শাওয়াল ১৪৩১   ||   অক্টোবর ২০১০

বন্ধু! নিজের প্রতি দয়া করুন

মাওলানা আবুল কাসেম আযহারী

 ছেলেটিকে মাদরাসায় দিলেন কেন? মাদরাসায় পড়লে কি ভাত মিলবে? এই ভুল কইরেন না? তাড়াতাড়ি মাদরাসা থেকে এনে স্কুলে দিন।

উপরের কথাগুলো বললেন আমার এক আত্মীয় অপর এক আত্মীয়কে। কথাগুলো শুনে খুবই অবাক ও মর্মাহত হলাম। কারণ যিনি তা বললেন তিনি মুসলিম পিতার মুসলিম সন্তান  এবং নিজেকে তিনি মুসলিম হিসাবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন।

ইসলামের এমন কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে যেগুলো অন্তর থেকে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। নতুবা তিনি মুমিন্তমুসলমান হতে পারেন না। আল্লাহ তাআলার সকল সিফাত অর্থাৎ গুণাবলিতে বিশ্বাস স্থাপন করা   এর অন্ত র্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ তাআলা আলীমঅর্থাৎ দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু জানেন। তিনি সামীঅর্থাৎ সবকিছু শোনেন। তিনি বাছীরঅর্থাৎ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু দেখেন। তিনি কাদীরঅর্থাৎ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি রাযযাকঅর্থাৎ সকল সৃষ্টিজীবের রিজিকদাতা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি জানেন তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি’ (সূরা হুদ : ৬)

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, (তরজমা) এমন কত জীবজন্তু আছে, যারা নিজেদের খাদ্য মজুদ রাখে না। আল্লাহই রিজিক দান করেন তাদেরকে ও তোমাদেরকে এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা আনকাবুত : ৬০)

‌হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (তরজমা) নিশ্চয়ই রিজিক বান্দাকে সেভাবে তালাশ করে, যেভাবে তার মৃত্যু তাকে তালাশ করে।’-সহীহ ইবনে হিব্বান ৮/৩১, হাদীস ৩২৩৮

অর্থাৎ মানুষের মৃত্যু যেমন অবধারিত তেমনি তার রিজিকও তার কাছে পৌঁছা অবধারিত।

সারকথা এই যে, প্রতিটি প্রাণীর রিজিক আল্লাহ তাআলাই দান করেন এবং এই রিযিক অবশ্যই তার কাছে পৌঁছবে। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুমিন্তমুসলমানের ঈমানের অংশ। অতএব মাদরাসায় পড়লে, ইলমে দ্বীন অর্জন করলে রিযিক জুটবে না-এ কথা বলা, বিশ্বাস করা চরম অজ্ঞতা কিংবা ইলমে ওহীর প্রতি চরম বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ, যা ঈমানকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।

এখানে মনে রাখা উচিত যে, যারা কুরআন্তহাদীস পড়ে, ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে এবং আল্লাহর হুকুম-আহকাম মোতাবেক জীবন যাপন করে, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আর আল্লাহ তাআলার সুন্নতহল, প্রিয় বান্দাদেরকে মাঝে মধ্যে বালা-মুসিবত ও অভাব-অনটন দিয়ে থাকেন। এর পিছনে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলার অনেক হেকমত-রহস্য থাকে। যেমন তাদের গুনাহ মাফ করা, মর্তবা বুলন্দ করা, তারা যেন কখনো আল্লাহমুখিতা থেকে গাফিল না হন সেজন্য সতর্ক করা, সর্বোপরি তাদের ঈমান ও ছবরের পরীক্ষা গ্রহণ করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) এবং আমি তোমাদিগকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন্তসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের কিছু ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। (হে নবী) আপনি    সুসংবাদ দান করুন ধৈর্য্যশীলদের, যখন তাদের উপর বিপদ আপতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’’ (বাকারা : ১৫৫-১৫৬)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখনো তোমাদের কাছে আসেনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা, তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর সাথে ঈমান আনয়নকারীগণ বলে উঠেছিল, কখন আসবে আল্লাহর নুসরত। জেনে রাখ, অবশ্যই আল্লাহর নুসরত নিকটে। (সূরা বাকারা : ২১৪)

হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, (তরজমা) সবচাইতে অধিক বালা-মুসিবতে পতিত হয়েছেন নবী-রাসূলগণ, তারপর যথাক্রমে তাঁদের নিকটবর্তী ব্যক্তিগণ।’-জামে তিরমিযী ২/৬৫

যাই হোক, আল্লাহ তাআলা যেসব বিষয়ের উপর ঈমান আনতে বলেছেন, সেসব বিষয়ে পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস রাখা এবং শরীয়তের হুকুম-আহকাম     অনুগতচিত্তে মেনে নেওয়া মুসলিম হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কেউ যদি ইসলামের কোনো বিধান বা নিদর্শন, এমনকি ছোট থেকে ছোট কোনো সুন্নত বা মুস্তাহাব নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাহলে তার ঈমান থাকবে না। দুনিয়ার আদমশুমারিতে সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সে মুমিন নয়। কুরআন, হাদীস ও দ্বীন্তধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে কঠোর  হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি এই নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে, যখন আল্লাহ তাআলার বিধানসমূহের প্রতি অস্বীকৃতি  ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হতে শুনবে, তখন তাদের (ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের) সাথে বসবে না-যতক্ষণ না তারা অন্য আলোচনায় লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা মুনাফিক ও কাফির সকলকে জাহান্নামে একত্র করবেন।’ (সূরা নিসা : ১৪০)

অন্য আয়াতে আছে, (তরজমা) হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা তোমাদের ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশা করে তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।’ (সূরা মায়িদা : ৫৭)

অন্য আয়াতে আরো বলা হয়েছে, (তরজমা) যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তবে তারা বলবে-আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং কৌতুক করছিলাম মাত্র। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে, তাঁর হুকুম-আহকামের এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে? তোমরা উপর পেশ করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পর কাফির হয়ে গিয়েছ।’ (সূরা তাওবা : ৬৫-৬৬)

অতএব কুরআন্তসুন্নাহর আলোকে এটা প্রমাণিত যে, শরীয়তের কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, উপহাস করা, হাসি-তামাশা করা হচ্ছে এমন কঠিন অপরাধ, যা ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। তাই দ্বীন ও শরীয়ত এবং দ্বীনী ইলম ও দ্বীনী হুকুম-আহকাম নিয়ে উপহাসমূলক কথাবার্তা ও কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুমিন্তমুসলিম নর-নারীর ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ঈমান রক্ষা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

advertisement