মুহাররাম ১৪৩২   ||   ডিসেম্বর ২০১০

ইভটিজিং : প্রতিকার-চিন্তার গোড়ায় গলদ

নাজমুল হক

ইভটিজিং এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত একটি সমস্যা। ইতিমধ্যে তা চরম আকার ধারণ করেছে এবং একে কেন্দ্র করে হত্যা ও আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। এসব ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ায় প্রশাসনও সম্ভবত কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। বখাটেদের কঠিন শাস্তির বিধান করে নতুন আইন প্রণয়ন ও তা কঠোর হস্তে প্রয়োগের দাবি উঠেছে। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ ও আন্তরিক হয় তাহলে হয়ত তাৎক্ষণিক কিছু সুফল পাওয়া যাবে, কিন্তু  স্থায়ী সমাধান যে বিদ্যমান ব্যবস্থায় পাওয়া যাবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আমরা ইভটিজিং সমস্যাকে আলাদা করে দেখার পক্ষপাতি নই। দেহের দুষিত রক্ত যেমন সর্বাঙ্গে খোস পাচড়ার জন্ম দেয় তেমনি তাকওয়া ও খোদাভীতিহীন জীবনব্যবস্থাও জন্ম দেয় অসংখ্য অনাচার ও দুর্নীতির। শুধু সাময়িক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মলম দিয়ে সমাজদেহের এই ঘা সারানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য সবার আগে চাই দুষিত রক্তের শোধন।

কোনো শিশুই বখাটে হয়ে জন্মায় না। সমাজ ও পরিবেশই তাকে বখাটে বানায়। এজন্য আজ যখন বখাটেদের শাস্তি দাবি করে মিটিং-মিছিল হচ্ছে, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীগণ বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন, সামাজিক সচেতনতা, আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের সুপারিশ আসছে তখন মনে হয়, সবার আগে এই দেশ ও জাতির তথাকথিত অভিভাবকদেরই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। বখাটেপনার কারণে যদি বখাটেদের শাসি- হয় তাহলে যাদের মূর্খতা ও মূঢ়তার কারণে একটি গোটা প্রজন্ম বিপথগামী হয়েছে তাদের কেন শাস্তি হবে না?

আগেই বলেছি, ইভটিজিং কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়; বরং তা সুশিক্ষার অনুপসি'তি, নগ্নতা ও বেহায়াপনার ব্যাপক বিস্তার এবং নারী ও পুরুষের পর্দাহীন জীবন যাপনের কারণে সৃষ্ট অসংখ্য সমস্যার একটি। এই মৌলিক কারণগুলির দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সুশিক্ষার অনুপসি'তি

আমরা মুসলমান, কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা-কারিকুলামে কুরআন্তসুন্নাহর কোনো স্থান নেই। তদ্রূপ শিক্ষা-ব্যবস্থায় ইসলামী আদর্শের কোনো প্রতিফলন নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা কিছু অপর্যাপ্ত বৈষয়িক জ্ঞান অর্জন করলেও তাকওয়া ও খোদাভীতি এবং আদর্শ জীবন যাপনের প্রেরণা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকছে। শরীয়তের হুকুম-আহকামের সাথে তাদের ন্যূনতম পরিচয়ও গড়ে ওঠছে না। উপরন' সহশিক্ষার ফলে অনেক ক্ষেত্রে কৈশোর থেকেই তাদের হাতে খড়ি হচ্ছে অনৈতিক যৌন সম্পর্কে। আর একথা তো বলাই বাহুল্য যে, আজকের শিক্ষার্থীই আগামী দিনের শিক্ষক। পাঠ্যসূচিতে কুরআন্তসুন্নাহর অনুপসি'তি এবং মুত্তাকী-পরহেযগার শিক্ষকের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কুফল বিভিন্ন উপসর্গের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু শাসি- ও প্রতিবাদের মাধ্যমে কি এসব উপসর্গের নিরাময় করা সম্ভব?

অশ্লীলতার ব্যাপক বিস্তার

নগ্নতা এখন কোথায় নেই? পত্রিকা, সাময়িকী, বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড সর্বত্র নগ্নতার ছড়াছড়ি। সিডি-ভিসিডি ও ইন্টারনেটের নগ্নতা এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদেরও হাতে হাতে। মায়েরা আঁতকে উঠছেন কিশোর সন্তানের মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও ক্লিপ দেখে। এরপর রয়েছে উদ্দাম আকাশ-সংস্কৃতি। উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা এসব গ্রোগ্রাম গিলছে, অতপর অনুকরণের চেষ্টা করছে। পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণ-উচ্চারণ সব কিছুতেই নির্বিচার পরানুকরণ। এরই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিচ্ছে ইভটিজিং, ধর্ষণ, হত্যা ও আত্মহত্যা। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সকল পথ খোলা রেখে এর ফলাফল ঠেকিয়ে রাখা কি আদৌ সম্ভব?

মেয়েদের পর্দাহীন জীবন যাপন আমাদের সমাজ মেয়েদেরকে পর্দাসম্মত সুস্থ ও শালীন জীবন যাপনের শিক্ষা দেয়নি। নারী-মুক্তি ও নারী স্বাধীনতার চটকদার শ্লোগানের মাধ্যমে তাদেরকে ঘর থেকে বের করা হয়েছে। এরপর ব্যবহার করা হয়েছে পণ্যের বিপননে ও বিজ্ঞাপনে এবং শ্রোতা-দর্শকের মনোরঞ্জনে। পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা নারীকে একটি সুলভ পণ্যে পরিণত করেছে। তরুণ প্রজন্মও তাদেরকে ভোগ্যপণ্যের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারছে না। এই সর্বগ্রাসী জোয়ারে শুধু সমাজের উঁচু শ্রেণীই ভেসে যায়নি, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ শ্রেণীকেও তা গ্রাস করেছে। ভদ্র ও রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের কাছেও পূর্ণ পর্দা একটি আতঙ্কের বিষয়। ফলে তারাও রাস্তাঘাটে বের হচ্ছে বেপর্দা হয়ে। কলেজ-ইউনিভার্সিটি, মার্কেট-শপিংমল, হোটেল-রেস্তোরা, সর্বত্র পর্দাহীনতার ব্যাপক বিস্তার। ফলে নারীরা রাস্তাঘাটে উত্যক্ততার শিকার হচ্ছে, পরকীয়ার ফাঁদে পড়ে ঘর-সংসার তছনছ করছে, প্রতারিত কিংবা নিপীড়িত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এককথায় নারীমুক্তির অশুভ চিতায় নারীর মর্যাদা ও সতীত্ব তো দগ্ধ হচ্ছেই,  নারীকেও যেতে হচ্ছে সহমরণে।

বলাবাহুল্য, এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া নারী-নির্যাতন বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এরপর আছে আমাদের দায়িত্বশীলদের প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছার প্রশ্ন। একটি দৈনিক পত্রিকার পক্ষ হতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছিল। সাক্ষাতকারের কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি।

প্রশ্ন : নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আপনি কি মনে করেন না যে বিজ্ঞাপন ও টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোগুলোয় শিশুদের দিয়ে বড়দের মত করে নাচ-গান  করানো সমস্যাজনক ? বিশেষ করে হিন্দি চ্যানেলের মাধ্যমে যেসব অনুষ্ঠান বাংলাদেশের দর্শক দেখছে, সেগুলোয় নারী ও শিশুদের ইমেজকে (ছবিকে) যৌনতাপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর প্রভাব তরুণদের উপর পড়ছে ।

উত্তর : এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যৌন হয়রানির শাস্তির বিষয়টা নিশ্চিত করা। টেলিফোন, ইন্টারনেট, মোবাইল, ফোন ইত্যাদির কারণেও তো অনেক ধরনের হয়রানি হচ্ছে। এখন আমরা এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলছি। (উত্তরে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাটা লক্ষ্যণীয়।)

প্রশ্ন : কিন্তু এখনই তো এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ?

উত্তর : এটা কি আইন দিয়ে করবেন নাকি সচেতনতামূলক কাজ চালাবেন, সে প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেট ইত্যাদির বিষয়ে পৃথক আইন আসবে কি না, এলে হয়তো সেখানে এটা নিয়েও আলেচনা হবে।

প্রশ্ন : ইন্টারনেটের সুযোগ তো সবার নেই, কিন্তু কোটি কোটি শিশু ও বড়রা  এখনই স্যাটেলাইট চ্যানেলের কিছু কিছু অনুষ্ঠানের ক্ষতিকর প্রভাবে পড়ছে। অস্ট্রেলীয় সরকার তাদের দেশে এ বিষয়ে কমিশন গঠন করে পর্যালোচনা করেছে, আইন প্রণয়ন করেছে।

উত্তর : তাহলে হয়তো এটাও একটা বিষয় হতে পারে, যেটাকে সক্রিয় বিবেচনায় আনা যেতে পারে। এ নিয়ে কী করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে পারি। (মরুদণ্ডহীনতা আর কাকে বলে?) আমাদের একটি শ্রেণী যাদের অনুকরণ করতে পারাকে পরম মোক্ষলাভ বলে মনে করে তাদের জানা থাকা উচিত যে, ঐ স্বর্গরাজ্যের নারীরাও এখন আত্মরক্ষার জন্য ইসলামী আদর্শের দিকেই ঝুঁকছেন।

এ প্রসঙ্গে আমেরিকার এক খ্রিস্টান মহিলার নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করছি। এই মহিলা প্রতিনিয়ত পাব-এ রোস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়ার জন্য যাতায়াত করতেন। সব সময় তিনি আধুনিক পোশাকে সজ্জিত থাকতেন। আর সে পোশাকে ছিল এক ধরনের উগ্রতা। এর ফলে অধিকাংশ সময় তিনি তরুণ যুবকদের উত্যক্ততার সম্মুখীন হতেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ তিনি খুঁজছিলেন। হঠাৎ তার মনে হল, মুসলিম মহিলারা হিজাব পরেন, সেটা পরলে কেমন হয়। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে হিজাব পরা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন, কেউ তাকে আরা উত্তক্ত করছে না; বরং রাস্তা-ঘাটে সবাই তাকে সমীহ করছে। এ ঘটনা তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে এবং পরে তিনি মুসলমান হয়ে যান। এ ধরনের দৃষ্টান্ত একটি দুটি নয়, অনেক। সমপ্রতি  বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকার ইসলাম গ্রহণ পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সাংবাদিকরা তাঁকেও হিজাব ও পর্দা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর উত্তর ছিল আমার আধ্যাত্মিক সফর যদি আমাকে হিজাব পর্যন্ত নিয়ে যায় তাহলে অবশ্যই আমি হিজাব গ্রহণ করব। 

 

advertisement