল, আছরের পর মক্কা থেকে আমাদের বিদায়; আর আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় আরো আগে যোহরের পরে। যত কষ্টের হোক, বিদায় আমার কাছে অপরিচিত ছিলো না এবং বিদায়ের দিনটি ছিলো না আমার অজানা। কিন্তু মেয়ে ও তার মা মিলনের আনন্দে এমনই বিভোর ছিলো যে, বিদায়-দিনের কথা  তাদের মনেই ছিলো না, কিংবা জানা ছিলো না। এমনই হয় প্রিয়তমের সঙ্গে প্রথম মিলনের আনন্দ। বিদায়ের কথা, বিচ্ছেদের মনে থাকে না। একেবারে চুপি চুপি এসে মনের দুয়ারে দস্তক দেয়। তখন খুব ব্যথা লাগে, খুব কান্না পায়, চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরে। বিদায় তাওয়াফের পর মুনাজাতে দু’হাত তুলে মেয়ে ও তার মা কেঁদেছিলো প্রাণভরে। আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় নিতে আমরাও কাঁদি, তারাও কাঁদে। কার কান্না আল্লাহর কাছে কত প্রিয় তা আল্লাহ জানেন। আমি শুধু বলতে চাই কান্নার সৌন্দর্যের কথা। আমি নিজেও কেঁদেছি বিদায়ের কান্না এবং দেখেছি বহু কান্না, তবে আল্লাহর বান্দিরা যেভাবে বিদায়ের কান্না কাঁদে তার সৌন্দর্যের সত্যি কোন তুলনা নেই। আজ আল্লাহর ঘর থেকে বিদায়কালে মেয়ে ও তার মায়ের কান্না থেকে এবং এই সেদিন সেই জনমদুঃখিনী নারীর কান্না দেখে আমার এমনই মনে হয়েছে। আল্লাহর ঘরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু তাতে নাড়ীর বন্ধন নেই। তাদের ভালোবাসায় আছে নাড়ীর বন্ধন, তাই বিদায়কালে তারা অনুভব করে নাড়ীছেঁড়া বেদনা এবং কাঁদতে পারে এমন কান্না।

***

আমার প্রিয় ছাত্র ইলয়াস খান, বহু দিন থেকে জিদ্দায় থাকে সপরিবারে। সে নাছোড়বান্দা হয়ে আমাদের নিয়ে গেলো জেদ্দায় তার বাসায়। দস্তরখানের আয়োজনটা ছিলো মনে রাখার মত, যদি খাওয়া হয়েছিলো খুব সামান্য। এশার পর রওয়ানা হলাম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। রাতের জেদ্দা শহরের আলোক-সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে পৌঁছে গেলাম বিমানবন্দরে।

এবার কিতাব হয়েছিলো অনেক। আমি নিজে যোগাড় করেছি, ভাই নাজমুল কারীম এবং ভাই মানছূর দিয়েছেন, মদীনা শরীফ থেকে ভাই মছীহুল্লাহ এবং ভাই মুহিউদ্দীন দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বড় বড় পাঁচটি কার্টুন। অন্যান্যবার বিমানবন্দরে আমার কষ্ট আমাকেই পোহাতে হয়েছে। এবার আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম; দৌড়ঝাঁপ যা করার সালমান করেছে। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।

ঢাকা বিমানবন্দরে আমার জন্য এমন একটি কষ্ট অপেক্ষা করছিলো যার সঙ্গে আগে কোন পরিচয় ছিলো না। কিতাবের একটি কার্টুন পাওয়া গেলো না। গেলো না তো গেলোই না। বেল্ট ঘুরছে, আমরা ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কত মানুষের কত সামান আসে, আমার কিতাবের কার্টুনটি আসে না! বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে, এই বুঝি আসে! এই বুঝি আসে! কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত আর আসে না। একসময় বেল্ট বন্ধ হয়ে গেলো, আর কোন সামান নেই। আমি কাঁদিনি এবং আমার চোখে পানি আসেনি, তবে ভিতরটা কান্নায় ফেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ মুখ থেকে বের হয়ে গেলো একটি কথা। মেয়েকে বললাম, সাফফানা, এখন যদি আমার সামনে তোমার মৃত্যু হতো তাহলেও আমার এত কষ্ট হতো না, যত কষ্ট হচ্ছে কিতাবগুলো হারিয়ে। আল্লাহর শোকর, মেয়ে আমার মনের ব্যথা বুঝতে পেরেছিলো। তাই বাবার মুখের এমন ‘নিষ্ঠুর’ কথায়ও মনে সে কষ্ট নেয়নি, বরং আমাকে অভিভূত করে বলে উঠেছিলো, আমিও আববু, যদি সম্ভব হতো, প্রাণ দিয়ে হলেও তোমার কিতাবগুলো তোমার কাছে এনে হাজির করতাম।

কথাটা তো বলে ফেলেছিলাম কিতাব হারানোর বেদনার আতিশয্যে। আর কিতাবও একসপ্তাহ পর ফিরে পেয়েছিলাম সালমানের দৌড়ঝাঁপের ওছিলায়, আলহামদু লিল্লাহ, ওয়া জাযাহুল্লাহু খায়রান। তবে ঐ কথাটি আমার মনের ভিতরে বরাবর কাঁটা হয়ে বিঁধছিলো যে, কিছু কিতাবের জন্য কলিজার টুকরো মেয়েকে এমন করে বলা কি ঠিক হয়েছিলো! এজন্য তারপর থেকে আমি সবসময় ইসতিগফার করছি এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছি, কোন কারণে মনের ভিতরে যত তোলপাড় হোক এমন কোন কথা যেন কখনো না বলি যাতে কারো মনে কষ্ট হতে পারে, কিংবা এক নেয়ামতের কারণে অন্য নেয়ামতের না-কদরি    হতে পারে।

তবে আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিক, আল্লাহ তাকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কিছু দিন আগে তিনি ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ থেকে একটি ঘটনা শুনালেন, হাররার মর্মান্তিক ঘটনায় হযরত ওরওয়া বিন যোবায়র (রা)-এর সমস্ত কিতাব পুড়ে গিয়েছিলো, আর তিনি বেদনার আতিশয্যে বলে উঠেছিলেন-

এই কিতাবগুলো জন্য খুশিমনে আমি আমার পরিবার-পরিজন ও ধনসম্পদ বিসর্জন দিতে প্রস্ত্তত আছি।

অনেক সময় প্রকৃত বিষয় জানা থাকে না, তবে ‘দিল কী আওয়ায’ বলে যে একটি কথা আছে, দিলের সেই আবেগ ও আওয়ায থেকে কোন কথা বলে ফেলি। পরে যদি ঐ কথার পক্ষে কোন সনদ পাওয়া যায় তখন বড় আনন্দ হয়, দিলে বড় সুকূন ও সাকীনা হাছিল হয়। প্রথমে আল্লাহর শোকর আদায় করি; তারপর মাওলানা আব্দুল মালিকের শোকর আদায় করি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন হয় যে, তিনি আমার সামনে সেই ‘দিল কী আওয়ায’-এর সমর্থনে কোন না কোন সনদ তুলে ধরেন। বড় গিবতা হয় তার প্রতি। মাশাআল্লাহ, অনেক পড়েন এবং যত পড়েন তত মনে রাখেন; আমি পড়ি খুব কম, মনে রাখতে পারি আরো কম।

সর্বশেষ ঘটনাটি এখানে বলতে ইচ্ছে হয়। গত সংখ্যায় শুধু ‘দিলকি আওয়ায’ থেকে বে-ইখতিয়ার লিখেছিলাম, ‘আমাদের নারিদের আমরা যেন আল্লাহর ঘরে নিয়ে যাই।’

মাওলানা আব্দু মালিক (ছাহেব) লেখাটি পড়ে বললেন, আপনার কথা তো মিলে গেছে উম্মতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নছীহতের সঙ্গে! এই দেখুন মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বা-এর দু’শ ত্রিশ পৃষ্ঠায় আমীরুল মু‘মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন-

এই নারীদের তোমরা হজ্ব করাও। এমন যেন না হয় যে,  তোমরা তাদের সেবা তো ভোগ করলে, আর তাদের শিকল তাদের গলাতেই পেঁচিয়ে রাখলে। (অর্থা আল্লাহর হক আদায়ের ক্ষেত্রে তাদেরকে কোন সাহায্য করলে না। এটা বড়ই যুলুমের কথা।)

এমন মহামূল্যবান সনদ পেয়ে কী যে রোমাঞ্চিত হলাম এবং সারা দেহে কী অপূর্ব শিহরণ অনুভব করলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

মক্কা থেকে বিদায়ের আগের দিন স্বপ্নে দেখেছিলাম, আববা ইনতিকাল করেছেন এবং হারামে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। যেদিন সফর থেকে ফিরে এলাম সেদিনই শুরু হলো আববার মারাযুল মাউত। তিনমাস পর তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করলেন, ইননা লিল্লাহি ওয়া ইননা ইলাইহি রাজিঊন।


(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement