যিলকদ ১৪৩১   ||   নভেম্বর - ২০১০

তালিবানে ইলমের উদ্দেশে: তোমরা কে, তোমরা কী, তোমাদের গন-ব্য কোথায় -২

মাওলানা মানযূর নো‘মানী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

আমার নিজের অভিজ্ঞতা

এ ক্ষেত্রে আপনাদের সামনে আমি নিজেকে দৃষ্টান্তরূপে তুলে ধরতে কোন সংকোচ বোধ করবো না। কারণ আমি মনে করি, এযুগের মানুষের জন্য তাতে বড় শিক্ষা রয়েছে। আমার জন্মস্থান হচ্ছে ইউপির মুরাদাবাদ জেলার সম্ভল নামক মহকুমা। প্রশাসনিক কাঠামোর দিক থেকে এটি মহকুমা ও সাবডিভিশন হলেও জনবসতির দিক থেকে এর গুরুত্ব ছিলো অনেক বেশী। তখন এর জনসংখ্যা ছিলো লাখের উপরে। তো আজ থেকে ষাট সত্তর বছর আগে আমার আব্বাজান মহকুমার নেতৃস্থানীয় ও বিত্তবানদের একজন বলেই গণ্য হতেন। সুতরাং সন্তানদের জাগতিক উচ্চ শিক্ষা দান করার সুযোগ তার ছিলো, বরং বলা যায় অবারিত সুযোগ ছিলো। কিন্তু তিনি নিয়ত করে রেখেছিলেন, ন্তানদের যদ্দুর সম্ভব দ্বীনী শিক্ষা দান করবেন, যেন তাদের আখেরাত নিরাপদ হয়, সেই সঙ্গে তার নিজের আখেরাতের জন্যও যেন তারা কাজে আসে।

আমার বয়স যখন বারো তেরো তখন আমাদের জেলায় একজন ইংরেজ কালেক্টর এলেন। জানা নেই, কী কারণে তিনি আব্বাজানের প্রতি খুব আন-রিক ছিলেন। তিনি যখন জানতে পারলেন, আব্বাজান তার কোন     স্তানকেই জাগতিক শিক্ষা দান

করেননি তখন খুব অবাক হলেন এবং তাকে উদ্বুদ্ধ করলেন, ন্তত আমাকে যেন স্কুলে পাঠানো হয়। তিনি বললেন, পাঁচ বছরে তো সে এন্ট্রান্স পাশ করে ফেলবে, তখন আমি তাকে নায়েব তহশীলদারের চাকুরী দিয়ে দেবো।

তখনকার যুগে নায়েব তহশীলদারি অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করে ডেপুটি কালেক্টর পর্যন্ত হওয়া যেতো। আর এটাই ছিলো ভারতীয়দের জন্য চাকুরীর স্বর্ণশিখর। কালেক্টর হতে পারতো     শুধু ইংরেজ।

আব্বাজানের রূহের উপর আল্লাহ তাআলা রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন; তিনি ইংরেজ কালেক্টরের পক্ষ হতে এমন সদয়পরামর্শ পাওয়ার পরো আমাকে ইংরেজী শিক্ষার পথে চালিত করতে রাজি হননি। বিষয়টি যখন আব্বাজানের কিছু নিঃস্বার্থ বন্ধুর কানে গেলো তখন তারা তাকে বারবার অনুরোধ করলেন যে, এমন সুযোগের অবশ্যই সদ্ব্যবহার করা উচিত।       ন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করার কোন অধিকার তার নেই।

শেষে আব্বাজান তাদের বললেন, ঠিকই বলেছেন, ন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। আসল কথা হলো, এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত যে, আমার জীবদ্দশায় সন্তানদের উপার্জনের কোন প্রয়োজন আমার হবে না, বরং ইনশাআল্লাহ আমিই তাদের ভরণ-পোষণ করতে পারবো। তবে মৃত্যুর পর কবরে আমার তাদের উপার্জনের প্রয়োজন হবে। সুতরাং তাদের আমি ঐ শিক্ষাই দান করবো যা কবরে আমার কাজে আসবে।

আব্বাজান এ নিয়তেই আমাকে দ্বীনী শিক্ষা দান করেছেন যে, আমি যেন দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত থাকি এবং আখেরাতে তার কাজে আসি। অর্থাৎ তিনি আমাকে আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। সংসার জীবনে দীর্ঘ দিন তিনি আমার অর্থ-প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন, বরং বলা যায় যত দিন বেঁচে ছিলেন, তিনি আমার পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন।

আমার ধারণা ও বিশ্বাস এই যে, আব্বাজানের ইখলাছ ও নেক নিয়তেরই বরকত ও সুফল এই যে, আমি কোন বিত্তবান মানুষ নই, কিন্তু দুনিয়াতে আল্লাহ আমাকে ঈর্ষণীয় সচ্ছলতা দান করেছেন এবং এত সুখ-শান্তি ও প্রশান্তি দান করেছেন যা বড় বড় বিত্তশালীদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

আলহামদু লিল্লাহ, জীবনের সকল প্রয়োজনই আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে আমার পূরণ হয়ে যায়। যদি আমি ডেপুটি কালেক্টর হতাম, এমনকি কালেক্টরও হতাম তাহলেও এমন   শান্তির জীবন কিছুতেই আমার ভাগ্যে হতো না। এসবই ছিলো আব্বাজানের সেই ইখলাছ ও নেক নিয়ত এবং ঈছারও কোরবানির সুফল।

আমার বিত্তশালী না হওয়ার কারণও কিন্তু আব্বাজানের একটি দুআ। হজ্বের সফর থেকে ফিরে একদিন একান্তে তিনি আমাকে বলেছিলেন, সফর থেকে তোমার জন্য আমি কিছু আনিনি, তবে একটি দুআ করে এসেছি এবং আশা করি ইনশাআল্লাহ তা কবুল হবে। আমি দুআ করেছি, তোমার কাছে যেন সম্পদ না থাকে, তবে কখনো যেন অর্থকষ্ট না হয়। এটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। এখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার মুআমালা এমনই যেমন আব্বাজান দুআ করেছেন। আমার ধন ছিলো না, তবে আমি ধনীছিলাম, হাদীছ শরীফে যেমন বলা হয়েছে-

ليس الغنى بكثرة العرض، إنما الغنى غنى النفس

(সম্পদের সচ্ছলতা আসল সচ্ছলতা নয়, আত্মার সচ্ছলতাই হলো আসল সচ্ছলতা।)

আলহামদু লিল্লাহ, আমার কাছে কখনো সম্পদ জমা হয়নি, তবে আমার কখনো কোন অর্থকষ্ট হয়নি। আমি আমার অবস্থার উপর অন্তর থেকে খুশী।

(অনুবাদকের কথা-আমার মত গোনাহগার বান্দার সঙ্গেও আল্লাহ মুআমালা অনুরূপ। আমি আমার মরহূম আব্বাজানকে অনেকবার বলেছি, আব্বা, আমার জন্য দুআ করুন, আল্লা যেন আমাকে অনেক সম্পদ দান করেন এবং আমি তা দ্বীনের পথে খরচ করতে পারি। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে এ দুআ আমি আদায় করতে পারিনি। তিনি বলতেন, আমি তোমার জন্য সম্পদের

দুআ করবো না। আমি দুআ করি, আল্লাহ সব সময় তোমার জরুরত পূরা করে দেন।

আব্বার জীবদ্দশায় যখন

অভাবনীয়ভাবে আমার জরুরত পুরা হতো, আব্বা বলতেন, ‘দেখছনি আব্বু! আল্লায় তোমার জরুরত পূরা করছেনি! তারপরো আমি বলতাম, আব্বা আমার জন্য..., আর তিনি একই কথা বলতেন।

তো আমার জীবনে আব্বার

দুআর বরকত দুভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমত যখন যে জরুরতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছি আল্লাহ গায়ব থেকে তা

পূরা করে দিয়েছেন, কখনো আসবাব দ্বারা, কখনো আসবাব ছাড়া।

দ্বিতীয়ত যখন আমার চাওয়া কোন জরুরত পূরা হয়নি তখন আল্লাহ তাআলা আমার দিলে এই ইতমিনান ঢেলে দিয়েছেন যে, আমি যেটাকে জরুরত ভেবেছি সেটা আসলে

জরুরত ছিলো না, ছিলো জরুরতের ওয়াহম বা ভুল ধারণা।

জরুরত হলে অবশ্যই আল্লাহ তা পূরা করতেন। রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানী ছাগীরা)

ভরসা করে দেখুন

আমার পেয়ারে ভাই! আবারও বলছি, এখনো যদি নিজেদেরকে আপনারা আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করার নিয়ত না করে থাকেন তাহলে এখনই আগে বাড়ুন। আল্লাহর সঙ্গে

এই মুআমালাটি করে নিন, তারপর নিজেদের সেভাবে তৈয়ার করুন। আমি কসম করে বলছি, আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতেও আপনাদের সঙ্গে বিশেষ মুআমালা হবে। সেই

মুআমালার প্রকৃত প্রকাশ তো ঘটবে আখেরাতে। কারণ আখেরাতের জীবন হলো অনন্তকালের এবং আখেরাতই হলো চিরস্থায়ী প্রতিদানের জগত।

কিন্তু এই দুনিয়াতেও আপনাদের

প্রতি অলৌকিক ও গায়বি অনুগ্রহের

প্রকাশ ঘটবে এবং ঘটতে থাকবে।

যেহেতু এ যুগে সর্বক্ষেত্রে

আমরা দুর্বল। চারদিকে শর ও ফাসাদের ছড়াছড়ি, ফিতনার      ভয়াবহ আগ্রাসন, সেহেতু আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার গায়বি মদদ ও সাহায্যও আগের চেয়ে অনেক বেশী। এখন আমাদের সামান্য আমলের অনেক বেশী আজর। কেন আপনারা কি পড়েননি সেই হাদীছ-

عن أبي ذر رضي الله عنه في حديث، سيأتي على الناس زمان يقل علماءه ويكثر خطباءه من تمسك فيه بعشر ما يعلم نجا

মুসনাদে আহমদ ৫/১৫৫)

(মানুষের সামনে এমন যামানা আসবে যখন আলিম কম হবে, বক্তা বেশী হবে। তখন যারা যদ্দুর জানে তার দশমাংশের উপর আমল করবে, নাজাত পেয়ে যাবে।)

আপনারা কি পড়েননি সেই হাদীছ-

من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر شهيرد

(আমার উম্মতের ফাসাদের সময় যে আমার সুন্নাত আঁকড়ে ধরবে তার জন্য থাকবে শহীদের আজর।)

তদ্রূপ এখন আমাদের সামান্য মেহনত এবং সামান্য ছবর-মোজাহাদার উপর অনেক বেশী গায়বী মদদ ও নোছরত নাযিল হয়ে থাকে।

এটা শুধু আমার মত গোনাহগার মানুষের যিন্দেগির তাজরাবাই নয়, আল্লাহর নেক বান্দা যারা, তাদেরও সারা জীবনের অভিজ্ঞতা। আপনারা একটু অগ্রসর হয়ে দেখুন, আল্লাহর কসম, প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই অনুভব করতে পারবেন যে, আল্লাহ তাআলা আপনাদের দিকে দৌড়ে আসছেন। জীবনের বিভিন্ন মোড়ে,

বিভিন্ন যোগে-দুর্যোগে দেখবেন কীভাবে আল্লাহ তাআলা সাহায্যের

হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এখন শুধু বিশ্বাস করছেন, তখন প্রত্যক্ষ করবেন যে, সত্যি আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন-

نعم المولى، ونعم النصير

কেউ যখন নিজেকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে, আল্লাহ তখন তার বান্দাদের দিলকে তার দিকে ধাবিত করে দেন। আসমান থেকে তখন ঘোষণা নেমে আসে,

অমুক বান্দাকে তিনি ভালোবাসেন সুতরাং আহলে যামীনও যেন তাকে ভালোবাসে।

আপনি একবার সামান্য একটু আগে বেড়ে দেখুন না! একবার শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে দেখুন না!

তো আপনাদের খিদমতে এবং আপনাদের মাধ্যমে দ্বীনী মাদারিসের সকল তালিবানে ইলমের খিদমতে আমার পহেলা আরয ও প্রথম নিবেদন এই যে, আপনারা নিজেদের পরিচয়, অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হোন। ইলমে দ্বীনের উদ্দেশ্য,

গুরুত্ব ও ফযীলত জানতে চেষ্টা করুন। বিরাছাত ও নিয়াবাতের মাকাম ও মরতবা কী তা অনুধাবনের চেষ্টা করুন। তারপর যদি এই মর্যাদাপূর্ণ পথে চলতে চান তাহলে পূর্ণ উদ্যম উদ্দীপনার সঙ্গে, জাগ্রত

চিন্তা-চেতনার সঙ্গে এবং বিশুদ্ধ নিয়ত ও আত্মনিবেদনের সঙ্গে অগ্রসর হতে থাকুন। নিজেদেরকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করুন, দ্বীনের খিদমতের জন্য ওয়াকফ করুন। আপনার যা

কিছু শক্তি-সামর্থ্য, যোগ্যতা ও একাগ্রতা, তা এই পথে ব্যয় করুন। দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের জন্যই

যেন হয় আপনার বাঁচা-মরা ও জীবন-মরণ। ইলমের জন্যই আপনি জীবন ধারণ করবেন এবং ইলমের জন্যই আপনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন।

এই যে আপনার নিয়ত ও শপথ, এটাকে বারবার স্মরণ করুন এবং ঝালিয়ে রাখুন। আমি তো আরয করবো যে, এ বিষয়ে মাঝে-মধ্যে আপনারা পরস্পর মোযাকারা করুন এবং প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য নির্জনে মোরাকাবা করুন, আত্মনিমগ্নতার সঙ্গে ধ্যান করুন যে, আমি নিজেকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছি, দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের জন্য ওয়াকফ করেছি।

আমি ওয়ারিছ হতে চাই ইলমে নবীর, আমলে নবীর এবং আখলাকে নবীর। আমি সরল পথে চলতে চাই এবং উম্মতকে সরল পথে পরিচালিত

করতে চাই। এখন থেকে আমি শুধু আল্লাহর জন্য, অন্য কারো জন্য নই, নই অন্য কিছুর জন্য।

আর দুআ করতে থাকুন,

হে আল্লাহ! তুমি আমাকে অবিচলতা দান করো। হে আল্লাহ!

আমাকে তুমি তোমার জন্য করে নাও

এবং তুমি হে আল্লাহ, আমার জন্য   হয়ে যাও।

 

অনুবাদ : মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ


 

advertisement