শাওয়াল ১৪৩১   ||   অক্টোবর ২০১০

যে পথে সম্ভব দ্বীনি বিপ্লব

ইসহাক ওবায়দী

কদিন আগে জমিয়াতুল মাদারিসিল কওমিয়া সেনবাগ-এর উদ্যোগে জমিয়তের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেখানে ছাত্রদের প্রতি উস্তাদদের হামদরদী ও সমবেদনার ওপর গুরুত্বারোপ করে আমার হামছবক, বুযুর্গ আলেমে দ্বীন, মাওলানা কারী আবদুল বারী ছাহেব একটি ঘটনা বলেছিলেন। ছাত্রদের প্রতি তাঁর সহযোগিতা ও সহমর্মিতাও দৃষ্টান্ত  দেওয়ার মতো। তাঁর সহযোগিতায় উত্তর সেনবাগে এই পর্যন্ত বহু ছেলেরই আলেম হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এমনি একটি ঘটনা বলে সেদিন তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। 

তাঁর প্রচেষ্টায় এক গরীব পরিবারের দুই ছেলে ফেনীর জামেয়া মাদানিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছিল। হঠাৎ তাদের বাবা   ন্তেকাল করেন। জামেয়া মাদানিয়ার মুহতামিম জনাব মাওলানা মুফতী সাইফুদ্দীন সাহেব ও মাদরাসার প্রধান শিক্ষক জনাব মাওলানা মুফতী আহমদুল্লাহ সাহেবসহ অনেক শিক্ষক-ছাত্র মরহুমের জানাযায় শরীক হন। আবদুল বারী ছাহেব বললেন, তাঁরা যাওয়ার সময় সাথে এক বউস্তা চাল নিয়ে গিয়েছিলেন। কদিন পর এক বউস্তা মসুরের ডাল পাঠিয়ে দেন। আরো কদিন পর আরো তিন বস্তা চাল পাঠিয়েছিলেন। একটি এতিম পরিবারে তাঁদের এই সহযোগিতার কথা আশ-পাশের সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের মুখে মুখে তা আলোচিত হতে থাকে। আলেমগণ তাঁদের এতিম ছাত্রদের পরিবারের প্রতিও যে এমন সহযোগিতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন তা সচক্ষে দেখতে পেয়ে গ্রামবাসী মুগ্ধ হয়ে যায়। 

এখানে দেখার বিষয় এই যে, সামান্য সহযোগিতার দ্বারা কত বড় দ্বীনি উপকার হয়ে গেল। বিভিন্ন সংকটে মানুষ যাদের কাছে পায় তাদেরকেই তারা আপন মনে করে। তাই গণমানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আলেমসমাজকে বিপদাপদে কাছে না পাবে এবং তাদের অভিভাবক বলে মনে করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দ্বীনি পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে না। আলেমসমাজ সাধারণ মানুষকে দ্বীন দিতে চান বটে; কিন্তু জনগণ সঠিক বুঝ না থাকার কারণে সঠিকভাবে দ্বীন নিতে পারে না। বিশেষত সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে জীবনধারণের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়। তাই আলেমসমাজের নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ তারা পায় না। এমতাবস্থায় তাদের জীবনযুদ্ধে আলেমসমাজের অংশগ্রহণই হতে পারে তাদেরকে কাছে টানার একটি বিশেষ উপায়।

আলেমসমাজকে শ্রদ্ধা করার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের দ্বীনি ফায়েদা হাসিল সাধিত হবে। শ্রদ্ধা-ভক্তি না থাকলে কেউ কারো কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করতে চায় না। আর এই শ্রদ্ধাভাজন হতে হলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত অনুযায়ী জনগণের উপকার ও খেদমতে আলেমসমাজকে নিবেদিত হতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আলেমসমাজ জনগণের বৈষয়িক সহযোগিতার বিষয়ে তেমন করে চিন্তা-ভাবনা করছি না। কিন্তু এই চিন্তাটা খুবই জরুরি। দ্বীনের স্বার্থেই জরুরি।

কতই না ভালো হত, যদি আমরা জনগণের সুখ-দুঃখের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করতে পারতাম। খেদমত মানুষকে যতটা কাছে টানে ও অনুগত করে অন্য কিছু ততটা করতে পারে না। তাই দেখা যায়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একেকটি সেবার ঘটনা এবং তার সুফল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

আলেমসমাজ জনগণের হৃদয় ও আত্মার সেবায় নিয়োজিত আছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু  মানুষের অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা এমন যে, এটা পূরণ করা ছাড়া হৃদয় ও আত্মার দাবি পূরণ করা কঠিন। তাই গণমানুষের বৈষয়িক  আমাদেরকে সহযোগিতার হাত দরাজ করতে হবে। একজন দিনমজুর বা রিকশাওয়ালা পেটের ক্ষুধা নিয়ে আমার কাছে দ্বীনি সবক নিতে কিছুতেই আসবে না। তার চিন্তা থাকবে এক/দুই সের চাল/ডাল কীভাবে ঘরে নেওয়া যায়। তার এই বৈষয়িক চিন্তায় আমিও যদি শরিক হতে তবেই সে আমার কাছ থেকে দ্বীন শেখার অবকাশ পাবে। কিন্তু এখানেই আমাদের বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। আর এরই সুযোগে ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদী-খৃষ্টানচক্রের এনজিওগুলো  গরীব জনগণের বন্ধু সেজে তাদের দ্বীন ও ঈমান ধ্বংস করেছে। এর দায় কিছুটা হলেও আলেমসমাজের উপরও বর্তায় বৈ কি?

মাদরাসাগুলোর পক্ষ থেকে গরীব জনগণের দুঃখ-কষ্টের সময় যদি একটু সাহায্যের হাত প্রসারিত করা হয়, তাহলে আশা করা যায়, সমাজের দ্বীনি চেহারা অন্যরকম হবে। আর এ কাজটা মাদরাসার জন্য খুব কঠিন নয়। সমাজের বিত্তবান ও দানশীল ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় তা করা যেতে পারে। মাদরাসাকে শুধু উদ্যোগ নিতে হবে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে মাদরাসা বা আলেমসমাজের সাথে গরীব জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের সম্পর্ক তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। তখন সামাজের ওপর আলেমসমাজের যে প্রভাব পড়বে তা অনেক বেশি গভীর ও  সুদূর প্রসারী হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

ফেনীর জামেয়া মাদানিয়া মাদরাসার মতো আরেকটি মাদরাসাকেও আমি দেখেছি, গরীব জনতার দুঃখ-দুর্দশার সময় সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে। দেশের অন্যতম বিশিষ্ট আরবী ও বাংলা সাহিত্য বিশারদ, বহুগ্রন'প্রণেতা জনাব মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ ছাহেবের মাদরাসা মাদরাসাতুল মদীনাকে দেখেছি, ঢাকার বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্গত মানুষের মাঝে মাদরাসার পক্ষ থেকে চাল-ডালের প্যাকেট বিরতণ করতে। এভাবে প্রতিটি মাদরাসা তথা আলেমসমাজ যদি গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার সময় তাদের কাছে থাকার চেষ্টা করি এবং সাধ্যমতে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসি তাহলে অচিরেই ইহুদী-খৃষ্টান এনজিওগুলো তাদের কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ করতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে আমজনতার কাছে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছানোও আমাদের জন্য সহজতর হবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের সহীহ সমঝ-বুঝ দান করুন এবং সহীহ তরীকায় আমল করার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।

 

 

advertisement